somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ গল্পঃ হ্যারিসন বার্জেরন (কার্ট ভনেগাৎ)

০১ লা আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০৮১ সালের কথা। অবশেষে মানুষেরা সম-অধিকারের ব্যাপারটা শিখে নিয়েছে ঠিকঠাক। কেবল ঈশ্বরের চোখে কিংবা আইনের চোখে নয়, এই সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। কারো চেহারা একটু 'বেশি' ভাল ছিল না, কারো শক্তি 'বেশি' ছিল না; কিংবা দৌড়ের গতি অন্যদের চেয়ে 'বেশি' দ্রুত ছিল না। সবাই সমান। কোন কমবেশি, কোন বৈষম্য নেই। এই অনন্য সমতার খুঁটি হিসেবে কাজ করেছিল সংবিধানের ২১১, ২১২ আর ২১৩ নম্বর বিধি, এবং বিধিটিকে সাধারণ জীবনে প্রয়োগ করার জন্য ইউনাইটেড স্টেটস হ্যান্ডিক্যাপার জেনারেলের অধীনে দিনরাত কাজ করা এজেন্টদের অন্তহীন একাগ্রতা।

অবশ্য দুই একটা বিষয় তখনো ঠিক সন্তোষজনক ছিল না। এপ্রিল মাসের কথাই ধরা যাক, মানুষ এই বিচ্ছিরি মাসটায় 'এখনো কেন বসন্ত আসে না' এই চিন্তায় খেপে থাকত। আর এই বিচ্ছিরি মাসেই, জর্জ এবং হেজেল বার্জেরনের চোদ্দ বছরের ছেলে, হ্যারিসনকে এজেন্টরা ধরে নিয়ে গেল।

ব্যাপারটা দুঃখের সেটা ঠিক (হাজার হলেও ছেলে!) , কিন্তু জর্জ আর হেজেল এই বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামাল না। হেজেলের মাথায় গড়পড়তা বুদ্ধি, তাঁর মানে কোন একটা বিষয়ে সে সংক্ষিপ্ত, সর্বোচ্চ কয়েক সেকেন্ডের জন্য চিন্তা করতে পারত। আর জর্জের বুদ্ধি সাধারণের চেয়ে একটু বেশি হওয়ায়, তার কানে ছোট্ট একটা হ্যান্ডিক্যাপ রেডিও গুঁজে রাখতে হত। রেডিওটা সবসময় পরে থাকা বাধ্যতামূলক। জিনিসটা একটা সরকারি ট্রান্সমিটারের সাথে টিউন করা, প্রতি বিশ তিরিশ সেকেন্ড পরপর তাতে বেজে উঠত কোন না কোন তীক্ষ্ণ কর্ণবিদারী শব্দ; যাতে জর্জের মতো মানুষেরা তাদের মস্তিস্ককে অন্যায্য চিন্তাভাবনার কাজে লাগিয়ে বাড়তি সুবিধা নিতে না পারে।

জর্জ আর হেজেল টিভি দেখছে। হেজেলের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির ফোঁটা, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মনে নেই ঠিক কি কারণে কাঁদতে শুরু করেছিল ও।

টিভির স্ক্রিনে দেখাচ্ছে ব্যালে-নৃত্য।

জর্জের মাথার ভেতরে ভারি একটা শব্দ বজজবজজ করে ওঠে। গৃহস্থের সাড়া পেলে লিকলিকে চোর যেমন করে পালায়, মাথার ভেতরে শব্দভীতু ভাবনাগুলো এই ধ্বনি-চিকিৎসায় অতিষ্ঠ হয়ে তেমনি ভেগে গেল চুপচাপ।

-'ভালই তো নাচে মেয়েগুলো, সুন্দর লাগে, তাই না?', হেজেল বলে।
বিভ্রান্ত জর্জ নড়েচড়ে ওঠে, 'হাহ?'
-'ব্যালেরিনাদের নাচটা, সুন্দর না?'

