কবিতার প্রতি আমার আকর্ষণ দুর্নিবার। অনেক বাঙ্গালীর মতো আমারও এ আকর্ষণ শুরু হয়েছে ভাষা শিখার আগে থেকেই। ঠিক তখন থেকেই যখন আমি পড়তে পারতামনা, লিখতে পারতামনা। শৈশবে মায়ের আদর করার ছলে আওড়িয়ে যাওয়া ছড়াগুলো কিংবা দাদী নানীদের সেই বচনগুলো এ আকর্ষণের ভিত্তি। ভিত্তিটা এতোই মজবুত যে পরবর্তী জীবনে এ আকর্ষণ থেকে আর মুক্তি মেলেনি। জীবনের ২৯ বছরের বেশিরভাগ সময়টা শুধু কবিতার পিছনেই ব্যয় করলাম।
এ আকর্ষণের অনিবার্য পরিনতি হিসেবে পরবর্তী পর্যায়ে নিজেও কিছু একটা লেখার চেষ্টা করলাম। আমি জানি, আমি কবিতা লিখতে পারিনা। আমি জানি আমি কখনই কবি হতে পারিনা। আমার কবিতাগুলো এলোমেলো কিছু ছড়ানো ছিটানো শব্দ ছাড়া কিছুইনা। তবু লিখে যাই, তবুও লিখে যাবো। স্বীকৃতির জন্য নয়, কবিতাকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবসি শুধু এটা প্রমাণের জন্য।
ঠিক এই কারণেই নিজেকে কবি হিসেবে পরিচয়দানের চেয়ে কবিতার পাঠক হিসেবে পরিচয় দিতেই আমি স্বস্তি বোধ করি। যখন যে কবিতা সামনে পেয়েছি তাই পড়েছি কিংবা পড়ি। কিন্তু জীবনের একটা পর্যায় অতিক্রম করে এসে আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছি বেশিরভাগ কবিতাই আমার মনে নেই। তবে কি আমি কবিতাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়িনি? তবে কি আমি কবিতাগুলোকে ভালোবাসিনি?
যখন কবিতাগুলোকে মনে করার চেষ্টা করি তখন শৈশবের সেই সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, আমি হব সকাল বেলার পাখি, আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই, আমাদের ছোট নদী চলে বাকে বাকে, আবার আসিব ফিরে-- এগুলোর কথাই প্রথম মনে পড়ে। তারপরে মনে পড়ে হাইস্কুলে উঠে পড়া শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের কিছু কবিতা। যৌবনের শুরুতে যখন মনে প্রেমের আগমন হয়েছিলো তখন জীবনানন্দ দাশের পঠিত সুরঞ্জনা কিংবা বনলতা সেন কবিতাগুলো এখনও মাঝে মাঝে মনে সুর তুলে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়া মাইকেলের সমুদ্রের প্রতি রাবণ কিংবা হাইস্কুলে পড়া বঙ্গভাষা অথবা মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের বঙ্গবাণী কবিতাগুলো এখনও মনে ভাস্মর। হালের নির্মলেন্দ্র গুণ বা হুমায়ন আজাদের কিছু কবিতাও মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
এই ২৯ বছরের প্রচেষ্টার ফলে শুধু এই গুটি কয়েক লেখাই আমার মনে আসে কেন? বাকি লেখাগুলো কোথায় হারালো? এর একটা কারণ হতে পারে আমি হয়তো পরিপূর্ণ নিবেদিত প্রাণ ছিলাম না। তবে সম্ভবতো আরো একটা কারণও আছে এবং কারণটা অবশ্যই হেলাফেলা করার মতো নয়।
আজকাল কবিতার ভাষাগুলো খুবই দুর্বোধ্য। আধূনীক কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় এগুলো সাধারণের জন্য লেখা নয়। সাধারণ মানুষ এগুলো বুঝলো বা পড়লো কি না এ নিয়ে সম্ভবতো লেখকের কোন মাথাব্যাথা নেই। লেখাগুলো শুধুমাত্র লেখকের নিজের জন্য কিংবা তাঁর কিছু শুভাকাংখী অথবা সাহিত্য সমালোচকদের জন্যে। মাঝে মাঝে অবশ্য আমার মনে হয় লেখাগুলো সম্ভবতো শুধুমাত্র লেখকের নিজের জন্য। কারণ যারা এর প্রশংসা বা সমালোচনা করেন তাঁরাও লেখাগুলো ঠিকমতো আত্বস্থ করেছেন বলে মনে হয় না।
আমি ব্লগের কবিতাগুলোও মনোযোগ দিয়ে পড়ি। আমার মনে হয় এই কবিতগুলোও দুর্বোধ্যতার দোষে দূষ্ট। বেশিরভাগ কবিতাই আমি বুঝিনা। অনেকক্ষেত্রে শুধুমাত্র শব্দের বৈচিত্রময় প্রয়োগ দেখে আপ্লুত হই এবং মন্তব্য করি। একজন সাধারন মানুষ হিসেবে অথবা সাধারন মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আমার বিশ্বাস কবিতাগুলোর বিষয়ে সাধারন পাঠকও একই মত দিবেন। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি এটা বলার স্পর্ধা দেখাচ্ছিনা যে কবিতাগুলো উচ্চমানের নয়। কবিতাগুলো অবশ্যই উচ্চমানের। কিন্তু এটাও সত্যি যে এই উচ্চমানের কবিতাগুলো এতোটাই উচুমানের যে তা সাধারনের ধরাছোয়ার বাইরে।
মানুষ তাই মনে রাখে যা সে বুঝতে পারে। পৃথিবীতে তাই টিকে থাকে যা সাধারন মানুষ টিকিয়ে রাখে। ছেলেবেলার কবিতগুলো আমরা এখনও মনে রাখি কেন? এখনও মনের অজান্তে আবৃত্তি করি কেন? কারণ একটাই, এগুলো খুব সহজ, সরল, প্রাণবন্ত ভাষায় রচিত যার বক্তব্য সবাই খুব সহজেই আয়ত্ত্ব করতে পারে।
আমি মনে করি গল্প, কবিতা, উপন্যাস নাটক বা অন্যান্য সাহিত্যকর্ম সাধারণ মানুষের বুঝবার ক্ষমতা চিন্তা করেই রচিত হওয়া উচিত।কারণ একটা মহৎ লেখার উদ্দেশ্য কখনই লেখক, সমালোচক কিংবা শুভাকাংখী নন। এর উদ্দেশ্য অবশ্যই সাধারন পাঠক। সাধারন পাঠক লেখাটিকে মনে রাখলেই তা টিকে থাকবে। মনে না রাখলে অনিবার্যভাবেই তা বিস্মৃতির অতল গহবরে হারিয়ে যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ২:৫৯