somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জিললুর রহমানের তিনটি বই

০১ লা মার্চ, ২০১০ দুপুর ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক ফেব্রুয়ারিতে তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ বাংলাদেশের যে কোন লেখকের জন্য একটি বিরল ঘটনা । আর তিনি যদি প্রান্তবর্তী (ঊভয়ার্থে ) কেউ হন তাহলে তো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফেব্রুয়ারির উল্লেখ এ কারণে যে বাংলাদেশে প্রকাশনার স্স্ফুর্তি ঘটে মূলত এই ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমী কেন্দ্রিক মাসব্যাপী যে অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় তাকে ঘিরেই। এই ফেব্রুয়ারিতে লিরিক থেকে প্রকাশিত হয়েছে উত্তর আধুনিক কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক জিললুর রহমানের কবিতা, প্রবন্ধ এবং অনুবাদ মিলিয়ে তিনটি বই যথাক্রমে “শাদা অন্ধকার” , “অমৃত কথা” এবং “আধুনিকোত্ত্বরবাদের নন্দনতত্ত্ব কয়েকটি অনুবাদ”।

শাদা অন্ধকার
বিগত দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে রচিত কবিতার সংকলন “শাদা অন্ধকার” । “শীত মানে তো শীতের ব্যাপার” এর রচনাকাল ১৯৮৭ আর “হোলি উৎসব” এর রচনাকাল ২০০৯। এ তথ্যগুলো কবি জিললুর রহমানের কাব্যচর্চার কাল পরিধি সম্পর্কিত ধারণাকে বিবৃত করে মাত্র। এ নাতিদীর্ঘ কাব্যযাত্রাকালে “শাদা অন্ধকার” তাঁর দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অন্যমন্ত্র” থেকে “শাদা অন্ধকার” নিমার্ণের মাত্রায় ও বিষয়াকরণের উপলব্ধিতে বিশিষ্ট, উচ্চারণের বাচনিক সাযুজ্য সত্বেও। এ বইতে পরিসরের দিক থেকে ছোট ও বড় মিলিয়ে কবিতা সংকলিত হয়েছে মোট ৩৬টি। গ্রন্থনাম শীর্ষক কবিতাটির অনুপ্রেরণার উৎস নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক হোসে সারামাগো এবং এটি তাকেই উৎসর্গীত। গ্রন্থিত কবিতাগুলোয় জিললুর রহমান এমন সব ষঙ্গ-অনুষঙ্গকে তাঁর কাব্যাখ্যানে আত্মিকৃত ও বিন্যস্ত করেছেন যা আমাদের চেনা পরিবেশ ও প্রতিবেশের দৈনন্দিনতায় আকীর্ণ কিন্তু ভিন্নতর অর্থ ও পরিসরের দ্যোতনায় ভাস্বর। তাই তার কবিতার চেনা সুর ও স্বর, শব্দ কি চিত্রকল্পের প্রক্ষেপণ পাঠককে ভাবনার ভিন্ন কোন স্তরে উন্নীত করে , শীষ দেয় পাঠকের মগ্ন চৈতন্যে। কখনো ব্যক্তিগত ভ্রমণ অভিব্যক্তির প্রকৃতিকে অতিক্রম করে যান সমষ্টির ভ্রমণশীলতায়। একদিকে যেমন কর্মব্যস্ত বর্হিমুখ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিচ্ছেদ কাতরতার ঘাটে তেমনি প্রকৃতির অপরূপ লাবণ্যশোভা কি ভয়াল সুন্দরেও বিমোহিত হয়ে পড়েন কবি জিললুর রহমান। তারই আভাস পাই “শাদা অন্ধকার” এর নানান কাব্যাকল্পে। এ যেন নিরন্তর ভ্রমণ বা বারবার ফিরে ফিরে আসা নানান বিকল্প থেকে নিজ অন্তপুরে আত্ম আবিষ্কারের পরিধি পেরিয়ে। তাই তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয় সমতলে প্রবাহমান জনস্রোতের অনন্ত সলিল, পহাড়ী ঝোরার গা থেকে গড়িয়ে পড়া কান্নার অতিপ্রাকৃত রহস্যময় শব্দের অলংকার। প্রান্তিক মানুষের বিশ্বাসের বিন্দু ছুঁয়ে তাই গড়ে ওঠে তাঁর কবিতার শরীর।এই একাকী যাত্রায় কবি দেখতে পান সফেদ আধাঁরের রূপ তাই তিনি পাঠককে সহযাত্রী হতে প্ররোচিত করেন তাঁর কাব্য প্রকল্পনায়। “শাদা অন্ধকার” এর বিষয় ভাবনাকে প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় উদ্ভাসিত করেছেন শিল্পী ঢালি আল মামুন।

