এরপর পুঠিয়া। বগুড়া থেকে রাজসাহী আসতে হাতের বামে রাস্তার প্রায় পাশেই এই জায়গাটা। হেটেই চলে যাওয়া যায়।কিন্তু ততক্ষণে শরীরে তেমন শক্তি অবশিষ্ট নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় একত্রিশ বছরের আমি সত্তর বছর পুরনো বডিতে ঢুকে বসে আছি। তাও সত্তর বছরে অনেককেই আমি শক্তিশালী দেখেছি। ভ্যানে চড়ার একটা আলাদা মজা আছে। আবার সফরসঙ্গীর উৎসাহ আমার খুব ভালো লাগছে। অনুজ জিজ্ঞেস করলো, আপনি আরো উঠেছেন? আমি একটু বিজ্ঞের ভাব নিয়ে বললাম যে এটাই প্রথম নয়। আসলে আমি আগে দিনাজপুরে একবারই উঠেছি। ভ্যানে আসতে আসতে চোখ জুড়িয়ে গেলো। এর আগের তিক্ততাটা একটু কমলো। একটু হোমোফবিক হবার কারনে কোন পুরুষের এই ধরনের আচরণ আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়। বাসের কন্ডাকটর মহাশয় একটু ইয়ে ছিলেন। তার ভাষায়," ব্রেকটা একটু হালকা ছুয়ে দেন তো উনারা নামবেন বুঝলেন।"
বা দিকে পুঠিয়া থিয়েটার। জরাজীর্ণ অবস্থা সবচেয়ে বেশী বোধয় এই থিয়েটারেরই। ভাবতেই ভালো লাগলো। আগে এখানে নাটক হতো। মনোরঞ্জনের সবেচেয়ে প্রাচীন কায়দা। সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম। এখন মন রঞ্জিত হয় না বরং ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এখন দর্শকসারির সবাই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মাঝে মাঝে কল আসে উচ্চস্বরে। যার কারনে এমন শক্তিশালী সৃষ্টি নিবিড়ভাবে দেখা যায় না। আগে হয়তো এই জায়গায় সবাই মিলে উপভোগ করতেন খুব। শিল্পীরা তাদের নিখুত আর যোগ্য করে তুলতে আপ্রান চেষ্টা করে যেতেন। এখনকার শিল্পীদের কথা ভেবে খুব হাসিই পেয়েছে থিয়েটারটির সামনে।
ভ্যানে চড়ার সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এতে পা ঝুলিয়ে বসা যায়। সুখকর একটি অনুভুতি । সবারই একবার অন্তত উত্তরে এসে ভ্যানে চড়া উচিত। গবেষণা করলে পাওয়া যেতে পারে যে আপনি যদি স্ট্রেস, এঞ্জাইটি, উচ্চ রক্তচাপ থেকে বাচতে চান, উত্তরে যান এবং নিয়ম করে একঘন্টা ভ্যানে চড়ে ঘুরে বেড়ান।
কারুকাজ করা মঠ আর মন্দির সবখানে। আর তার চারদিকে নিরাপত্তা জনিত বেড়া। বাইরে থেকে দেখলাম আর খুব ভেতরে যাবার ইচ্ছে দমন করলাম। আগেকার দিনে বর্ণভেদ ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে। নিম্নবর্ণজাত(!) হিন্দুদের মন্দিরে ঢুকতে দেয়া হতো না। কত আকুল হয়ে একটি বাচ্চা ঢুকতে চাইতো আর দূর থেকে দেখতো তা ওখানে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেছি কিছুটা। মানুষ খুবই অদ্ভুত জীব। একটা বাচ্চা ছেলে জানলোই না সে কেনো মন্দিরে যেতে পারবে না। জাত বর্ণের বিচারে পরে ওভাবেই তার জীবন শেষ হলো। ভাবা যায়?
সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের সবচেয়ে পরম পূজ্য হলেন শিব। শিব হলেন সংহারকর্তা। ধ্যানে মগ্ন থাকলেও ত্রিনয়নে সবই দেখতে পান। শিব মন্দিরের প্রধান দরজাও বন্ধ ছিলো। কিন্তু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় দৌবারিক দরজা খুলে দেন। ছবি তোলা নিষেধ। কিন্তু আমার হাতে ক্যামেরা দেখে বোধয় তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দেন। হয়তো এইটুকু সময়ের জন্যই খুলে দেয়া হয়। স্প্লিট সেকেন্ডসের জন্য দেখতে পেলাম। তার আগে অবশ্য দৌড়ে উঠতে হয়েছে। উচু মন্দির টা আমার আর্কিটেক্ট অনুজের ভাল লেগেছে বোঝা যায়। তাকে কাছে ধারে পেলাম না। চারদিকে ঘুরছিলো। যাকে বলে প্রদক্ষিণ।
এই স্থাপনার লাগোয়া একটি মাদ্রাসা দেখতে পেলাম। ছোট বাচ্চারা সালাম দিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো আমার হাতে এটা কী এবং কোথা থেকে এসেছি। শিক্ষকতার বদভ্যাস হিসেবে ওখানেই বোঝানো শুরু করলাম আদ্যোপান্ত। কিন্তু কতটা বুঝতে পেরেছে তা নিয়ে চিরাচরিত শিক্ষকসুলভ সন্দেহ থেকেই গেলো। শেষে মুচকি হেসে বললাম, এটা ক্যামেরা।
মন্দিরেরে স্থাপনার ঠিক সামনেই কবর দেখতে পেলাম। এভাবেই সবাই ইতিহাস হয়ে যাবে। অন্যান্য সব স্থাপনার মতো। এখানে সবাই নিরুপায়। সময় তার নিজের গতিতে বয়ে যাবে। সবকিছু ক্ষয়ে খসে পড়বে। ধুলোয় মিশে বিলীন হয়ে যাবে। দ্য আল্টিমেট ডেস্টিনেশন।
সবেচেয়ে দুরাবস্থায় আছে এই বাড়িটি। এখানে বেড়া দেয়া নেই। বিবর্ণ হয়ে আছে বেচারি। মনে হলো দম্ভের সাথে বলছে,
"আমায় দেখো। আমার ভেতর প্রাণে ভরপুর এক বিশাল জগৎ ছিলো। আমার দেয়ালে আর্তনাদ থেকে উল্লাস সবই ছিলো। ছিলো শিশুদের কোলাহল। ছিলো চুমু, ছিলো দীর্ঘশ্বাস, ছিলো প্রেম, ছিলো অভিসার, ছিলো অন্যায়, ছিলো অনাচার, ছিলো অহংকার, ছিলো জৌলুস। এখন তার কিছুই নেই। কিন্তু আমি ছিলাম। আমাকে তোমরা অস্বীকার করতে পারো না।"
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ৭:৪৪