'হু,' জর্জ সম্মতি দেয়। স্ক্রিনে তাকিয়ে একটু ভাবার চেষ্টা করে ব্যালেরিনাদের নিয়ে। ওদের নাচ আসলে খুব একটা ভাল ছিল না, অন্য সবাই চেষ্টা করলে যতটা ভাল নাচতে পারত তেমনি; সাধারণই বলা চলে। তাদের ঘাড়ে-গলায় ওজনদার ব্যাগ ঝোলানো, যাতে ভুল করে হলেও নাচের অসাধারণ কোন ভঙ্গি দেখাতে না পারে; মুখে মুখোশ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে এদের কারো সুন্দর চেহারা দেখে আরেকজনের মনে হীনমন্যতা সৃষ্টি না হয়। এসব জিনিস চাপিয়ে দিয়ে নর্তকীদের হয়তো ভারাক্রান্ত করা উচিত না, এরকম একটা অস্পষ্ট চিন্তা ওর করোটিতে রূপ নিতে থাকে; কিন্তু কানের রেডিওতে আরেকটা কর্কশ শব্দ আবার বিক্ষিপ্ত করে দেয় সবকিছু।

জর্জ সামান্য ছিটকে ওঠে, ওর সাথে সাথে স্ক্রিনে আটটা মেয়ের মাঝে দুজন ব্যালেরিনা-ও চমকে যায়, নাচের তাল ভুলে দাঁড়িয়ে পড়ে।

হেজেল ওকে নিঃশঙ্কচিত্তে দেখে। যেহেতু তাঁর নিজের কোন হ্যান্ডিক্যাপ যন্ত্রপাতি পরা নেই, তাই সে জর্জকে জিজ্ঞেস করে সাম্প্রতিক শব্দটা শুনতে কেমন।

'মনে হচ্ছিল কেউ একটা দুধের খালি বোতলকে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে,' ও উত্তরে বলে।
-'আমার তো জিনিসটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে, জানো? কত বিচিত্র শব্দ শোনা যায়', হেজেলের কণ্ঠে ঈর্ষা, 'এজেন্টরা এত সব অদ্ভুত শব্দ বানায় কি করে?'
'আমম...', কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না জর্জ।
-'আমি হ্যান্ডিক্যাপার জেনারেল হলে কি করতাম, জানো?' হেজেল উজ্জ্বল চোখে বলে। সত্যি বলতে হেজেলের চেহারার সাথে হ্যান্ডিক্যাপার জেনারেল, জনাবা ডায়ানা মুন গ্ল্যাম্পারস-এর অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল। 'আমি জেনারেল হলে প্রতি রোববারে ঘণ্টা বাজাতে বলতাম-মিষ্টি ঘণ্টার শব্দ। ধর্মকে শ্রদ্ধা জানানোও হয়ে যেত একসাথে।'
'ঘণ্টার শব্দ হলে তো আমি ভাবতে পারতাম', জর্জ বলে।
-'ধরো অনেক জোরে জোরে বাজাতাম, তাহলে? হোতো না?' হেজেল আপনমনে বিড়বিড় করে, 'মনে হয় অনেক ভাল একজন জেনারেল হতাম আমি।'
'হলে অন্যদের মতই হতে! আমরা সবাই সমান, মনে আছে?' জর্জ বলে।
-'আছে তো! আমার চেয়ে ভাল কে জানে এই কথা?' হেজেল হাসে।

'তা ঠিক', ও স্বীকার করে। ক্ষণিকের জন্য ওর আবছা আবছাভাবে মনে হয় নিজের অস্বাভাবিক ছেলের কথা, এখন যাকে আটকে রাখা হচ্ছে জেলে। কিন্তু কানের ভেতরে একুশ দফা কামান দাগার বিকট শব্দ ভুলিয়ে দেয় সব দুশ্চিন্তা।

'ব্বাস', হেজেল ওর দিকে তাকিয়ে বলে, 'এবারে খুব লেগেছে, না?'

এবারে এতোটাই জোরে লেগেছে যে জর্জের মুখ পুরো সাদা হয়ে যায়, সারা শরীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপছে। আটজন ব্যালেরিনার দুজন হাঁটু ভেঙে পড়ে গেছে স্টুডিয়োর মেঝেতে, দুই হাতে মাথা চেপে গোঙাচ্ছে।

