রোস্তম ফকির
(পর্ব -০৩)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
সারাদিন কেউ রোস্তম ফকিরের দেখা পেল না। সন্ধার পূর্বমূহুর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেই দালান ঘর থেকে আধা মাইল উত্তরে পাওয়া গেল। রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে পূর্ব দিকে মুখ করে পানির দিকে তাকিয়ে লাঠির গোরার অংশ মাটিতে ঠেকিয়ে উপরের অংশ নিজের ঘাড়ে হেলান দিয়ে দুই হাতে লাঠির মাঝখানে ধরে বসে আছে। মুখটি সুখনা। হয়তো সারা দিন খাওয়া হয়নি। রোস্তম ফকিরের সমবয়সী আকবার আলী কাছে এসে ডান পার্শ্বে বসে বলল, রোস্তম ভাই, সারা দিন কই ছিলেন?
রোস্তম ফকির জবাব দিল, ঐ উত্তর দিকে।
--- রিলিফ আনতে যান নাই?
--- না।
--- কেন?
--- ঐ চোরের দেয়া রিলিফ আমি নিমু না।
--- সারা দিন খাইছেন কিছু?
--- না।
--- ভিক্ষায় গেছিলেন?
--- না।
--- না খায়া কয় দিন থাকবেন?
--- আল্লায় যে কয় দিন রাখে।
--- রাইতে খাইবেন কি? ঘরে খাওন আছে?
--- না।
--- তাইলে এক কাজ করেন, সোজা আমার ডেরায় চইলা যান, আমি কয়া দিতেছি, আমার বউ চারটা গম দিলে ভাইজা খায়া নিয়েন। বুড়া বয়সে না খায়া থাকা ঠিক না।
--- গম কই পাইলেন?
--- চেয়ারম্যানের কাছ থিকা রিলিফ আনছি।
--- ঐ চোরের দেয়া রিলিফের গম আমি খামু না।
রোস্তম ফকিরের এরকম কথায় লোকটি খুব আশ্চার্য হলো। সারা দিন না খেয়ে আছে, ক্ষুধায় মুখ শুকিয়ে গেছে, তারপরেও চেয়ারম্যানের উপর থেকে তার জেদ কমছে না। বৃদ্ধ বয়সে চাল চুলোহীন ফকিরের প্রতিবাদী কণ্ঠ তার কাছে ভাল লাগলেও, না খেয়ে প্রতিবাদ করাটা ভাল লাগল না। তার এরকম জেদ আর কখনও দেখেনি। এর আগে ভিক্ষার জন্য মানুষ কত তাকে তিরস্কার করেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, প্রতিউত্তুর করতেও কখনও দেখা যায়নি। বৃদ্ধ হলে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়। রোস্তম ফকিরের আজ তাই হয়েছে।
আগে রোস্তম ফকিরকে দেখলে কেউ তার দিকে তেমন একটা তাকাতো না। গতরাতের ঘটনার পর থেকে ফকির যার সামনেই পড়ছে সেই একবার তাকে ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখছে।
রোস্তম ফকির আর আকবার আলীর কথাপোকথনের সময় কৌতুলবশতঃ অনেকেই সেখানে জড়ো হয়েছিল। কেউ কেউ বলল, রোস্তম ভাই, আপনি চেয়ারম্যানের কাছে যায়া মাফ চান। তাইলে আপনারে গম দিয়া দিব।
রোস্তম ফকির পিছন ফিরে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বলল, মইরা গেলেও আমি চেয়াম্যানের কাছে যায়া মাফও চামু না, ঐ চোরের গমও নিমু না।
পাশান নামের আরেক জন বলল, রোস্তম ভাই, আপনে চেয়ারম্যানরে বার বার চোর চোর কইতেছেন ক্যান? এটা হুনলে তো চেয়ারম্যান আপনারে বাইন্ধা পিটাইবো।
রোস্তম বলল, পিটানোর আর বাকী রাখছে কি? রাইতে আমরে পিটাইছে না?
