স্বৈরতন্ত্র নিজের জায়গায় এখনো ঠিকঠাক কায়েম আছে। শুধু আপডেটেড হয়ে এখন তা গণতন্ত্রের মোড়কে। অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের ধমক দেয়া বক্তৃতায় বলতে শুনেছি এই যে- স্বৈরাচারের সমস্যা একটাই, আর তা হলো তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। আমি আসলে এই বক্তব্যের সাথে একদমই একমত না। এর কারণ বাঘা বাঘা রাজনীতিকরা ইতিহাস থেকে কতোটা শিক্ষা নিয়েছে জানি না, কিন্তু স্বৈরাচার ঠিকই নেয়। তার ভুরি ভুরি উদাহরণ তুলে ধরা যাবে।
সে যাই হোক, বাংলাদেশ নিয়ে তুলে ধরা যাক কিছু সমীকরণ। মেলানোর দায়ভার নিয়ে অবশ্য কেউ আপনাকে বাধ্যা করবে না। ভোটের খেলা সাঙ্গ হওয়ার ভীতি নেই স্বৈরাচারের। কারণ সেখানে ভোটের বালাই থাকে না। আমাদেরও ভোটের বালাই নেই। রয়েছে নির্বাচনের বালাই। এটা দিয়েই মূলত চোখে ঠুলি পরানো হয়। স্বৈরশাসনকে মোড়ানো হয় গণতন্ত্রের মোড়কে। পরে অবশ্য খোলসের থেকে বের আসে শামুকের আসল রূপ। বৈশিষ্ট্য বদলায় না স্বৈরতন্ত্রের, বদলায় খোলস।
আরব বসন্ত মনে আছে? হুম, সেই ২০১০'র কথা। বাওয়াজিজি'র নিজ শরীরে আগুন ধরিয়ে আহুতি। পুলিশি দূর্নীতির বিরুদ্ধে এই আহুতি বিপ্লবের ঘূর্ণিঝড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাহরাইন, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়ায়। তোপের মুখে বাধ্য হয় প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বিন আলি পদত্যাগ করতে। তিউনিসিয়া পায় নতুন এক সংবিধান। বদল আনার ইচ্ছে নিয়ে এগোচ্ছে তারা। জানেন কি, এই আন্দোলন পুরোটা স্প্রেড করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে? স্ল্যাক্টিভিজম, বা সহজ করে বললে যাকে বলা চলে অনলাইন প্রতিবাদ। শুধু এই স্ল্যাক্টিভিজম-এর ফলেই বিশ্ব দেখেছি আরব বসন্ত। আচ্ছা, আপনার মনে পড়েকি, দু'দিন আগেও আপনার রাষ্ট্রের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক রেস্ট্রিকটেড করা হয়েছিলো? প্রশ্ন, কেনো করা হয়েছিলো? উত্তর, স্ল্যাক্টিভিজম রোধের জন্য। প্রমাণ হয় স্বৈরাচার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ রাষ্ট্রের মধ্যে ১৫১তম। কেনো? উন্নয়নের জাবর কাটা রাষ্ট্রের এই অবস্থা কেনো? কারণ স্বৈরাচার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে।
বৈশ্বিক দূর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দূর্নীতিবাজ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ১৪তম। ঋণখেলাপিতে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে এর অবস্থান ১ম। অর্থপাচারকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ ৩০-এ। ১৬৩ রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিসূচকে বাংলাদেশ ৯৭। এবছর এই অবস্থান আরও অবনতি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা ১৩৯তম ১৮৭'র মধ্যে। এবছরে দারিদ্রহার ৪২.৫℅। এই সব কিছুর পরেও শুধু উন্নয়ন জাবরকেটেই ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে সব। এখানেই খোলস থেকে বের হয়ে শামুকের আসল রূপ।
সব কিছুর পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়িয়ে রাখা হয়েছে একটা গ্রে-এরিয়া বা গ্রেয়-জোন। আর সেটা হচ্ছে আপনি হয়তো রুলিং পার্টির পক্ষে, নইলে আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। আপনি অমানুষ হন, অসভ্য হন, বর্বর হন, যা খুশি তা হন, পার পেতে পারেন। (নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ মনে পড়ে? দেলোয়ার গং জামিনে মুক্ত!) কিন্তু আপনি ফেরেশতা হন, যতোই লজিক্যাল হন, রুলিং পার্টির না হলেই আপনি হয়ে যাবেন জামাত শিবির। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। (লেখক মোশতাক মনে নেই? কার্টুনিস্ট কিশোর মনে নেই?) আর গ্রে-এরিয়ার আইডিয়া হয়ে পড়েছে ডমিনেন্ট বা ডিটারমিনেন্ট। এসবের পরে আপনার মনে হয়না যে স্বৈরাচার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আপডেটেড হলেও আপনি আপডেটেড হননি?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:০১