'খুব দুর্বল দেখাচ্ছে তোমায়,' হেজেল বলে, 'সোফায় হাত পা ছড়িয়ে শোও তো লক্ষ্মীটি, তোমার হ্যান্ডিক্যাপ ব্যাগটার ওজন বালিশের ওপরে দাও।' জর্জের গলায় বাঁধা সাতচল্লিশ পাউন্ড ওজনের ক্যানভাসের ব্যাগটার কথা বলছিল ও, যার ভেতরটা অসংখ্য তামার ছোট ছোট বলে ভরতি, 'ওজনটা কমলে ভাল লাগবে তোমার। ক্ষণিকের জন্য আমরা দুজন সমান না হলে কিছু যায় আসে না।'

জর্জ হাতে ব্যাগটার ওজন অনুভব করে। 'থাকগে', ও বলে, 'এখন আর ভারি লাগে না জিনিসটা। শরীরের অংশই হয়ে গেছে বলতে গেলে।'

'কদিন ধরে তোমাকে খুব ক্লান্ত, দুর্বল লাগছে,' হেজেল সহানুভূতিপূর্ণ গলায় বলে, 'যদি কোন একটা ব্যবস্থা করা যেত, যদি শুধু ব্যাগের নিচে ছোট্ট একটা ফুটো করে তামার কয়েকটা বল সরাতে পারতাম! বেশি না, এই দুই-চারটা।'

'একটা বল সরালে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড, আর দুই হাজার ডলার জরিমানা,' জর্জ বলে, 'এত ঝামেলায় কে যাবে, শুনি?'

'কাজ থেকে বাসায় আসার পরে যদি সরাও? ওজন কমিয়ে তুমি তো কারো সাথে পাল্লা দিতে যাচ্ছ না, স্রেফ বসে বিশ্রাম নেবে।'

'শোন, আমি যদি এরকম চুরি করে সুবিধা নেওয়া শুরু করি, দেখাদেখি বাকিরাও তাই করবে। তারপর দেখা যাবে আমরা আবার অন্ধকার যুগে ফিরে গেছি, মানুষ আবারো ইঁদুরদৌড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, মানবসভ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তোমার কি ভাল লাগবে তাতে?'
-'মোটেই না!', হেজেল বলে।
'তাহলে বোঝো। মানুষ নিয়মকানুন মেনে না চললে সমাজের কি অবস্থা হত, ভেবে দেখেছ কখনো?'

হেজেল প্রশ্নের জবাব না দিতে পেরে যদি ফের জিজ্ঞেস করত, খুব একটা লাভ হত না। কারণ জর্জের মাথায় এই মুহূর্তে চড়াসুরে কর্কশ সাইরেন বাজছে একটা।

-'হয়তো ভেঙে পড়ত সবকিছু', উত্তর দিতে পেরে হেজেলকে খুশি দেখায়।
'কি ভেঙে পড়ত?', জর্জ শূন্য দৃষ্টিতে বলে।
-'সমাজ', হেজেল অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, 'এই এখনই এইটেই জিজ্ঞেস করলে না তুমি?'
'কি জানি!'

টিভির প্রোগ্রামটা হঠাৎ থামিয়ে খবর প্রচার করা শুরু হয়, এক নার্ভাস স্যুটটাইপরা লোক স্টেজের মাঝখানে এসে একতাড়া কাগজ হাতে কিছু বলার চেষ্টা করে। প্রথমে বোঝা যাচ্ছিল না কি বলা হচ্ছে, কারণ অন্য সব খবর-পাঠকের মতো সুরেলা কণ্ঠ ঢাকবার জন্য এই লোকেরও ভোকাল হ্যান্ডিক্যাপ লাগান আছে, আর উত্তেজিত হলে ভোকাল হ্যান্ডিক্যাপ যন্ত্রটা উচ্চারণ করার ক্ষমতাই বন্ধ করে দেয়। প্রায় আধমিনিট ধরে লোকটা বলার চেষ্টা করল, 'সুধী দর্শকবৃন্দ', কিন্তু শেষমেশ কিছুই বলতে না পেরে এক ব্যালেরিনার হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে মুখ ঢেকে চলে গেল বাইরে।

'আহা, বেচারা লজ্জা পেয়েছে,' হেজেল সান্ত্বনার সুরে বলে, 'লজ্জা পাওয়ার কি আছে? ঈশ্বর ওকে যা দিয়েছেন তাই নিয়ে চেষ্টা করেছে, এটাই বড় কথা। এত সাহস দেখানোর জন্য বরং ওর বেতন বাড়িয়ে দেওয়া উচিৎ।

