যথারীতি বুয়েটে চান্স পাই নাই। পাওয়ার কথাও ছিলনা। একেবারে ভর্তি পরীক্ষার সময় ম্যালেরিয়া এবং টাইফয়েড একসাথে হওয়ার পরও কেউ যদি চান্স পাওয়ার আশা করে তার মানসিক সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন উঠা উচিত। এই চিন্তা করে শান্তি পেলাম যে এমনিতেই তো চান্স পেতাম না, অসুস্থ হয়ে ভালোই হল, একটা অজুহাত পাওয়া গেল। চান্স পাওয়ার পর খুলনা বেড়াতে যাব এই চিন্তা করে কুয়েটের ফর্ম কিনেছিলাম। দেখা গেলো কুয়েটে চান্স না পেলে আর এই বছর কোথাও ভর্তিই হতে পারব না। কুয়েটে যখন পরীক্ষা দেই তখনো আমি পুরোপুরি সুস্থ না। ম্যালেরিয়ার ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তখনো ভাত দেখলেই বমি আসে। যাই হোক, পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট দেখে আমি অবাক!!! অপেক্ষমান তালিকায় ৬২৫!!! আরো অবাক হলাম যখন মেকানিক্যাল এ হয়ে গেলো!!! খুশিতে পাগল হয়ে যাবার অবস্থা!!! আশেপাশের জ্ঞানী ব্যাক্তিরা বুঝানো শুরু করলেন যে যাও পড়ে এসো, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, তুমি ভালো (!!!) ছাত্র গেলেই ভালো রেজাল্ট হেন তেন... তো আমিও পটে গেলাম। আমারও মনে হতে লাগল ভালো রেজাল্ট করা তেমন কোনো ব্যাপার না! আতেঁল আতেঁল একটা ভাব নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রথমেই ধাক্কা খেলাম পানি খেতে গিয়ে। মনে হয়েছিল কেউ ফাজলামি করে লবণ মিশিয়ে দিলো নাকি? পরে জানলাম না, এখানকার পানিই এইরকম। নটর ডেমের ছাত্র ছিলাম, ডিসিপ্লিন বা নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে বোধ করি নটর ডেমিয়ানদের বেশি অভিজ্ঞ কেউ নেই। এখানকার নিয়মানুবর্তিতার ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি মনে হতে লাগল। কেমিস্ট্রি সেশনাল কাজ শেষ করার পরও বের হওয়া যেত না। সময় শেষ ৫টায়, ৫টায় ই ছাড়া হবে!!! ইত্যাদি ইত্যাদি বহু ভুজুং ভাজুং। যধারীতি হলে সিট পেলাম না, থাকতে হবে মেসে। ভর্তি হওয়ার দিন মেস ঠিক করে গেলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম সেই মেস ছিলো কুয়েটের বিখ্যাত ডাক্তারের মেস। ক্লাস শুরু হওয়ার পর প্রথমেই হাস্যকর লাগল স্যারদের কথা বার্তা। প্রথম দিকে তাঁরা বুঝানোর চেষ্টা করলেন কুয়েট কি কি কারণে বুয়েট হইতে ভালো!!! সেটা এক দিয়ে ঠিক ছিলো, কেননা যারা বুয়েটে চান্স পায় নি, তাদের সান্তনা দেয়ার জন্যেই তারা এটা করতেন। তবু আমার কাছে ভালো লাগেনি। কিন্তু আমার কলেজের সামনে পিছনের চার বেঞ্চের আমিই একমাত্র ভাগ্যবান যে বুয়েটে চান্স পায়নি! বলতে গেলে বন্ধু বান্ধবের সবাই বুয়েটে পড়ে, আমি খুব ভালোমতো জানি বুয়েট কি জিনিস। একদিন এক জুনিয়র শিক্ষকের সাথে লেগেই গেলো। তিনি রুয়েট থেকে পাস করে সদ্য কুয়েটে যোগ দিয়েছেন। সেকেন্ড ছিলেন তাঁর ডিপার্টমেন্টে। একদিন কথায় কথায় বলছিলেন যে একবার এক কোম্পানীতে তিনজন নেয়ার কথা ছিলো। সেখানে বুয়েট, কুয়েট আর রুয়েট থেকে একজন করে চাকরী পেয়েছিলো, যাদের একজন ছিলেন তিনি। তো তাঁর বক্তব্য ছিলো বুয়েটের ছেলেরা যদি এতোই ভালো হবে, তবে তো তিনজনই বুয়েটের চাকরী পাওয়ার কথা। কিছু না ভেবেই বলে ফেলেছিলাম স্যার, বুয়েটের যে ছাত্র সেকেন্ড হয়েছে, সে এতোদিনে দেশের বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে চলে গেছে। মনে হয় না সেই ছাত্র কোথাও চাকরীর জন্য আবেদন করবে। সেই দিন থেকে সেই স্যার আর আমাকে দেখতেই পারেন না। দিন কয়েক ভালোই গেলো, এরপরই শুরু হলো গা জ্বালা করা। কুয়েট খুলনা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে। আড্ডা দেওয়ার কোনো জায়গা নাই। যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। বোর হতে হতে আর বোর হতে পারি না এমন অবস্থা। পুরো ক্যাম্পাসে কোনো বন্ধু নেই, খুলনার যেসবদবন্ধু ছিলো তারা পর্যন্ত বুয়েটে চান্স পেয়ে ঢাকা চলে গিয়েছে। আর আমি ঢাকা থেকে এই খুলনায়। আস্তে আস্তে কুয়েটের সবকিছুই অসহ্য লাগা শুরু হলো। ক্লাস করা কমিয়ে দিলাম, ধান্ধা করা শুরু করলাম কিভাবে এখান থেকে বের হওয়া যায়। সেইসময় দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত কম্পিউটার সেন্টারে নেট ব্রাউজ করে। যে টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম তার মাঝে মনে হয় কেবল এই নেটের টাকাই উসুল করেছিলাম। বন্ধু বান্ধবের সাথে আলোচনা শুরু করলাম যে পড়বই না কুয়েটে। ২০০৬ সালে মেডিকেল ভর্তি কেলেংকারীর কথা বোধ করি সবাই জানেন। মেডিকেল পরিক্ষার্থী ব্যর্থ মনোরথ বন্ধুর সংখ্যা নেহাত কম ছিলনা, তাই বন্ধুদের উৎসাহের কমতি হয় নি। যথারীতি বাসায় বিদ্রোহ ঘোষনা করলাম, পড়ব না আমি কুয়েটে। আমি দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিবো। প্রথমে ব্যাপারটাকে হালকা ধরে নিয়ে বাসা থেকে পাত্তাই দেয় নি। যখন নিয়মিত ঘ্যান ঘ্যান করা শুরু করলাম, সিরিয়াসলি নিতেই হলো। তারপরও খুব একটা গা করার লক্ষণ দেখলাম না। বুঝলাম এভাবে কাজ হবে না। এইচএসসি পরীক্ষার আগে আগে ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে চলে গেলাম বাসায়... তারপর সে এক অন্য গল্প... সেটা আর একদিন করা যাবে...
**এটা অনেকটা রোজনামচা লেখার মতো। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন। কুয়েট সম্পর্কে আমার চিন্তা ভাবনা আমার ব্যক্তিগত। কেউ যদি মনে করে থাকেন এখানে কুয়েটকে ছোট করা হয়েছে, সানন্দে মতামত এবং মাইনাস দিয়ে যাবেন।
খেরোখাতা : ২ : সেকেন্ড টাইম!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৮