ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)এর সাথে সম্ভবত সবাই পরিচিত, শুধু মাত্র সংকটাপন্য মৃত্যুর সাথে পান্জ্ঞা লড়া রোগির শেষ আশ্রয় স্থল এই আইসিইউ। হ্যা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশটিকে সম্ভবত আসিইউতে ট্রান্সফার করার সময় হয়েছে।
বিজয়ের এই মাসে আমরা সবাই এখন হিসেব মিলাতে বেস্ত, স্বাধীনতার ৪০ বছরে কত টুকু এগিয়েছি আমরা ? টিভি-সংবাদপত্র তথা সব মিডিয়াতেই আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব কষছেন নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞগন। খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা পড়ছি-শুনছি সারা মাস জুড়েই।
একথা নিশ্চই সবাই মানবেন যে, বিগত ৪০ বছরে আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। ৭২ এ ৫৭% প্রোভার্টি রেট নিয়ে যাত্রা শুরু করে ৯০ এর দশকে ৪২% ও ২০১০ এ আমরা তা থিউরেটিকালী ৩৪% নামিয়ে আনতে পেরেছি। বিগত ৪০ বছরের সরকারগুলর তাৎপর্যপূর্ন কোন সহায়তা ছাড়াই (কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে) বাংলাদেশের সাধারন জনমানুষের বিপুল প্রাণশক্তি ও অদম্য আকাংখায় তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আমাদের আজকের অর্থনীতি।
গত চার দশকে আমাদের কৃষকরা খাদ্য উৎপাদন ৩ গুন বাড়িয়েছে। দুই-তিনটি বছর ছাড়া ১৯৯৭ এর পর থেকে আমরা কার্যত খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন একটি দেশ। সম্পুর্ন কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে আমরা ধীরে হলেও হালকা ও মাঝারি শিল্প নির্ভর অর্থনীতিতে নিজেদের নিয়ে এসেছি। পাশা-পাশি প্রায় ১ কোটি (সরকারী হিসেবে ৭০ লাখ) প্রবাসী শ্রমজীবী বাংলাদেশীর প্রেরিত অর্থ, প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক ঝন্জ্ঞা-বিক্ষুদ্ধ বাংলাদেশকে বার বার বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।
আমাদের শ্রমে-ঘামে তিলে তিলে গড়ে উঠা এই অর্থনীতির অবস্থা এখন প্রায় চুড়ান্ত রকমের খারাপ অবস্থায় পরেছে। ২০১০ সাল শুরু হয়েছিল ১০ ভাগ মুদ্রাস্ফিতি, ডলার মূল্য ৭০ ও ১১ বিলিয়ন বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ নিয়ে। আর আজ শেষ সময়ে এসে মুদ্রাস্ফিতি ১২, ডলার মূল্য ৮১ ও বৈদেশিক রিজার্ভ ৯ বিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে।
দূর্নীতি মুক্ত মন্ত্রী সভা নিয়ে আত্নতুষ্টিতে ভোগা প্রধান মন্ত্রী ৩য় বছরে এসেই শুনলেন তার সুযোগ্য দৌড়বিদ যোগাযোগ মন্ত্রীর কৃতকর্মের ফিরিস্তি। অবস্থা এতই খারাপ যে বিশ্বব্যাংক, জাইকা যুগপত ভাবে বছরের সর্ববৃহত বৈদেশীক ঋণ আটকে দিয়েছে। সরকারের ব্যার্থতা ও মধ্যপ্রাচ্চ্যে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় রেমিটেন্স প্রবাহে ভাটার টান শুরু হয় বছরের শুরুতেই। গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে সরকারের উচ্চাভিলাসি কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র। ৩ বছর মেয়াদি এই কোন্দ্রগুলো শুরুর পেছনে যুক্তি ছিল ৩-৫ বছরের মধ্যেই সরকারী-বেসরকারী বড় বড় বিদ্যুত কেন্দ্রগুল উৎপাদনে চলে আসার মধ্যবর্তি সময়ে আপদকালিন ও অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে এগুল নির্মিত হবে।
