স্টেরিওটাইপ শব্দটা মূলত ঋণাত্মক অর্থেই ব্যবহৃত হয় ... কাউকে তার কোনো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ঢালাও ভাবে কিছু একটা ভাবাই এর অর্থ। কমেডি ঘরাণার মূল কৌশলগুলোর মধ্যে এটি একটা ... ভাঁড় গোছের চরিত্রকে দিয়ে ভাড়ামি করাতে হলে তাকে স্টেরিওটাইপড করে ফেলা যায়, আর যে গোষ্ঠীর মধ্যে ফেলা, তাদের দুর্নাম যেকারণে, তা দেখিয়ে দর্শকদের (যারা আবার ঐ গোত্রে পড়েনা) বিস্তর আমোদ দেয়া চলে।
বাংলা নাটকে এই রকম স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেসব নাটক হতো, তার নাট্যকারেরা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসতেন বলে মনে হয় (হয়তোবা আমিও এখানে স্টেরিওটাইপে ফেলছি তাদের)। সেজন্য অধিকাংশ নাটকেই কমিক রিলিফ চরিত্রটি হতো নোয়াখালী বা চট্টগ্রামের, অবোধ্য অমার্জিত শব্দ চয়নে যাদের বিমল আনন্দ। নাটকের ঘটক হবে গোলটুপী পরা, বাম গালে একটা বড় আঁচিল থাকবে, হাতে একটা ছাতা। আদিবাসী কাউকে দেখাতে হলে তার নাম হবে মলুয়া, কথা বলবে “বটেক”, “বাবু”, “হামি” এরকম ভাষাতে। গ্রামবাসী নায়ক নায়িকার মা কথা বলবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রংপুরের ভাষাতে, অথবা নিতান্তই “শুদ্ধ” ভাষাতে। মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটি হবে হতদরিদ্র, এবং অধুনা-ক্ষমতাধর-পূর্বে রাজাকার মোড়লের হাতে নিগৃহীত। নাটক থেকে সিনেমাতেও আসবে এসব স্টেরিওটাইপ, নায়িকার বড়লোক বাবার নাম হবে অবধারিত ভাবে “চৌধুরী সাহেব”, বাড়ির ভেতরে পরবেন ড্রেসিং গাউন, ধুমপানের পাইপ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নামবেন। নায়ক গরীব কিন্তু শিক্ষিত হলে নির্ঘাত হবে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। বাংলা নাট্যকারদের দোষ দেই কীভাবে, স্বয়ং শেক্সপিয়ারের নাটকে স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি ... ইহুদি শাইলক হয় ভিলেন, চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের ঘৃণ্য ভিলেন ফ্যাগিনকেও দেখানো হয়েছে ইহুদি। সেরকম হালের মারদাঙ্গা টাইপের হলিউডী ছবিতে ভিলেনটা হয় আরব মুসলমান।
নাটক-সিনেমা থেকে বাস্তবতার মধ্যেও একই দশা। হিন্দু হলেই ধরে নেয়া হবে, ব্যাটা একটু পরেই সব কিছু পাচার করে দেবে ভারতে, অথবা আওয়ামী লীগের সমর্থক হবে। কারো মাথায় টুপি থাকলে, বা মুঠোখানেক দাড়ি থাকলে সন্দেহ হবে, জামাত-শিবির কি না। চারুকলা কিংবা স্থাপত্যের ছাত্রদের হতে হবে লম্বা এলোমেলো চুলের সিগারেট ফোঁকা চেহারা, আর বুয়েটের প্রকৌশলবিদ্যার কারিগরেরা হবে চশমাপরা নিরীহ চেহারার বিশিষ্ট আঁতেল। বুদ্ধিজীবীরা হবে ফতুয়া বা পাঞ্জাবী পরা, কাঁধে শাল। সাফারি সুট কিংবা মুজিব কোটে বেরিয়ে আসবে রাজনৈতিক পরিচয়।
