বাউল তত্ত্ব অনেকেরই অপছন্দের বিষয়। কিন্তু বাউলদের কথা বা তত্ত্বকে তারা বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেন না। তার কারণ হিসেবে যা মনেহয় আমার তা হল সত্যকে সহ্য করার ক্ষমতা খুব কম সংখ্যক মানুষেরই হয়। এই কারণেই বাউলরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতিত এবং নির্বাসিতও হয়ে থাকে তাদের নিজেদের সমাজ থেকে। তেমনই একজন বাউল “বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম।"
বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে খ্যাত ছিলেন শাহ্ আব্দুল করিম। ১৯১৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী তে জন্ম এই কিংবদন্তির। খুব দরিদ্র ঘরে জন্ম বলেই পড়াশুনা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু ছোট থেকেই গানের প্রতি মায়া আর বাউলতত্ত্বের প্রতি ভালবাসা থেকেই হয়ে ওঠেন বাউল সম্রাট। কিন্তু তার জীবন খুব মসৃণ ছিল না। গান গাওয়া আর গানের প্রতি ভালবাসার কারণেই তাকে তার গ্রামের থেকেই বের করে দেয়া হয় ঈদের দিন ঈদের নামাজের জামাতের সময়ে। শেষ পর্যন্ত সেই মসজিদেই তার জানাজা হয়।
লালন সাঁই কে নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও বেশ কিছু তথ্যচিত্র নির্মিত হলেও আমাদের ভাটি অঞ্চলের বাউল সম্রাটকে নিয়ে তেমন কোন কাজই করা হয় নি। তার জীবনী এবং তার জীবন যাত্রা নিয়ে শাকুর মজিদ স্যারের একমাত্র কাজ “ভাটির পুরুষ”। আজ এই “ভাটির পুরুষ” সম্পর্কেই কিছু লিখতে বসা। কারণ আমার জানা মতে অনেকেই (শুধু অনেকেই না, মাপ নিলে এই অনেকের পাল্লাটাই ভারী হবে) এখনো জানেনই না এই প্রামাণ্যচিত্র সম্পর্কে। এত বলিষ্ঠ একজন মানুষ যার সারা জীবনই কেটেছে কোন না কোন সংগ্রামের মাধ্যমে, তার জীবনীমূলক আরও কোন কিছু কেন নেই সেই ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হয়নি আমার।
বাংলার বাউলদের যদি কোন ভাবে আলাদা করতে চায় কেউ তবে অনায়েসে দুইটি ভাবে আলাদা করা যায়। একদল বাউল শুধুই দেহতত্ত্ব আর মানব ধর্মের বিশ্বাসী। যাদের বিভিন্ন গানে আমরা শুধুই মানব সেবা আর নিজেকে অন্যের তরে বিলিয়ে দেয়ার কথাই শুনতে পাই। আর এক দল শুধু দেহতত্ত্বই নয় বরং প্রেমের কবিতা আর গানের প্রতিই নিজেদের সৃষ্টির বেশিরভাগ অংশকে ব্যাবহার করেছেন। শাহ্ আব্দুল করিম দ্বিতীয় ধারার বাউল। তার গানের কথা খুব সরল সহজ ভাবেই মানুষের কাছে পৌছায় বলেই মানুষ তার গানে নিজেদের প্রতিচ্ছবি খুজে পায়। শাহ্ আব্দুল করিম প্রধানত বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কবি। তবে একুশ শতকের শুরুর দিকে তিনি ও শহুরে জনগোষ্ঠীর সম্পর্কটি নতুন এক স্তরে উপনীত হয়। তার কারণ হিসেবে দেখাতে পারি বেশ কজন শিল্পী তার গান গেয়ে দেশে বিদেশে বেশ পরিচিতি পেয়ে যান। তখনই শাহ্ আব্দুল করিমের সাথে আমার পরিচয় এবং এখন পর্যন্ত তা অবিচ্ছেদ্যই রয়ে গেছে।
শাকুর মজিদ স্যারের নির্মিত “ভাটির পুরুষ” তথ্য চিত্রটি যারা দেখেননি, শুধু গানই শুনেছেন আব্দুল করিমের তারা নতুন করে আবষ্কার করবেন শাহ্ আব্দুল করিমকে। পুরো তথ্যচিত্রে তিনি গানের সাথে সাথে নিজের কথা বলেছেন। কিন্তু সেখানে নেই কোন কৃত্রিমতা। তথ্য চিত্রের নির্মাণকালে তিনি সুস্থই ছিলেন, তাই কথা ও গান গুলো বেশ পরিস্কার ভাবেই দর্শক শ্রোতাদের ভালো লাগবে। তথ্য চিত্রে নবীন শিল্পীদের গায়কী আর শাহ্ আব্দুল করিমের গায়কির মাঝে পার্থক্য দেখতে পাবেন সবাই। কিছু অংশে সঞ্জীব দা আর শাহ্ আব্দুল করিম দুই জনেই একই গান গাইছে কিন্তু ভিন্ন ঢঙে তাও বেশ উপভোগ করার মতই। গায়কির ঢঙ বলতে কেউ গানকে নষ্ট করা বুঝবেন না। কারণ একেক জন মানুষের গান গাওয়ার ধরণ এক এক রকমের। সেইটাই গায়কি। তথ্যচিত্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার এইটাই।
