শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
একদিন পরেই শুক্রবার। সকালেই বাবাকে ঐ বাড়ির ঘরবর (অর্থাৎ বর দেখা অনুষ্ঠানকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘরবর বলে) উপলক্ষে ডাকা হয়েছে। বাবা সকালে গিয়ে বর দেখা উপলক্ষ্যে কি কি করতে হবে সব ব্যবস্থা করে দিয়ে আবার ফেরৎ আসলেন। ফেরৎ আসার কারণ হলো তখনও আমাদের ধান কাটা শেষ হয় নাই। ধান কাটার জন্য কয়েকজন কৃষাণ নেয়া হয়েছে। তাদের কারণেই বাবা সকালে গিয়ে আবার ফেরৎ আসলেন। কামলাদের ধান কাটার সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে দুপুরের পরেই রওনা দিলেন। সাথে আমিও আছি।
বরের বাড়ি কনের বাড়ি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে। গ্রামের নাম নিশ্চিন্তাপুর। পুরো গ্রামটিই চর এলাকা। মানাস নদী পার হয়ে বালুচর হাঁটতে হাঁটতে যখন বরের বাড়ি গিয়ে পৌঁছিলাম তখনও ঢেঁকির পার পড়তে ছিল। কারো বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে বা জামাই ঝি আসলে সেই বাড়ির ঢেঁকির পার পরার শব্দ শুনলেই বোঝা যেত। ধান ভাঙার জন্য ঢেঁকির পার পরার শব্দ আর চাউলের গুড়ি কোটার জন্য ঢেঁকির পার পরার শব্দের কিছুটা তারতম্য ছিল। চাউলের গুড়ি কোটার জন্য ঢেঁকির পারের শব্দ একটু ঘন ঘন হতো আর ধান ভাঙার জন্য ঢেঁকির পারের শব্দ লম্বা লম্বা হতো।
গ্রাম এলাকা হওয়ায় সন্ধ্যার আগেই প্রায় সব রান্না শেষ। সেই সময় গ্রামে বিদ্যুতের ব্যাবহার ছিল না এবং চর এলাকায় বিদ্যুতের কথা কেউ কল্পনাও করতো না। সর্বত্রই কুপি বা ল্যাম্পের ব্যাবহার ছিল। তবে কোন বড় অনুষ্ঠান হলে ধনীরা হ্যাজাক লাইট জ¦ালাতেন আর নি¤œ মধ্যবিত্তরা হ্যারিকেন জ¦ালাতেন। রাতের আলোর সুব্যাবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার আগেই দিনের আলোতে রান্নার কাজ শেষ করতে হয়েছে।
সন্ধার পূর্বমুহূর্তে কনে পক্ষের এাগারো জন লোক এসে হাজির। এগারো জনের মধ্যে তিনজন ঐ বাড়ির ঝি জামাই বাকিরা মুরুব্বি। কনে পক্ষ যখন বরের বাড়ি এসে উপস্থিত হলো তখন মাগরিবের নামাযের সময় হয়েছে। সেই আমলে গ্রামে গ্রামে কোন মসজিদ ছিল না, দুই তিন গ্রাম মিলে একটা মসজিদ। এ গ্রামেও কোন মসজিদ নাই। মসজিদে নামায পড়তে হলে অন্য গ্রামে যেতে হয়। মসজিদ না থাকায় বাড়িতেই নামাযের ব্যাবস্থা করা হলো। নামাযের বিছানা হিসাবে যা দেয়া হলো সেটা ছিল ডিঙি নৌকার পাল তোলার বাদাম। লম্বায় বারো হাত। প্রস্তও ছয় হাতের কম নয়। সেই ডিঙি নৌকার বাদামের উপর দাঁড়িয়েই কনে পক্ষ এবং ছেলে পক্ষ মিলে জামাতে নামায আদায় করলেন।