এহেন মানসিকতা অব্যাহত থাকবে দেশের বাইরে এলেও। কৃষ্ণাঙ্গ দেখলেই সন্দেহ হবে, ছিনতাই করবে নির্ঘাত এখনই। (আমার এক বাঙালি বন্ধু এই সমস্যাতে পড়ে প্রায়ই ... হুডতোলা জ্যাকেট পরে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যায় হেঁটে গেলে নাকি উলটো দিক থেকে আসা ছেলে মেয়েরা সবাই ভয় পেয়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে হাঁটে)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বা পাকিস্তানীদের স্টেরিওটাইপ কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলো মুদী দোকানদার হিসাবে ... ইদানিং অবশ্য গাদায় গাদায় দক্ষিণ এশীয় প্রকৌশলীদের দেখে সেটা কমেছে। ভিলেনের স্টেরিওটাইপের ব্যাপারটা কালে কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালটে গেছে ... বর্ণবাদের আমলে ভিলেন হতো কৃষ্ণাঙ্গরা ... তাদের “পাশবিকতা” দেখানো হতো, আর শ্বেতাঙ্গ নায়ক অসহায় নায়িকাকে উদ্ধার করতো এই কৃষ্ণাঙ্গ ভিলেনের কবল থেকে। বিংশ শতকের শুরুতে ইতালীয়দের অভিবাসন বেড়ে যায়, আর দরিদ্র ইতালীয় অভিবাসীরা অনেক শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীর কাজ আরো কম বেতনে করে হাতিয়ে নেয়। ফলে সে সময়কার গল্প নাটকে সিনেমাতে ভিলেনের স্টেরিওটাইপে এসে পড়ে ইতালীয়রা। ইহুদীবিদ্বেষ অব্যাহত থাকায় ধনী ভিলেন দেখানো হতো এই ধর্মাবলম্বী কাউকে। সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশক জুড়ে জাপানি ব্যবসায়ীরা নবলব্ধ বিত্তে কিনতে থাকে আমেরিকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এ সময়ের এশীয়-বিরোধী স্টেরিওটাইপিংটাও লক্ষ্যনীয়। গল্প সিনেমাতে এশীয় পুরুষ হলেই হতো গ্যাংস্টার, ধুর্ত ব্যবসায়ী, কিংবা বেকুব গোছের বোকাসোকা দোকানদার – মূল নায়কের সাথে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বোল বলে হাসির পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই তার কাজ।
অবশ্য স্টেরিওটাইপ নিয়ে মস্করাও কম করা হয় না টিভি/সিনেমাতে। জনপ্রিয় মার্কিন কার্টুন দ্য সিম্পসন্সের সবগুলো চরিত্রই ইচ্ছাকৃতভাবে চরম স্টেরিওটাইপড। ভারতীয় মুদী-দোকানী অপু, কুটকৌশলী ব্যবসায়ী মিস্টার বার্ন্স, হোমার সিম্পসন নিজেই – সবই বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ, আর ইচ্ছা করেই তাদের বিভিন্ন আচরণ দেখিয়ে স্টেরিওটাইপিংকেই মস্করা করা হয়। একই ব্যাপার দেখি আরেক জনপ্রিয় কার্টুন “ফ্যামিলি গাই”-তে, সবাই সেখানে স্টেরিওটাইপড, সবার কাজই স্টেরিওটাইপ অনুসারে।
স্টেরিওটাইপিং নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক না কেনো, হয়তো এটা থেকে বেরুনো সম্ভব না আমাদের কারো পক্ষেই। অনেক চিন্তা করে যা মনে হয়, এটা মানুষের অবচেতনে প্রোথিত একটা ব্যাপার – সেই আদিম কালে মানুষ যখন প্রকৃতি আর অন্য প্রাণীদের সাথে সংগ্রামে ব্যস্ত, তখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো এক মুহুর্তেই যে, সামনে যা এসেছে তা শত্রু না মিত্র। আর সেই ক্ষণিক-সিদ্ধান্ত নিতে হলে চেহারা দেখে আন্দাজ করাটাই একমাত্র কৌশল ... আচরণ-বিচার করার সময় কোথায়।
পূর্বপুরুষদের সেই প্রবৃত্তি আজও হয়তো রয়েছে আমাদের মনের গহীনে, তাই দেখামাত্র কাউকে ফেলে দেই স্টেরিওটাইপে, লেবেল লাগিয়ে দেই ইচ্ছে মতো। হয়তো এই প্রবৃত্তির কবল থেকে মুক্তি নেই আমাদের, যতোই চেষ্টা কসরত করি না কেনো।
হয়তোবা এ আমাদের মানবিক সীমাবদ্ধতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ১:২৫