somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মা, আমার ঈশ্বর।

১৭ ই জুন, ২০০৮ বিকাল ৩:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তর্কাতীতভাবেই আমি অসামাজিক। সামাজিক কোন অনুষ্ঠান আমাকে টানেনা। শেষবার কবে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম তা স্পষ্ট মনে নেই। অবশ্য এটা আমাকে মোটেই আন্দোলিত করেনা যে আমার কোন বন্ধু নেই। দীর্ঘ ২৯ বৎসরের জীবনে আমি কোন বন্ধু তৈরি করতে পারিনি।ভবিষ্যতে পারবো তেমন কোন ভরসা নেই, প্রচেষ্টাও নেই।প্রথার বাইরে যে দু'চার জন বন্ধু আছেন তা এই ব্লগকেন্দ্রিকই। সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল, ঠিক এই কারণে বোধ করি এখন পর্যন্ত টিকে আছে। জীবনের চরম মুহুর্তগুলোকে একাকীত্বের সাথে উপভোগ করি, তা আনন্দেরই হোক বা দুর্যোগেরই হোক।

মানুষ হিসেবে আমি চরম নৈরাশ্যবাদী এবং চূড়ান্ত নেতিবাচক মনোভাবের অধিকারী। মানুষের মাঝে আমি ভালো কিছু দেখিনা, আশাও করিনা। ধর্মবিশ্বাসে আমি নাস্তিক। তবু ঈশ্বরের অবাধ্যতার কারণে অপদার্থ মানুষগুলোকে তিনি স্বর্গ হতে বহিস্কার করেছেন-- এই বক্তব্য আমাকে কম নাড়া দেয়না। মানুষের আচরণে প্রচলিত এই মিথও মাঝে মাঝে বিশ্বাসে পরিণত হয়।

মানুষ হিসেবে আমি মোটেও নস্টালজিক নই। পুরনো স্মৃতিগুলো এখন আর আমাকে তাড়িত করেনা। ভবিষ্যৎকে নিয়েও কোন স্বপ্ন দেখিনা। কিন্তু বললেই কী স্মৃতি বা স্বপ্ন থেকে মুক্তি আছে? জীবনতো স্বপ্ন আর স্মৃতির সমন্বয়েই গঠিত।

মনস্তাত্ত্বিক এই পরিবর্তন কোন একক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। এই ঢাকা শহরের বেশিরভাগ স্কুল, কলেজই কোন না কোন নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহ্রত হওয়ার কারণে আমার পদচারণায় ধন্য হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মহাখালীতে অবস্থিত এক প্রতিষ্ঠানে লিখিত পরীক্ষা পরবর্তী মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলাম। মৌখিক পরীক্ষার সময়ে কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কিছু কাগজ ফটোকপি করতে হয়। এর ফলে বাড়ি ফিরবার জন্য যে টাকাটা বরাদ্দ ছিলো তা শেষ হয়ে যায়। মহাখালী থেকে আমার বাড়ির দুরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। পায়ে হেঁটে এমন দুরত্ব অতিক্রম অসম্ভব। তাই ভাড়া না থাকা সত্ত্বেও লজ্জাকে সংকোচিত করে একটি বাসে চড়লাম। একটু পরেই কনট্রাক্টর ভাড়া চাইলে আমি আদ্যোপান্ত সব খুলে বললাম। চেহারায় মারাত্বক রকমের একটি বিজ্ঞতা এনে সে বলল, "পুরা রাস্তাটাই যদি আপনে আমার ঘাড়ে চইড়া যান তাইলোতো আমার ঘাড় ভাইঙ্গা যাইবো। আপনি সামনের স্টপিজে নাইমা পুরা রাস্তাটা ভাগ ভাগ কইরা কয়েকজনের ঘাড়ে চইড়া যান। তাইলে সবাই দম ফালানোর চান্স পাইবো"। বাসে অনেক ভদ্রলোক (অন্তত পোশাকে) থাকলেও কেউ আমাকে প্রোটেক্ট করতে এগিয়ে আসেননি। অগত্যা সামনের স্টপিজে নেমে পড়লাম। লজ্জাকে পুনরায় সংকোচন করে নতুন করে কোন বাসে ওঠে নতুন মোড়কের কোন অপমান সহ্য করার মতো কোন যোগ্যতা ছিলোনা বলেই বোধ করি পুরো রাস্তাটাই হেটে আসলাম। এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন অবশ্য পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকবার হয়েছিলাম। বিষয়টা অনেকটা স্বাভাবিকতার পর্যায়ে চলে এসছিলো।

বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় আর আগের মতো স্বতঃস্ফুর্তভাবে গৃহীত হচ্ছিলামনা। এ কারণ সম্ভবতো এ ধরণের আড্ডায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হলে যে রসদ যোগানোর প্রয়োজন তার সামর্থ্য আমার ছিলোনা। তাই চরম কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার আগেই আড্ডার অভ্যাসটা পরিত্যাগ করলাম। একজন মানুষকে সম্ভবতো সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসতাম। 'সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসতাম' এই উপলব্ধিটা আরো জোরদার হলো যখন তার বিয়োগ পরবর্তী সময়ে বহুদিন আমার বাম হাতটাতে কোন বোধ পেতামনা। কিন্তু একটা সময় প্রকাশিত হলো এই বোধটা সম্পূর্ণই এক তরফা। কারণ মাস ছয়েক পরে তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হলো তখন এটা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হলোনা যে তার মতো উচ্ছল রমণী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

আমার দিন শুরু হতো বাবার বকুনি খেয়ে। দিন শেষ হতো একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বাবার এ আচরণ কোন অবস্থায়ই বাড়াবাড়ি বা অযৌক্তিক ছিলোনা। পৃথিবীর সব পিতাই ঐ অবস্থায় এরূপ আচরণ করতেন। ষাটোর্ধ্ব বয়সের একজন মানুষ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে যখন পুত্রের উপর নির্ভর করে নিশ্চিত মনে বিশ্রামে যাওয়ার কথা তখনো পুত্রের অপদার্থতার কারণে তাঁকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে। কাজেই এমন অপদার্থ পুত্রেকে বকা দেয়াটা তার অধিকারের পর্যায়েই ছিলো।

স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসটা একসময় খুব শক্তিশালীই ছিলো। বকুনি পর্ব শেষ হলে রোজরাত্রে বালিশে মুখ গুজে অশ্রুসিক্ত নয়নে ঈশ্বরের কাছে সাহায্য চাইতাম। এ অবস্থায় মাঝে মধ্যেই একটা কোমল স্নেহময় হাতের পরশ পাওয়ামাত্রই নিজেকে সামলে নিতাম। মনে হতো, আমার কান্না শুনে ঈশ্বর হয়তো স্ব-শরীরে আমাকে স্বান্ত্বনা দিতে চলে এসেছেন। চোখের জল মুছে অনেক আশা নিয়ে অচেনা আগন্তুকের দিকে তাকাতাম। দেখতাম,না এতো ঈশ্বর নন। শীয়রের পাশে আমারই মতো অস্রুসিক্ত নয়নে আমার মাথায় হাত হাত রেখে বসে আছেন এক রমণী, আমার মা। বুঝলাম, ইশ্বরতো দূরের কথা মা ছাড়া এই মুহুর্তে আমার মাথায় হাত বুলাবে এমন ফুরসত কোন ইতর প্রাণীরও নেই।

আমার দিন বদলে গেছে তা আমি বলিনা। তবে মেরুদন্ডটা একটু সোজা হইছে। 'মেরুদন্ড সোজা হওয়ার' এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে ধাপে আমি বুঝেছি, জগতে আসলে বন্ধু কিংবা ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আর আদৌতে যদিও থেকে থাকে তবে এসবের সব রূপ একজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ। আমার মা, আমার একমাত্র বন্ধু। আমার মা, আমার ঈশ্বর।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০০৯ সকাল ১১:২৬
৩৪টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×