আগামীকাল, পয়লা জুলাই কানাডা ডে, সরকারি ছুটির দিন। ইতিহাসের এই দিনে কি যে হয়েছিলো সেটা আমার জানা নেই। গুগল করা যায়। গুগল, তুমি কি জানো পয়লা জুলাই কেন কানাডা ডে পালন করা হয়? অন্তর্জাল জানালো ১৮৬৭ সালের এই দিনে কানাডার বিচ্ছিন্ন প্রদেশগুলো এক হয়েছিলো। আগে সেগুলো ছিলো ব্রিটিশদের এক-একটি আলাদা আলাদা কলোনি, ইতিহাসের সেই দিনটি থেকে প্রদেশগুলো হল সঙ্ঘবদ্ধ রাজ্য।
শনি-রবিবার মিলিয়ে গ্রীষ্মের তিন দিনের ছুটিতে মানুষের নানা রকম ভ্রমণ পরিকল্পনা থাকে। কেউ তিন-চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে যায় লেকের ধারে কটেজে ছুটি কাটাতে। নির্জন বনের ধারে অবসর কাটায় ছোট সরু নৌকা নিয়ে লেকের জলে ছল-ছল শব্দ তুলে ঘুরে বেড়িয়ে। কেউ বৃক্ষে ছাওয়া বাগানের শীতল ছায়ায় হ্যামোক পেতে শুয়ে বসে বই পড়ে কাটিয়ে দেয় বেলা। কেউবা ব্যাগপ্যাক পিঠে বেঁধে যায় পাহাড়ে ঘুরতে, সেখানে পাথুরে ঝরণার পাশ ঘেষে ট্রেইল ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটে যায় উঁচুতে। পাহাড়ের চূড়া থেকে নীলাভ-সবুজ লেকগুলোকে মনে হয় "জীবনের সমুদ্র সফেন"।
আমাদের মতো অভিবাসী পরিবারগুলো, যাদের অনেকগুলো ডলার খরচ করে লং-উইকেন্ড স্মৃতিময় করে রাখার আকাঙ্ক্ষা নেই, তারাও বেড়িয়ে পড়ে দুই-তিন ঘণ্টার দূরত্বে, দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসার ভ্রমণে। যাওয়ার আগে বাড়ির কাছের দেশি রেস্তোরাঁ থেকে গাড়িতে তুলে নেই বিরিয়ানির ট্রে। সাথে ওয়ান-টাইম থালা-বাসন, কোক-পেপসি-পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট, আর ঘাসের উপর বিছানো যায় এমন মাদুর। এক বিরিয়ানিতে তিন-চারটি পরিবারের দুপুরের খাবার দিব্যি হয়ে যায়। লেকের জলে শরীর-ঢাকা ভারী কাপড় পরে দাপাদাপি করে ক্লান্ত হয়ে বিরিয়ানি মুখে দিতেই কেমন মাখনের মতো গলে যায়। লেকের পাশে খোলা উদ্যানে বেঞ্চ দখল করে আমরা যখন সেই এলাচ-লবঙ্গ-জাফরানের ঘ্রাণ ওঠা বিরিয়ানি গপাগপ খাই, তখন অন্য জাতির লোকেরা জাফরানের ঘ্রাণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, আমাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে। আমরা অবশ্য পরোয়া করি না। এদেশে সকলেই আমাদের মতো ইমিগ্র্যান্ট!
কানাডার জাতীয় সংগীতটা যেন কী? স্ত্রীকে ডেকে বলি, "কানাডা ডেতে একটু জাতীয় সঙ্গীতটা গেয়ে শোনাও দেখি।" সে প্রথমে সতর্ক হয়ে ওঠে। মতলবটা যে কি, সেটা বোঝার চেষ্টা করে। পরে যখন বোঝে যে বিপদ কিছু নেই, তখন সুর করে গেয়ে ওঠে, "ও কানাডা.."। পুরো গানের সে শুধু এই দুটি শব্দই বলে!
- এর পরে কি? প্রশ্ন করি আমি।
- তুমিই বল না, এর পরে কি?
- আমি কি আর জানি যে এর পরে কি।
- তাহলে আমিই বা জানবো কি করে?
