আমি একখানা টাই। আমার জন্ম হইয়াছিল ইংলন্ডের কোন এক শহরে। টাই গোষ্ঠীতে আমি অভিজাত শ্রেণীরই বটে। বঙ্গদেশে আমার আমদানী হইয়াছিল বড় কোন এক ব্যবসায়ীর হাত ধরিয়া। বঙ্গদেশের আভিজাত্য লইয়া আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহের যে উদয় হয় নাই তাহা নহে। তথাপি হৃদয়ে আশা ধারণ করিয়াছিলাম টাই বংশে আমার আভিজাত্যর পুরষ্কার স্বরূপ অভিজাত এবং অর্থশালী ব্যক্তির পোশাকস্বরুপই যে আমি শোভা পাইব তাহাতে কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না। বঙ্গদেশে আসিবার পরে আমার স্থান হইল ইহার রাজধানী ঢাকা শহরেরই কোন এক অভিজাত পোশাকের দোকানে। প্রতিদিন কত অভিজাত ব্যক্তিই না সেই দোকানে আসিত, হায়! কিন্তু অত্যন্ত বেদনার বিষয় ছিল উহারা কেহই আমাকে পছন্দ করিত না। ক্রমশই যেন বঙ্গদেশীয় ব্যক্তিদের আভিজাত্য লইয়া সন্দেহ আমার মনে ধীরে ধীরে প্রবল হইতেছিল। যাহাই হোক এমনি ভাবে দোকানে ঝুলিয়া থাকিয়া আমার দিনাতিপাত হইতেছিল। এমনি সময়ে সৃষ্টিকর্তা আমার দিকে মুখ তুলিয়া তাকাইলেন। কোন এক যুবক সেই দোকানে আসিয়া আমাকে পছন্দ করিয়া বসিল। বোধ করি বঙ্গদেশীয় ভাষায় তাহাকে মফিজ ব্যতীত আর কিছু দিয়াই বিবৃত করা যায় না। তাহার মত যুবক একখানা টাই দিয়া কি করিতে পারে তাহা কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। সে অত্যন্ত চড়ামূল্য দিয়া আমাকে কিনিয়া লইল। হৃদয়ে সন্দেহ তারি সাথে আগ্রহের মেঘ লইয়া আমি তার সাথে যাত্রা করিলাম। সে আমাকে যেইস্থানে লইয়া গেল তাহা কোন অভিজাত এলাকা তো নয় বরঞ্চ কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস বলিয়া বোধ হইল। সে আমাকে তাহার সহপাঠীদের সম্মুখে উন্মোচন করিল। তাহার সহপাঠীগণ আমার বেশ তারিফই করিল বলা যায়। অস্বীকার করি না আমি কিঞ্চিত গর্বই বোধ করিয়াছিলাম। তাহার পরে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম সে আমাকে দিয়া কি কার্য সম্পাদন করে। অবশেষে সেই শুভদিন আসিল। সেই যুবক আমাকে পরিধান করিয়া বাবুটি সাজিয়া ছাত্রাবাস হইতে বাহির হইল। বাহির হইবার সময় সে তাহার সহপাঠীগণকে শুধাইল “অফিসে যাইতেছি” বলিয়া। যারপরনাই বিষ্মিত হইলাম। তাহার মত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক অফিসে কি করিতে পারে তাহা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কিছুতেই কল্পনা করিতে পারিলাম না। ধারণা করিয়াছিলাম সে আমাকে তাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লইয়া গিয়া পাঠ বিষয়ে কিছু কার্য সম্পাদন করিতে চায়। তাহা তো নয়ই সে আমাকে মনুষ্যচালিত ত্রিচক্রযান যাহার বঙ্গদেশীয় নাম “রিকশা” তে চড়াইয়া যাত্রা শুরু করিল। সত্যি কথা কহিতে কি আমি যথেষ্টই অপমানিতে বোধ করিয়াছি। আমার মত একখানা অভিজাত পোষাককে বাষ্পচালিত যানে করিয়া ভ্রমণ না করিলে আমার অপমানই হয় বৈকি! যাহা বুঝিলাম রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় তাহার অফিসখানা। তাহার অফিসখানাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগ করা কিছু অফিসঘর দেখিলাম। সেইখানে প্রতি ঘরে কতিপয় ব্যক্তি কোন এক ব্যক্তিকে বিশেষ করিয়া কোন এক বিষয়ে জ্ঞান ঢালিয়া দিতে ব্যস্ত ছিল। যুবকও তেমনি এক স্থানে আসন গ্রহণ করিল। আসন