(পর্ব-০১)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
রোস্তম ফকির সহজ সরল এবং কিছুটা হাবাগোবা ধরণের। নিজে কোন প্যাঁচের কথা বলে না, আবার প্যাঁচের কথা কেউ বললেও বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। তার হাঁটা চলার ভাব ভঙ্গি দেখে লোকে পাগল মনে না করলেও আধপাগল মনে করে। হাঁটার সময় ডান দিকে কাত হয়ে মাথাটা ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটে। খুব জোরেও হাঁটে না আবার খুব আস্তেও হাঁটে না, সবসময় একইভাবে হাঁটে। এখন বয়স হওয়ায় লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না। লাঠি ভর দিয়ে হাঁটলেও আগের মতই একই তালে হেঁটে বেড়ায়।
কিছুদিন আগে রোস্তম ফকিরের স্ত্রী পরপারে চলে গেছে। ঘরে কোন সন্তানাদি নেই। নিঃসন্তান রোস্তম ফকিরের একা সংসার। জমিজমা কিছু নেই। সরকারী রাস্তার পাশে ছোট একটি খড়ের ঘরে বসত। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কাজ করে খাওয়ার মত শরীরে তেমন তাগদ নেই। সারাদিন ভিক্ষা করে যা জোটে তাই নিজের হাতে রান্না করে খায়। যেদিন ভিক্ষা করতে পারে না, সেদিন না খেয়েই শুয়ে থাকে। ধার দেনা করে খাওয়া পছন্দ করে না। ভিক্ষা করে খেলেও চুরি-ছ্যাঁচড়ামি, দুর্নীতি, মিথ্যা কথা বলা মোটেই পছন্দ করে না।
আষাঢ় মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে অতিরিক্ত বন্যা হলো। সবার ঘর-বাড়িতে পানি উঠল। গেরস্তরা থাকা-খাওয়ার সমস্যার পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, ধান-চাল নিয়ে চরম বিপদে পড়ল। পানির উপর মাচা করে থাকার ব্যবস্থা করলেও, রান্নার ব্যবস্থা করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হলো না। গ্রামের পূর্ব পার্শ্বেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ। সবাই অগত্যা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, চাল-ডাল নিয়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নিল। অনেকেই আলগা টিন বা চাটাই দিয়ে বাঁধের উপরে থাকার জন্য অস্থায়ী ডেরা নির্মাণ করল।
রোস্তম ফকিরও এর ব্যাতিক্রম নয়। সেও একটি ছেঁড়া কাঁথা, একটি বালিশ, দুটি রান্নার হাঁড়ি ও ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বাঁধে গিয়ে উঠল। তার সমস্যা হলো, সবার ছোট খাটো ডেরা বা চাল থাকলেও তার মাথার উপর কোন চাল নেই। চাল তোলার মত কোন সামর্থ্যও নেই। রাতের বেলা বাঁধের উপর খোলা আকাশের নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকল। রাতের ভ্যাপসা গরমে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকতে রোস্তম ফকিরের ভালই লাগছে। উপরে তারা ভরা আকাশ দেখতে চমৎকার। লক্ষ লক্ষ তারার নয়ন কাড়া দৃশ্যের পাশাপাশি ঝিঁ ঝিঁ পোকা ও ব্যাঙের ডাক শুনতে মন্দ নয়। ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের সাথে তাল মিলিয়ে রোস্তম ফকিরও গুনগুন করে গান গাইতে লাগল। গান গাইতে গাইতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। খোলা আকাশের নিচে আরামেই ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু বাধ সাধল বৃষ্টি। হঠাৎ করে রাতের বেলা বৃষ্টি পড়া শুরু করলে অন্য সবাই শুণ্য আকাশের নিচ থেকে যে যার ডেরায় চলে গেল। কিন্তু রোস্তম ফকিরের কোন ডেরা বা চাল না থাকায় অন্যের ডেরায় আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। কোথাও মাথা গোঁজার ঠাই না পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের স্লুইস গেটের পাশে পাহারাদারের জন্য নির্মিত ছোট দালান ঘরের বারান্দায় গিয়ে উঠল।
দালান ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিলেও ঘুমানো সম্ভব হলো না। কারণ রোস্তম ফকিরের মত অনেকেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। যেখানে গাদাগাদি করে বসে থাকার জায়গা মেলে না, সেখানে ঘুমাবে কি করে? ভোরের দিকে বৃস্টি থেমে গেল। অনেকেই বারান্দা থেকে নেমে অন্যত্র চলে গেল। কিছুটা ফাঁকা হলে রোস্তম ফকির এই সুযোগে কাঁথা-বালিশের পোটলার উপর গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙে। বেলা বেড়ে গেলেও রোস্তম ফকিরের ভাগ্যে কোন খাবার জুটল না।