- কেন তুমি না অনেকটা মুখস্থ করেছিলে নাগরিকত্বের পরীক্ষার সময়ে?
- সে কি আর মনে আছে।
- না, ভেবেছিলাম তোমার স্মৃতিশক্তি তো ভালো, হয়তো তোমার মনে থাকতে পারে আরও কিছুদূর।
কোভিডের সময়ে আমাদের নাগরিক হয়ে ওঠার পরীক্ষা ছিল। সে সময় ইংলণ্ডের রানীর প্রতি আনুগত্য, কানাডার ইতিহাস, এ দেশের আইন, প্রজাতন্ত্র, আদিবাসী সমাজ বিষয়ে একটি পুস্তিকা পড়ে অনলাইনে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের একটা পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। পুস্তিকা পড়তে বা পরীক্ষা দিতে মন্দ লাগেনি, কিন্তু এর আগে যখন সিটিজেনশিপের আবেদনপত্র পূরণ করতে হয়েছিলো তখন বিরক্ত লেগেছিল।
অভিবাসী-নীতিগুলো উন্নত দেশগুলোর বানানো কৌশল বই আর কিছু নয়। এই কৌশলে তারা দেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে। অভিবাসীদের কাজ এদের শ্রমিক স্বল্পতাকে পূরণ করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাওয়া। বিনিময়ে আমরা এদের লেকের জলে দাপাদাপি করার সুযোগ পাই, ভালো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে এমন বহু-লেনের রাস্তায় গাড়ি দাবড়িয়ে পিকনিক স্পটে যাই। আমাদের সন্তানেরা বিনে-মাইনের মানসম্পন্ন স্কুলে পড়ে। আবার টাকার অভাবে যেন বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে না হয়, সেরকম এক ব্যবস্থা যার নাম "ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার" এমন প্রশংসনীয় বন্দোবস্তের অন্তর্ভুক্ত হই ।
এই সব সুবিধা প্রাপ্তির মূল্য হিসেবে সকল শ্রমিকের বেতন থেকে আয়কর বাবদ বড় অংকের টাকা কাটা যায়। প্রজাদের টাকাগুলো যখন এক পাত্রে জমা হয়ে শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তা জালের মতো অনেকগুলো মানব-হিতকর সুবিধা হয়ে ফিরে আসে, তখন কৃত্রিম ভাবে হলেও এদের সমাজে এক ধরনের সাম্যের সৃষ্টি হয়। তখন মনে হয় দেশটিতো বেশ, আমি নাই বা পারলাম এদের সংস্কৃতিতে মিশতে!
আমাদের মতো শ্রমিকদের নিয়ে তৈরি করা নীতি এদের অর্থনীতির একটি মাত্র দিক। অর্থনীতি কেন্দ্রিক অভিবাসন-নীতির আরেকটি অংশে আছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কুখ্যাত অপরাধী থেকে শুরু করে অসৎ রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, সরকারি চাকুরেদের অবৈধ অর্থ নিরাপদ স্বর্গে টেনে নিয়ে আসা। কালো টাকা বাংলাদেশে ট্যাক্স দিয়ে সাদা করা যায়। কিন্তু গরীব দেশের ট্যাক্স দিয়ে লাভ কি? বরং কোনো এক ভাবে কানাডায় টাকা পাচার করা গেলে এমন স্বর্গ আর নেই। বিষয়টি নিয়ে এদের উচ্চবাচ্য নেই বরং একধরনের নীরব সমর্থন আছে। গরীর দেশের সম্পদ তাদের দেশে আসলে সব দিক থেকেই তাদের লাভ।
