'O God! I could be bounded in a nutshell, and count myself a King of infinite space...'
Hamlet, II, 2
'But they will teach us that Eternity is the Standing still of the Present Time, a Nunc-stans (as the schools call it); which neither they, nor any else understand, no more than they would a Hic-stans for an Infinite greatness of Place.'
Leviathan, IV, 46
অগ্নিক্ষরা এক ফেব্রুয়ারি দুপুরে বিয়াট্রিয ভিটেরবো মারা গেল।
তার মৃত্যুতে বুকের ভেতরে বিষাক্ত ক্ষতের মত কিছু বিষাদ জড়ো হয়েছিল। ব্যথা কমাতে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের বিলবোর্ডগুলো দেখছিলাম। পুরনোটা বদলে ওখানে একটা নতুন বিজ্ঞাপনের উদয় ঘটেছে, কোন একটা আমেরিকান সিগারেটের রংচঙে ছবি টানানো হয়েছে। ব্যাপারটা আমাকে আহত করল, কারণ এই নতুন সিগারেটের ব্র্যান্ড চিৎকার করে বলছিল- বিয়াট্রিযকে ছাড়াই জগৎ নিজের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাবে। এই সামান্য পরিবর্তন সামনের বহু বহু অশেষ পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করছিল সদম্ভে। অবশ্য কেমন একটা অন্তঃসারশূন্য ভাবনা ঘুরছিল মাথায়, বিশ্ব পালটালেও আমি তো পালটাচ্ছি না...
আমি জানি, মাঝে মাঝে আমার খাদহীন ভালবাসার প্রকাশে ও বিরক্ত হয়েছে। আমাকে অপমান করেছে, দূরে ঠেলেও দিয়েছে। এখন অন্ততঃ 'মৃত' বিয়াট্রিযকে আমার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসতে পারি। তাতে প্রতিউত্তর না পাই, অন্ততঃ অপমানিত হবার ভয় তো থাকে না! আমার মনে আছে এপ্রিলের তিরিশে ওর জন্মদিন। এই দিনে যদি বিয়াট্রিযের বাবা আর কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি- ওর চাচাত ভাইয়ের সাথে দেখা করি, ভালো হয় না? ওদের বাসাটা গ্যারেই স্ট্রীটে। আরেকবার সেই ছোট, বিক্ষিপ্ত সাজানো ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করব। দেয়ালে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকা ওর অসংখ্য ছবির খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করব সানন্দে। বিয়াট্রিয ভিটেরবোর প্রোফাইল ছবি, একটা ছবি ঝকঝকে রঙিন। বিয়াট্রিয একটা মুখোশ পরে আছে- ১৯২১ এর কার্নিভ্যালের সময়কার ছবি। বিয়াট্রিয- গির্জার পাশে দাঁড়িয়ে আছে; বিয়াট্রিয- বিয়ের পোশাকে গির্জার মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চুমু খাচ্ছে জামাই রবার্তো আলেসান্দ্রি-কে; বিয়াট্রিয- ডিভোর্সের কিছুদিন পর টার্ফ ক্লাবের পার্টিতে; বিয়াট্রিয- কুইলমসের বীচে চাচাত ভাই আর ভাইবৌয়ের সাথে; বিয়াট্রিয- কোলে একটা বলিরেখাসমৃদ্ধ কুকুর নিয়ে (কুকুরটা ভিলেগাস হাইডো দিয়েছিল- বজ্জাত লোক); বিয়াট্রিয- হাসছে, চিবুকের ওপরে হাত রেখে,...অন্ততঃ এবারে আগের মত র্যাপিং পেপারে মুড়ে বই নিয়ে যেতে হবে না, নিজের অস্তিত্বের কথা ওকে জানান দেবার জন্য। বিয়াট্রিয, দেখো, আমি আছি! কিন্তু ও বইগুলো খুলেও দেখত না। কিভাবে জানলাম?
বইগুলোর মাঝখান থেকে সেলাই কেটে আমি আলগা করে রাখতাম, যাতে বই খুললেই পাতাগুলো পড়ে যায়। কিন্তু মাসদুয়েক পর যখন বইগুলোকে ড্রয়িংরুমের এককোণে পড়ে থাকতে দেখতাম, তখনও তারা অক্ষত থাকত, হাসত আমার দিকে চেয়ে, জিব বের করে ভেংচে দিত। যাক, সে অন্ততঃ র্যাপিং পেপারটা তো খুলত!
বিয়াট্রিয ভিটেরবো মারা গেল ১৯২৯ সালে। তখন থেকে, প্রতিবছর তিরিশে এপ্রিল আমি ওদের বাড়িতে যেতাম। ঠিক সাতটা পনেরোতে বাড়িতে ঢুকতাম, ভেতরে বসে থাকতাম প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিটের মতো। প্রতিবার আগের বছরের চেয়ে একটু পরে ঢুকতাম, আর বেরোতাম আরেকটু দেরিতে। ১৯৩৩ সালে, বাড়িতে ঢোকার পরপরই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, ফলে বিয়াট্রিযের পরিবার বাধ্য হয়েই আমাকে ডিনারের দাওয়াত দিল (স্বাভাবিকভাবেই, আমি লুফে নিলাম সুযোগটা)। ১৯৩৪ সালে, আমি বাড়িতে গেলাম একটা সান্তা ফে ক্রিম কেক নিয়ে, আর এবারও আমাকে ডিনারের জন্য থাকতে বলা হল। এভাবে অনর্থক বিষাদে ভরপুর সব অনুষ্ঠান আর মেকি দুঃখের মাখামাখির মধ্য দিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে একদিন আমি আবিষ্কার করলাম, বিয়াট্রিযের পরিবার, বিশেষ করে কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি আমাকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।
বিয়াট্রিয ছিল লম্বা, রোগা, সামান্য কুঁজো হয়ে হাঁটত; ওর হাঁটার ভঙ্গিতে একধরণের সংশয়হীন সাবলীলতা ছিল। দারুণ সতেজতা ছিল। আর কার্লোস আরজেন্টিনো হল গোলাপি-মুখো, ভীষণ মোটা, ধূসর চুলের একটা অপদার্থ। একমাত্র এর হাতটা শিল্পীদের মত (আসলে বিয়াট্রিযের মত); সুন্দর, রুচিশীল। সে কাজ করত বুয়েন্স আয়ার্সের দক্ষিণাংশে একটা ছোট্ট লাইব্রেরিতে। তাকে বাসায় খুঁজে পাওয়া যেত খুব কম, লাইব্রেরিতেই পড়ে থাকত সারাদিন। দুই পুরুষ ধরে আর্জেন্টিনায় বাস করা সত্ত্বেও, ইতালিয়ান রক্তের প্রভাব তার কথাবার্তায়, চলনবলনে স্পষ্ট ছিল। কথা বলার সময় অর্থহীন ভারি বিশেষণ ব্যবহার করতে, বা একটা কথা বলার আগে বিনা কারণে বিরতি নিতে তার মনে হয় খুব ভাল লাগত। নিজেকে একজন দারুণ সাহিত্যবোদ্ধা মনে করত গাধাটা। যেমন একবার সে পড়ল এক অখ্যাত কবি, পল ফোর্টকে নিয়ে। 'ইনি হলেন কাব্যশাস্ত্রের রাজপুত্র', দানেরি (বিনা কারণে) গলা উঁচু করে চিল্লাত, 'মানুষ তাকে যথোপযুক্ত সম্মান দেয় না, বুঝলে বোর্হেস, কিন্তু একদিন এরাই তাকে মাথায় করে নাচবে।'
১৯৪১ সালের তিরিশে এপ্রিলে, সান্তা ফে কেকের সাথে সাথে একটা আরজেন্টাইন কগনাক নিয়ে বিয়াট্রিযের বাসায় গেলাম আমি। দানেরি গ্লাসে একচুমুক গিলল, ঘোষণা করল, 'ভালো জিনিস', এবং আরও কয়েক চুমুক পরে গা এলিয়ে দিয়ে মানুষের আধুনিক জীবনের মহিমা ব্যাখ্যা করা শুরু করল।
'দেখো', সে অস্বাভাবিক উৎসাহ নিয়ে শব্দবমি করতে লাগল, 'আমাদের চারপাশে কত ভালো ভালো জিনিস আবিষ্কৃত হচ্ছে। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, ফোনোগ্রাফ, ওয়্যারলেস সেট, স্লাইড প্রজেক্টর, চলচ্চিত্র (বলে হিক! করে উঠল), ডিজিটাল ডিকশনারি, টাইমটেবিল, হ্যান্ডবুক, বুলেটিন...'