ঐ বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলের একটি ও এখন পর্যন্ত উৎপাদনে আসেনি এবং আগামী ১'৫-২ বছরেও আসার কোন সম্ভবনা নেই। ফলে কুইকরেন্টাল কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ইতিমধ্যেই আরো ২ বছর বাড়ান হয়েছে। সরকারী দলের নেতা,কর্মি, ব্যবসায়ীদের আনুকূলে বরাদ্য হওয়া এই কুইকরেন্টাল কেন্দ্রগুলো নিয়ে ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, ওভার ইনভয়েসিং করে যন্ত্র আমদানীর নামে এক দিকে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে অন্যদিকে ৩-৫ বছরের পুরন যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরী করায় ঐগুল ১৫-২০% ও কোন কোন ক্ষত্রে ৫০% কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। অথচ ৫৫ টাকার ফার্নেস অয়েল ২৬ টাকায় প্রদান ও ৩'৫-৪ টাকায় বিদ্যুৎ ৬-৮ টাকায় কেনার চুক্তি করে সরকার বিপুল পরিমান টাকা ঐ কুইকরেন্টাল মালিকদের পেছনে ভর্তুকি দিচ্ছে। অথচ নতুন শিল্প-কারখানা দূরে থাক খোদ মহানগরী ঢাকাতেই ১৬ হাজার তৈরী ফ্লাটে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পারছে না। দেশের জিডিপির ১৬% যোগানদাতা আবাসন শিল্প গত এক বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে। আটকে গেছে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থান।
দেশের প্রধান দুই শেয়ার বাজারের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই, বিগত ১ বছর ধরেই লাল বাতি জ্বলছে। অর্থবছরের (জুলাই ১১ -জুন ১২ ) প্রথম ৫ মাসেই সরকার স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে যেখানে সারা অর্থবছরের লক্ষমাত্রা ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা।
প্রথম দিকে অর্থ মন্ত্রী ও প্রাধান মন্ত্রী তুরী মেরে উড়িয়ে দিয়ে দম্ভ করেছেন 'দেশ চালাতে রিজার্ভের প্রয়োজন হয় না, চালাতে জানলে এমনিতেই চালান যায়। বঙ্গবন্ধুর আমলে রিজার্ভ ছিলনা বলে কী দেশ চলে নি ?'
শুনে হাসব না কাদব ঠীক বুঝতে পারিনি। সরকারী কর্মি-সমর্থক, মন্ত্রীদের কাছে ৭২-৭৫ স্বর্নযুগ হলেও দেশের আমজানতার কাছে তা ছিল দুঃসপ্ন ........ ৭৪ এর দুর্ভিক্ষে ২ লাখ স্বজনের মৃত মুখ ওনারা ভুলে গেলেও দেশবাসী ভুলে যায় নি। জিয়া পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে পন্চমুখ প্রধান মন্ত্রী রীতিমত বিশ্ব ব্যংককে ধমকে বলছেন 'প্রমান ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ অগ্রহযোগ্য। এটা তাদেরকেই (বিশ্ব ব্যাংক) প্রমান করতে হবে'। ভাব এমন ঋণ দাতা যেন বিশ্বব্যাংক নয় স্বয়ং বাংলাদেশ সরকার। অথচ তত্বাবধায়ক আমলে দায়ের করা মামলার সূত্র ধরে শেখ হাসিনা প্রতি দিনই জিয়া পরিবারকে চোর-বাটপার বলে বেড়াচ্ছেন। মামুনের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে তারেকের ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করার বিদেশী এফবিআই এজেন্টের স্বাক্ষী যোগার করতেই মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ৩ বছর ফুরিয়ে গেছে আর প্রমান করাত বহু দূর। অথচ আদালতে মোকাবেলা না করেই একই তত্বাবধায়ক আমলে করা ১৫ দূর্নীতি মামলা থেকে নিজের নাম কাটিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