অমৃত কথা

গদ্য বয়ানে “অমৃত কথা” কবি জিললুর রহমানের দ্বিতীয় প্রবন্ধ প্রকল্প । প্রথম প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে “উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায় ” শিরোনামে যার আলোচনার পরিধি সমীতি ছিল তাত্ত্বিকতায়। বর্তমান সংকলনে কিছু তত্ত্বিক সমীক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে স্মৃতির মুকুরে ভেসে ওঠা যাপিত জীবনের সঙরাগ। অথবা বলা যায় আরো বিস্তারে কবি জিললুরের বিকাশ পথে প্রকাশের প্ররোচনা যেসকল অধ্যায় রচনা করেছে তার কিছু চলচিত্র এতে পাওয়া যায়। মোট আটটি শিরোনামের অধীনে সংকলিত গদ্য রচনা সমূহের বিষয় বিন্যাস হলো “কবিতা কবিতা”, “ফেরির ফেরারি”, “লিটল ম্যাগাজিন : সমস্যার নানা প্রেক্ষিত”, “আমার মিলন দা”, “অন্তর বাজে তো যন্তর বাজে”, “আড্ডার খোঁজে”, “ এখন সে সব স্মৃতিকথা..”, “সবুজ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহংকার”।
গদ্যের স্বকীয় ভঙ্গিতে কবিতার অন্তর সন্ধান যেমন করেন “কবিতা কবিতা” প্রবন্ধে তেমনি প্রশ্নের মতো করে নিজেকেই বুঝি শুধান নানান অমীমাংসিত বিষয়ের উত্তর। কর্মজীবনের বাস্তবতা কবিকে টেনে নিয়ে গেছে জীবনানন্দের দেশে। নিত্য সে ভ্রমণের কেজো ক্লান্তির সাথে যেমন যুক্ত হয়েছে প্রিয় পরিজনের বিচ্ছেদ কাতরতা আর মিলনের আকুলতা তেমনি কবির পর্যটক চোখ খুঁজে ফিরেছে ভোরের অরুণোদয়ের অনুপম প্রশান্তি কী রাতের চন্দ্রালোকের ভাসমান রহস্যময়তা। এ সব ভ্রমণ-অনুপুঙ্খের প্ররোচনার দায় তার নানান কবিতায় যে অনুদিত হয়েছে তার সংযোগসূত্র আবিষ্কারের ভার ভাবি জিললুর গবেষকের জন্য তোলা থাক। কবি জিললুর রহমান দীর্ঘ সময় ধরে ছোট কাগজ লিরিক এর সাথে সম্পৃক্ত। ছোট কাগজ বিষয়ক ভাবনা “লিটল ম্যাগাজিন : সমস্যার নানা প্রেক্ষিত” এ সন্নিবেশিত হয়েছে। সৃজনশীল ব্যাক্তি মানুষের সাহচর্য কিভাবে আরেকজন সৃজনশীল মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে “আমার মিলন দা” তারই বয়ান। উত্তর আধুনিক দর্শন চেতনার ভাব সমণ্বয়ে বাংলা কবিতার বদলে যাওয়া বিষয়ক একটি রেখাচিত্র “অন্তর বাজে তো যন্তর বাজে”। কর্ম উপলক্ষে সিলেট বাস এর অভিঘাতে সৃষ্ট নিঃসঙ্গতা অতিক্রমণের অভিপ্রায়ে নানান আড্ডা পর্যটন। এবং কবিতার ভিন্নমাত্রিক নিমার্ণ পরিপ্রেক্ষিতের সুলুক সন্ধান মিলবে “আড্ডার খোঁজে”-এ। “ এখন সে সব স্মৃতিকথা..” বা “সবুজ আমার অমৃতের একগুচ্ছ অহংকার” এই দুটো লেখায় ও খুজে পাওয়া যাবে জিললুর রহমানের কবি হয়ে ওঠার পূর্বাপর। এই বইটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে কবি জিললুর রহমানের কাব্যগ্রন্থের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে পাঠক হয়ত অন্যকোন পাঠব্যঞ্জনায় উপনীত হতে পারেন যেখানে ভিন্নতর রসের সন্ধান মিলবে সুনিশ্চিত। সুদৃশ্য প্রচ্ছদে সেই স্মৃতিময়তার আবহ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী তাসাদ্দুক হোসেন দুলু।

আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব কয়েকটি অনুবাদ

এই গ্রন্থে সংকলিত অনুদিত প্রবন্ধ গুলোর পুনঃপাঠ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেই সব উন্মাতাল বেড়ে ওঠার দিনে। পুরো নব্বই দশক জুড়ে বাংলা কবিতার যে স্বকীয় সত্ত্বাকে খুঁজে ফেরা উত্তর আধুনিক সচেতনতা বা দর্শন চর্চার ভিতর দিয়ে তারই প্রয়োজন সৃষ্ট অনুসন্ধিৎসায় বিচরণ বর্হিবিশ্বের সমসাময়িক জ্ঞানতত্ত্বে। যার প্রায় পুরোটাই ধারণ করেছে ছোট কাগজ “লিরিক”। সেই সময়ে এ সকল বিদেশী রচনার বাংলা অনুবাদের প্রাসঙ্গিকতা আজো অটুট । সবগুলো প্রবন্ধের অনুবাদ একই মলাটে পাওয়ার সুবিধে হলো এই যে বিষয়ের দিক থেকে এগুলো একটি পুর্ণাঙ্গ ধারণা তৈরী করতে সক্ষম। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে কেবল মেধার গুণে ভিনদেশী সাহিত্য পাঠ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করা চলে কিন্তু সেটি সর্বসাধারণের পাঠ সীমায় আনতে গেলে মাতৃভাষায় অনুবাদে যে সময় ও পরিশ্রম জরুরী সেই দুরূহ কাজটিও অনুবাদক জিললুর রহমান করেছেন অবলীলায়। সেটি মূলত সম্ভব হয়েছে ঐ ছোট কাগজের প্রতি অপরীসিম দায়বদ্ধতার কারণে। প্রবন্ধগুলোর অনুদিত শিরোনাম এবং মূল লেখকদের নাম সমকালীন বাস্তবতায় তাদের প্রাসঙ্গিকতাকে অনিবার্য করে তুলে। সংকলিত অনুবাদ প্রবন্ধগুলো হলো ইয়রগেন হ্যাবারমাস এর “আধুনিকতা - একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প”, “আধুনিকোত্তরবাদের কাব্যতত্ত্ব” লিন্ডা হাচিওন, “আধুনিকোত্তর ও বিলম্বিত আধুনিক” চার্লস যেঙ্কস, টেরি ঈগলটনের
“ আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব”, “সাবঅলটার্ন কথা বলতে পারে কি?” গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এর রচনা। এই অনুবাদ গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী তাসাদ্দুক হোসেন দুলু।

এই বই তিনটির সম্মিলিত পাঠ বইগুলোর রচয়িতা জিললুর রহমান ও তার লেখক মানস সম্পর্কে পাঠক সাধারণের কাছে একটি সামগ্রিক ধারণা তৈরীতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। বইগুলোর বহুল পাঠ ও সামগ্রিক সাফল্য কামনা করি।

(দৈনিক পূর্বকোণের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত)
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×