ও বারবার বলতে লাগল যে, মানুষ এতো যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছে যে, এখন সত্যিকারের ভ্রমণ করাটা হল অনর্থক খরচ। বলল, 'এই বিংশ শতাব্দিতে কোন জায়গা তুমি দেখতে চাও? তোমাকে ওইখানে যেতে হবে না। জায়গা-ই তোমার কাছে আসবে। আর ভবিষ্যতে মানুষ ভ্রমণ করবে বাড়ি থেকে না বেরিয়েই।' তার ব্যাখ্যা ভীষণ বোকা-বোকা, অবাস্তব আর ফাঁপা লাগল আমার কাছে। তাই সাথে সাথে আমি কথার স্রোত অন্যদিকে সরিয়ে দিলাম, বললাম সে এইসব 'গুরুত্বপূর্ণ' আইডিয়া লিখে রাখে না কেন। এবং সবচেয়ে বড় ভুলটা করলাম।
দানেরি বলল যে এই কাজ সে ধরেছে বহুদিন আগে থেকেই। এই আইডিয়া, এবং এইরকম আরও বহু বহু আইডিয়া সে তার কবিতায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনেক বছর ধরেই সে এই কবিতা লিখছে, একাকীত্ব এসে হানা দিয়েছে- কাজ এসে বিরক্ত করেছে- তবুও সে কবিতাটা লেখা থামায় নি। প্রথমে দানেরি নিজের 'কল্পনার দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে', তারপর 'কলম তুলে নিয়ে কাগজের ক্যানভাসে ছবি এঁকেছে' (গাধা কোথাকার)। কবিতার নাম ছিল 'পৃথ্বী', এবং তাতে পৃথিবীর রূপক-নির্ভর বর্ণনার কোন অভাব ছিল না।
ভদ্রতার খাতিরে আমি তাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সে কবিতার কয়েকটা লাইন পড়ে শোনাতে চায় কিনা। দানেরি তার ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একগাদা কাগজ বের করল, তারপর কণ্ঠে পরিতৃপ্তি নিয়ে পড়তে লাগল,
সেই বৃদ্ধ গ্রিকের মতই, আমার চোখেতে লেগে আছে
তোমাদের নগরী
তোমাদের খ্যাতি
তোমাদের কাজ, সেই দিন, সেই রাত বিবর্ণ হয়ে
অম্বরে অটুট;
কোন নাম, কারো বাস্তবতা না পাল্টে-
আমি নিঃসঙ্গ প্রাচীন সমুদ্রযাত্রায় নামি...অতোঁয়া দে
মাকামব্রেঁ।
'যেদিক থেকেই দেখো না কেন, এই প্রথম স্তবকটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং', দানেরি নিজের মতামত দিল, 'সাধারণ পাবলিকের কথা বাদই দিলাম, যেকোনো সাহিত্যের প্রফেসর কিংবা সমালোচকও মুগ্ধ হয়ে যাবে শব্দচাষ দেখে।'
'দ্বিতীয় স্তবকে দেখবে মহাকবি হোমার থেকে শুরু করে হেসিয়ড পর্যন্ত যারা যারা মহাকাব্য রচনা করেছেন, তাঁদের সেই প্রাচীন ধারা পুনর্জীবিত করা হয়েছে। আর তৃতীয়টা- ক্ষয়িষ্ণু Baroque শিল্পরীতি ফলো করে দুই শ্লোকে কবিতার আসল, বিশুদ্ধ ফর্ম তুলে আনা হয়েছে। চার নম্বর শ্লোকে দেখবে আবারো একটু ফ্রেঞ্চ ভাষা এসেছে, সেই সাথে কবিতার যে সতেজতা, যে তীব্র আবেদন- তার সাবলীল হৃদপ্রকাশ ঘটেছে। আসলে পুরো কবিতায়, কখনো দুই দুই চার ফরম্যাট আবার কখনো পাঁচ আট তিন ফরম্যাটে আমি একটা গল্প বলে গেছি। গল্পটা ত্রিশ শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ হওয়া সাহিত্যের গল্প। এখানে Odessey-র মহাকাব্যিক এসেন্স আছে, Works and Days-এর সারমর্ম আছে, Xavier de Maistre-র মত তুচ্ছ কিন্তু হালকা মেজাজের গীতিকাব্যের সুখস্পর্শও আছে!'
দানেরি আমাকে আরও অনেক অনেক স্তবক পড়ে শোনাল, আর প্রত্যেক স্তবকের ওপরে দীর্ঘ ব্যাখ্যা-বক্তৃতা দিয়ে নিজের প্রতিভার কথা ঘেউঘেউ করে বলতে লাগল। কবিতার লাইনগুলো মোটেই আকর্ষণীয় ছিল না। একেকটা স্তবক কে কত ভারি তাই নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, অপ্রয়োজনীয় টীকা-টিপ্পনী আর অপরিচিত শব্দ নিয়ে পুরো কবিতা ভরপুর। আমার দুঃখ হতে লাগল, ইস, কাগজের কি নিদারুণ অপচয়!