নামায পড়ার পরপরই কনেপক্ষকে ঘরে নিয়ে বসতে দেয়া হলো। বরের বাড়ি ততটা উন্নত নয়। চারদিকে চারটি ছনের ঘর মাঝখানে উঠান। ঘরের বেড়াগুলি পাট খড়ি দিয়ে তৈরী। চারটি ঘরের মধ্যে দু’টি শোবার ঘর, একটি রান্না ঘর আর একটি গোয়াল ঘর। যে ঘরে বসতে দেয়া হয়েছে ঘরটি পশ্চিম দূয়ারী উত্তর দক্ষিণ লম্বা। লম্বায় চৌদ্দ পনেরো হাতের বেশি নয়। প্রস্ত সাত বা সাড়ে সাত হাত হবে। বরের বাপের ঘরবাড়ি যাই হোক না কেন গৃহস্থ হিসাবে অনেকটা সচ্ছল। ভাত কিনে খেতে হয় না। নিজের ক্ষেতের ধান পাট যা পায় তাই দিয়েই সারা বছর চলে।
ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখি ধানের নাড়া বিছিয়ে তার উপরে নকসী কাঁথা বিছানো হয়েছে। কনের বাড়ি ও বরের বাড়ির লোকজনসহ প্রায় বিশ বাইশ জন মানুষ। ঘরে জানালা না থাকায় সন্ধার পরপরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটি হ্যারিকেন জ¦ালিয়ে মাঝখান রাখলেও ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো হচ্ছে না। হ্যারিকেনের আবছা আলোতেই ঘরে বসে থাকা বুড়োদের গালগপ্পো হাসিঠাট্টা চলছে। পরিচিত অপরিচিত অনেক লোক একত্রে হলে যা হয়। সদর আলী জ্যাঠা এতক্ষণ ঘরের বাহিরে ছিলেন। মোফাত ভাই সদর আলী জ্যাঠার আপন ভগিনা হওয়ায় তিনিই খাওয়া দাওয়ার তদারকি করতেছেন। ঘরে ঢুকে কনে পক্ষকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন, আপনাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে খাইবার দিবার চাই। বর পক্ষের একজন বললেন, খামাখা রাইত কইরা লাভ কি, যতো তাড়াতাড়ি আমাগো বিদায় করতে পারেন ততই ভালো, অনেক দূর হাইটা যাইতে হইবো, আগে আগে খাওন দিলেই ভালো হয়।
জ্যাঠার কথা মতো দুইজন থালা বাসন নিয়ে হাজির হলো। হাত ধোয়ার জন্য একজন কাসার বদনা ভরা পানি নিয়ে এলেন। প্রত্যেকের থালায় থালায় পানি ঢেলে হাত ধুয়ে দিলেন। আরেকজন এসে থালা থেকে হাত ধোয়া পানিগুলো বালতিতে ঢেলে নিয়ে থালা পরিস্কার করে দিলেন। হাত ধুয়ে সামনে থালা নিয়ে বসে আছি। এমন সময় দুই তিনজন মাটির হাঁড়ি নিয়ে উপস্থিত হলো। প্রথমেই দিল মুড়ির মোয়া তারপর চিড়ার মোয়া, খৈয়ের মোয়া, চাউল ভাজার মোয়া এরপর তেলে ভাজা পিঠা, কুলি পিঠা এবং দুধ পিঠা। পিঠা খাওয়ার পরপরই দেয়া হলো চাউলের পায়েস। পায়েস খাওয়া শেষ হলে দেয়া হলো ভাত, ভাত দেয়ার পরপরই দেয়া হলো আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, বিলের বড় বড় পুটি মাছ ভাজা, কৈ মাছ ভাজা। ভাজাভাজি খাওয়া শেষ হতে না হতেই দেয়া হলো হাঁসের ভুনা মাংস এবং আলু বেগুন দিয়ে রান্না করা হাঁসের মাংসের তরকারি সাথে দেয়া হলো মাসকালাইয়ের ডাল। কনের বাড়ির মতো অতো আইটেম না থাকলেও খাওয়া খারাপ হলো না। সুস্বাদু রুচিসম্মত খাবার খেয়ে মোটামুটি পেট ভরে গেল। সব শেষে দেয়া হলো দুধ ভাত।