গ্রহণের কিয়ৎক্ষণ পরে তাহার কাছেও তদ্রুপ এক ব্যক্তি আসিল। সে ঐ ব্যক্তিকে কাগজ কলম লইয়া জ্ঞান ঢালা আরম্ভ করিল। তাহার বিশাল সেই ভাষণ শুনিয়া সেই ব্যক্তির চোখ গোল গোল হইয়া উঠিল। এমএলএম, ডায়মন্ড, নোয়া নামক গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি শুনিয়া আমার কান ঝালাপালা হইবার উপায় হইল। আমি তৎক্ষণাৎ সেই ব্যক্তির চেহারা নোয়া নামক গাড়ির স্বপ্নে উজ্জ্বল হইয়া যাইতে দেখিলাম। নিজেরই আফসোস হইতে লাগিল, আহা আমিও যদি মানবজাতির সদস্য হইতাম তবে আমিও এইরুপ নোয়া গাড়ির মালিক হইতে পারিতাম। বাস্তবে তাহা আর সম্ভবপর নহে। ভাষণ শেষ হইবার পড়ে সেই ব্যক্তি শিঘ্রই অর্থ লইয়া আসিবে এই আশা দিয়া বিদায় হইল। বিদায় হইবার পরে যুবকটি তাহার সহকর্মীগণের সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত হইল। সে যাহা বলিল তাহা শুনিয়া আমি আমার বিষ্ময় চাপিয়া রাখিতে পারিলাম না। সে যাহা কহিল তাহার মর্মার্থ হইল এই ব্যক্তির মুরগী হইবার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। এইরূপ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি কিরূপে মুরগী হইতে পারে তাহা আমার কিছুতেই বোধগম্য হইল না। কথোপকথন শেষ হইবার পরে সে ছাত্রাবাসের পথে রওয়ানা করিল। ছাত্রাবাসে পৌছাইয়া সে তাহার ল্যাপটপ বাহির করিয়া চলচ্চিত্র দেখিতে বসিল। তাহাকে কি কারণে কহিতে পারি না চিন্তিত লাগিতেছিল। ঘরের সকলে বাহির হইয়া যাইতে সে ঘরে ছোক ছোক করিতে লাগিল। অবশেষে কিছু একখানা দেখিয়া তাহার চেহারাখানা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। ভালমতন দৃষ্টিপাত করিয়া দেখি তাহার হাতে তাহার কোন এক সহপাঠীর মুঠোফোনখানা। লজ্জায় আমার মাথা কাটিবার উপক্রম হইল, অবশেষে আমি কিনা কোন এক চোরের সম্পত্তি? দুঃখে অপমানে আত্মহত্যা করিবার সাধ হইল। কিন্তু হায়, তাহা তো আমার জন্য সম্ভবপর নহে! হঠাৎ করিয়াই তাহার কোন এক সহপাঠী ঘরে প্রবেশ করিল এবং যুবক তাহার হাতে ধৃত হইল। কিছু সময় এর মধ্যই তাহার সকল সহপাঠী হাজির হইল। সহপাঠীগণের প্রশ্নের উত্তরে সে যাহা কহিল তাহার মর্মার্থ এই যে ল্যাপটপখানা সে বহু ধারদেনা করিয়া কিনিয়াছিল পরিচিত ব্যক্তিগণকে মুরগী বানাইতে সুবিধা হইবে এই ভাবিয়া। সেই ধারদেনা শোধ করিবার নিমিত্ত সে এই কার্য করিয়াছে। সহপাঠীগণ প্রশ্ন করিল তাহার অফিস হইতে আয় কিরূপ? উত্তের সে যাহা জানাইল তাহা আরো বিষ্ময়কর। তাহার অফিস হইতে আয় তো হয়ই না বরঞ্চ সে যে অর্থ দিয়া সদস্য হইয়াছিল সে অর্থও সে উসুল করিতে পারে নাই। পরিচিত আত্মীয়-স্বজনদিগকে মুরগী বানাইবার একান্ত বাসনায় সে দীর্ঘদিন ঘুরিয়াছে। কিন্তু তাহাতে আশানুরূপ ফল তো হয় নাই বরঞ্চ তাহারা তাহাকে এড়াইয়া চলিত। তাই অর্থ যোগাড় করিবার একান্ত বাসনায় সে অবশেষে চৌর্যবৃত্তির পথ ধরিয়াছে। তাহার বক্তব্য শুনিয়া তাহার সহপাঠীগণের মাঝে কোনরূপ সহানুভূতি তো দেখিলামই না বরঞ্চ তাহারা তাহাকে ধিক্কার দিয়া ঘর হইতে বমাল বাহির করিয়া দিল। পরিতাপের বিষয় এই যে দাবড়ানির আতিশায্যে যুবক আমাকে ভুল করিয়া ফেলিয়া রাখিয়া গেল। আর এমনি করিয়া আমার অভিজাত ব্যক্তির গলায় ঝুলিবার স্বপ্নও অপূর্ণ রহিল ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১০ বিকাল ৫:৫৯