জীবনে মাত্র একবার আমার সুযোগ হয়েছিল মাইকেল ড্রেটনের Polyolbion পড়ে দেখার। এই বইয়ে তিনি ইংল্যান্ডের উদ্ভিদ ও প্রাণীজীবন, জলবিদ্যা, সামরিক ইতিহাস, স্থাপত্যবিদ্যা- সবগুলোর ওপর আহরিত জ্ঞান এবং পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন। আমি নিশ্চিত, এমনকি এই সুবিশাল সৃষ্টিও কার্লোস দানেরির কবিতা থেকে অনেক অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। দানেরি ঠিক করেছিল পুরো পৃথিবীর বর্ণনা সে কবিতায় তুলে ধরবে, এবং ১৯৪১ সালের মধ্যে সে প্রায় দেড় লাখের মত শব্দ লিখে ফেলেছিল (অবশ্যই, কবিতার শব্দসংখ্যা কত সেটা দানেরি-ই জানিয়েছিল)। নতুন অনেক শব্দ সে আবিষ্কার করেছিল। তার মতে আকাশের আসল রঙ 'দিব্যশ্বেত', নদী 'কাঁকড়ার মত ঘষটে ঘষটে' বয়ে চলে, এবং মাথাব্যথা করার সময় যে অনুভূতি হয় তার নাম 'স্পর্শজ'। মাঝরাতের দিকে আমি জান নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এলাম।
দুই সপ্তাহ পর, দানেরি আমাকে কল করল- সম্ভবত ওর জীবনে প্রথমবারের মত। 'আমার বাড়িওয়ালা দুই বুড়ো-বুড়ি আছে না, জুনিনো আর জুনগ্রি? ওরা আজকে একটা ককটেল পার্টি থ্রো করেছে, 'স্যালন বারে'। কি বল বোর্হেস, যাবে?' দানেরি পার্টির দাওয়াত দিল আমাকে। উৎসাহ ছিল না, কিন্তু সময় কাটানোর মত কিছু পাচ্ছিলাম না (আর ফ্রি খাবার কে-ই বা মিস করতে চায়?) - তাই রাজি হয়ে গেলাম।
স্যালন বারে গিজগিজ করছিল মানুষ, টেবিল খুঁজে পাওয়াই দায়। বারের চেহারায় আধুনিক ধাঁচ আনার অস্বাভাবিক চেষ্টা করা হয়েছে- অবশ্য যা আশা করেছিলাম তারচেয়ে একটু কুৎসিত কমই। পাশের টেবিলে বসে থাকা লোকজন চোখ বড় বড় করে দম না ফেলে বকবক করছিল- 'দেখেছ, পার্টিতে কি পরিমাণ খরচ করেছে? ওরে বাপ, জুনিনো জুনগ্রি কি দিলখোলা মানুষ!' দানেরি আশেপাশে তাকিয়ে মুগ্ধ হবার ভান করছিল, একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'যা-ই বল বোর্হেস, আমার দেখা বেস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে এটা একটা।'
সে তারপর তার কবিতার চার-পাঁচটা অংশ আবার পড়ে শোনাল। কে জানত এই লোক পকেটে কবিতা-লেখা একতাড়া কাগজ নিয়ে ফেরে! তার সোজা শব্দকে অনর্থক প্যাঁচানোর অভ্যাসটা আমার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিল। যেখানে স্রেফ 'নীল' ব্যবহার করলেই হয়, সেখানে 'জলোবিম্ব' লাগিয়ে দিয়েছে। 'মায়ের দুধ'টা তার জন্য 'বেশি সোজা' হয়ে যায়, এর বদলে বেছে নিয়েছে 'পয়ঃ', 'স্তন্যক্ষীর', এমনকি একটা শব্দ বানিয়েও ফেলেছে- 'পয়স্বিনী'! কিছুক্ষণ কবিতা নিয়ে কথা বলেই দানেরি আসল কথাটা পাড়ল: 'বুঝলে, আসলে সকল গ্রেট সাহিত্যকর্ম শুরু হওয়া উচিত একটা গ্রেট মুখবন্ধ দিয়ে। ধর মোটামুটি পরিচিত একজন রাইটার যদি একটা বইয়ের শুরুতে কিছু লিখে দেয়, তাহলে পাঠকের কাছে বইটার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়। আমি চিন্তা করছি আমার কবিতাটার প্রথম ভল্যুমটা বের করে ফেলব। বেশি না, ২৫ হাজারের মত শব্দ থাকবে ওটাতে...'
এতক্ষণে আমাকে পার্টিতে ডাকার মাজেজা বুঝতে পারলাম। দানেরি বই লিখছে, আর আমাকে চেপে ধরবে তার বইয়ের শুরুতে ভাল ভাল কিছু কথা লিখে দেবার জন্য। তার এই শব্দের জগাখিচুড়িকে ভাল বলে স্বীকৃতি দিলে, আমার লেখক জীবনের কি অবস্থা হবে তাই নিয়ে ভয় ধরে গেল। সৌভাগ্যক্রমে দানেরি জানাল, আমাকে না, সে চায় আমার পরিচিত এক রাইটার- আলভারো মেলিয়ান লাফিনোঅরকে। আমি যেন আলভারোকে অনুরোধ করে ব্যাপারটা সেটল করে ফেলি। দানেরি আরও যোগ করল, 'আর বিয়াট্রিয বেঁচে থাকলে তোমাকে ও-ই বলত কাজটা করে দিতে।'
হাতে ধরা বিয়ারের প্রভাবেই হয়তো, আমি উচ্ছ্বসিতভাবে রাজি হলাম। 'হু, ঠিক ঠিক। সামনের বৃহস্পতিবারে রাইটার্স ক্লাবে ডিনারের দাওয়াত আছে আমার, ওখানে আলভারোর সাথে কথা হবে। ওকে তোমার কথাটা বলে দেখব, হুঁ? আচ্ছা, আসি তাহলে।' বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সামনের মোড়টা ঘুরতে ঘুরতে আমি অপশনগুলো ভেবে দেখতে লাগলাম।
১) আমি আলভারোকে বলতে পারি, ভাই, আমার মৃত প্রেমিকার চাচাত ভাই একটা বিশাল আবর্জনা প্রসব করেছে, প্রকাশ করতে চায়। তুমি একটা প্রিফেস লিখে দাও।
২) কিছুই না বলে চুপচাপ ডিনার খেয়ে এসে পড়া।
হুমম...নম্বর দুই। নিঃসন্দেহে দুই।
কিন্তু, পরবর্তী শুক্রবারটা শুরু হলো একপ্রকার আত্মা-ধকধক-করা ভয় নিয়ে। ফোনের দিকে তাকিয়ে আমি কুঁকড়ে যেতে থাকলাম। একটু অপরাধীও মনে হচ্ছিল নিজেকে। যে যন্ত্র একসময় বিয়াট্রিযের সিল্কের মত কোমল কণ্ঠস্বর বয়ে নিয়ে আসত, সেই একই যন্ত্রে আজ হয়তো দানেরির ধোঁকা-খাওয়া রাগান্বিত গলা শুনতে হবে। খোদার অসীম রহমতে, কেউ ফোন করল না।
তার পরের দিনও না।
তার পরের দিনও না।
ক্রমান্বয়ে দানেরির ফোনকল যে আসতে পারে, এই কথাটাই আমি ভুলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু অক্টোবরের শেষের দিকে একদিন, ফোন বাজল। লাইনে ছিল দানেরি। আমি প্রথমে ওর কণ্ঠ চিনতে পারিনি দেখে বিরক্ত হলো, একটু আহতও হলো মনে হয়। আমি ভাবছিলাম হয়তো বইয়ের কথা তুলবে, কিন্তু দানেরি কথা বলল আরেক বিষয়ে, 'জানো, হতভাগা জুনিনো-জুনগ্রি আমার বাড়ি ভেঙে ফেলতে চায়? ওরা নাকি স্যালন-বারটাকে আরও বড় করবে!' তারপর সে সুর করে অর্ধেক-কান্না অর্ধেক-গালাগালির মত একটা কিছু করতে লাগল।