তবে কনের বাড়িতে যে বুড়োগুলো চার পাঁচ জনের খাবার খেয়ে নাম করেছিলেন তারাও আমাদের সাথেই খেয়েছেন। আমি মনে করেছিলাম এখানেও হয়তো তারা ঐ বাড়ির মতো খাবেন। কিন্তু না ওনারা এখানে খাওয়া নিয়ে কোন প্রতিযোগীতা করলেন না। তবে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খেলেন। হয়তো বরের বাড়ির আর্থিক অবস্থা চিন্তা করেই উনারা অতিরিক্ত খাবার খেলেন না। বরের পক্ষ থেকে পায়েস আর ডাল পর্যাপ্ত পরিমাণ দিতে চাইলেও কনে পক্ষের লোকজন তাদের খাওয়ার চাহিদার অতিরিক্ত খেলেন না।
খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে সবাই বসে আছি। এমন সময় বাটা ভরা পান সুপারি নিয়ে ঘরে ঢুকল মোফাত ভাই। মোফাত ভাইয়ের গায়ে একটি সাদা শার্ট, পরনে আধাপুরান মাঝারি মানের লুঙি, মাফলারের মতো করে গলার দুইপাশে ঝুলিয়ে রাখা গামছা। এই অবস্থায় মোফাত ভাই ঘরে ঢুকে ইতস্তত করতে লাগল। এর আগে হয়তো এরকম পরিবেশের সম্মুখীন কখনও হয় নাই, যে কারণে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দারোগা পুলিশের সামনে আসামীরা যেভাবে ভয়ে কাঁপতে থাকে মোফাত ভাইও কিছুটা সেরকম কাঁপতে ছিলেন। তার ইতস্ততা ও ভীতি ভাব দেখে বাবা বললেন, আগে সবাইরে সালাম দাও। লেখাপড়া না জানা সহজ সরল মোফাত ভাই যেভাবে সালাম দিলেন তা আজো মনে আছে। তিনি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন, সালাই মালাই কুম। সালাই মালাই কুম বললেও উপস্থিত লোকজনের মধ্যে থেকে এই সালামের ভুল ধরলেন না। ভুল না ধরার কারণও আছে, ঐ সময় দুই চার দশ গ্রাম খুঁজেও কোন মাদ্রসা পড়ুয়া ছাত্র পাওয়া যেত না। দুই চারজন কোরান পড়–য়া মুন্সি থাকলেও তারা নিজেরাও শুদ্ধ উচ্চারণ জানতো না।কাজেই মোফাত ভাইয়ের সালাই মালাই কুম শুনে সবাই একযোগে বলে উঠলেন অলাই কুম আচ্ছালাম।
সালাম দেয়ার পর বাবার কথা মতো তিনি নিজ হাতে একটি একটি করে পান তৈরী করে বৃদ্ধদের হাতে হাতে দিলেন। সবাইকে পান দেয়া শেষ হলে মোফাত ভাইকে বসতে বলা হলো। মোফাত ভাই ঠিক দরজা বরাবর পূর্ব দিকে মুখ করে বসলেন। ঘরের চারদিকেই লোকজন বসা। কারো মুখে কোন কথা নাই। নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ ভেঙে মোফাত ভাইকে বাবা বললেন, বাবারে-- গলা থেকে গামছাটা সরাও, গলায় গামছা থাকলে আবার কেউ কেউ মনে করতে পারে তোমার গলায় ঘ্যাগ (গলগন্ড) আছে। কথা শুনে অনেকেই হো হো করে হেসে উঠলেন। সবার হাসি দেখে মোফাত ভাইয়ের লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাওয়ার অবস্থা হলো। মাথা নত করে গামছাটি গলা থেকে নামিয়ে নিচে রাখলেন। এমন সময় সদর জ্যাঠা মেয়ে পক্ষকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনাাদের ছাওয়ালের কাছে কোন জিজ্ঞাসা থাকলে করতে পারেন। জ্যাঠার কথা শুনে কনে পক্ষের একজন মোফাত ভাইকে লক্ষ্য করে