২০১৬ সালের মার্চ মাসের সকালে কাধে ছোট একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে বেড়িয়েছি বাড়ি থেকে। গাজীপুর টাকশাল-শিমুলতলী পথ ধরে রেল লাইনে উঠে পায়ে হেঁটে চলে যাবো রাজেন্দ্রপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত। ভাওয়াল গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশনের পরেই হাতের ডানে এটি পত্রহীন নেড়া মাঝারি সাইজের বৃক্ষ নজরে পরলো। নেড়া বলে নজরে পরলো তা কিন্তু নয়, বরং নেড়া গাছের কয়েকটি ডালের আগায় কয়েটি করে হলুদ ফুল ফুটে আছে। ফুল গুলি আমার অচেনা, এর আগে এই ফুল আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আবার গাছে তেমন কোনো পাতাও নেই যে পাতা দেখে গাছটিকে চিনবো। অবশ্য পাতা থাকলেও তেমন একটা লাভ হতো না, কারণ আমি পাতা দেখে গাছ খুব একটা চিনতে পারি না। বরং ফুল দেখে গাছ চিনতে সুবিধা হয় আমার জন্য। অতএব এই ফুল এবং গাছটি আমার অচেনা। গাছটি দেখেই মনে হয়েছে খুব বেশী বয়স নয় তার, তাই হয়তো ফুলও হয়েছে ছাড়া ছাড়া কয়েটি।
কতেক কঠোর তপে, যাগ যজ্ঞ পুজা জপে,
গ্রহদিন গেল নিবড়িয়া।
জনি পূজা বাদ্য নাটে, দশমে গামার কাটে,
নদীতটে জয় জয় দিয়া।
পণ্ডিত পদ্ধতি কাছে, জাগাল গামার গাছে,
গণেশাদে পূজিয়া দেবতা ।
বৃক্ষের বরণ করি, সংষান্ত-শাহিত ধরি,
বান্ধিলো সবায় হাতে সূতা ।
কামারে গামার কাটি, ঘয়ে আসি পরিপাটী,
গাঁধিছে সাম্যাস-কাটি তায়।
----- শ্রীধর্ম্মমঙ্গল - ঘনরাম চক্রবর্তী
এরপরে এই ফুলের দেখা পাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নীলকুঠি বাজার নামক স্থানে, পুরনো নীল কারখানার চুল্লি দেখতে গিয়ে। ঠিক রাজপথের পাশেই একটি মাঝারি গাছ, পাতাহীন এবং অনেক গুলি ফুল ফুটেছে। বেশ কিছু হলদে ফুল গাছের তলে ঝরে পরে আছে। হলদে এই ফুলের নাম গামারি। জ্বী ঠিকই পড়েছেন, গামারি গাছের ফুল এটি। ঢাকার হাতিরঝিলে রামপুরার অংশের ফুট অভার ব্রিজের কোনায় গামারি গাছ আছে, ফুলও ফুটছে বেশ কয়েক বছর ধরে। আর আছে মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে, বেশ কয়েকটি, বেশ বড় বড়, প্রচুর ফুল ফোটে। ঝরা ফুলে গাছের নিজে হলদে আবেশ ছড়িয়ে পরে।
গামারিকে আমরা চিনি কাঠ গাছ হিসেবে। কাঠের আসবাব তৈরিতে সেগুনের পরেই গামারি কাঠের প্রাধান্য। গামারি কাঠ যতই ভালো হোক আমাদের তাতে কোন উৎসাহ নেই। আমাদের উৎসাহ আজ গামারির ফুলে।
কাঠ গাছ হলেও গামারি গাছে কিন্তু বেশ চমৎকার গাঢ় হলদে ফুল ফোটে। ফুলের গোড়ার দিকটা থাকে খয়রি-বাদামী।
গামারির আরো কয়েকটি নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে গামার সবচেয়ে বশী পরিচিতো, তাছাড়া গাম্বার, সুভদ্রা, কৃষ্ণবৃন্তা, শ্রীপর্ণী, কম্ভারী, গোপভদ্রা, মধুমতি, সুফলা, মেদেনী, কাশ্মরী, ভ্রমরপ্রিয়া ইত্যাদি নামও শুনতে পাওয়া যায়।
গামারি ফুলে বেশ মধু হয় বলে ভ্রমরের কাছে গামারি ফুলের আকর্ষণ প্রচুর। বসন্তে যখন পত্রহীন গামার গাছে হলদে ফুলে ভরে উঠে তখন ভ্রমরের ছুটে আসে মধু পানে। তাই গামারের আরেক নাম ভ্রমরপ্রিয়া হয়েছে। তবে শুধু ভ্রমর নয় বরং টিয়া আর কাঠবিড়ালিরও খুব প্রিয় এই গামার ফুল। ফুল ফুটলে মিষ্টি গন্ধে মম করে।
বাংলার মত ইরেজিতেও গামারির বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে। যেমন - Chandahar Tree, Cashmere Tree, Comb Teak, White Teak ইত্যাদি।
গামারির Scientific Name - Gmelina arborea.
গামারি একটি দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। লম্বায় এটি ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু হতে পারে। পত্রমোচী গাছ বলে শীতে সমস্ত পাতা ঝরে যায়। পাতা বড় তাম্বুলাকৃতির হয়। তাম্বুলাকৃতি মানে হচ্ছে কিছুটা পানের মতো দেখতে। গামারি ঔষধিসমৃদ্ধ এক ভেষজ উদ্ভিদ।
ছবি তোলার স্থান ও সময় : বিভিন্ন সময় ছবিগুলি তুলেছি হাতিরঝিল, বোটানিক্যাল গার্ডেন, মিরপুর, ঢাকা থেকে।
তথ্য সূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, অন্তর্জাল।
ছবি ও বর্ণনা : নিজ।