নাগরিক হয়ে গেলে আস্তে আস্তে নিজের দেশ থেকে শিকড়টা আলগা হতে থাকে, আর বাড়তে থাকে এখানকার শিকড়। তখন এদেশে নিজের বাড়িটাকে কেমন ছোট ছোট মনে হয়। মনে হয়, ইস যদি একটা বড় বাড়ি কেনা যেত! বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডটা যেন একটু বড় হয়, গ্রীষ্মের দিনগুলোতে বাচ্চারা যেন খেলতে পারে। সেই পিছন-উঠোনে নিজের হাতে গড়া লাউয়ের মাচাওয়ালা বাগানটি বন্ধু-বান্ধবদের দেখিয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। নতুন বাড়ি কিনতে আরও ডলারের দরকার। কী করা যায়, কী করা যায়? উপায় বের হয় যে দেশে থাকা বাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হোক। কে আর যাবে দেশে, ছেলে মেয়েগুলো এখানেই সব সেটেলড। তারা কি আর দেশে গিয়ে গরম আবহাওয়ায় টিকতে পারবে। দেশে যা কিছু আছে, দাও সব বিক্রি করে। সেই টাকার সাথে ব্যাংক লোন মিলিয়ে এখানেই আরেকটি বাড়ি কেনো।
যাদের বাড়ি ছোট, তাদের বড় বাড়ির দরকার হয়। যাদের একটা বাড়ি আছে, তাদের দুটি বাড়ি না হলে চলে না। এই তো চাই, এই তো চাই! উন্নত দেশের অর্থনীতি এই ধরনের মানুষই চায়, যাদের উচ্চাকাঙ্খা আছে। এই উচ্চাকাঙ্খা, এই বিপুল লোভ ধনতন্ত্রের চালিকা শক্তি। আরেকটি বাড়ি না কিনলে ব্যাংক নতুন করে লোন দেবে কাকে? এদেশে যার বড় অংকের লোন নেই, ব্যাংকের কাছে সে এক বিচিত্র ঘৃণিত মানুষ, যাকে পারলে তারা যাদুঘরে রেখে আসেন।
আমার মেয়ে শীতের সময়টায় তার এক বন্ধবীর সাথে সপ্তাহে একদিন পিয়ানো ক্লাসে যেত। সেই আর্ট স্কুলে পিয়ানো ছাড়াও স্কুল-পড়ুয়া বাচ্চাদের আরও কিছু সাংস্কৃতিক অনুশীলন হত। শীতের তুষার-পরা দুপুরগুলোয় আমরা যখন ওদের ক্লাসে পাঠিয়ে ভিজিটর কক্ষে বসে বসে ঝিমোতাম, তখন সেখানে আরেকটা ঘরে নাটকের রিহার্সাল চলতো। নাইন-টেনে পড়ুয়া ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নাটক। নাটকের কিছু কিছু সংলাপ এবং দেয়ালে ঝুলানো পোস্টার দেখে বুঝলাম নাটকটি হ্যান্স অ্যান্ডারসনের বিখ্যাত গল্প "ছোট্ট মৎসকন্যা (The Little Mermaid)" এর নাট্যরূপ। তবে সেটি ছিলো গীতিনাট্য। গানে গানেই সব সংলাপ। নাটকের যিনি নির্দেশক, একজন বয়স্ক কানাডিয়ান মহিলা, তিনি আমাদের ঝিমানো দেখে একদিন ধরে বসলেন।
-তোমরা আসছো তো, তোমাদের সন্তানদের নিয়ে নাটক দেখতে? বললেন সেই মহিলা।
তার চোখে মুখে নাটকের কলাকুশলিদের মত উচ্ছ্বাস। এই নাটক না দেখলে যেন জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে, এমন ভাব। নাটকের শো হবে পরের মাসে শহরের ডাউনটাউনের মনোরম এক থিয়েটারে। সেই থিয়েটারের ভিতরে কখনো না ঢুকলেও বাইরে থেকে সেটা দেখেছি। সেখানে শেক্সপিয়রের নাটক থেকে আরম্ভ করে, বিভিন্ন ধরনের সংগীতানুষ্ঠান সারা বছর ধরেই চলতে থাকে। যদিও গত সাত বছরে একদিনও সেই অনুষ্ঠানগুলোর কোনটাতে আমরা যাইনি। তিনি আমাদের পই-পই করে বলে দিলেন, বাচ্চাদের নিয়ে আমরা যেন অবশ্যই তাদের গীতি-নাটক দেখতে যাই।
- খুব ভালো নাটক বুঝেছো, বাচ্চারা খুব উপভোগ করবে, এমনকি তোমরা বড়রাও।