সকাল এগারটার দিকে ওই এলাকার ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সাহেব কিছু সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বাঁধে এলেন। তার এলাকার লোকজনের দুরাবস্থার খোঁজখবর নিলেন। অনেকেই তার কাছে নানা রকম অভিযোগ জানালো। তার মধ্যে বেশির ভাগ লোকেরই খাদ্য সমস্যা। বিশেষ করে গরীব মানুষগুলোর কোন কাজ-কর্ম নেই, তাই তাদের আয় রোজগার বন্ধ। খাদ্যের অভাবে অনেকের চুলা বন্ধ। চেয়ারম্যান সাহেব সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আমি এখনই ডিস্টিৃক্ট বোর্ডে যাচ্ছি, দেখি আপনাদের জন্য কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা করা যায় কিনা”। চেয়ারম্যান সাহেবের এমন কথায় বিপদগ্রস্থ লোকজন খুশিই হলো। সাহায্য সহযোগীতার আশ্বাস পেয়ে অনেকেই চেয়ারম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।
পরদিন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড থেকে কর্মকর্তা এসে পরিদর্শন শেষে দুর্দশাগ্রস্ত লোকজনের জন্য সরকারের ত্রাণ ভান্ডার থেকে দু’শ বস্তা গম বরাদ্দ করে গেলেন। চেয়ারম্যান সাহেব একদিন পরেই চারটি বড় বড় নৌকায় করে দু’শ বস্তা গম নিয়ে এলেন।
এলাকার মেম্বার এবং সাঙ্গ-পাঙ্গদের দ্বারা ত্রাণ বিতরণের জন্য একটা তালিকা পূর্ব থেকেই তৈরী করা ছিল। সেই তালিকা অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ করা হবে। তবে আজকে নয়, আগামী কাল সকাল দশটা থেকে। এতো লোকের মাঝে ত্রান বিতরণ করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। কাজেই আজকের এই পরন্ত বেলায় ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব নয়। চেয়ারম্যান সাহেব একজন দফাদারসহ তিনজন চৌকিদার গম পাহাড়ায় রেখে গেলেন। গম পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেই দালান ঘরেই মজুত থাকল। যাবার সময় চেয়ারম্যান সাহেব সবাইকে ডেকে বলে গেলেন, “আমার বিনা হুকুমে যেন একটা গমও কেউ নিতে না পারে। সবাই মিলে গম পাহারা দিবেন। কোন ক্রমেই যেন্ গম চুরি ডাকাতি না হয়”। এসব কথা যখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন তখন রোস্তম ফকির সেখানে উপস্থিত ছিল।
আকাশ মেঘলা থাকায় সে রাতেও রোস্তম ফকির দালান ঘরের বারান্দায় শুয়ে থাকল। আধপাগল ভিক্ষুক হিসেবে চৌকিদার দফাদাররা তার থাকার ব্যাপারে কোন বাধা দিল না। তার সাথে চেয়ারম্যানের সাঙ্গ পাঙ্গরাও শুয়ে থাকল।
গভীর রাতে মানুষের কানাঘুষার শব্দে হঠাৎ রোস্তম ফকিরের ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখে বিল্ডিংয়ের কাছে দু’টি নৌকা ভিরতেছে। রাতের আবছা অন্ধকারে নৌকায় বেশ কয়েক জন লোক দেখা যায়। রোস্তম ফকির ডাকাত মনে করে তাড়াতাড়ি চেয়ারম্যানের সাঙ্গপাঙ্গদের ডেকে উঠাল। অনেকে উঠল অনেকে উঠল না। অনেকে বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল, এই রোস্তম ভাই, আপনি ঘুমান তো!
রোস্তম ফকির জবাব দিল, হুঁ - - আমরা শুইয়া থাকমু, আর ওরা রিলিফের গম আমাগোরে চোখের সামনে দিয়া ডাকাতি কইরা নিয়া যাইবো, এইডা চাইয়া চাইয়া দেখমু। তোরা আমারে পাগল পাইছস? আমি এইডা হইবার দিমু না।
যারা বসেছিল, তাদের একজন শুয়ে থাকা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ চামচাকে জিজ্ঞেস করল, ভাই জানেন নাকি, এরা কারা?
সে জবাব দিল, এরা চেয়াম্যানের লোক।
-- চেয়ারম্যান কি আইতে কইছে?
-- হ-- আইতে কইছে।
-- কখন কইছে?
-- যাওয়ানের সময় আমারে ডাইকা কয়া গ্যাছে।
-- যদি অন্য কেউ হয়?
-- নৌকায় চেয়ারম্যান সাব নিজেও আছে।
-- সব মাল নিয়া যাইবো?
-- না, অর্ধেকের বেশি নিয়া যাইবো।
-- নিয়া কি বিলি করবো না বেইচা দিব?
-- বেইচা দিব।
-- মহাজন কেডা?
-- গঞ্জের কানু মহাজন।
চামচার মুখে একথা শোনার পর যারা উঠেছিল তারা আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু এই কথাপোকথন রোস্তম ফকিরের কানে গেল না। তারা কি বলতেছে সেদিকে সে খেয়ালও করল না। সে তার হাতের লাঠি নিয়ে যেমনি বসে ছিল তেমনি বসে রইল। এমন সময় নৌকা থেকে চার পাঁচজন লোক এসে দফাদারকে দরজার তালা খুলে দিতে বলল।
দফাদার জিজ্ঞেস করল, চেয়ারম্যান সাব নৌকায় আছে কি?