'সুধী দর্শকবৃন্দ,' ব্যালেরিনা কিছুটা অপ্রস্তুত কণ্ঠে কাগজ দেখে পড়তে শুরু করল। মেয়েটা নিশ্চয়ই অসাধারণ সুন্দরী, কারণ তার চেহারা ঢেকে রাখা মুখোশটা ভীষণ কদাকার দেখতে। তার হ্যান্ডিক্যাপ ব্যাগটাও অস্বাভাবিক বড়, ভারি; সাধারণতঃ দু'শ পাউন্ড ওজনের মানুষেরা এরকম ব্যাগ নিয়ে ঘোরে। এর মানে মেয়েটা নিশ্চয়ই সবগুলো নর্তকীর মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালি এবং সবচেয়ে সুন্দরী।

ব্যালে-নর্তকীর গলার স্বর উষ্ণ, মিষ্টি, অস্বাভাবিক সুরেলা একটা টান আছে; ভদ্রমহিলাদের মত স্বাভাবিক নয় মোটেই। তাই সে দর্শকদের কাছে নিজের কণ্ঠের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয়, 'মাফ করবেন,' তারপর একঘেয়ে ঘড়ঘড়ে প্রাণহীন গলায় কাগজের বাকি অংশ পড়তে থাকে।

'হ্যারিসন বার্জেরন নামক জনৈক চোদ্দ বছর বয়স্ক কিশোর', মেয়েটা প্রায় কিচকিচ করে বলতে থাকে, 'আজ সকালে কারাগার থেকে পলায়ন করে। সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার সন্দেহে তাকে আটক করা হয়েছিল। সে মারাত্মকভাবে প্রতিভাবান, একজন প্রশিক্ষিত ক্রীড়াবিদ, এবং সাংঘাতিক বিপদজনক ব্যক্তি। পালানোর সময় তার শরীরে একাধিক হ্যান্ডিক্যাপ পরানো ছিল। এই ভয়ানক অপরাধীকে ধরিয়ে দেবার জন্য রাষ্ট্রের সকল সুনাগরিকদের বিনীত অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।'

বিভিন্ন কোণ থেকে তোলা হ্যারিসনের একাধিক ছবি স্ক্রিনে দেখানো হয় কয়েকবার। তারপর ওর দাঁড়ানো অবস্থায় তোলা একটা ছবিকে ফুট-ইঞ্চির হিসাবে দেখান হয়। ছেলেটা পুরো সাত ফুট লম্বা।

হ্যারিসনের ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছিল হ্যালোউইনের দিনে লোহাদানো সেজে বেড়িয়েছে। রাষ্ট্রের সবচে ভারি হ্যান্ডিক্যাপগুলোতে তার শরীর ঢাকা। সমতার স্বার্থে বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত তার হ্যান্ডিক্যাপগুলোকে আরও ভারি, আরও উন্নত করতে হয়েছে। ছোট্ট রেডিওর বদলে তার কান ঢেকে রেখেছে একজোড়া দানবাকার ইয়ারফোন, উজ্জ্বল চোখ দুটোকে ঘোলাটে করে রেখেছে একজোড়া পুরু কাঁচের লেন্স। এই লেন্স তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দিয়ে অন্ধপ্রায় করে রাখে, আর সবসময় তীব্র মাইগ্রেনের ব্যথা জোগান দেয়।

তার সারা শরীর আঁকড়ে ঝুলছে বিশাল বিশাল ভারি লোহার খণ্ড। সাধারণতঃ শক্তিশালি মানুষদের জন্য যে হ্যান্ডিক্যাপ ব্যাগ দেওয়া হয়, সেটা মোটামুটি দেহের সাথে মানিয়ে যায়, কেতাদুরস্ত লাগে দেখতে। কিন্তু হ্যারিসনকে দেখে মনে হচ্ছে হেঁটে-চলে বেড়ানো জীবন্ত এক ভাঙারি দোকান। দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন চোদ্দ বছর বয়েসি এই ছেলেটা শরীরে তিনশ পাউন্ডের হ্যান্ডিক্যাপ ওজন নিয়ে ঘোরে।

হ্যারিসন দেখতে ভাল ছিল বলে, এজেন্টরা তার নাকে লাল রাবারের বিতিকিচ্ছিরি একটা বল লাগিয়ে দিয়েছিল, চেঁছে দিয়েছিল পুরুষ্টু ভুরূদুটো। দশে পড়ার আগেই তার সমান ধবধবে শাদা দাঁত ঢাকা থাকত কালো কুচকুচে দুর্গন্ধময় আবরণ দিয়ে।

