ঃ মানুষ অমর নয়, পৃথিবী অক্ষয় নয়- বিজ্ঞান এবং ধর্ম দু’তত্ত্বই সে রূপ বিবৃতি দেয়। আসলে স্বতঃসিদ্ধ বলে কিছুই আর থাকেনা তাই, সকলই এবং সবই পরিবর্তনশীল, রূপান্তরই চরম বাস্তবতা। মানিস আর নাই মানিস। কেবল মাত্র আমাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতার কারনেই আমরা অনেক কিছুই স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেই। আমাদেরই সুবিধার জন্য। আপাত স্থায়ীত্ব স্থায়ী করা জন্য। তাই আইন যত আমারা দেশকাল পাত্র স্থান আর পরিবেশ সমাজ ভেদে তৈরী করে নিয়েছি এই জগতের মানবকূল তারও নিশ্চিত কোন স্বতঃসিদ্ধ স্থায়ীত্ব নেই। যে জিনিসের স্বতঃসিদ্ধ ভিত্তি নেই সেই আইন দ্বারা এক মানুষ আরেক মানুষের বিচার কিভাবে করতে পারে? আমার বোধগম্য হয়না। আইন ই মানবতার সবচেয়ে বড় ডেসট্রয়ার, অবিবেচক অন্ধ শাসক।
ঃঃ ওমন বলিস না বন্ধু, রাষ্ট্রদ্রেহীতা হয়ে যাবে। আইন না থাকলে খুব ভাল হতো, তাই না? যথেচ্ছা সেচ্ছাচারিতা হতো , অরাজকতা হতো। তখন তোর ঐ বস্তা পচা জ্ঞান কি বুলি আওরাত, হু?
ঃ আরে আইনই তো সবচেয়ে বড় অরাজক। কেনো তোার আইনী দলের বিজ্ঞরাই তো বলে বেড়ায় , আইন নাকি অন্ধ। সে শুধু শোনে। আমিও মানি, আসলেই তো আইনের কথা গুলো সমসাময়িক পরিস্তিতিরি উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা, কিন্তু সেই ভিত্তি সময় এর সাথে দূর্বল হয়ে ওঠে, কিন্তু অন্ধ চোখে সে ঘুন কে দেখে, বল।
ঃঃ তা বন্ধু তুই উল্টো পাল্টা যাই বলিস না কেনো, আমি মানবো কেনো।উদারহ তো দিতে পারছিসনা। আইন না থাকলে কি হতো -- আমি কিন্তু ভরি ভরি উদাহরণ দিতে পারব।
ঃ থাক , সব আমার জানা আছে। উদাহরণ চাস তো , খুব সাধারণ একটা উদাহরণ ই দেবো। তবে তোর মানার জন্য নয়। পাঠকের জন্য কেবল। কেবল জানার জন্য। আইনের সাথে পেরে উঠবে না। তাই মেনে কিছু হবেনা।
একটু অতীতে ফিরে যাই চল, মনে পড়ে বন্ধু সেই সে ছেলেটার কথা , শাকিল নামে সে পরিচিত ছিল। তার মা কাজ করত আমাদের বাসায়। ওরা থাকত আমাদের গলিটার পরে ঐ যে বাজারের পরের বস্তিটাতে। হয়তো ভুলে গেছিস । যাক , ওর জন্ম হয়েছিল ঠিক আমার জন্মের সাত দিন পরে। ওর মা বস্তির অন্য একটা ছোট মেয়েকে আমাদের বাসায় পারমান্টে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল আর উনি আসতেন দিনে একবার কঠিন কাজগুলো করে দিতে।
হয়তো সে বস্তির ছেলে দেখে সেভাবে মেশা হয়নি। কিন্তু চেনা জানা ছিল শাকিলের সাথে। দেখতাম আমি স্কুলে যাবার পথে, ও কাজ করতো রিকশার গ্যারেজে।
কাশ টেনে ওটার পরে আমি যখন কোচিং করতে যেতাম বড় রাস্তার ধারে হাসান আলী স্যারের কোচিং সেন্টারে আর গোপনে সুদীপ্তার হাসিটুকু চুরি করে মনটাকে ভরাতে।
সুদীপ্তা নামের মেয়েটিও কোচিং করতে আসত রোজ। আমার পরের ব্যাচে।
তখন আবার সেই শাকিল কে দেখতাম ওখানে একটা স্পিনিং মিলে কাজ করত। সামনে পড়লে ও আমাকে লম্বা একটা সালাম দিত। আমি বলতাম কিরে কেমন আছিস?
