somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সেকালের কনে দেখা

০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

খাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। তখনও মেয়ে দেখা হয় নাই। মেয়ে দেখার জন্য বর পক্ষ থেকে একজন বললেন, বেয়াই, খাওয়া দাওয়া তো শেষ হইল, এখন আর বেলা মাইরা লাভ কি, আপনারা মেয়াডারে দেখান। বেয়াই বলার উদ্দেশ্য হলো এই লোকগুলোর সাথে আগে থেকেই আত্মীয়তা আছে। বরের দূর সম্পর্কের খালাতো বোনকে এই বাড়িতে আগেই বিয়ে দেয়া হয়েছে।

মেয়ে দেখানোর কথা বলায় মেয়ের চাচা বাড়ির ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বাড়ির ভিতর থেকে ফিরে এসে পাত্র পক্ষকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখি উঠান ভরা মানুষ। মেয়ে দেখা উপলক্ষ্যে গ্রামের অনেক মহিলা শিশু জড়ো হয়েছে। এদিকে আমরাও আট দশ জন। কনের বাড়ির বাচ্চাকাচ্চা, ভাই-ভাবি, বোন-বোনাই, চাচা-চাচী, খালা-খালু, ফুফা-ফুফুসহ আত্মীয় স্বজন মিলে এক দেড়শ’র কম হবে না। উঠানের মাঝখানে একটি বেঞ্চি পাতা আছে। আমাদের গুষ্ঠির সব চেয়ে বড় জ্যাঠা সদর আলী প্রামানিকসহ কয়েক জন সেই বেঞ্চিতে বসার কিছুক্ষণ পরেই কনেকে একটি কাসার তৈরী বাটা ভরা পান সুপারি হাতে দিয়ে দু’জন মহিলা সামনে এনে হাজির করল। কনের বয়স খুব বেশি বলে মনে হলো না। এগারো বারো বছরের হবে। এতো মানুষের ভিরে কনে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাওয়ার অবস্থা। চিকচিকে জরির লাল পেড়ে শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরা অবস্থায় এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে কনে যখন সামনে এসে দাঁড়ালো তখন পুরো শরীর শাড়ি কাপড়ে ঢাকা থাকায় কনের চেহারা দেখার সৌভাগ্য কারো হলো না। সদর আলী জ্যাঠা বলে উঠলেন, মেয়ার মুখ না দেখালে কেমনে বুঝমু মেয়া কালা, ধলা না বদশ্রী

জ্যাঠার কথা শুনে কনের পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা তাড়াতাড়ি ঘোমটা সরিয়ে মুখটা বের করে দিলেন। দেখতে মন্দ নয়, মোটামুটি ফর্সা এবং মুখটি গোলগাল। সেই সময় মেকাপের প্রচলন ছিল না। ন্যাচারাল চেহারা। তবে বোঝা গেল মুখে কোহিনুর শিল্পগোষ্ঠীর তৈরী তিব্বত ¯েœা মেখেছে। সেই আমলে গ্রামাঞ্চলে তিব্বত ¯েœা ছাড়া অন্য কোন ¯েœার প্রচলন ছিল না। ভ্যানিসিং ক্রিম কোল্ড ক্রিমের নামই কেউ জানতো না। কারো কপালে একটি তিব্বত ¯েœা জুটলে সে নিজেকে ধন্য মনে করতো। সে যাই হোক কনে মুখ মন্ডলে ¯েœা দেয়ার পাশাপাশি চোখে কাজল দিয়েছে। সেই আমলে চোখের কাজল কেউ টাকা পয়সা দিয়ে কিনতো না, কলার পাতার উল্টো দিকে সরিষার তেল মেখে জ¦লন্ত প্রদীপের শিখার উপর কিছুক্ষণ ধরে রাখলে যে কালি তৈরী হতো সেটাকেই কাজল হিসাবে মেয়েরা ব্যাবহার করতো। তবে কলার পাতায় কাজল তৈরী হলেও সেই কাজলেই মেয়েদেরকে অনেক রুপসী মনে হতো যা বর্তমানের দামী মেকাপেও খুঁজে পাওয়া যায় না।

যাইহোক, কনে চোখে কাজল দিলেও কাজল আঁকা চোখের চাহনি দেখার সৌভাগ্য হলো না। লাজ্জায় হোক আর ভয়ে হোক কনে একবারও চোখ তুলে তাকায় নাই। চোখের চাহনি দেখার জন্য বরপক্ষ থেকেও কোন প্রশ্ন করা হলো না। তখনকার পরিবেশ অনুযায়ী মেয়েরা এমনিতেই বয়স্ক লোকজনের সামনে মাথা নত করে থাকতো তারোপর কনে দেখা অনুষ্ঠানে চোখ তুলে তাকানো তো প্রশ্নই আসে না। আমি মনে করেছিলাম কনে যেহেতু চোখ বন্ধ করে আছে জ্যাঠা হয়তো এবার বলবে, মেয়া কানা না অন্ধ কেমনে বুজমু চোখ খুলতে কন। আমার ধারণা ভুল হলো, জ্যাঠা চোখ খোলার কথা না বলে বললেন, মুখ তো দেখলাম চুল তো দেখালেন না। মেয়ের মাথায় চুল আছে না নাইড়া কেমনে বুঝমু, চুল দেখান।