“ভাটির পুরুষ” দর্শক শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করবে আশা করি। পুরো তথ্যচিত্র জুড়ে গানের পাশাপাশি করিমের জীবনের নানা দিক তুলে উঠেছে। শাহ্ আব্দুল করিমের জীবনের বড় একটা অংশ জুরে রয়েছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। যাকে তিনি “সরলা” নামেই ডাকতেন। তার রচনায়ও আমরা তার প্রভাব দেখতে পাই।
“সরল তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা।”
বাউলদের প্রকারভেদে শাহ্ আব্দুল করিমকে দ্বিতীয় ঘরণায় ফেলার কারণ তিনি নিজেই এই তথ্যচিত্রে বলেছেন তিনি “নারী ভক্ত” মানুষ। তাই তার গান গুলো মানুষের কাছে এত সহজেই পৌছে যায়। প্রকৃতিগত ভাবেই মানুষ তার বিপরীতলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শাহ্ আব্দুল করিমও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। তাই বার বার তার গানের মাধ্যমে তার প্রেম, ভালবাসা এবং বিচ্ছেদ ফুতে উঠেছে খুব সহজ সরল ভাবেই।
তথ্যচিত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সংগীততত্ত্ব বিভাগের যশস্বী অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী বাউলদর্শন ব্যাখ্যা করেছেন, করিম ও সুনামগঞ্জের গানের ধারা নিয়ে নিজস্ব মতামত রেখেছেন। ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীই প্রথম ১৯৯০/৯১ সালের দিকে শাহ আবদুল করিমকে ঢাকায় নিয়ে এসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বুদ্ধিজীবিমহলের সাথে শাহ্ আব্দুল করিমের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সে অনুষ্ঠানে করিমের গান শুনে কবীর চৌধুরী থেকে তসলিমা নাসরীন বাকরুদ্ধ।
ওই একই সময়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শাহ আবদুল করিমকে ঢাকায় এনে করিমের একটি ইন্টারভিয়্যূ ও গান রেকর্ডিং করেছিলেন এবং কেন একুশে পদকটি ভাটি অঞ্চলের এই সুরসাধককে দেওয়া হচ্ছে না তা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন, পরে করিমকে একুশে পদকে ভূষিত করা হলে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
শাহ্ আব্দুল করিম যে শুধুই প্রেমের পূজারী তা বললে ভুলই হবে। তার গানের মাধ্যমেই প্রকাশ পায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধাচরণ।
“গ্রামের নওজওয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মূর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” -- এই গানের মাধ্যমে তার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ট কন্ঠ যেমন প্রকাশ পায় তেমনি
“এই কি তুম্বার বিবেচনা কেউরে দিলা মাখন ছানা
কেউর মুখে অন্ন জুটে না ভাঙ্গা ঘরে ছাওনী নাই” -- এই গানে বাংলার গরীব দুঃখী মানুষের প্রতি অবিচারের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। এছাড়াও
“অনেকে বলে আমকে গাও না একটা তেল-চোরার গান
তেলচূড়া যে বিষম চোরা সে যে অনেক ক্ষমতাবান।।
দেখরে ভাই বিচার করে তেল-চোরা রয়েছে ঘরে