নুরুন্নবী বলল, রাইতে তো পিটাইছে মাইরা ফালায় নাই। এবার পিটাইয়া মাইরাই ফালাইবো। আচ্ছা আচ্ছা মাইনষে হের সাথে জোড়া ধরে না। আর আপনি ফকির হয়া জোড়া ধরবার গ্যাছেন। আপনার আসলে আক্কেল নাই। বুড়া হইছেন তো হুস হারা হইছেন।
রোস্তম ফকির এবার রেগে গিয়ে বলে উঠল, এই হারামজাদা। তোরে উপদেশ দিবার কইছি। আমারে তোরা পাগল পাইছস -- না- -হ? যা হারামজাদা, আমি আর এইহানে থাকুম না। বলেই উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
লোকটি আবার বলল, থাকবেন কেমনে? নিজে খান ভিক্ষা কইরা, আবার চেয়ারম্যানরে কন চোর।
রোস্তম ফকির এ কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে ফিরে উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে হারামজাদা-- রোস্তম ভিক্ষা কইরা খাইলেও জীবনে কোন দিন চুরি কইরা খায় নাই। শালা চোরের দল, চেয়ারম্যানের সাফাই গাইতে আইছে আমার কাছে। বলেই সে দক্ষিণ দিকে হন হন করে চলে গেল।
তার চলে যাওয়ার ভাব দেখে অনেকেই হো হো করে হেসে উঠল। আবার অনেকে তার জন্যে দুঃখ করল। মধ্য বয়সী হযরত আলী ছেলে-ছোকরাদের ধমক দিয়ে বলল, এ-- ই- - তোরা ফকিররে ক্ষ্যাপাইতাছোস ক্যান হা- - হ-। একে তো ফকির তার উপর আধাপাগোল মানূষ, কখন কি কয় হুস নাই। একটুতেই চেইতা যায়। তারে উল্টাপাল্টা কথা কয়া আরো চেতাইতেছোস। বেশি চেতাইলে আবার না রাগে দুঃখে হার্ঠফেল কইরা মরে! লোকটির ধমকের পরে আর কেউ কোন কথা বলল। সবাই চুপচাপ যে যার জায়গায় চলে গেল।
সন্ধার পরে অনেকেই রোস্তম ফকিরকে খুঁজল, কিন্তু দেখা পেল না। কানু মন্ডল গরু রাখার জন্য যে ছাপড়া গোয়াল তুলেছিল তারই আড়ালে চুপ করে না খাওয়া অবস্থায় শুয়ে থাকল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ রাস্তার উপর বসে থেকে বেলা উঠার পর পর আস্তে আস্তে উত্তর দিকে রওয়ানা দিল। রাস্তায় যার সাথেই দেখা হলো সেই তাকে বলল, রোস্তম ভাই ভাল আছেন? কই যাইতেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।
রোস্তম ফকির এর আগেও এ রাস্তায় অনেক যাতায়াত করেছে। তবে আজকের মতো এতো কুশলাদি কখনও কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করে নাই। দুর্ধর্ষ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রিলিফ চুরির প্রতিবাদ করায় তার জনসমর্থন বেড়ে গেছে। রোস্তম ফকিরের নাম এখন অত্র এলাকার মানুষের মুখে মুখে। রোস্তম ফকিরের কাজের প্রশংসা মুখে উচ্চারণ না করতে পারলেও তার সাথে কথা বলে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে।
সারাদিন সারারাত না খাওয়া শরীরে রোস্তম ফকিরের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও সে ঐ ইউনিয়নের সীমানার ভিতর ধনী-গরীব কারো কাছেই ভিক্ষার আবদার করল না। তার ধারণা, ভিক্ষা চাইলে যদি চেয়ারম্যানের দেয়া রিলিফের গম বের করে দেয়। পণ করেছে না খেয়ে মরে গেলেও চেয়ারম্যানের দেয়া কোন কিছু সে গ্রহণ করবে না।
বয়সের ভারে ন্যুজ্ব তারোপর দুর্বল শরীর। অভুক্ত থাকায় একটু হাঁটলেই শরীর অস্থির লাগছে। একটু পর পর বসে জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করছে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সকাল ৮টা / ৯টার দিকে পাশের ইউনিয়নে গিয়ে পৌঁছল। সেখানে ভিক্ষা চাইলে দু’একটি ঘর থেকে ভিক্ষা দিলেও বেশিরভাগ লোকই নিষেধ করে দিল। বন্যার কারণে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে চাল ডাল সাথে আনে নাই। যে কারণে অনেকেই ভিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা থাক সত্বেও দিতে পারছে না। অনেকে আবার ভিক্ষা চাওয়ায় তিরস্কার করছে।
(--- চলবে ---)
গল্প ঃ রোস্তম ফকির (পর্ব-০১
গল্প ঃ রোস্তম ফকির (পর্ব -০২)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৪