বলল, তোমার নাম কি? জবাবে মোফাত ভাই বলল, মোঃ মোফাত আলী, বাপের নাম? মোঃ হবিবর রহমান, তোমরা ভাই বোন কয়জন? বলল, আমার কোন ভাই বোন নাই, আমি একলা। বরের নাম, বাপের নাম ভাই বোনের সংখ্যা জানার পরে জিজ্ঞাস করলেন, কোরান কতাব কিছু পড়ছাও। মোফাত ভাই উত্তর দিলেন, জে না। এতটুকু জিজ্ঞাস করার পর সবাই যখন চুপচাপ তখন সদর জ্যাঠা আবার বললেন, আর কিছু কি জিজ্ঞাইবেন? জিজ্ঞাইলে জিজ্ঞান। কোনায় বসে থাকা এক বৃদ্ধ বলে উঠল, আচ্ছা বাবা কও তো দেহি, একশ’ ট্যাকা মণ ধান হইলে আড়াই শের ধানের দাম কত? প্রশ্ন শুনে মোফাত ভাই কাঁপতে লাগল, প্রায় পাঁচ মিনিট পার হওয়ার পরও যখন উত্তর দিতে পারছিল না তখন বাবা বলল, আরে বাবা হিসাব যা জানো তাই কও এতো চিন্তা করার কি আছে? এইহানে তো আমরাই তোমার সাথে বইসা আছি। বাবার কথা শুনে মোফাত ভাই কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, সাড়ে ছয় ট্যাকা। তার উত্তর শুনে বুড়োরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। এক বৃদ্ধ সদর জ্যাঠাকে উদ্দেশ্য করে বলল, বিয়াই, ছাওয়াল কি হিসাব ঠিক কইছে? জ্যাঠা উত্তরে বললেন, হিসাব যা কইছে খারাপ কয় নাই, আপনাগো হিসাব করতে গিয়া ছাওয়াল কিন্তু অনেক মাথা খাটাইছে, একেবারে আন্তাজি কয় নাই। জ্যাঠার এমন উত্তর শুনে আমার হাসি আটকাতে পারছিলাম না। হাসি চেপে রেখে বাবাকে বললাম, বাবা, ভাই তো হিসাব ভুল করছে। বাবা আমাকে ছোট একটা ধমক দিয়ে বলল, আরে বাবা চুপ থাকো। তোমার জ্যাঠা কি কয় হেইডা শোন।
কনে পক্ষের সামনে বসে মোফাত ভাই হিসাবে ভুল করেছে, ভুল করার কারণও আছে, একে তো তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া নাই তারোপর ্ এক বাবার এক ছেলে হওয়ায় তাকে কখনও কোন সংসারের দায়িত্ব দেয়া হতো না। সারাদিন খেলাধুলা আর মাঠে মাঠে গরু চরানই ছিল তার কাজ। তারপরেও যতটুকু পেরেছে উত্তর দিয়েছে।
অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন, এমন প্রশ্ন আর উত্তর কি আসলেই সত্য নাকি বানানো গল্প। না ভাই বানানো গল্প না, বাস্তবেই এই প্রশ্নটি তাকে করা হয়েছিল। মোফাত ভাই এখনো বেঁচে আছেন। কয়েক বছর আগে ভাবিসহ মোফাত ভাইয়ের সাথে দেখা। গাছের নিচে বসে যখন তাকে জিজ্ঞাস করলাম, ভাই বলেন তো, এক শত টাকা মণ ধানের দাম হলে আড়াই শের ধানের দাম কত? আমার প্রশ্ন শুনে মোফাত ভাই হাসতে হাসতে বলল, পুরানো কথা এখনো তুই ভুলতে পারোস নাই, তুই আর শরম দিস না তো।
জীবনে অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছি অনেক কিছু দেখেছি কিন্তু এই বিয়ের মতো এমন ঘটনা আর কোন বিয়েতে খুঁজে পাই নাই। বিয়ের পুরো ঘটনাই স্মৃতি হয়ে আছে। এতো বছর পরও ঘটনাগুলো মনে পড়লে নিজে নিজেই হেসে থাকি।
(চলবে)
ছবি ঃ ইন্টারনেট