'প্রিয় নাগরিকগণ, যদি আপনারা এই ঘৃণ্য শ্রেণীবাদি অপরাধীকে দেখতে পান, তবে কোনোক্রমে তার সাথে যুক্তিতর্ক করতে যাবেন না। আমি আবারো বলছি, যদি আপনারা একে দেখতে পান, সরাসরি এজেন্টদের খবর দেবেন, কোনোমতেই যুক্তিতর্ক করতে যাবেন না।'

মেয়েটার পেছন থেকে হঠাৎ কব্জা থেকে উপড়ে ফেলা দরজার মড়মড় আর্তনাদ ভেসে আসে।

টিভির স্ক্রিন থেকে উড়ে আসা হুড়োহুড়ি, চিৎকার, ধাক্কাধাক্কির উন্মাতাল শব্দে হেজেল আর জর্জের ঘরটা ভরে যায়। হ্যারিসনের ছবিটা ঝাপসা হয়ে কাঁপতে থাকে, যেন ভূমিকম্পের তালে তালে নেচে যাচ্ছে।

জর্জ মুহূর্তের মাঝে ভূমিকম্পের উৎসটা চিনে ফেলে। এর আগে এই একই তালে কতবার তার বাসাটি নড়ে উঠেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। 'ইয়াল্লা,' ওর কণ্ঠে বিস্মিত উপলব্ধির ছাপ, 'ওইতো হ্যারিস--!'

কথা শেষ করার আগেই মাথার ভেতরে দুটো মোটরগাড়ির সংঘর্ষের ধাতব কিরকির শব্দে চোখ বন্ধ করে ফেলতে বাধ্য হয় জর্জ। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার যখন ও চোখ খোলে, স্ক্রিন থেকে হ্যারিসনের ছবিটা উধাও হয়ে গেছে। সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে একশভাগ জীবন্ত, রাগান্বিত আস্ত হ্যারিসনকে।

সার্কাসের ক্লাউনের মতন চেহারা নিয়ে, সারা শরীরে লোহার ধাতব শব্দ নিয়ে, স্টুডিয়োর ঠিক মাঝখানটায় ঋজু দাঁড়িয়ে আছে কিশোর অপরাধী। তখনো তার হাতে ধরা উপড়ানো দরজার নব। সবাই, ব্যালেরিনা-মিউজিশিয়ান-ক্যামেরাম্যান, সবাই হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে; জানে, মৃত্যু সুনিশ্চিত।

'আমি তোমাদের সম্রাট!' হ্যারিসন অস্বাভাবিক ভারি গলায় হাঁক ছাড়ে। 'মহাপরাক্রমশালি সম্রাট, বুঝলে! আমি যা বলব তাই করতে হবে সব্বাইকে।' কথার গুরুত্ব বোঝাতেই হয়তো, সে মেঝেতে পদাঘাত করে একবার, তাতেই পুরো স্টুডিয়ো কেঁপে ওঠে।

'দেখ, ওরা আমাকে পঙ্গু করে, হ্যান্ডিক্যাপ পরিয়ে প্রতিবন্ধী বানিয়ে রেখেছে,' সে নিজেকে দেখিয়ে গর্জন করে ওঠে, 'তারপরেও কেউ ঠেকাতে পারে নি, কিচ্ছুটি করতে পারে নি। এখন ওরা চেয়ে দেখবে আমি কি করতে পারি।' বলে হ্যারিসন শরীরের লোহার বাঁধন, যা কিনা পাঁচ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত চাপ স্বচ্ছন্দে নিতে পারে, সেটাকে ভেজা টিস্যু পেপারের মত অবলীলায় ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে।

ও শরীর ঝাড়া দেয়, গায়ে ঝালাই করা লোহার খণ্ডগুলো টুংটাং করে খসে পড়ে মেঝেতে।

মাথায় পরানো শক্ত হারনেসে আঙুল ডুবিয়ে সামান্য চাপ দিতেই ওটা শোলার মত মটমটিয়ে ভেঙে যায়। ইয়ারফোন আর পুরু চশমা ছুঁড়ে ফেলে দেয়ালে, শতখণ্ড হয়ে যায় সেগুলো। নাকের লাল বলটা খুলে ফেলে দেয় মেঝেতে।