ঐ মহিলাটি আবার মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে শাড়ির নিচ থেকে খোপা বাঁধা চুলগুলো আলগা করে দেখালেন। চুল খুব লম্বা নয় তবে সেই সময়ের তুলনায় স্বাভাবিক ছিল। এর পরে আবার জ্যাঠা বললেন, মেয়ে খোড়া না ন্যাংড়া কেমনে বুজমু একটু হাটায়া দেখান। মহিলাটি কনেকে পাঁজাকোলা করে জড়িয়ে ধরে একটু হাঁটালেন। এরপর বললেন, এক বদনি পানি আনেন। জ্যাঠার কথামতো একজন তাড়াতাড়ি এক বদনা পানি নিয়ে এলে জ্যাঠা পুরো পানি দাঁড়ানো কনের সামনে মাটিতে ঢেলে দিয়ে বললেন, মা এই পানির উপরে একটু হাঁটোতো। মেয়েকে ধরে ধরে একজন পানির উপরে হাঁটালেন। জ্যাঠা উঠানে ছড়ানো পানির কাদায় মেয়ের পায়ের ছাপ দেখে বললেন, পাও ঠিক আছে, মেয়ে খরম পাইয়া না। এরপর মেয়ের চাচাকে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়ারে কোরান কেতাব কিছু পড়াইছেন। মেয়ের চাচা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, কন কি বেয়াই, মেয়া মক্তবে পড়ে। নিজেরা খাই বা না খাই মেয়ারে আল্লার কালাম শিখাইতে চেষ্টার ত্রুটি করি নাই। মেয়া অনেক আগেই কায়দা পড়া শ্যাষ করছে এখন পুরা সেপারা পড়বার পারে। জ্যাঠা বললেন, তাইলে মা তুমি আলাহামদো সুরা কও তো।

দৃশ্যটি আজো মনে আছে, যে মেয়ে লজ্জায় ভয়ে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সেই মেয়েকে সুর করে সুরা পাঠ করতে বলতেছে। এরকম পরিবেশে এই মেয়ে তো দূরের কথা কোন হাফেজ মওলানা সাহেবের গলা দিয়েও সুর করে সুরা কেরাত বের হওয়ার কথা না। তারপরেও মেয়ের মুখ থেকে সুরা কেরাত শোনার জন্য উপস্থিত সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। সে কিছু বলছে না দেখে পিছনে দাঁড়ানো মহিলারা তাকে বারবার তাগাদা দিতেছে, তুই না সেপারা পড়ছোস, আলাহামদো সুরা ক’। অনেক ঠেলাঠেলির চোটে মেয়ে চোখ বন্ধ করেই বলল, আউযু বিল্লা, বিসমিল্লাহ, বলেই বলল, আলাহামদো লিল্লা আর বলতে পারলো না। মেয়ে ভয়ে লজ্জায় কেঁদে দিল। কনের দুলাভাই সম্পর্কীয় একজনে বলে উঠল, আউযু বিল্লা, বিসমিল্লাহ যহন কইছে তাইলে ধইরা নেন কোরান শরীফও পড়বার পারবো।

এরপর জ্যাঠা আর কোন প্রশ্ন না করে ছেলে পক্ষের লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা কেউ কি মেয়ারে আর কিছু জিগাইবেন? বরপক্ষের লোকজন বলল, না আপনি যা জিগাইছেন এর পরে আর জিগানের কিছু নাই। বরপক্ষের কথা শুনে জ্যাঠা মেয়ের চাচাকে বললেন, আইচ্ছা, মেয়ারে নিয়া যান। মেয়েকে দুই তিনজন মহিলা ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে যাওয়ায় পরিবেশ অনেকটা স্বাভাবিক হলো। মহিলাদের জটলা কমে গেল। পাড়াপড়শী যারা এসেছিল তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে যাওয়ায় কিছু বয়স্ক পুরুষ মানুষ ছাড়া আর কেউ রইল না। এভাবেই মেয়ে দেখার পর্ব শেষ হলো।