এ ধরনের শোতে টিকিট কিনতে হয়। তিনি আমাদের কিছু ফ্রি টিকিট দিয়ে দিলেন। হয়তো জানেন যে নতুন ইমিগ্রান্ট, পয়সা খরচ করে নাটক দেখার মানুষ এরা নয়। আমার সেই বন্ধুর তেমন ইচ্ছে নেই। আমারও যে খুব একটা ইচ্ছে ছিলো তাও নয়। এদেশের মুসলিম প্রধান এলাকার মসজিদগুলোয় ছুটির দিনগুলোতে মক্তব বসে। সেখানে কোরান শিক্ষার ক্লাস হয়। কিছুদিন থেকে ভাবছিলাম মেয়েকে সেই কোরান শিক্ষার ক্লাসে দেব। আবার এই গ্রীষ্মে নাকি বাচ্চাদের বাংলাভাষা শিক্ষার একটা ক্লাস শুরু হতে পারে, সেই ক্লাসেও সন্তানদের পাঠাবো বলে ভেবে রেখেছি।
আমরা যে বছর কানাডায় আসি তখন আমার নতুন-পুরানো মিলিয়ে তিনটি পাসপোর্ট একসাথে জোড়া লাগানো ছিলো। তিনটি পাসপোর্ট নিয়ে চলার কারণ, শুনেছিলাম যে এতে নাকি পাসপোর্টের গুরুত্ব বাড়ে। এয়ারপোর্ট পুলিশ নাকি এ ধরনের পাসপোর্ট ওয়ালাদের কিছু সম্মানের চোখে দেখেন। কানাডার ইমিগ্রেশনের লাইন সেই মোটা পাসপোর্ট দিয়ে পার হলাম। কিন্তু কয়দিন পরে আরেকটি ছোট শহরে যাবার জন্য বিমানে ওঠার আগে যখন আইডি হিসেবে পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম, তখন চীনা চেহারার সপ্রতিভ এয়ারলাইন কর্মী আমার পাসপোর্টটি নেড়ে চেড়ে বললেন, এত ভারী পাসপোর্ট তুমি বহন করো কি করে?
নাগরিকত্ব অনুষ্ঠান বলে এখানে একটা অনুষ্ঠান হয়। সেখানে একজন বিচারপতি নতুন নাগরিকদের শপথ পাঠ করান। অনুষ্ঠানের এক পর্বে ইংরেজি এবং ফরাসি (কানাডার আরেকটি জাতীয় ভাষা) দুই ভাষাতেই জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হয়। নাগরিকত্বের শপথে কি বলেছিলাম মনে নেই, তবে মনে আছে যে আমার হেঁড়ে গলায় ফরাসি ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া দেখে আমার স্ত্রী খুব হেসেছিলেন। নাগরিকত্ব অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব হলো বিচারপতির সাথে ছবি তোলা। কোভিডের সেই সময়ে আমাদের নাগরিকত্ব অনুষ্ঠান ছিল অনলাইনে। বিচারপতিকে মনিটরে রেখে তার সাথে অনেকেই ছবি তুলেছিলেন, আমরাও বাকি রাখিনি।
মাঝে মাঝে ভাবি যে দেশে আমার জন্ম নয় সেখানে নাগরিক হয়ে ওঠা বিষয়টি কেমন? নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিয়ে যে নাগরিক হয়ে ওঠা যায় না, সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় নাগরিকত্বের বিষয়টি বড় ঘোলাটে, বড় স্বার্থপর। ভাবনাটি আমাকে একই সাথে বিভ্রান্ত ও দুঃখিত করে।
অভিবাসীরা নাকি স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করে আর শরণার্থীরা দেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হন। হৃদয়ের গভীরে আমি জানি যে দেশত্যাগের সাথে সাথে আমিও আসলে শরণার্থী হয়ে গেছি, অন্ততপক্ষে সংস্কৃতিগতভাবে হলেও। আশ্রয় পাওয়া শরণার্থী নই, আশ্রয়হীন শরণার্থী। যে দুঃখের ভিতর দিয়ে আমি দরিদ্র দেশ-মাতার সন্তান হয়ে ছিলাম, সেই দুঃখের গ্রন্থি যখন ছিন্ন করেছি তখন থেকেই সে আমার পর হয়ে গেছে!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০২৪ রাত ১:১৮