ক্রমে ক্রমে এরকম সবগুলো হ্যান্ডিক্যাপ সরিয়ে নিলে হ্যারিসনের আসল মুখটা উন্মোচিত হয়। এরকম একটা অভিজাত, রাজকীয় চেহারা দেখলে বজ্রদেব থর-ও হয়তো সম্ভ্রমে মাথা নুইয়ে ফেলতেন।

'আমি এখন আমার সম্রাজ্ঞীকে বেছে নেব', মাথা নিচু করে কাঁপতে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে সে বলে, 'আছ কেউ, এমন কোন মেয়ে, যার রুখে দাঁড়ানোর সাহস আছে? বিশ্বটাকে পায়ে মাড়িয়ে সম্রাটের পাশে বসার, সিংহাসনে আসীন হবার মত হিম্মত আছে? এমন সাহসি আছে কেউ এখানে? থাকলে দাঁড়াও, উঠে দাঁড়াও।'

একটা দীর্ঘ নিশ্চুপ মুহূর্ত কাটল। তারপর দৃঢ় চোয়ালে, আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে একজন ব্যালেরিনা নাচের অপরূপ ভঙ্গিমায় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। হ্যারিসন হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে তার হ্যান্ডিক্যাপগুলো একে একে সরিয়ে ফেলতে শুরু করে। সব শেষে সরায় মুখ ঢেকে রাখা কদাকার মুখোশটা। মেয়েটার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে।

খোদার কসম, রম্ভা-উর্বশী ঈর্ষায় বিষ খেয়ে মরত এমন রূপের ছটা দেখলে।

'এসো,' হ্যারিসন নরম গলায় তার হাত ধরে বলে, 'চলো এদের দেখিয়ে দেই আসল নাচ কাকে বলে।' তারপর বাকি লোকের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দেয়, 'বাজাও!'

মিউজিশিয়ানরা হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলি করে তাদের চেয়ারে ফিরে যায়। হ্যারিসন তাদের হ্যান্ডিক্যাপ খুলে দেয় একে একে। 'ভালমত গান বাজাবে,' ওদেরকে সে বলে, 'তাহলে তোমাদেরকে আমার রাজ্যের মন্ত্রী-উজির-জমিদার বানিয়ে দেব।'

বাজনা শুরু হয়। প্রথমে সুরটা বিদঘুটে বিস্বাদ, মেকি লাগছিল শুনতে। কিন্তু হ্যারিসন দুই সঙ্গীতজ্ঞকে হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় তুলে নেয়, তারপর ওদেরকে লাঠির মতো ঝাঁকিয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে চিৎকার করে গান গেয়ে বুঝিয়ে দেয় যে সুরটা এমন হওয়া চাই। এরপর আবার পুতুলের মত বসিয়ে দেয় চেয়ারে।

এবারের বাজনাটা শুরু হলে আগের চেয়ে অনেক মিষ্টি মনে হয়।

হ্যারিসন আর ব্যালেরিনা চুপ করে অতি মনোযোগের সাথে বাজনা শোনে কিছুক্ষণ, যেন নিজেদের হৃদস্পন্দন বাজনার তালে তালে মিলিয়ে নিচ্ছে।

তারপর দুজনে একই সাথে স্বতঃস্ফূর্ত চপল পায়ে নড়তে শুরু করে। হ্যারিসন সম্রাজ্ঞীর কোমরে ওর বড় বড় হাত রেখে পুরো ওজনটা নিজে নিয়ে নেয়। দুজনে এমনভাবে মিশে যায় যেন তাদের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই।

তারপর, তারপর যেন উদ্যম, উচ্ছ্বাস, উন্মাদনার একটা প্রাকৃতিক বিস্ফোরণ ঘটল দুজনের মাঝে। বাতাসে লাফিয়ে উঠে দুই বিদ্রোহী আনন্দনৃত্য করতে শুরু করল। এরা শুধু যে রাষ্ট্রের সব নিয়ম-কানুন ত্যাগ করে মুক্ত হয়েছে তাই নয়, এমনকি বিশ্বজগতেরও সব বিধিবিধানকে যেন তুচ্ছ করে নাচে মেতেছে। হেঁটে, ঘুরে, চরকি কেটে, পাক খেয়ে, লাফিয়ে, বাতাসে ভেসে বেরিয়ে ওরা নাচল। সব বিধি-নিষেধ, বাধা-বিপত্তি ভুলে গিয়ে অদম্য এক মুক্তির উৎসাহে ওরা নাচল।