এরপর মেয়ের চাচা বলল, আপনারা অনুমতি দিলে আপনাগো একটা কথা জিগাইবার চাই। একজন বয়স্ক মুরুব্বি বলে উঠলেন, কি জিগাইবেন মন খুইলা কন।
মেয়ের চাচা বললেন, মেয়া তো দেখলেন আপনাগো পছন্দ অপছন্দ নিয়া কোন কথা থাকলে একটু খুইলা কন।
জ্যাঠা মুরুব্বিদের মুখের দিকে তাকিয়ে কারো কোন প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে বললেন, মেয়া যা দেখলাম ভালোই দেখলাম। মেয়া নিয়া আমাগো আপত্তি নাই। বলেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে জ্যাঠা মেয়ের বাপ চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বিয়াই, মেয়া তো দেখলাম, এবার দয়া কইরা যদি আমোগো ছাওয়ালডারে দেহেন তাইলে খুশি হমু।
একজন বলল, বিয়া শাদীর ব্যাপার যহন ছাওয়াল তো দেহাই লাগবো।
জ্যাঠা বলল, ছাওয়াল দেখবার কবে যাইবার চান, তারিখ দেন।
মেয়ের চাচা উঠানের এক কোনে গিয়ে মেয়ের বাপ এবং জামাইদের সাথে একটু বোঝাপড়া করে এসে বললেন, আত্মীয়তা যদি আল্লায় লেইখা থাকে তাইলে আর দেরি কইরা লাভ কি, পরশুদিন শুক্রবার মগরোবের ওক্তে যাইবার চাই।
জ্যাঠা আর কোন বাড়তি কথা না বলে বললেন. ঠিক আছে তাইলে আপনেগো কথা মতো পরশুদিন শুক্রবারেই দিন তারিখ থাকল।

মোটামুটি বর দেখার তারিখ পাকাপাকি হওয়ায় সবাই বিদায় নেয়ার জন্য উঠিউঠি করছি, এমন সময় কাসার বাটা ভরা পান সুপারি নিয়ে একজন হাজির হলো। বুড়োরা শেষ মূহুর্তে আবার পান সুপারি মুখে পুরে চিবোতে চিবোতেই কনের বাপ চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা হলো। দু’একজনের সাথে কিছুদূর এসে রাস্তা ভিন্ন হওয়ায় আমরাও আমাদের বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
(চলবে)
ছবি ঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কামাল আতাতুর্ক: ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও স্বকীয়তা ধ্বংসকারী এক বিতর্কিত শাসক

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৪২

কামাল আতাতুর্ক: ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও স্বকীয়তা ধ্বংসকারী এক বিতর্কিত শাসক

তুরষ্কের বিখ্যাত আয়া সোফিয়া মসজিদের ছবিটি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) তুরস্কের ইতিহাসে এক প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=স্নিগ্ধ প্রহর আমার, আটকে থাকে স্মৃতিঘরে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:০০


কিছু স্নিগ্ধ প্রহর স্মৃতির ঝুলিতে বন্দি রাখি,
শহরের ক্লান্তি যখন ঝাপটে ধরে,
যখন বিষাদ ব্যথা আঁকড়ে ধরে আমায়,
স্বস্তি শান্তি দিয়ে যায় ফাঁকি
ঠিক তখনি উঁকি দেই স্মৃতিঘরে,
মুহুর্তেই সময় পরিণত হয় সুখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমা করো মা'মনি

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:২৩

এখন অনেক রাত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আইপ্যাডে নিউজ পড়ছিলাম আর সেহরির অপেক্ষা করছি। মাগুরার ছোট্ট শিশুটির হাসপাতালে জীবন-মরন যুদ্ধের খবর বিভিন্ন পত্রিকায় দেখছিলাম। মন থেকে চাইছিলাম মেয়েটি সুস্থ হয়ে যাক।

আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন: প্রতারকদের ভীড়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের সহায়তা কার্যক্রম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৪


জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত হওয়ার ভুয়া দাবি করে সহায়তার টাকা নিতে গিয়ে ফাঁস হয়েছেন মামি-ভাগনে ফারহানা ইসলাম ও মহিউদ্দিন সরকার। তাঁদের জমা দেওয়া এক্স-রে রিপোর্ট যাচাই করে দেখা যায়, দুটো... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামনে বিপুল, বিশাল চ্যালেঞ্জঃ মোকাবেলায় কতটুকু সক্ষম বিএনপি?

লিখেছেন শেহজাদ আমান, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



১. ভুল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, দূরদর্শিতার অভাব

বিএনপি বাংলাদেরশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। লোকবল ও জনপ্রিয়তায় তাঁর ধারেকাছেও নেই অন্যকোনো রাজনৈতিক দল। মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক ধারায় আছে বলেই বাংলাদেশের মধপন্থী ও উদারপন্থী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×