somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম দিয়েছিলেন। কলেজের স্কাউট হওয়ায় তিনিও ঐ ট্রেনিংয়ে যুক্ত হন। কলেজে রোভার স্কাউটদের ট্রেনিং করানোর জন্য অনেকগুলা কাঠের রাইফেল ছিল। অধ্যক্ষ ওয়াহিদ উদ্দিন আহমেদ কাঠের রাইফেলগুলো যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ছাত্রদের হাতে তুলে দিয়ে সহযোগীতা করেন। ঐ কাঠের রাইফেলগুলো দিয়েই গাইবান্ধা কলেজে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়।

সেই সময় বড় ভাই গাইবান্ধা কলেছে পড়ার জন্য শহরের খান ব্রাদার্স এর মালিকের বাসায় ভাড়া থাকতেন। সাথে থাকতেন ফুলছড়ি বাজারের রব্বানী ভাই (যিনি দেশ স্বাধীনের পরে গাইবান্ধা সোনালী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়েছিলেন)। কয়েকদিন পরে বড়ভাই গাইবান্ধা শহর থেকে গ্রামে চলে আসেন। গ্রামে এসে দেলোয়ার ভাই, আব্দুর রহমান ভাইসহ এলাকার অনেক ছাত্রদের একত্রিত করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একটি মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। তাদের এই চেষ্টার সফলতা স্বরুপ অনেক স্কুল কলেজের ছাত্র এসে স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দেন। স্বেচ্ছায় স্বর্তস্ফুর্তভাবে এই দলে যোগ দেয়ার কারণ হলো-- একদিকে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার প্রবল ইচ্ছা অপর দিকে অত্যাচারী লুটেরা পশ্চিম পাকিস্থানীদের কাছ থেকে পুরোপুরি এদেশকে মুক্ত করা। এদেশকে স্বাধীন করার জন্য ছাত্র জনতা মিলিতভাবেই সচেষ্ট হয়ে উঠে। তরুণ যুবকদের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করার আরেকটি কারণ হলো তখনো বাংলাদেশে কোন রাজাকারের সংগঠন তৈরী হয় নাই। শহর এলাকায় দালালদের অত্যাচার থাকলেও রাজনৈতিকভাবে কোন দালাল আমাদের এলাকায় তখনও ছিল না, দালাল না থাকায় স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিতে কেউ ভীতিবোধ করে নাই।

মুক্তিযুদ্ধের এই স্বেচ্ছাসেবক দলকে সহযোগীতার জন্য এলাকার কিছু গন্যমান্য ব্যক্তিও এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মোঃ সাফায়েত আলী প্রধান, সোলায়মান আলী প্রামানিক এবং দেলোয়ার হোসেন মাস্টার। সাফায়াত মৌলভী সাহেব প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। প্রথম দিন তিনিই ট্রেনিংয়ের উদ্বোধন করেন। এর পর ট্রেনিং করানোর জন্য মোঃ বণিজ মিয়াকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বণিজ মিয়া সেই সময়ের পাকিস্তান সরকারে ট্রেনিং প্রাপ্ত আনসার সদস্য ছিলেন। উনাকেই ট্রেনিং কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। বণিজ মিয়া আমাদের সিংড়িয়া গ্রামেরই লোক ছিলেন। আমাদের বাড়ি থেকে কয়েকশত গজ উত্তরে বাড়ি ছিল। তার শ^শুরের নাম আব্দুল আজীজ। উনি আব্দুল আজীজ মিয়ার বড় জামাই ছিলেন এবং শ^শুর বাড়িতেই থাকতেন।
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য মোটামুটি একটি সংগঠন দাঁড় হলে বণিজ মিয়া কমান্ডার হিসাবে প্রত্যেক দিন বিকাল বেলা কাতলামারী তহশীল অফিসের সামনে এসে হাজির হতেন। তখন অত্র এলাকায় আর কোন বড় মাঠ ছিল না। ফুলছড়ি থানার সিংড়িয়া গ্রামের কাতলামারী তহশীল অফিসের পূর্ব পাশে অনেক বড় একটি মাঠ ছিল। যে মাঠে গ্রামের ছেলেরা এসে ফুটবল, ভলিবল, দাড়িয়াবান্ধাসহ নানা ধরনের খেলাধুলা করতো, সেই মাঠকেই ট্রেনিং করানোর জন্য উপযুক্ত মনে করা হলো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই মাঠেই কয়েক গ্রাম থেকে ছাত্ররা এসে জড় হতো। ছাত্রদের মোটামুটি একটা সংখ্যা জমায়েত হলেই ট্রেনিং শুরু করতেন। এই ট্রেনিংয়ে নির্দিষ্ট কোন সদস্য সংখ্যা ছিল না গ্রামের ছাত্রদের উপস্থিতির উপরে সদস্য সংখ্যা কম বেশি হতো।