তার হতাশা আমাকেও ছুঁয়ে গেল। আসলে বয়স পঞ্চাশের কোঠা পার হয়ে গেলে, একটা সময় সকল পরিবর্তনই বিষবৎ মনে হয়। তাছাড়া আমার বিয়াট্রিযের সব স্মৃতির বসবাস তো ওখানেই। আমি সামান্য অস্বস্তির সাথে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দানেরি আমার কথা কানেই তুলল না। ও বলতে লাগল, 'ওরা যদি সত্যি সত্যি বাড়িটা ভেঙে ফেলে, আমি মামলা ঠুকে দেব। ডাঃ জুনিকে হায়ার করে মামলা লড়ব। না হলেও পঞ্চাশ হাজার ডলার ড্যামেজ ফী দেওয়াবো ওদের দিয়ে।'
ডাঃ জুনির নাম শুনে আমি একটু নিশ্চিত হলাম। এ ব্যাটা সাত ঘাটের পানি খাওয়া লোক, এবং পুরো এলাকায় তুখোড় উকিল নামে পরিচিত। আমি দানেরিকে বললাম তাড়াতাড়ি তাকে হায়ার করে ফেলতে, দানেরি সম্মতি জানিয়ে বলল সে এই বিকালেই কল করবে। তারপর, কোন গোপন কথা বলার সময় আমরা যেমন গলা নামিয়ে ফেলি, তেমনি করে ও জানাল, কবিতাটা ও শেষ করতে পারেনি। মাটির নিচের ঘরের 'আলেফ'টা নষ্ট হয়ে গেলে পারবেওনা।
'জিনিসটা ডাইনিং রুমের নিচের ঘরে', দানেরি গলা আরও নামিয়ে ফেলল, 'আলেফের ভিতরে, জানো বোর্হেস, পুরো পৃথিবীটা ঢুকে বসে আছে। ওটা আমার--আমার! একেবারে ছোট্ট থাকতে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ওটাকে। নিচের ঘরে যাবার সিঁড়িগুলো খুব ঢালু দেখে চাচা-চাচি আমাকে কখনো ওখানে যেতে দিতেন না আমাকে। একদিন যখন কেউ বাসায় ছিল না, আমি চুপিচুপি নিচে নামতে শুরু করি। কিন্তু সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে যাই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন চোখ খুললাম, তখনি সামনে দেখতে পেলাম জিনিসটা। আলেফ।'
'আলেফ?' আমি বোকার মত পুনরাবৃত্তি করলাম।
'হ্যাঁ, পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে পুরো পৃথিবী ঢুকে বসে আছে। সমস্ত পৃথিবীর সবকিছু তুমি একত্রে দেখতে পাবে, সকল সম্ভাব্য অ্যাঙ্গেল থেকে, পুরোপুরি পরিস্কারভাবে- কিন্তু তবুও একটার সাথে আরেকটা কক্ষনো গুলিয়ে যাবে না। এই আবিস্কারের কথা আমি কাউকে বলিনি। এরপরে সুযোগ পেলেই মাটির নিচের অন্ধকার ঘরটায় গিয়ে আলেফের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আলেফের কারণেই তো কবিতাটা লিখতে পারছিলাম, সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে করে। আর ওরা আমার আলেফ নিয়ে যাবে? নষ্ট করে দেবে? কক্ষনো না। আলেফটা শুধু আমার, আমার। ডাঃ জুনি সবার সামনে কোর্টে প্রমাণ করে দেবেন।'
আমি যুক্তি দিয়ে দানেরিকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, 'তুমি না বললে ঘরটা অন্ধকার? তাহলে আলেফটাকে দেখলে কি করে?'
-'আরে যদি মহাবিশ্বের সকল কিছু আলেফের ভিতরে থাকে, তাহলে তো সব তারা-নক্ষত্র, সব আলোর উৎসও এর ভিতরে আছে। তাহলে এর বাইরে তো অন্ধকারই থাকবে। সোজা জিনিসটা ধরতে পারছ না?'
'আচ্ছা তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি।'
দানেরি কিছু বলতে পারার আগেই ফোনটা নামিয়ে রাখলাম। হাঃ! নিজেকে আস্ত গাধা মনে হচ্ছে আমার। এই ব্যাপারটা আগে চোখে পড়েনি কেন? ভিটেরবো বংশের সকল পুরুষের মতই, কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি-ও একটা পাগল ছাড়া আর কিছু নয়। পাগলামির লক্ষণ আগেই ছিল, বাড়ি ভেঙে ফেলার কথায় মাথার ওপরে হয়তো চাপ পড়েছে; পুরোপুরি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। তার এই পাগলামিতে আমার কেমন একটা যেন স্যাডিস্টিক আনন্দ হতে লাগল। আনন্দের পরিপূর্ণতা আসবে চোখের সামনে ওকে পাগলামি করতে দেখলে। মনের গহিনে, কেন যেন এই গাধাটাকে প্রথম দিন থেকেই ঘৃণা করে আসছি। কে জানে, হয়তো ও-ও একই রকম ঘৃণা করে আমায়!
গ্যারেই স্ট্রীটের বাসাটায় ঢুকলাম। কাজের মেয়েটা বলল অপেক্ষা করতে, কারণ দানেরি সেলার রুমে 'ছবি ডেভেলপ করছে'। সোফার পাশে পুরনো পিয়ানো, কেউ বাজায় না বোঝাই যাচ্ছে। ধুলো জমে গেছে। তার পাশে একটা ফুলহীন শূন্য ফুলদানি। ফুলদানির পেছনে দেয়ালে বিয়াট্রিযের বিশাল চকচকে ছবি। আমি আশেপাশে তাকাই।
কেউ নেই।
আমি মোহগ্রস্ত প্রেমিকের মত সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। ছবিটার ওপর মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলি, 'এই, এই বিয়াট্রিয, এই বিয়াট্রিয ইলেনা ভিটেরবো, তাকাও তাকাও, দেখ, দেখ আমি, আমি বোর্হেস- এসেছি।'
কিছুক্ষণ পর কার্লোস এলো। শুকনো গলায়, কোন প্রকার কুশল জিজ্ঞাসায় না গিয়ে বলল, 'প্রথমে এক গ্লাস সুয়েডো-কগন্যাক গিলবে। তারপর যাবে সেলারে। শোনো, কোন আলো নিয়ে যেতে পারবে না। সেলারের মেঝেতে চিত হয়ে শোবে, আর চোখ রাখবে সিঁড়ির উনিশ নম্বর ধাপে। তুমি নিচে যাবার পর আমি দরজাটা বন্ধ করে দেব। কোন নড়াচড়া করবে না, চোখ সরাবে না। আর ইঁদুর গায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে গেলে ভয় পেয়ো না, ওরা কামড়ায় না...সাধারণতঃ।'
-'তারপর?'
