১৯৯৮ সালে গুগলের প্রতিষ্ঠা, স্ট্যানফোর্ডের দুই ছাত্র - সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজের হাতে। এরা দুজনে ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট গুলোকে কিভাবে র্যাংকিং, বা ক্রম নিরূপণ করা যায়, সেই গবেষণা করছিলেন। তা করতে গিয়ে তাঁরা বের করেন পেইজর্যাংক নামের একটি অ্যালগরিদম। আর সেই পেইজর্যাংকের চমৎকারিত্বেই গুগলের অনুসন্ধানের মান হয়ে উঠে এতোটা ভালো।
সের্গেই আর ল্যারিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুই-তিন জনে শুরু হওয়া এই গুগল আজ হাজার দশেক প্রোগ্রামারের এক বিশাল প্রতিষ্ঠান। আর গুগলে সার্চ করাটা এতই নিত্যনৈমিত্ত্বিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, অনেক অভিধানে "গুগল" নামের ক্রিয়াপদটিও যুক্ত হয়েছে, যার অর্থ ইন্টারনেটে কারো সম্পর্কে তথ্য বের করা।
ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্য-উত্তর ভাগে, সানফ্রান্সিস্কো আর সান হোসে শহরের মাঝে, সেই সুবিখ্যাত সিলিকন ভ্যালির কেন্দ্রস্থলের মাউন্টেইন ভিউ শহরে গুগলের সদরদপ্তর। জায়গাটা চমৎকার, আবহাওয়াটা বাংলাদেশের হেমন্তকালের মতো থাকে সারা বছর জুড়েই। দিনের বেলাতে তাপমাত্রা ২০-২৫ সেলসিয়াস, আর রাতে ১৫-১৬ ডিগ্রির মতো। আর ভারি সুন্দর রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশ। সানফ্রান্সিস্কোতে অবশ্য ঠান্ডা পড়ে এই গরম কালেও, প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল স্রোতের কল্যাণে। কিন্তু উপকূল হতে ৪০ মাইল ভেতরের সিলিকন ভ্যালিতে আসতে আসতে ঠান্ডার প্রকোপ কমে আসে।
আমি আর আমার স্ত্রী জারিয়া বাসা খুঁজে নিয়েছিলাম গুগলের প্রধান দপ্তরের মাইল দুয়েকের মধ্যেই। আমাদের ঐ বাসা হতে মাইল দেড়েক আসলেই হাইওয়ে ১০১ পড়ে, আর তার ওপারেই গুগল। হাইওয়ে ১০১ চলে গেছে সানফ্রান্সিস্কো হতে লস অ্যাঞ্জেলেস অবধি। তবে ভীড়টা হয় সানফ্রান্সিস্কো হতে সান হোসের মধ্যকার অংশে, অর্থাৎ সিলিকন ভ্যালির এলাকাটাতে। এখানেই লাগালাগি করে শহর গুলো গড়ে উঠেছে। সান হোসের পশ্চিমে পর্যায়ক্রমে সান্তা ক্লারা, সানিভেইল, মাউন্টেইন ভিউ, পালো আল্টো (স্ট্যানফোর্ডের ক্যাম্পাস), আর তার পরে আরো কিছু শহর পেরিয়ে সবার পরে হলো সানফ্রান্সিস্কো। এই এলাকার তাবৎ মানুষ তাই হাইওয়ে ১০১ দিয়েই চলাচল করে থাকে। প্রতি পাশে ৪টি করে মোট ৮লেইনের এই হাইওয়ে সারাক্ষণ জমজমাট। বলা হয়ে থাকে, হাইওয়ে ১০১এর ট্রাফিক জ্যাম দেখেই বোঝা যায়, সিলিকন ভ্যালির অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন। আমি অবশ্য প্রচন্ড ভীড় দেখেছি, তাই বলতে পারি, এখন এখানকার কোম্পানিগুলোর রমরমা অবস্থা।
তা অবশ্য গুগল, ইয়াহূ!, সান, আর মাইক্রোসফটের বিশাল অফিস গুলো দেখলেই বোঝা যায়। এদের মধ্যে গুগল সবচেয়ে নবীন। তার পরেও প্রায় ২ মাইল এলাকা জুড়ে এদের মোট ১৬টা অফিস ভবন রয়েছে। এর পরেও জায়গা হচ্ছেনা দেখে আশে পাশে আরো অনেক ভবন ভাড়া নেবার পাঁয়তারা চলছে।
তথ্য প্রযুক্তির এই প্রাণকেন্দ্রে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটা সহজ না। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে পুরো আমেরিকার সব নামজাদা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা এখানে ইন্টার্নশীপ, বা তিন মাসের শিক্ষানবিশী কাজের জন্য আবেদন করে থাকে। (গুগল অবশ্য এই তিন মাস ওদের স্থায়ী প্রকৌশলীদের হারেই বেতন দেয় )। গত কয়েক বছর গ্রীষ্মকালে কাজ করেছি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারকম্পিউটার সেন্টার এনসিএসএ-তে। তাই এবছরের শুরুতেই ঠিক করি, এবার আর এখানে না, বরং গবেষণা ও প্রোগ্রামিং এর হাতে কলমে কাজ হয়, এমন কোথাও ইন্টার্নশীপ করবো। অফার অবশ্য পেয়েছিলাম বেশ কয়েক জায়গা থেকে। কিন্তু মাইক্রোসফট, এইচপি, কিংবা ইয়াহুর থেকেও গুগলে কাজ করার ইচ্ছাটা অনেক বেশি ছিলো। কারণ, গুগলের সম্পর্কে এতো গল্প চালু, ওদের কাজের পরিবেশের এতো সুনাম, আর এতো প্রচন্ড ইন্টারেস্টিং সব প্রজেক্ট ওদের এখানে চলছে, তাই ভেবেচিন্তে গুগলের ইন্টার্নশীপটাই বেছে নিই।
গুগলে এসে এই তিন মাসে যা দেখেছি, তাতে বুঝেছি, সিদ্ধান্তটা ঠিকই নিয়েছিলাম। প্রথম দিনটি থেকেই শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত চমৎকৃত হয়েছি প্রতিদিনই, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের অসাধারণ প্রয়োগের বিভিন্ন নিদর্শন দেখে দেখে।
(ছবি - গুগলে আমার অফিস ভবনের সামনে আমি, গুগলের মূল ভবন বিল্ডিং ৪০-র পাশে আমি ও জারিয়া, এবং গুগলের মূল চারটি ভবনের মাঝের বাগানে জারিয়া। ডাইনোসরের সাথের ছবি আগামী পর্বে আসছে)
[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ২:১৫