লেখিকা: ফাতিহা অরমিন নাসের, লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ই আরকিতে।
যুদ্ধে ট্যাংক নিয়ে হামলা করে শত্রুপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য হলিউডি সিনেমায় প্রায়ই দেখা গেলেও গর্বের বিষয় হচ্ছে, ১৯৭১ সালের মহান বিজয় দিবসের দিনই যশোরের শিরোমণিতে যৌথবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিসেনারাও ট্যাংক আর দূর্দান্ত রণকৌশলকে সঙ্গী করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে জিতেছিলেন এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। “ট্যাংক ব্যাটল অফ শিরোমণি” নামে পরিচিত এ যুদ্ধের রণকৌশল এতটাই বীরত্বপূর্ণ ছিলো, যে পৃথিবীর ৩৫টি দেশের মিলিটারি একাডেমিতে বিশেষ একটি চ্যাপ্টার হিসেবে পড়ানো হয় ব্যাটল অফ শিরোমণির গল্প।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে যুদ্ধ যখন প্রায় শেষের পথে, তখন ‘প্রাচ্যের স্তালিনগ্রাদ’ নামে পরিচিত যশোর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান নেয় পাক সেনাবাহিনী। প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য, দেড়শো আর্টিলারি আর অন্তত ৩৪টি ট্যাংক নিয়ে সুসজ্জিত এ বাহিনীকে পরাস্ত করার জন্য যৌথবাহিনী ভালো প্রস্তুতি নিয়েই এগিয়ে আসে। কিন্তু যশোর সেনানিবাসে প্রবেশ করেই মুক্তিবাহিনী দেখতে পায়, শক্ত ঘাঁটি ছেড়ে খুলনার রূপসা নদীর কাছে শিরোমণিতে অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তানীরা। শিরোমণির প্রতিটি পাকা বাড়িতে ডিফেন্সিভ অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি জুট মিল ও কেবল মিলগুলোও দখল করে নিয়েছিলো তারা, কয়েক গজ পরপরই বাংকার আর স্থল মাইন বসিয়ে পুরো এলাকা রেখেছিলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। যৌথবাহিনীকে বোকা বানানোর জন্য নিজেদের আসল ঘাঁটির সামনে নকল একটা স্ক্রিনিং পজিশনও তৈরি করে রেখেছিলো তারা। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে যৌথবাহিনীর কমান্ডার মেজর মাহেন্দ্র সিং এগিয়ে যান স্ক্রিনিং পজিশনের দিকে, আর মুহূর্তের মধ্যেই তাদের বহরকে ছিন্নভিন্ন করে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার মেজর হায়দার। প্রায় ৩০০ সৈন্য হারিয়ে হতবাক যৌথবাহিনী এবার যুদ্ধ হস্তান্তর করেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরকে।
মেজর মঞ্জুর প্রথমেই ভারতীয় সেনা আর মুক্তিসেনাদেরকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে ঘিরে ফেলেন পাকিস্তানিদের। তারপর ট্যাংক নিয়ে সোজা হামলা করেন পাকবাহিনীর ওপর। ট্যাংকের আঘাতে যখন পাকবাহিনী হতভম্ব, তখনি ট্যাংকের পেছনে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এসে আক্রমণ শুরু করেন, তাদের সাথে যোগ দেন ডিফেন্সিভ পজিশনে থাকা ভারতীয় সেনারা। ১৬ তারিখ জেনারেল নিয়াজী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও খুলনায় মেজর হায়দার যুদ্ধ চালিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন, আর দিনব্যাপী পর্যদুস্থ হন মেজর মঞ্জুরের অসামান্য বুদ্ধিমত্তার কাছে। শেষমেশ ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন মেজর হায়দার, শেষ হয় শিরোমণির রক্তক্ষয়ী ট্যাংক ব্যাটল। সমরবিদদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটিমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই ট্যাংক, আর্টিলারি, পদাতিক আর হাতাহাতি যুদ্ধের এমন নজির শিরোমণি ছাড়া আর কোথাও দেখা যায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১০:২৮