সুকৌশলে চুরি করে চোরে জানে চুরির সন্ধান।।” – এভাবেই বিভিন্ন শোষণের বিরুদ্ধে তিনি অনেক রচনায় তার বিরোধীতা করে গেছেন।
শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় কিছু গান
• বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে
• আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
• গাড়ি চলে না
• আমি কূলহারা কলঙ্কিনী
• কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
• কোন মেস্তরি নাও বানাইছে
• কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
• বসন্ত বাতাসে সইগো
• আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু
• মহাজনে বানাইয়াছে ময়ুরপংখী নাও
• আমি তোমার কলের গাড়ি
• সখী কুঞ্জ সাজাও গো
• জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে
• মানুষ হয়ে তালাশ করলে
• আমি বাংলা মায়ের ছেলে
• রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না
• বাউলা গান
• সুনা বন্ধু ভুইলো না আমারে
• বন্ধুরে কই পাব সখি গো
• মুর্শিদ ধন হে
• আসি বলে গেল বন্ধু
একুশে পদক সহ আরো নানা পুরষ্কারে ভূষিত এই শিল্পীকে নিয়ে টানা সাত বছর সময় ধরে শাকুর মজিদ বানিয়েছেন ‘ভাটির পুরুষ’। ‘ভাটির পুরুষ’- এ উঠে এসেছে সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ধিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মানো শাহ আবদুল করিমের জীবন কাহিনী। এখানে তার সম্পর্কে নানা তথ্য হাজির করা বাদেও ড. মৃদুলকান্তি চত্রবর্তী, এদেশে নিযুক্ত সাবেক বৃটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, কথা সাহিত্যিক ড. হুমায়ূন আহমেদ, প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী রুহী ঠাকুর ও সঞ্জীব চৌধুরীর শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে বয়ান ও তাদের সঙ্গে তার নানা স্মৃতি। এছাড়াও শাকুর মজিদ তুলে এনেছেন স্থানীয় মানুষের মতামতও। এই প্রামাণ্যচিত্রটি বাজারজাত করেছে লেজার ভিশন। বাউল গানের গভীর আকর্ষনের কারণে বিশ্বব্যাপী ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকবেন শাহ আবদুল করিম, বাংলার ভাটি অঞ্চলের মেষপালকের হৃদয়ের সঙ্গে সমকালীন বিশ্বের সাধুসমাজের জানাশোনা হবে, চিন-পরিচয় হবে -এসব কারণে না হলেও এই তথ্যচিত্রটি সকলের দেখাটা দায়িত্ব বলে মনে করি। ।
তিনি শুধুই সাধকই ছিলেন না, ছিলেন প্রেমময়তার প্রতীক। শাহ আবদুল করিম গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সালে পরলোকগমন করেন। তাঁর সেই চলে যাওয়াটি অবশ্যি দৈহিক, যেহেতু বলা হয় আমাদের শরীরটি তৈরি মাটির-আর আত্মা নাকি অমর। আত্মা অমর না হলেও শাহ আবদুল করিম যে বাংলায় চিরকাল বেঁচে থাকবেন সে ব্যাপারে কোন সংশয় নেই । তার কারণ করিমের আন্তরিকতা। তার শিল্পে-যাকে আমরা বলি গান, সেই গানে কোনও রকম ফর্মালিটি নেই, কৃত্রিমতা নেই ...এটিই করিমের অমরতা লাভের রহস্য বলে বোধ হয় ...
সবাই সময় নিয়ে দেখে ফেলবেন আশাকরি “ভাটির পুরুষ”। আশা করি ভবিষ্যতেও আব্দুল করিম কে নিয়ে আরো অনেক অনেক ভালো কাজ হবে। সেই আশায় রইলাম।
ভাটীর পুরুষ
পরিচালনাঃ শাকুর মজিদ
পরিবেশনাঃ লেজার ভিশন
ডাউনলোডঃ Click This Link
ইয়ুটিউবে দেখতে চাইলেঃ https://www.youtube.com/watch?v=AfasqXaX3H
পরের পোষ্টঃ ~মহাজনের নাউ~
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৩১