এইতো ক’দিন আগেই তখন এস এস সির জন্য ফরম ফিলাম করলাম। জন্ম তারিখ এক বছর কমিয়ে দিয়েছিলাম, তাতে সে কোচিং এ সুদীপ্তার সামনে বুক কাঁপার মত যথার্থ বয়সই ছিল, মাত্র ১৪ বছর এক মাস। বাস্তবে বয়স ছিল ১৫ বছর এক মাস। সে হিসেবে শাকিলের বয়সও হবে সেই একই , মাত্র সাত দিনের ছোট যে ছেলেটি।
সেদিন ছিল সোমবার , স্যার ১০/১৫ মিনিট আগে ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সুদীপ্তার জন্য আমি তখনও দাঁড়িয়ে ছিলাম । উপযুক্ত কারন ও ছিল। আমার কাছ থেকে ইংরেজীর নোটটা নিয়েছিল গত পরশু । আজ ফেরত দেয়ার কথা। ও এর মধ্যে সুদীপ্তাই আমার সাথে পরিচিত হয়েছিল, আমার সাহস হতো না কোনদিন। সে যা হোক। আমি অপো করা জন্য পাশের একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কোক খেতে লাগলাম। এখনের এইসব সিগারেটের অভ্যেস করার মত মনসাহস বা অন্তস্থ ইচ্ছা জাগার বয়স বোধহয় তখনও হয়নি।
শাকিলের সাথে দেখা হয়েছিল ওখানেই। সাথে আরেকটা ছেলে ছিল । সূতোর টানে হাত কেটে রক্ত ঝরছিল ছেলেটার। শাকিল নিজের গায়ের জামাটা খুলে চেপে ধরে রেখেছিল ওর কাটা জায়গাটা। ডাক্তার খানায় ঢুকছিল। আমি দৌড়ে গেলাম। একটা সেলাই লেগেছিল , তেমন বেশী কিছু নয়। শাকিল খুবই উদ্বিঘœ ছিল। ওর সবচেয়ে ভাল বন্ধু ঐ ছেলেটা , নাম ছিল খায়রুল।
নিয়তির টুইস্ট দেখ, ওরা দু’জন আবার কাজে চলে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম সুদীপ্তার সাথে, মানে ঐ বলছিল, আমি হাল্কা কম্পিত হচ্ছিলাম । ঠিক সেই সময় প্রচন্ড চিৎকার। পাশের মসজিদটাতে মাত্র জোহরের নামায শেষে মুসুল্লিরা বের হচ্ছিল। সুদীপ্তা স্যারের বাসায় ঢুকে গেলো আর আমি ছুটে গেলাম ভিড়ের দিকে , ভিড়টা ছিল শাকিল যে মিলে কাজ করত তার পিছনের দিকে। সুদীপ্তা বলেছিল ভিড়ে যেও না, বাসায় চলে যেও। আমি ওর কথা রাখিনি। উহ! সেই বিভৎস চেহারাখানা একটু আগে দেখা সেই খায়রুলের তাহলে দেখা হতোনা। দেখার দরকার ছিল। পৃথিবীতে অনেক কিছুই দেখে রাখা দরকার। এড়িয়ে যাওয়ার নাম কখনই জীবন হতে পারেনা।
আকাশের দিকে মুখ করতেই শাকিল কে দেখলাম, অনঢ় অবাক, বিহ্বল দাঁড়িয়ে পাঁচ তলার উপরে ছাদেও কোনায়। ওখান থেকেই পড়ে গেছে খায়রুল, কে যেন বলল , ঐ যে ঐ ছেলেটা ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে...
খায়রুলের বাবাও কাজ করত ঐ মিলে, তিনি এক সিবিএ নেতার চামচা জাতীয় পদার্থ, পরে সব জেনেছিলাম। পুলিশ আসার আগেই শাকিলকে বাঁধা হয়েছিল মিলের ভেতর। আমি ঢুকতে পেরেছিলাম। মিলের ম্যানেজার আমাকে চিনত কোন এক কারনে। শাকিল বলছিল ভাইয়া , আমি কিছু করিনাই, আমি তো বরং ওরে বাঁচাইতে গেছিলাম, পারলাম না ভাইয়া, আমার চোখের সামনি ও ...
আমিও শুনতে পারলাম না, বললাম সব ঠিক হয়ে যাবে। ছাদে দুপুরের লাঞ্চ খাচ্ছিল যে মেয়েগুলো তাদের অনেকেই নিশ্চুপ ছিল কোর্টে পরবর্তীতে যদিও ঐ সময় অনেকে বলছিল, ওর কোন দোষ নাই, খায়রুল হঠাৎ মাথা ঘুইরা পইড়া গেছেগা...
তখনতো অত বুঝিনাই, কিন্তু আজ তো বুঝি...