'তাকিয়ে থাকার দুই এক মিনিটের মধ্যেই তুমি আলেফ দেখতে পাবে। আলেফ, আমার সত্যিকারের সম্পদ, আমার আত্মা! কত ভাগ্যবান তুমি ভেবে দেখ, এই জিনিস তোমাকে দেখতে দিচ্ছি!' দানেরির চোখমুখে নাটুকে একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল।
ডাইনিং রুমে যেতে যেতে সে যোগ করল, 'আর, যদি দেখতেই না পাও, তাহলে বুঝতে হবে তোমার ভাগ্য খারাপ, নয়তো চোখ নষ্ট। এখন যাও যাও, তাড়াতাড়ি কর। ফিরে এসে বিয়াট্রিযের ছবির ওপর যত খুশি হুমড়ি খেয়ে পড়ে থেকো।'
ওর বারংবার তাগাদায় কিছুটা বিরক্ত হয়েই আমি সেলারের সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে অন্ধকার সেলারটাকে কালো সর্বগ্রাসী একটা গহ্বরের মত লাগছিল। অন্ধকার আস্তে আস্তে চোখে কিছুটা সয়ে আসতে লাগল। আবছা আলোয় দেখতে পেলাম ঘরে কয়েকটা শূন্য কমদামি বিয়ার-কেস পড়ে আছে, এখানে ওখানে ক্যানভাসের শূন্য বস্তা দুএকটা ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দানেরি বস্তাগুলোর একটা তুলে দু'ভাঁজ করল, তারপর সিঁড়ির সামনা-সামনি একটা জায়গায় বিছিয়ে দিল। আমি একটু বিরক্ত হবার ভঙ্গি করলাম।
'আহা, বালিশ হিসেবে হয়তো খুব একটা সুবিধার না', দানেরি শুকনো মুখে বলল, 'কিন্তু যদি জিনিসটা আর হাফ ইঞ্চিও বেশি পুরু হয়, তাহলে কিচ্ছু দেখতে পাবে না, গাধার মত শুয়ে থাকতে হবে শুধু শুধু। সুতরাং অমন করে মুখ বেঁকিও না। চটপট শুয়ে পড়ো এখানে, তারপর মেঝে থেকে গুণে গুণে উনিশ নম্বর ধাপের দিকে তাকিয়ে থাক।'
ও যা বলল একে একে সবই করলাম, তারপরে অবশেষে দানেরি দূর হল। দরজাটা লাগিয়ে দেবার পর, সত্যি বলতে একটু ভয় ভয় লাগছিল। আবছা আবছা যে আলোটা এতক্ষণ আসছিল, সেটাও দূর হয়ে যাওয়ায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। নিজের হাত পা মাথা সব কেমন বিচ্ছিন্ন, আলাদা আলাদা মনে হচ্ছিল। পরম অন্ধকারে ডুব দিলে যা হয়। এরকম অবস্থায় ভাবতে ভাবতে প্রথম বারের মত বুঝতে পারলাম, নিজেকে কি পরিস্থিতিতে ছুঁড়ে ফেলেছি। দানেরি পাগল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার পাগলামিতে আমি যদি সায় না দেই, যদি বলি আমি সত্যিই কোন আলেফ-টালেফ দেখিনি, তাহলে ও কি করবে? নিজের পাগলামি লুকিয়ে রাখতে মেরে ফেলবে আমাকে? নাকি এই ব্যবস্থা আরও আগে করে রেখেছে? কগন্যাকে বিষ মিশিয়ে দেয়নি তো??--ভাবতে ভাবতে আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠতে থাকে, আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি-- তারপর চোখ খুলি আবার। তখনই আমি দেখতে পেলাম আলেফ-টা।
গল্পের এই অংশে এসে আমাকে থেমে পড়তে হচ্ছে বারবার। একজন লেখক হিসেবে নিজের অক্ষমতারও মুখোমুখি হচ্ছি। তবুও, চেষ্টা করি।
প্রতিটি ভাষাই কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রতীক, চিহ্ন নিয়ে গড়ে ওঠে। আর প্রতীক বা চিহ্নগুলো বেছে নেওয়া হয় ব্যবহারের ক্ষেত্রবিশেষে, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তাহলে যে জিনিসটা আগে আমি কখনো চোখে দেখিনি, অনুভব করিনি, তাকে কি দিয়ে বর্ণনা করব? অন্ধকে আকাশের রং যে নীল, বধিরকে পিয়ানোর সুর যে কেমন মিষ্টি - সেটা কি রূপক দিয়ে বোঝানো যায়?
