somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রশীদ হলের চিড়িয়াখানা - ৩ (পানি বিশারদ ও নেতা কাহিনী)

১৯ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(বুয়েটের রশীদ হলে আমার দীর্ঘ সময় কেটেছে, বুয়েট জীবনের পুরোটাই। এই সোনালী সময়ের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে এই সিরিজটা। আগের দুটো পর্ব লিখেছিলাম বছর খানেক আগে, এখন আবার লিখছি। সেই সময়টা মন থেকে ম্লান হয়ে যাওয়ার আগেই লেখা হয়ে যাক দিনগুলোর স্মৃতি)।
------
[পর্ব ১] [পর্ব ২]
------

বুয়েটের সব হলগুলোর মধ্যে রশীদ হলের বদনাম একটু বেশিই, বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা এখান থেকেই হয়ে থাকে সেটা দুর্জনেরা বলে। কথাটা অবশ্য মিথ্যা না, আমার থাকার বছর কয়েকে যতবার পরীক্ষা পেছাবার আন্দোলন শুরু হয়েছে, ততোবারই সেটা শুরু হয়েছে রশীদ হলের ডাইনিং হল থেকে।

পরীক্ষা পেছানোর ফরমুলা খুব সহজ। পরীক্ষার আগের দুই সপ্তাহের যে প্রস্তুতি ছুটি নামের অদ্ভুত, অদ্বিতীয় পদ্ধতি আছে, সেই প্রস্তুতি ছুটির চার পাঁচদিনের মাথায় ডাইনিং হলে ঢোকার মুখে একটা কাগজ ফেলে রাখতে হবে, “অমুক-তমুক অজুহাতে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না, এই ব্যাপারে আগ্রহীরা সাক্ষর করুন”। আর সাথে গুটি কয়েক ভুয়া সাক্ষর। এর দুই দিনের মাথায় ডাইনিং এ খাওয়ার সময়ে উচ্চস্বরে বলাবলি করতে হবে, “পরীক্ষা তো এবার পিছিয়েই গেলো”। ব্যস, বুয়েটের হলে থাকা আঁতেলতম ছাত্রও এসব কথা শুনে ধরে নেবে, এটাই হবে, এবং পড়ালেখা বাদ দিয়ে টিউশনীতে চলে যাবে। এর আধা থেকে এক দিনের মাথায় হলের গেস্ট রুমে রাত ১টার দিকে একটা মিটিং ডেকে রাতের আঁধারে পরীক্ষা পেছানোর মিছিল বের করে, দুই একটা জানালা-টানালা ভাঙলেই কাজ সারা। দিন দুয়েকের মাথাতেই লাল রুটিন বা নীল রুটিন চলে আসবে।

আমাদের রশীদ হল থেকেই এভাবে শুরু হতো সব পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন। মিছিল বেরুতো রাতের আঁধারে, কারণ বুয়েটের আন্দোলনবাজ ছেলেপেলেরাও দিনের বেলা মিছিল করে চেহারা দেখাতে সাহস করে না। মিছিলগুলো হল থেকে হলে ঘুরে ঘুরে লোকজন বাড়ানোর চেষ্টা করতো, বুয়েটের আঁতেলতম হল সোহরাওয়ার্দী হলে অবশ্য ঢুকতে পারতোনা অধিকাংশ সময়েই, আর শেরে-বাংলার ছেলেপেলে পানি মারতো দুই হলের মধ্যকার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে।

পানি মারা অবশ্য বেশ মজার কাজ। পরীক্ষা পেছানোর মিছিল ছাড়াও নবীন বরণ, rag, লেভেল পুর্তি, এরকম অনেক বিষয় নিয়ে শোভাযাত্রা বেরুতো, সেই রাতের বেলাতেই। এই সব মিছিলে পানি মারাটা রীতিমতো বাধ্যতামূলক ছিলো হলের ছেলেপেলের জন্য। কেউ কেউ পানি মারাতে প্রচন্ড সুনিপুণ দক্ষতা অর্জন করেছিলো ... বালতি রেডি থাকতো, মিছিলের আওয়াজ পেলেই বালতিভরে প্রস্তুত। আর কীভাবে চারতলা থেকে হিসেব করে পানি মেরে লক্ষ্যভেদ করা যাবে, তাও এই পানি-বিশেষজ্ঞদের নখদর্পনে ... সব সময়ে মিছিল করা লোকজন ভেজা কাক হয়ে ফিরতো।

---

রশীদ হলের আরেকটা ব্যাপার ছিলো – নেতাধিক্য। মোটামুটি সব ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার গোছের নেতারা ঘটনাচক্রে রশীদ হলের বাসিন্দা ছিলেন। আমরা যখন ঢুকি, তখন সেখানে ত্রাস-সৃষ্টিকারী নেতা ছিলেন শহীদুল্লাহ ভাই। গুজব ছিলো, শহীদুল্লাহ ভাই নাকি শুরুতে ছিলেন ছাত্রলীগের পাতি নেতা, ছিনতাই করার দায়ে ছয় মাস হাজতে কাটিয়ে ফেরত এসে শুরুতেই অস্ত্র সহ এক চেলাকে নিয়ে হলে হলে ঘুরেন, আর তখনকার ছাত্রলীগের বড়সড় নেতাদের চেলা দিয়ে চড় মারান। সেই থেকেই বুয়েটের ছেলেপেলে শহীদুল্লাহ ভাই আতংকে ভুগতো।