বিএনপি সরকারের বিদায়ের পর আমরা শুনেছি লক্ষ কোটি টাকার দূর্নীতির খবর। এই সরকারের তিন বছরেই যা অবস্থা দাড়িয়ে তাতে ঠিক বুঝতে পারছি না যে এই সরকারের বিরুদ্ধে ঠিক কত শত কোটি টাকার দূর্নীতির অভিযোগ উঠবে।
এদিকে ব্যংক ব্যবস্থাও প্রায় লাটে উঠেছে। সরকার ও সরকরার দলীয় লোক জনের রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া লোনের ভারে সোনালী, জনতা, অগ্রণী সহ ৮ বিশেষায়িত সরকারী ব্যংক প্রকোট অর্থ সংকটে পরেছে ( প্রথম আলো ২৩-১২-২০১১)। বেসরকারী ব্যাংকগুল ও সরকারের দানবীয় ক্ষুদা মেটাতে মুমূর্ষ প্রায়, ১২ টি বেসরকারী ব্যাংক গ্রাহককে লোন দেয়া দূরের কথা আমানতকারীদের আমানতের নিরাপত্তা সণ্চিতির নির্ধারিত টাকাও (সিআরআর) বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে ব্যার্থ হয়েছে (কালের কন্ঠ ২৪-১২-২০১১)। শেয়ার বাজারের ৩০ লাখ আগেই সর্বশান্ত হয়েছে আর এখন চরম ঝুকির মুখে পড়েছে ৫ কোটি আমানতকারী সন্চয়।
ইউরোপ-আমেরিকায় শুরু হওয়া রিসিশনের ২য় ধাক্কা বাংলাদেশের রফতানী খাতকে ও বিশাল চেলেন্জ্ঞের মুখে দার করিয়ে দিয়েছে। শুধু ইউরোপ থেকেই ৮ হাজার কোটি কাটার রফতানী আদেশ বাতিল হয়েছে বিগত ২ মাসে। অপর দিকে ১ সপ্তাহেই ৩ টাকা বেরে ডলারের বিপরিতে টাকার বিনিময় মূল্য দাড়িয়েছে ৮১ টাকা।
সর্বগ্রাসী এক কালো ছাড়ায় এখন ঢাকা পরেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যংকের নির্বুদ্ধিতা ও চলমান বৈশ্বিক মন্দা পুর অবস্থাকেই দিন দিন দুঃস্বহ করেতুলছে। মন্দের ভাল এই যে মাল সাহেবরা ২-৪ দিন ধরে আস্তে আস্তে মুখ খুলছেন....... দেরীতে হলেও স্বীকার করছেন যে তাদের ভ্রান নীতি এই পতনের জন্য দায়ী আর প্রভাবক হিসেবে রিসিশন ত রয়েছেই।
বাজারে বেশ কিছু গুজব ইতিমধ্যেই বাস্তবতা পেয়েছে বা পেতে যাচ্ছে
১। ডলার মূল্য ৯০ এমনকি ১০০ ছুটে পারে। ( গত বৃহস্পতিবার কাব মার্কেটে ৮৫ ও ব্যংকে ৮১ ছিল)।
২। আইএমএফ থেকে সরকরার যে কোন শর্তে জরুরী ঋণ নিচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ মূল্য বাড়ানো ও আরো রক্ষনাত্বক ব্যাংকনীতি গ্রহন করতে যাচ্ছে । ( আজ কালের কন্ঠে এ নিয়ে ২ টি রিপোর্ট এসেছে)
৩। সরকার দ্রুত সরকারী চাকরীর বয়সসীমা ২ বছর বৃদ্ধি করবে। কারন চাকরী পরবর্তী পেনশনের টাকা দেয়ার মত অবস্থায় সরকার নেই। (বয়সসীমা ২ বছর বৃদ্ধির ঘোষনা ইতিমধ্যেই দেয়া হয়েছে। প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা পুরোটা এক সাথে না দেয়ারও আদেশ অচিরেই অলিখিত ভাবে হলেও জারি করা হবে।)
৪। সরকার উচ্চ সুদে সভরেণ তথা সার্বভৌমত্ব ঋণ নেয়ার জন্য দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। আর এই ঋণ নিয়ে এখন চরম বেকায়দায় পরেছে ইটালি, গ্রীস।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সামনে একটি কঠিন বছর অপেক্ষা করছে। আইসিইউ তে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির মুমূর্ষ অবস্থা দেশের মানুষকে হয়ত এই দশকের কঠিনতম পরীক্ষায় ফেলবে..............।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৩৪