সুফিরাও খোদাকে নিয়ে গান বাঁধতে গিয়ে, লিখতে গিয়ে এরকম সমস্যায় পড়েছেন। তারা এর সমাধানে আবার রূপক-ই বেছে নিয়েছেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বোঝাতে গিয়ে এক পার্সিয়ান সুফি একটা পাখির কথা বলেছেন, যেটা একইসাথে পৃথিবীর সব পাখির অংশ। ফ্রেঞ্চ দার্শনিক Alanus de Insulis সেই ১১৬০ সালে একটা গোলকের কথা বলেছেন; মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু এর কেন্দ্র, কিন্তু এর কোন পরিধি নেই। আরও আছে চারমুখো Ezekiel-এর কাহিনি; যে একই সময়ে একই সাথে উত্তরে-দক্ষিণে-পূর্বে-পশ্চিমে যেতে পারে (বিনা কারণে এগুলো বলছি না, আলেফের আইডিয়াটার সাথে এদের প্রত্যেকের কোন না কোন দিকে মিল আছে)। হয়তো আমি আরও উদাহরণ দিতে পারব, কিন্তু তাতে জিনিসটার বর্ণনা আরও ঘোলাটে, অস্পষ্ট লাগবে আপনাদের কাছে। সসীমের মাঝে কখনো অসীমের ধারণা ঢোকানো সম্ভব কি? আলেফের দিকে তাকানোর সাথে সাথে কোটি কোটি মানুষের হাসি-কান্না-আবেগের ছবি (আসলে চলমান সিনেমার মত প্রত্যেকটা, কিন্তু বিভ্রান্তি কমানোর জন্য 'ছবি' শব্দটা ব্যবহার করছি) আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, প্রত্যেকে সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে, কোথাও কোন অস্পষ্টতা নেই। প্রত্যেকটা ঘটনা ঘটছিল একই সাথে। কিন্তু তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে এখন যা লিখব, তা আসবে ক্রমান্বয়ে। কারণ ভাষা বর্ণনার ওপর নির্ভরশীল, আর সকল বর্ণনাই একটা ক্রম মেনে চলে।
উনিশ নম্বর ধাপের একটু পেছনে, আঁধারের মাঝে, ছোট একটা গোলক শূন্যের ওপর ভাসতে ভাসতে ধীরে ধীরে ঘুরছিল। আমি আরেকটু ভাল করে দেখলাম। না, আসলে ওটা স্থির, কিন্তু গোলকের মাঝে অসংখ্য জিনিস ঘুরছে, ফিরছে, পাক খাচ্ছে - তাই পুরো জিনিসটাই নড়ছে বলে ভ্রম হচ্ছে। গোলকটা ব্যাসে কত হবে? এক ইঞ্চি, নইলে এক ইঞ্চির একটু বেশি। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবটাই ওই এক ইঞ্চি গোলকের মধ্যে ভাসছিল। কোন কিছুকে যত ভাবে দেখা সম্ভব, তার ওপর যতভাবে আলো ফেলা যায়, ঠিক ততভাবেই আমি প্রত্যেকটা বস্তুকে দেখছিলাম। আয়নার বিপরীতে আরেকটা আয়না লাগিয়ে একটা নির্দিষ্ট কোণ থেকে তাকিয়ে দেখবেন, মনে হয় একটার পর একটা অসংখ্য আয়না দেখা যাচ্ছে। তেমনি, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটা জিনিসের অসংখ্য রূপ একই সাথে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
আমি দেখতে পেলাম বিশাল সুনীল সমুদ্র, দেখলাম রাত নেমে আসতে, দেখলাম ভোর হচ্ছে। প্রতিটা মানুষকে আলাদা করে দেখলাম। কালো পিরামিডের অন্ধকার কোণে এক মাকড়সার রূপালি জাল দেখলাম। একটা বিক্ষিপ্ত গোলকধাঁধার মত জায়গা দেখলাম (পরে মনে হল ওটা সম্ভবতঃ লন্ডন ছিল)। দেখলাম অসংখ্য চোখ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা আয়নায় নিজেকেই দেখছে। আমি পৃথিবীর সবগুলো আয়না দেখলাম, কিন্তু কোথাও নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পেলাম না। আমি...বুকে বাতাস ভরে নিলাম অনেকটা। চোখ বন্ধ করলাম। তারপর তাকালাম আবার।
সোলার স্ট্রীটের একটা বাড়ির সামনের উঠোন। বাড়ির চকচকে টাইলস।
সেই একই টাইলস, যা ত্রিশ বছর আগে ফ্রে বেন্তোসে এক বাসায় দেখেছিলাম।
আঙুর-শাখা।
তুষার।
টোব্যাকোর ঘ্রাণ।
ধাতুর কাঁচা খণ্ড, দূষিত বাষ্প।
মরুভূমির উঁচুনিচু বালুর স্তুপ।
বালুর স্তুপের প্রতিটি আলাদা আলাদা কণা।
লম্বা করে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। তার চেহারা ভুলব না কখনো। দেখলাম তার জট-পাকানো চুল, তার ডান স্তনে ক্যান্সারের সংক্রমণ।
ফুটপাথের একপাশে একটা জায়গায় পড়ে থাকা আলগা মাটি। আগে একটা গাছ ছিল এখানে।
আদ্রোঁগ শহরের এক কোণে একটা সামার হাউস। দেখলাম বাসাটার এক ঘরে ফিলেমন হল্যান্ডের প্রথম বইটার ইংরেজি অনুবাদের প্রথম কপি, পড়ে আছে অযত্নে। একই সময়ে বইটার প্রতিটা পাতার প্রতিটা অক্ষর ফুটে উঠল চোখের সামনে (ছোট থাকতে মাঝে মাঝে মনে হত- আচ্ছা, কোন বই যখন বন্ধ করে শেলফে তুলে রাখা হয়, তখন অক্ষরগুলো আলগা হয়ে একটা আরেকটার সাথে মিশে যায় না কেন?)
জাপানের এক শহরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল বাংলার একটা গোলাপ ফুলের রং এসে মিশে গেছে সূর্যে।
শূন্য ঘর। আমার ঘর।
আলকামারের একটা ক্লজিটে দুটো আয়নার মধ্যে একটা গ্লোব রাখা। আয়নাদুটোয় গ্লোবের অসংখ্য প্রতিবিম্ব।
সন্ধ্যা নামছে। কাস্পিয়ান সাগরের তীর ধরে দৌড়ে যাওয়া একদল বন্য ঘোড়ার কেশর উড়ছে বাতাসে।
কারো হাতের হাড়গুলোর সূক্ষ্ম কাঠামো।
যুদ্ধরত সৈনিকরা বাড়িতে পাঠাচ্ছে ছবিঅলা পোস্টকার্ড।
মির্জাপুরের এক দোকানের শোকেসে স্প্যানিশ তাসের প্যাকেট।
একটা গ্রিনহাউসের মেঝেতে নুয়ে পড়া ফার্ণের ছায়া।
বাঘ এগোচ্ছে সাবধানে পাতা মাড়িয়ে, শিকারি চোখে ।
বন্য মোষের দল।
নদীতে জোয়ার ভাটা চলছে।
একটা প্রাচীন পার্সিয়ান জ্যোতির্মন্দির।
পৃথিবীর যত পিঁপড়ে আছে সবগুলোকে দেখলাম। সব।
একটা টেবিলের ড্রয়ারে কতগুলো চিঠি (হাতের লেখাটা দেখে আমি কাঁপতে শুরু করলাম), অবিশ্বাস্য অশ্লীল আর কামুক চিঠি।
বিয়াট্রিয লিখেছে কার্লোস আরজেন্টিনোকে।
দেখলাম একটা সমাধিফলক, যা আমি একসময় পূজা করতাম। তার নিচে পচাগলা অবশিষ্টাংশ, হাড় হয়ে গেছে ধুলো-মাটি। এদের সবার একসময় 'বিয়াট্রিয ভিটেরবো' নামক একটা একক, লোভনীয় অস্তিত্ব ছিল।
দেখলাম নিজের কালচে রক্তপ্রবাহ।
প্রেমিক-প্রেমিকারা মিলিত হচ্ছে।
প্রেম করছে।
মরে যাচ্ছে।
বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।
প্রত্যেক বিন্দু, প্রত্যেক কোণ থেকে আমি দেখলাম- আমি তাকিয়ে আছি আলেফের দিকে।
আলেফের ভেতরে দেখলাম পৃথিবী।
পৃথিবীর ভেতরে আলেফ।
আলেফে পৃথিবী।
পৃথিবীতে আলেফ।
আলেফ... পৃথিবী...