কমান্ডার বণিজ মিয়া প্রথম দিকে দুই তিনদিন লু্িঙ্গ পরে ট্রেনিং করালেও পরবর্তীতে তিনি আনসার বাহিনীর দেয়া খাকি পোষাক পরে আসতেন। তার পোষাকের সাথে ট্রেনিং করানোর হুইসেল বাঁশিও ছিল। কিছুদিন মুখে কমান্ড দিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ডিসিপ্লিন তৈরী হলে পরবর্তীতে তিনি বাঁশির হুইসেল দিয়ে কমান্ড দিতেন। অল্পদিনেই দক্ষ কমান্ডের কারণে মুক্তিযুদ্ধের এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীটি একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত হয়। লেফট রাইট, কুইক মার্চ, এবাউট টার্ন, স্ট্যাডার্ড আপ এইসব কমান্ড গুলো সবাই এতো সুশৃঙ্খল ভাবে পালন করতো-- দেখে বোঝাই যেত না একদল দামাল ছেলের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্য স্বেচ্ছায় নাম দেয়া একটি স্বেচ্ছাসেবক দল। তারা যখন পিডি প্যারেড করতো তখন তাদের পিডি প্যারেড দেখার জন্য গ্রামের অনেক লোক এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। উল্লেখ্য যে-- সে সময় বাংলায় কমান্ড দেয়ার প্রচলন খুব কম ছিল, ব্রিটিশদের শেখানো ইংলিশেই কমান্ড বেশি হতো। কারণ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষার পার্থক্যর কারণে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীদের কমান্ড ইংলিশেই চালু ছিল।

প্রথম ট্রেনিং শুরু হয়েছিল বাঁশের লাঠি দিয়ে। সবাই ট্রেনিংয়ে আসার সময় বাড়ি থেকে একটা করে মুঠো সাইজের তিনহাত লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে আসতেন। লাঠি ঘাড়ে নিয়েই রাইফেলের বিকল্প হিসাবে ট্রেনিং চলতো। বাঁশের লাঠি নিয়ে ট্রেনিং করে অল্প দিনেই একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী তৈরী হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো বাঁশের লাঠি নিয়ে লেফট রাইট করা গেলেও রাইফেল না থাকায় রাইফেলের প্রাকটিকেল যন্ত্রাংশের কোন কিছু শেখানো সম্ভব হতো না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমার বড় ভাই এবং দেলোয়ার ভাইসহ কয়েকজন ছাত্র গাইবান্ধা কলেজ গিয়ে রোভার স্কাউটদের ট্রেনিং করানোর জন্য যে কাঠের রাইফেলগুলো ছিল যেগুলো দিয়ে কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং চলতেছিল তারই একটি চেয়ে আনেন। এই কাঠের রাইফেলটি আনার পরে ট্রেনিংয়ের ধরন পাল্টে যায়। পিটি প্যারেড বাঁশের লাঠি দিয়ে হলেও রাইফেলের মেকানিকেল ট্রেনিংগুলো এই কাঠের রাইফেল দিয়ে শেখানো হতো। উল্লেখ্য যে-- যদিও এটা কাঠের রাইফেল ছিল তারপরেও এটা পুরোপুরি কাঠের ছিল না। বাট, বডি এবং ম্যাগজিন রাইফেলের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরী হওয়ায় দেখতে অবিকল রাইফেলের মতো ছিল শুধু বুলেট চালানোর জন্য বাস্তবে কোন ব্যারেল ছিল না। ব্যারেল অংশে পুরোপুরি কাঠ লাগানো ছিল। কাঠের ব্যারেলের ভিতরে কোন ছিদ্র না থাকায় রাইফেলের মেকানিকেল ট্রেনিং কাক করা, ট্রিগার চালানো, ম্যাগজিন খোলা লাগানোসহ অনেক কিছু শেখানো সম্ভব হলেও বুলেট লোড করে গুলি করার মতো কোন ট্রেনিং করানো সম্ভব হয় নাই। তারপরেও থ্রী নট থ্রী রাইফেলের ৮০% ট্রেনিং ঐ কাঠের রাইফেল দিয়েই কমান্ডার বণিজ মিয়া শিখিয়েছিলেন।

এই ট্রেনিংয়ে যারা অংশগ্রহন করেছিলেন নিচে তাদের অনেকের নাম দেয়া হলো--
১. মোঃ ইসাহক আলী গ্রামঃ সিংড়িয়া
২. মোঃ আব্দুর রহমান গ্রামঃ রতনপুর
৩. মোঃ দেলোয়ার হোসেন গ্রামঃ সিংড়িয়া
৪. মোঃ মজিবর রহমান গ্রামঃ সিংড়িয়া (আনসার সদস্য ছিলেন)
৫. মোঃ নজরুল ইসলাম গ্রামঃ কাতলামারী (বীর মুক্তিযোদ্ধা)।
৬. মোঃ রবিউল মিয়া গ্রামঃ গুনভরি উড়িয়া
৭. মোঃ হবিবর রহমান হবি গ্রামঃ কাতলামারী
৮. মোঃ আব্দুর রহমান গ্রামঃ কাতলামারী
৯. শ্রী কিশোরী বল্লভ গ্রামঃ সিংড়িয়া
১০. শ্রী বুধা মন্ডল গ্রামঃ সিংড়িয়া
১১. শ্রী সন্তোষ কুমার সরকার গ্রামঃ সিংড়িয়া
১২. শ্রী ভবতরন সরকার গ্রামঃ সিংড়িয়া
১৩. শ্রী হিরেন কুমার সরকার ওরফে বুধা গ্রামঃ সিংড়িয়া
১৪. মোঃ লুৎফর রহমান গ্রামঃ সিংড়িয়া
১৫. মোঃ জালাল মিয়া গ্রামঃ সিংড়িয়া
১৬. মোঃ শহীদুল ইসলাম প্রামানিক গ্রামঃ সিংড়িয়া
১৭. শ্রী নরেন্দ্রনাথ সরকার গ্রামঃ সিংড়িয়া
১৮. মোঃ নুরুল ইসলাম গ্রামঃ সিংড়িয়া

আরো অনেকে এই দলে মাঝে মাঝে অনিয়মিতভাবে ট্রেনিং করতে আসতেন (দুঃখের বিষয় এই মুহুর্তে তাদের অনেকের নাম মনে করতে পারছি না)।
(ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×