হলের মেস ম্যানেজার হয় দুজন ছাত্র, আর মেসের বাজার করার দায়িত্ব তাদের থাকে। হলের মাসিক ফিস্টের বাজেট থাকে প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকা। ফিস্টের দিন সকালে ম্যানেজারের দায়িত্ব হলো সেই টাকাটা রাস্তার ওপারের সোনালী ব্যাংক থেকে তুলে হলে ফেরা, আর মেসের বাজার করা ছোকরাকে নিয়ে বাজারে যাওয়া। সেবার হঠাৎ শোনা গেলো, শহীদুল্লাহ ভাই ঘোরাফেরা করছে ম্যানেজারদের মোলাকাৎ করার জন্য। দুই গোবেচারা মেস ম্যানেজার রাস্তার ঠিক ওপারে ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছে ঠিকই, কিন্তু ভয়ে আর ব্যাংক থেকে বেরুতে পারে না। অনেক পরে সাহস সঞ্চয় করে যখন বেরিয়ে মিনিট খানেকের হাঁটা পথের অর্ধেকটা এসেছে, তখনই পড়বি তো পড় শহীদুল্লাহ ভাইয়ের সামনে। ওনার “ঘোরাফেরা করাটা” অবশ্য আসলে গুজব ছিলো, কিন্তু মেস ম্যানেজার দুজনের দৌড়টাও দেখার মতো ছিলো বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

শহীদুল্লাহ ভাইয়ের এরকম কাহিনীগুলো সত্যি না মিথ্যা তা জানিনা। আমরা ক্লাস শুরুর কিছুদিন পরে কোনো কারণে ওনার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, বিশাল দাঁড়ি রেখে ঘোরাফেরা করা আর আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলতে থাকেন। সবাই তখন ওনাকে আরো এড়িয়ে চলতে থাকে, কারণ সামনে পড়লেই আধা ঘণ্টা হাত চেপে ধরে বিশাল ধর্ম-বিষয়ক দার্শনিক আলোচনা করতে থাকতেন। আস্তে আস্তে এসব বাড়তে থাকে, একবার পরীক্ষা চলার সময়ে রাত বারোটায় আমার পাশের রুমে ঢুকে আস্তানা গাড়লেন, সারা রাত সেখানকার একজনার কম্পিউটারে বসে বসে উঁচু আওয়াজে হিন্দি সিনেমার গান দেখতে থাকলেন। রুমের এক জুনিয়র ছাত্রের করুণ পরিণতি হলো, সারা রাত না ঘুমাতে পেরে সকালে বেচারা পরীক্ষাটা মিস করে ফেললো ঘুম থেকে না উঠায়।

শহীদুল্লাহ ভাইকে পরে মাঝে মাঝে হলে ঘুরতে দেখতাম। জানিনা, আহসানউল্লাহ হলের সালাম ভাইয়ের মতো তাঁরও একই পরিণতি হয়েছিলো কি না। সালাম ভাই প্রায় চল্লিশোর্ধ মানুষ, কাঁচাপাকা দাঁড়ি রেখে শার্ট-ইন করে জুতা পরে ঘুরতেন আহসানুল্লাহ হলের আশে পাশে। শোনা যায়, প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন, সত্তর বা আশির দশকে বুয়েটে পড়ার সময়ে প্রেমের ব্যর্থতায় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকেই বুয়েটের রাস্তায় তাঁর বসবাস। সারাক্ষণ রাগত স্বরে অদৃশ্য কারো সাথে ঝগড়া করে চলতেন। আলমের দোকান সহ সব খানে সালাম ভাইয়ের ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো, ওনার ব্যাচের সবাই নাকি চাঁদা তুলে একটা ট্রাস্ট করে রেখেছে, যার থেকে বুয়েট এলাকার সব দোকানে সালাম ভাইয়ের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা আছে, ওনার সহপাঠী বুয়েটের অনেক সিনিয়র শিক্ষক মাঝে মাঝে খোঁজ নিতেন।

শহীদুল্লাহ ভাইয়ের জন্য হয়তো সেরকম কিছু হবে না।

--
পাদটীকা – শহীদুল্লাহ ভাইয়ের পরে রশীদ হল তথা বুয়েটের ক্যাডার উপাধি নেন মুকি ভাই। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বুয়েট এলাকার সব টেন্ডারের দেখভাল করা, নির্বাচনের সময়ে হলের ছেলেপেলেকে নিয়ে পিন্টুর সপক্ষে ভুয়া ভোট দেয়াতে নিয়ে যাওয়া সহ সব কিছুতেই সোৎসাহে নিয়োজিত ছিলেন। পরে অবশ্য সনি হত্যা মামলাতে মুকি ভাই প্রধান আসামী হন, বিচারে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার সময়েও পলাতক ছিলেন। জোটসরকার শেষের দিকে গোপনে মৃত্যুদণ্ড রহিত করে যাবৎজীবনে পালটে দেয়। এখনো সম্ভবত পলাতক। রশীদ হলে শহীদুল্লাহ-মুকীদের স্থান আজ কে নিয়েছে, তা অবশ্য জানিনা, তবে হয়তোবা আজও অব্যাহত রয়েছে এই পরম্পরা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০০৮ দুপুর ২:২০
৫৪টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×