পৃথিবী...আলেফ...
তারপর নিজের পা, মুখ চোখ দেখলাম। নিজের নাড়িভুঁড়ি দেখলাম। তোমাকে দেখলাম। আমাকে দেখলাম। তারপর হাসলাম, চোখ বন্ধ করে কাঁদতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। মাথা ঘুরতে লাগল। বমি বমি কেমন যেন। মানুষ যাকে চেনে মহাবিশ্ব নামে, কিন্তু যার প্রকৃত রূপ- সম্পূর্ণ রূপ- সে কখনো দেখেনি- আমি সেই নিষিদ্ধ রূপ দেখলাম।
কি অসীম বিস্ময়, কি অসীম আনন্দ!
-'হা হা, পুরো বোকা হয়ে গেছ, তাই না?' একটা খুশি খুশি, আমুদে কণ্ঠস্বর বলে উঠল, 'যে জিনিস দেখালাম, এই ঋণ হাজার বছরেও শোধাতে পারবে না। জিনিসটা এক কথায় স্বর্গীয়, তাই না বোর্হেস, অ্যাঁ?'
কার্লোস আরজেন্টিনো দাঁড়িয়ে ছিল সিঁড়ির সবচে ওপরের ধাপটায়। দরজার ফাঁক দিয়ে যে ক্ষীণ হলুদ রশ্মি চুইয়ে চুইয়ে আসছিল, তার আলোয় আমি নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর বিড়বিড় করে জবাব দিলাম ওকে, 'স্বর্গীয়? হু, স্বর্গীয়ই বটে।'
আমার কণ্ঠে আশ্চর্যের সুরটাকে কার্লোস ভুল করে বিদ্রূপ ভাবল। একটু উদ্বেগে পড়ে গিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, 'তুমি তো সব দেখেছ, না? একেবারে পরিষ্কার করে?'
ওই মুহূর্তেই আমি আমার প্রতিশোধের উপায় খুঁজে পেলাম।
সরাসরি ওকে দয়া দেখানোর ভান করে, কোমল স্বরে ওর আতিথেয়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললাম, সেলারে শুয়ে থেকে আমি অনেক 'আনন্দ' পেয়েছি। সেই সাথে কাঁধে হাত দিয়ে মেকি সহানুভূতি দেখিয়ে বললাম, 'বাড়িটা ভেঙে ফেলা তো আর ঠেকানো যাবে না, তুমি এক কাজ কর - ক'দিন গ্রাম দিয়ে ঘুরে এস। শহরের পরিবেশটা এত বাজে, তোমাকে কি আর বলব- আমারই তো মাঝে মাঝে মাথা নষ্ট হয়ে যায়!'
দানেরিকে কেমন অসহায় দেখাচ্ছিল। ও আলেফের কথা বলতে চাইল, কিন্তু আমি হাত নেড়ে জোর করে সে নিয়ে আর কথাই বললাম না। বেরিয়ে আসার আগমুহূর্তে আমি ওর সাথে ভীষণ আবেগের সাথে কোলাকুলি করলাম; তারপর আরও একবার গ্রামের তাজা আলোবাতাসের উপকারিতা নিয়ে একটা ছোটোখাটো ভাষণ দিয়ে খুশিমনে বেরিয়ে এলাম। পেছনে পড়ে রইল বিধ্বস্ত দানেরি।
বাইরে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে, সিঁড়ি বেয়ে কনস্টিটিউশন স্টেশনে নামতে নামতে একটা ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরতে শুরু করল। সাবওয়ের ট্রেনে চড়তেই ভয়টা আরও ঘনীভূত হল। এই জায়গায় আমি আগে কখনো আসিনি, কিন্তু যেখানে তাকাচ্ছি, যার দিকে তাকাচ্ছি- প্রত্যেকটা বাঁক, প্রত্যেকটা মুখ অনেকদিনের পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। আমি এদের সবাইকে চিনি। সবকিছু দেখা হয়ে গেছে। সব পথ চলা হয়ে গেছে। একটা অবর্ণনীয় অনুভূতি চড়ে বসল বুকের ওপর। আমি কি আর কখনো নতুন কিছু দেখব না? শুনব না নতুন কোন সুর?
সম্পূর্ণ বিশ্বজগতের জ্ঞান আমাকে পাগলামির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, খুব আস্তে আস্তে।
সৌভাগ্যক্রমে, নির্ঘুম কয়েকটা রাত কাটানোর পর একদিন সকালে আবিষ্কার করলাম, পাখির এই ডাকটা আগে কখনো শুনিনি। বাইরের সূর্যোদয়টা নতুন মনে হচ্ছে। নতুন! এভাবেই বিস্মৃতির অতলে আলেফের কথাগুলো ডুবে গেল একদিন।
পুনশ্চ -
গ্যারেই স্ট্রীটের 'কোন একটা' পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলার ছয় মাস পরের কথা। প্রোক্রাস্ট অ্যান্ড কো. নামের এক প্রকাশনী কি জানি কোন কারণে দানেরির 'মহাকাব্যে'র একটা অংশ প্রকাশ করল। পুরোটা না, আর্জেন্টিনার বর্ণনার অংশটুকু। তারপর কি হল সেটাকে কি বলা যায়? (আমি বলব আমাদের সাহিত্যমানের জন্য একটা অশনিসংকেত) কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি জাতীয় সাহিত্য পুরষ্কারে দ্বিতীয় স্থান লাভ করল। ('প্রিয় বোর্হেস, তোমার অভিনন্দন-পত্র পেয়েছি', ক'দিন পর আমাকে ও চিঠি পাঠাল, 'ভদ্রতার মুখোশের নিচে তোমার ঈর্ষা আর বিদ্বেষের বাহার দেখে আমোদিত হলাম। তবে যা-ই বল, তোমাকে স্বীকার করতেই হবে এবারের জয়মাল্যটা আমারই প্রাপ্য। আমার মুকুটেই সাহিত্যের পদ্মরাগমণিটির যথার্থ স্থান') প্রথম পুরষ্কার পেলেন ড. আইতা, তৃতীয় পুরষ্কার গেল ড. মারিও বনফান্তির কাছে। সবচে অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা হল- আমার বই 'শানানো শব্দের চিরকুট' একটা ভোটও পেল না! নীরস আর মানহীন বাজারি লেখকদের জয় হল আরেকবার! দানেরির সাথে আমি কয়েকবার দেখা করার চেষ্টা করেছি। বাজারে গুজব আছে তার নাকি আরেকটা কবিতার বই বেরুবে। তিনটে বড় বড় প্রকাশনী ওর পেছনে লাইন দিয়ে বসে আছে। আলেফের প্রভাবমুক্ত হয়ে তার কলমও ঘন ঘন গর্ভবতী হয়ে পড়ছে, এখন লিখছে আমাদের জাতীয় বীর জেনারেল স্যান মারটিনকে নিয়ে (খুব সম্ভব একটা মহাকাব্য)।
আলেফ সম্পর্কে আমি কয়েকটা ধারণা যোগ করতে চাই- একটা এর প্রকৃতি নিয়ে, আরেকটা এর নাম নিয়ে। 'আলেফ' হচ্ছে হিব্রু বর্ণমালার প্রথম অক্ষর। এই শব্দটি কাব্বালা ধর্মে 'En Soph' নামে পরিচিত, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে 'ঈশ্বরের বিশুদ্ধ ও সীমাহীন বৈশিষ্ট্য'; এবং 'En Soph' বা আলেফ যদি মানুষের রূপ ধারণ করে, তাহলে তার মাথা স্পর্শ করে স্বর্গ এবং পায়ের পাতা স্পর্শ করে পৃথিবী (এই ধর্মে পৃথিবী-স্বর্গের মাঝে দূরত্ব অসীম ধরা হয়)। জর্জ ক্যান্টরের Mengenlehre গ্রন্থে আলেফকে ধরা হয়েছে ট্রান্সফাইনাইট সংখ্যার প্রতীক হিসেবে, (যেসব সংখ্যা যেকোনো সসীম সংখ্যার চেয়ে বড় কিন্তু অসীম সংখ্যা নয়) যেমন আলেফ-ওয়ান, আলেফ-নাল ইত্যাদি। অর্থাৎ আলেফ নিতান্তই কোন মনগড়া শব্দ নয়, এর পেছনে অনেক ইতিহাস আছে। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে দানেরি জানল কি করে, তার সেলারের জিনিসটার নাম 'আলেফ'?