ওরা নাচল দুটো চন্দ্রগ্রস্ত ঘাই-হরিণীর মতন অপার্থিব উল্লাসে।

স্টুডিয়োর সিলিংটা প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু। নাচতে নাচতে একেকটা লাফে ওরা আরও উঁচুতে উঠে যাচ্ছিল, একসময় মনে হল যেন সিলিংটা ছুঁয়ে ফেলবে দুজনে। তাই হোলো। সর্বশেষ লাফটায় ওরা ছুঁয়ে ফেলল সিলিংটাকে, তারপর সিলিং থেকে এক ইঞ্চি নিচে, যেন নিখাদ প্রেম আর ইচ্ছেশক্তিতে বলীয়ান হয়ে, স্থির ভেসে রইল বাতাসে। হ্যারিসন আর ব্যালেরিনা একে অপরকে আঁকড়ে ধরল, তারপর হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে লম্বা একটা সময় ধরে চুমু খেল। মনে হচ্ছিল ওদের এই অনন্য চুম্বন যেন থামিয়ে দিয়েছে খোদ সময়কেই।

ঠিক এই আবেগঘন মুহূর্তে রাষ্ট্রের হ্যান্ডিক্যাপার জেনারেল, জনাবা ডায়ানা মুন গ্ল্যাম্পারস হাতে একটা দোনলা দশগজি শটগান নিয়ে স্টুডিয়োর ভেতরে ঢুকলেন। তার নিষ্কম্প হাতে শটগান কেঁপে উঠল দুবার, এবং 'সম্রাট-সম্রাজ্ঞী' দুজনেরই মৃত্যু ঘটল তিরিশ ফুট ওপর থেকে মাটিতে পড়ার অনেক আগে।

ডায়ানা মুন গ্ল্যাম্পারস শটগান আরেকবার লোড করে তাক করলেন মিউজিশিয়ানদের দিকে। তারপর ঠাণ্ডা গলায় জানিয়ে দিলেন যার যার হ্যান্ডিক্যাপ পরে নেবার জন্য তারা আর দশ সেকেন্ড সময় পাচ্ছে।

তখনি বার্জেরনদের টিভির টিউব পুড়ে যাওয়ায় স্ক্রিন কালো হয়ে গেল, ঘরে নেমে এল নিস্তব্ধ অন্ধকার।

হেজেল জর্জকে কিছু বলার জন্য ঘাড় ঘোরাল, কিন্তু জর্জ কিচেনে গেছিল তখন, বিয়ার আনতে।

হাতে বিয়ারের একটা ক্যান নিয়ে সে ফিরে আসে, হ্যান্ডিক্যাপ সিগনালে আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থামে, তারপর হেজেলের পাশে গিয়ে বসে।
'কাঁদছিলে নাকি?' স্ত্রীর চোখে পানি দেখে জিজ্ঞেস করে ও।
-'হুঁ,' হেজেল অস্পষ্ট সুরে বলে।
'কেন?'
-'টিভিতে খুব কষ্টের একটা কিছু দেখাচ্ছিল।'
'কি দেখাচ্ছিল?'
-'কি যেন একটা। পরিষ্কার মনে নেই, গুলিয়ে গেছে।'
'কষ্ট মনে রাখতে নেই।'
-'রাখি না তো।'
'এইতো, লক্ষ্মী বউ আমার!' বলে স্ত্রীকে চুমু খেতে গিয়ে জর্জ একটু কেঁপে ওঠে। ওর মাথার ভেতরে শত শত হাতুড়ির সম্মিলিত ঠকাঠক শব্দ বেজে উঠলো এই মাত্র।

-'ব্বাস, খুব লেগেছে, না?' হেজেল বলে।
'অ্যা, কি বললে? আবার বলো।'
-'বললাম,' হেজেল নরম গলায় পুনরাবৃত্তি করে, 'খুব লেগেছে, না?'
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:১১
৫০টি মন্তব্য ৫০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×