থরে থরে ক্রিমজন কৃষ্ণচূড়া সে বসন্তেও ফুটে ছিল। রক্তাক্ত দোসরা ফাগুনের স্মৃতিচারণ করি। ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। নোনতা রক্তে স্নাত হয় রাজপথ। অতিতের পাতা খুলে ধরা যাক।
১৯৮২ সাল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারাল এইচ এম এরশাদের শাসন কালে তার শিক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ মজিদ খান এক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের স্পর্শকাতর অনুভূতির স্থান ধর্মকে পূঁজি করে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শুরু করেন।
রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই অর্ধ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করতে হবে। যদি তাদের বার্ষিক ফল খারাপ হয়, তবুও সেই শর্তে তারা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবে। এক কথায় টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি ক্রয়। শিক্ষা একেবারে পরিণত হতে যাচ্ছিলো পণ্যে। সাথে তাদের নীতিতে বাংলা ও ইংরেজির সাথে আরবিকেও বাধ্যতা মূলক করা হয়। যা একেতো মাতৃভাষাকে উপেক্ষা, উপরন্তু ধর্মের সেন্টিমেন্ট কে ব্যবহার করে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যকে কায়েম করা। সাম্প্রদায়িক শক্তির কবলে শেষ হতে যাচ্ছিলো বাংলা। শিক্ষার অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছিলো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের থেকে।
তবে প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিতে রাজপথ প্রকম্পিত করতে ছাড়েনি প্রগতিশীল ছাত্র-জনতা। প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা ১৯৮২ সালের ২১ নভেম্বর মোট ১১টি ছাত্র সংগঠন মিলে প্রকাশিত শিক্ষানীতি বাতিলের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে বসে গঠন করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। প্রত্যেক দল থেকে ১০ জন করে মোট ১১০ জনকে নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হয়।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে জনমত গঠন এবং আন্দোলনকে তরান্বিত করতে সবাই নেমে পড়ে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে। আন্দোলন যখন ক্রমেই জনতার মাঝে সারা ফেলছিল, তখন আন্দোলনকে সর্বোপরি ছাত্র জনতাকে অবদমিত করতে বসে থাকেনি তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এরশাদ। গ্রেফতার করা হয় তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ ফারুককে।
ফলে ছাত্র জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৮৩ সালের ২৭ ও ২৮ শে জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারাদেশের ছাত্র জনতা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। আর তা দেখে স্বৈরাচার শাসকগণ ভিত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য এরপরে উঠে পড়ে লাগে।
রক্তঝরা দোসরা ফাগুন বা ১৪ ফেব্রুয়ারি মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা ছাত্র জমায়েতের ডাক দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে থেকে মিছিলে দলে দলে শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অকুতোভয়ের মতে এগিয়ে চলছিল। স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হচ্ছিলো। ঢাকার হাইকোর্ট অবধি না যেতেই (বর্তমান শিক্ষা চত্বর) দেখে পুলিশের ব্যারিকেড। ব্যারিকেড বাধা অতিক্রম করার পূর্বেই অগত্যা রায়ট ভ্যান দিয়ে ছাত্র জনতার উপর গরম পানি নিক্ষেপ করা হয়। টার্গেট করে চলে গুলি বর্ষণ। চলে বেধড়ক লাঠিচার্জ ও নির্মম ভাবে বুটের আঘাত। স্পট ডেথ হয় অনেকেরই। অনেকের লাশ গুম করে ফেলা হয়। যাদের নাম জানা যায় তারা হচ্ছে জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, আইয়ুব, মোজাম্মেল, দিপালী।
রাইফেলের বুলেটের থেকে বাঁচার জন্য কেউ প্রাণপণে পালানোর চেষ্টা করে। কেউ কেউ কার্জন হলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। কেউ আবার সহপাঠীদের লাশ অবধি খুঁজে পায়নি। তখনো বিরতিহীন ভাবে বেজে যাচ্ছিলো রাইফেলের খইফোটার প্রতিধ্বনি।
অন্য দিকে যখন বসন্ত দুপুরে সূর্য হেলে পড়েছে, তখন ছাত্র জনতা ফের তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়ি সামনে জড় হতে থাকে। তখন রাইফেল তাক করে খোলা জিপ ঢুকে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফের বেধড়ক পেটানো হয় শিক্ষার্থীদের। ক্ষতবিক্ষত দেহে কেউ আবার যায় ঢামেকে।
এভাবেই শুরু হয় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত। ঘটনার পরিক্রমায় ১৯৯০’র গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচারী এরশাদের পতন নিশ্চিত হয়। আর এমন তাৎপর্যপূর্ণ দিনকে ঘিরে আমরা এখন ভালবাসা দিবস পালন করি বটে, তবে শহিদদের জন্য একবিন্দুও নয়। রক্তঝরা ফাগুনের এই দিনটাকে নবপ্রজন্ম কতটুকু মনে রেখেছে? আমরা দোসরা ফাগুন আর ১৪ই ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য বলে বুঝে থাকি শুধু ভ্যালেন্টাইন ডে নামে। দেখতে পাই সিংগাল পরিষদের প্রেমবঞ্চিত হওয়া নিয়ে বিক্ষুব্ধ মিছিল। অসভ্য উল্লাস আর স্থুলতা। অথচ তখনো তারা প্রেম করতো, প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়েই মিছিল হতো।
রক্তঝরা রক্তিমা ফাগুনের নতুন ভাবে আবির্ভাব ঘটুক। সব স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটুক। গনতন্ত্র মুক্তি পাক।
বাক স্বাধীনতা মুক্তি পাক,
মুক্তবাক বাক মুক্ত থাক।
রক্তঝরা ফাগুনের শুভেচ্ছা সাথে লাল সালাম স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সব শহিদের প্রতি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৩:১৯