পুলিশ চার্জশীটে ওর বয়স দিয়েছিল ১৯ বছর। না হলে যে জুভেনাইল কোর্টে চালান করার কথা। জুভেনাইল আইনের আওতায় ফেলালে পুলিশের নানান হয়রানী হতো। জুভেনাইল কোর্ট করে আলাদা বিচার করতে হতো। হাজতে অন্য আসামীদের সাথে রাখা যেতনা। দোষী সাব্যস্ত হলেও সংশোধন করা জন্য কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠাতে হতো।
এক খোঁচায় আঠারো বছর দেখিয়ে দিয়ে পূর্ণ বয়স্ক বানানো হলো আমারই সেই সময়ের বয়সী এক কিশোরকে।
সবচেয় আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো কোর্টের যে জর্জ ঐ বিচার করছিলেন, তিনি ছিলেন সুদীপ্তার বাবা এবং আমার বাবার বন্ধু। বাবা আমার পিড়াপিড়িতে জর্জ আঙ্কেলকে বলেছিলেন শাকিলের ব্যাপারে। সুদীপ্তও বলেছিল। ওতো চিনত শাকিলকে। কোন লাভ হয়নি। বয়সটাতো প্রমান করাই যায়নি। মিলের চাকুরীতে যে অষ্টম কাশ পাসের সার্টিফিকেট দেয়া ছিল তাতে বয়স হিসেব করলে ১৯ই হয়। সেখানে শাকিলের সই, তার বাবার সই স্পষ্ট ছিল। আর ছিল এজকটা স্কুলের হেডমাষ্টারের সইও। হায়রে দেশ, জন্ম নিবন্ধন থাকলে কি সুবিধাই না হতো তখন। আমারা, মানে আমার মা, আর অনেকে কোর্টে গিয়েও বলেছে ও আমারই সম বয়সী, প্রমাণ করা যায়নি। সুদীপ্তারাও তো এই মফস্বলের এই পাড়ায় কত বছর ধরে। ওনারাও জানে শাকিল এর জন্ম আমার ই সাথে একই বছর। কিন্তু আইন যে মানুষের কথা বোঝেনা।
জুভেনাইল কোর্ট হলোনা। বরং স্বাক্ষী জুটে গেলো , কে কে যেন দেখেছে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে খায়রুলকে। খাওয়ার নিয়ে নাকি ঝগড়া হয়েছিল, এমন একটা ঘটন্ওা বানানো হলো। ওর সহকর্মী কজন বেশ কাঁদছিল। আমাকে বলেছিল তারা , ঝগড়া তো দূরের কথা -খায়রুলকে সেদিন বরং মুখে তুলেই খাইয়ে দিয়েছিল শাকিল। আমিও সেটা বিশ্বাস করি। কিন্তু আইনএর কাছে বিশ্বাস অবিশ্বাস ভ্রান্ত। সে যে অন্ধ।
একটা ১৫ বছরের কিশোরের যাবৎজীবন কারাদন্ড হয়ে গেলো।
হাইকোর্টে যাওয়ার মতো পয়সা শাকিলের মার ( বাবা ছিলনা ওর, ছেড়ে গেছে অনেক আগেই) ছিলনা। তবুও আমার বাবা আর অন্য কয়েকজন আপীলের খরচ দিয়েছিল। কিন্তু ভিওে পয়সায় কতদূও আর! সেই একই শাস্তি রয়ে গেলো।
আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। শুনলাম। আমিও অন্ধ হয়ে গেলাম আইনের মত। ভুলেও গেলাম এক সময়।
কিন্তু মনে পড়ল কেনো জানিস। ক’দিন আগে দেখা হয়েছিল শাকিলের সাথে। পেপারে ওর নাম আসছিল ,ছবি উঠছিল নিয়মিত, চেনা চেনা মনে হতো। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছিল- ঐ কিনা। দেখা হতেই লম্বা একটা সালাম দিল। দোকানে বসিয়ে চা খাওয়াল।
ওর সেই অমায়িক ব্যবহার কিন্তু এখনও আছে। জানিনা আমি ওত বছর জেলে থাকলে আর অমায়িক থাকতাম কিনা, তাও ভুল বিচারের কারনে। ও কিন্তু আছে এবং পেপারেও ওর নাম আসে রোজ- ওযে টপ টুয়েন্টি টেরোরের মধ্যে একজন এই দেশের এখন। জেল ওকে ঐ লাইনে পারফেকশন এনে দিয়েছে, যেখানে এই বাইরের জগতের ট্রেনিং সমূহ আমাকে এনে দিয়েছে ফ্রাসটেশন আর ফ্রাশটেশন।
ঃঃ তারপরও খেয়াল করে বন্ধু । আইন কিন্তু ছিল । আমরা মানুষরা ব্যবহার করতে ভুল করি।
ঃ তাই... না! তাইলে ওত গুলো মানুষ ওর পে বলার পর্ওে কেনো আইন প্রমাণ চায়। কিসের প্রমান চায়? কিসের?
থাক , তুই তোর আইন নিয়ে থাক, থাক ভাল থাক।
ঃঃ সুদীপ্তার কি হলো পরে, কোন দিন বলিস নি তো ওর কথা?
ঃ শুনে কি করবি। ও এখন হিন্দু বিধবা। গোড়া হিন্দু ধর্ম মানে ওর উচ্চ শিক্ষিত পরিবার। আর বিয়ে দেবেনা কোনদিন। কি কঠিন আইন, একজন যুবতীর মনটাকেও বোঝেনারে। আইন খুবই অন্ধ , সর্বত্র , সর্বধারায়, সবখানে সব পরিবেশেই।
ওর সেই আইনের কাছে পরাজিত বলেই আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আর কোন দিন দেখা করতে এসোনা, খুব কষ্ট হয় , খুব কষ্ট তুমি কাছে আসলে।
৩/০৫/০৮
Refe. of the Picture attaced
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০০৮ দুপুর ১:৫৮