ওরা বলল, আছে, উনি নৌকায় বসা।
দফাদার বলল, ওনার কাছে তা হলে শুইনা আসি।
দফাদার নৌকায় গিয়ে উঠলে চেয়ারম্যান দফাদারকে ঘরের দরজা খুলে দিতে নির্দেশ দিলেন। দফাদার চেয়ারম্যানের কথা মতো তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। দরজা খোলার পর পরই আটদশজন লোক রুমের ভিতরে ঢুকে গমের বস্তা মাথায় নিয়ে বের হতে গিয়ে রোস্তম ফকিরের বাঁধার মুখে পড়ে গেল। সে লাঠি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, চেয়ারম্যানের হুকুম ছাড়া একটা গমও নিবার দিমু না।
তার হুঙ্কারে সবাই গমের বস্তা মাথায় নিয়ে থমকে গেল। তাকে কয়েকজন দৌড়ে এসে সরানোর চেষ্টা করল কিন্তু দরজা থেকে সে সরতে নারাজ। তার এক কথা, চেয়ারম্যান ছাড়া সে গম নিতে দিবে না।
একজন দৌড়ে নৌকায় গিয়ে চেয়াম্যানকে ঘটনা জানালো, চেয়ারম্যান নৌকার গুলুইয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সাঙ্গ-পাঙ্গদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ওই তোরা রোস্তম ফকিরকে আমার কথা বল, চেয়াম্যান নিতে কইছে, আর তারে কইয়া দে চেয়ারম্যান নৌকায় আছে।
দু’তিনজন এসে রোস্তম ফকিরকে চেয়ারম্যানের কথা বললেও রোস্তম ফকির তাদের কথা বিশ্বাস করল না। সে বলল, যদি চেয়ারম্যান নৌকায় থাইকা থাকে, তাইলে সামনে আইসা কইতে কও?
রোস্তম ফকিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে চেয়ারম্যান রাগান্বিত হয়ে নিজেই নৌকা থেকে নেমে আসলেন। রোস্তম ফকিরের সামনে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত হলেও কিছুটা সংযতভাবে বললেন, এই রোস্তম ভাই, আপনার কি হইছে, এরকম করতেছেন ক্যান?
রোস্তম ফকির বীরের মত বলে উঠল, দেখেন চেয়ারম্যান সাব, আপনে কয়া গ্যাছেন আপনের বিনা হুকুমে একটা গম কেউ নিবার পারবো না। কিন্তু এরা রাত কইরা চুরি কইরা গম নিয়া যাইতেছে। আপনে এদের বিচার করেন।
চেয়ারম্যান জবাব দিলেন, নিলে আপনের কি?
--- রিলিফের গম দশজনের হক। হগল মাইনষেরে ঠকায়া ওরা রাইতে চুরি কইরা নিব আর আমি চায়া থাকুম। এইডা কি হয়? আমি জান থাকতে একটা গমও নিবার দিমু না?
--- ওরা নিলে আপনের সমস্যা কি?
--- দশের মাল আমি নিতে দিমু না।
--- আমি নিতে কইছি, এবার নিতে দ্যান।
--- আপনে নিলে দিনে নিবেন, রাইতে নিবেন ক্যান?
--- এই ব্যাটা, আমি চেয়ারম্যান, আমার মাল আমি দিনে নিমু না রাইতে নিমু তোরে জিগায়া নিতে হইবো? আমার সামনে থাইকা সইরা যা ফকিরের বাচ্চা।
চেয়ারম্যান ধমক দিলেও রোস্তম ফকির পালোয়ানের মত বুক ফুলিয়ে বলে উঠল, আমার জান থাকতে একটা গমও নিবার দিমু না।
একথা বলার সাথে সাথে চেয়ারম্যান রোস্তম ফকিরের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, আর একটা কথা কবি তো জানে মাইরা ফালামু। ফকিরের বাচ্চা ফকির, খাস ভিক্ষা কইরা, আবার আমার সাথে বাহাদুরী করবার আইছস। আমি চেয়ারম্যান, মাল নিতে আইছি, তুই আমারে বাঁধা দ্যাস, সাহস তো কম না? ফকির বইলা এতক্ষণ তরে কিছু কই নাই। আর বেশি বাড়াবাড়ি করবি তো ডাকাতি কেসে পুলিশ দিয়া ধরাইয়া দিমু। জিন্দেগীতে আর জেলখানা থিকা বারাইতে পারবি না। বলেই সে সবাইরে ধমক দিয়ে বললেন, এই তোরা খাড়ায়া রইছস ক্যান। তাড়াতাড়ি মাল নিয়া নৌকায় উঠা।
মাল নৌকায় উঠানোর আদেশ দিয়ে চেয়াম্যান রোস্তম ফকিরের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে রাগে গজগজ করতে লাগলেন।
(--- চলবে ---)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:৪৬