আমার ধারণা, গ্যারেই স্ট্রিটের বাসায় আমি যা দেখেছিলাম- ওটা আসল আলেফ নয়। নকল।
আগে কয়েকটা তথ্য দেই। রিচার্ড ফ্র্যান্সিস বার্টন ১৮৬৭ সালের দিকে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭৫ বছর পর, জুলাই ১৯৪২ সালে এক গবেষক সাও পাওলোর লাইব্রেরিতে স্বয়ং বার্টনের হাতে লেখা একটা পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। পাণ্ডুলিপিতে বলা হয়েছে এক রহস্যময় আয়নার কথা, যাতে তাকালে ধরা পড়ে 'পুরো বিশ্বের প্রতিবিম্ব'। বার্টন বলছেন এই আয়নার মালিক ইস্কান্দার জুলকারনাইন, মুসলমানদের একটা অংশ বিশ্বাস করে ইনি একজন আল্লাহ-প্রেরিত নবী ছিলেন। একে পশ্চিমা বিশ্ব চেনে ম্যাসিডোনিয়ার 'আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট' নামে।
বার্টন একইরকম আরও কয়েকটা বিশেষ বস্তুর নাম করেছেন -- পার্সিয়ান সম্রাট কায়খসরু-র সাকির পেয়ালা- যাতে অনন্তকাল ধরে সাকি ঢাললেও অর্ধেকের বেশি ভরতো না কখনো। আরব্য এক হাজার এক রজনীর গল্পে আছে - তারিক-ইবনে-যিয়াদ সুউচ্চ এক দালানে খুঁজে পেয়েছিলেন আয়না- যাতে মানুষ বাদে আর সবকিছুর প্রতিবিম্ব দেখা যেত (Thousand and One Nights, 272)। জুলস ভার্ন, এইচ.জি ওয়েলসের প্রায় দুই হাজার বছর আগে সিরিয়ার অধিবাসী লুসিয়ান প্রথম সায়েন্স ফিকশন লেখেন, 'ট্রু হিস্টোরি' বা 'সত্যিকারের ইতিহাস' নামে। এই বইয়ে আছে চাঁদের গায়ে লেগে থাকা একটা আয়নার কথা (True History, I, 26)। দার্শনিক ক্যাপেলার Satyricon বইয়ে আয়নার তৈরি এক বর্শার উল্লেখ আছে - যা কারো গায়ে বিঁধলে সে অদৃশ্য হয়ে যেত।
জাদুকর মারলিনের আয়নার বর্ণনায় বলা হচ্ছে, 'এটি ছিল গোলাকার, ফাঁপা, এবং ফাঁপা অংশটিতে সত্যিকারের জগতের অবস্থান। আমাদের জগত ওই জগতটির প্রতিবিম্ব মাত্র (The Faerie Queene, III, 2, 19)।'
কায়রোতে 'আমর ইবনে আল-আসের মসজিদ' নামে একটি মসজিদ আছে। যেসব বিশ্বাসীরা ওই মসজিদে জড়ো হন- তাদের মাঝে একটি শতাব্দীপ্রাচীন ধারণা বিদ্যমান, যে- যেসব স্তম্ভ এত বছর ধরে মসজিদের ভার বহন করে চলেছে, তাদের একটির ভেতরে গোল একটা পাথর ঢোকানো আছে। অবশ্য পাথরটি কেউ কখনো দেখেনি। কিন্তু স্তম্ভগুলোর একটিতে কান পেতে থাকলে নাকি পুরো মহাবিশ্বের গুঞ্জন শোনা যায়। অনুভব করা যায়। মসজিদটি সপ্তম শতাব্দীতে তৈরি করা হয়। কিন্তু এর গায়ের ইটপাথর বা স্তম্ভগুলোর উৎস সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। যেমনটা ইবনে খালদুন লিখেছেন, 'যখন বেদুইনরা সভ্যতা গড়ে, তখন মরুভূমি তাদের বালু ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না। তাই তারা সভ্যতা গড়বার উপাদান ধার করে বাকি বিশ্বের কাছ থেকে।' ।
তাহলে যুগ যুগ ধরে আলেফের অস্তিত্ব কোথায় ছিল? মারলিনের আয়নায়? কায়রোর ওই মসজিদের কোন এক স্তম্ভে? সসীম কিছুতে অসীমকে অনুভব করা কি আদৌ সম্ভব? নাকি দানেরির ওই সেলারের মেঝেতে শুয়ে আমি সত্যিই 'আলেফ' দেখেছিলাম, এখন সেই অভিজ্ঞতা কোনোভাবে ভুলে গেছি, তাই সংশয় মাথাচাড়া দিচ্ছে?
আমাদের জগতটা পরিবর্তনশীল। সবসময় ঘুরছে, ফিরছে, রক্তের মত মেঝে বেয়ে গড়াচ্ছে, বদলে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে। মানুষের মনটা তেমনি, বাঁচতে বাঁচতে একসময় কুয়াশার মত বিস্মৃতি এসে ঢেকে দেয় প্রিয়- পরিচিত সবকিছুকে। আমি নিজেও বদলে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি। বছরের পর বছরেরা এসে বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্লান্তি। ভুলিয়ে দিচ্ছে আলেফ কি ছিল কি না ছিল।
ভুলিয়ে দিচ্ছে বিয়াট্রিযের মুখ।