শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
(মা দিবস উপলক্ষ্যে)
টঙ্গীর আশুলিয়ায় দু'টি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মরানাপন্ন অবস্থায় টঙ্গী হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল এবং ঢাকা মেডিকেল থেকে হোলিফ্যামিলী হাসপাতলে পৌঁছেছি। এব্যাপারে যুগান্তর পত্রিকার টঙ্গীর রিপোর্টার আর আমার অফিসের লোকজনের সহায়াতার কথা কোনদিনই ভুলতে পারবো না। সড়ক দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমার স্ত্রী ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছে। রাতেই গাইবান্ধা থেকে আমার ছোট ভাই, ছোট বোনসহ আত্মীয়স্বজন অনেকেই এসেছে। সুদূর গাইবান্ধা থেকে এত লোকজন ছুটে এলেও মাকে জানানো হয়নি। কারণ, মা ছেলে-মেয়েদের প্রতি খুবই দুর্বল। আমাদের সামান্য আহত অবস্থা দেখলেও কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলেন। সেই মানুষ যদি আমার সড়ক দুর্ঘটনায় মরানাপন্ন অবস্থার কথা শুনতে পায়, তাহলে হার্টফেল করতে পারেন। সেই অনুমান করে আমার দুর্ঘটনার কথা আমার ছোট ভাইবোনও জানায় নি।
কিন্তু বিধির সৃস্টি রহস্য বোঝা দায়! মায়ের নাড়ি-ছিঁড়ে জন্ম নেয়া সন্তানের খবর কেউ না দিলেও তার হৃদয়ে বিনা তারেই খবর হয়ে যায়। আমার মায়ের বেলাতেও এই নিয়মের ব্যাতিক্রম হয়নি। মা অস্থিরতায় ছটফট করতে থাকেন। এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে আমার খবর জিজ্ঞেস করেন। কেউ কোন উত্তর দিতে পারে না। উত্তর না দেয়ার কারণও ছিল, আমার সড়ক দুর্ঘটনার কথা মাকে যেমন জানানো হয় নি তেমনি আমার এলাকাতেও জানানো হয় নি। এ অবস্থায় মা তিনদিন অস্থিরতায় নাওয়া খাওয়া ভুলে এবাড়ি ওবাড়ি ছুটাছুটি করতে থাকেন। আমার ছোট ভাইও মাকে কিছু না বলে ঢাকায় চলে এসেছে। এতে মা আরো অস্থির হয়ে পড়েন। অবশেষে আমার কোনও খবর না পেয়ে নিজেই রিক্সা ভাড়া করে একা একা আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে উঠেন।
শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মা প্রথমেই আমার স্ত্রীর বড় ভাবীকে জিজ্ঞেস করেন। বড় ভাবী আমার খবর জানতেন। তিনিও সরাসরি দুর্ঘটনার খবর না বলে আদর আপ্যায়ন করে মাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার আদর আপ্যায়ন ব্যর্থ হয়। মা তার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই খচ্ছিলেন না। মায়ের ঘনঘন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বড় ভাবী উল্টো মাকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার মেজ ছেলের কিছু একটা সমস্যা হয়েছে এ খবর আপনি কোথায় পেলেন”?
মা সহজ সরল ভাবেই জবাব দেন, “তিন দিন হলো আমার অস্থির লাগছে, কোন কিছুই ভালো লাগছে না। আমার মন বলছে আমার ছেলেটার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে”।
আমার মায়ের এ কথা শুনে ভাবী আশ্চার্য হয়ে যান, আমার মায়ের সন্দেহ যে বাস্তব ঘটনা এটা তিনি কিভাবে বুঝলেন! তিন দিন হলো তার মনে অস্থির লাগছে অথচ আমার দুর্ঘটনাও তিনদিন হলো হয়েছে।
বড় ভাবী আমার মায়ের দুর্বলতা কিছুটা জানতেন, তাই তিনি সরাসরি আমার দুর্ঘটনার কথা না বলে বললেন, “আপনার মেঝ ছেলের সামান্য সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছিল এখন ভাল হয়েছে”। এটুকু শুনেই মা ভাবীকে বলেন, “আমার ছেলের সামান্য দুর্ঘটনা নয় গো বড় কিছু হয়েছে। সামান্য দুর্ঘটনায় আমার মন এমন অস্থির হওয়ার কথা না” বলেই মা ডুকরে কান্না কাটি শুরু করেন। ভাবী মাকে অনেক চেষ্টা করেও শান্ত করতে পারছিলেন না। পরে অনেক চেষ্টায় শান্ত করে বাসায় এনে রেখে যান।
প্রায় আড়াই মাস হাসপাতালে চিকিৎসার পর হাত পায়ের হাড় হাড্ডিতে লোহালক্কড় লাগানো আধা ভাঙা দেহ নিয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরে মায়ের এমন কাহিনী শুনে আমিও আশ্চার্য হয়ে যাই। এ যেন মায়ের নাড়ি-ছেঁড়া সন্তানের সংযোগ বিহীন সংযোগ। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই সন্তান থাকে না কেন, ইথারে সিগন্যাল পৌছার আগেই মায়ের কলিজায় খবর পৌছে যায়। ছেলের সাথে মায়ের এই সংযোগ আর কারো হৃদয়ে নাই।
আমার সেই সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। মা মারা গেছেন। এখন যত বিপদেই পড়ি না কেন, মা নেই আর কেউ আমার জন্য অস্থিরতায় ছটফট করবে না। যে মায়ের হৃদয়ে দুর্ঘটনার খবর পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই সন্তানের সুস্থ্যতা কামনা করে প্রার্থনা করতো, এখন আর কেউ সেই প্রার্থনা করবে না। আমার মায়ের হৃদয়ে আমার খবর যে ভাবে পৌছাতো, সেভাবে আর কারো হৃদয়ে পৌছাবে না। মা পরপারে চলে গেছেন সেই সাথে ছিন্ন হয়েছে মোর নাড়ির বন্ধন।
(ছবি ইন্টারনেট)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ রাত ১০:৫৩