স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের সময় নিয়ে লেখা হুমায়ূন আহমেদ এর দেয়াল-এ একটা চরিত্র আছে রাধানাথ বাবু। নীলক্ষেতে আদর্শলিপি নামে একটা ছাপাখানা চালান তিনি। এই রাধানাথ বাবু একবার ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বরে গেলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। দেখা করার ব্যবস্থা করেছিল ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস।
সাক্ষাতের সময় রাধানাথ বাবু বঙ্গবন্ধুকে বলেন, আমি আপনাকে সাবধান করতে এসেছি, আপনার সামনে মহাবিপদ। বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি কি কোনোভাবে ভারতীয় দূতাবাসের সাথে যুক্ত? উত্তরে রাধানাথ বাবু বলেন, জি না জনাব। তবে ইন্ডিয়া বিশাল দেশ। এই দেশ শুধু যে অ্যাম্বাসির মাধ্যমে কাজ করে তা না। তার আরও প্রক্রিয়া আছে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি কি এই প্রক্রিয়ার সাথে আছেন? রাধানাথ বাবু বললেন, হ্যাঁ।
বঙ্গবন্ধুর সাথে রাধানাথ বাবুর সাক্ষাতের এই ঘটনায় আমার কাছে যেটা লক্ষণীয়, সেটা হুমায়ূনের ভাষায় বঙ্গবন্ধু অনেক বৃদ্ধকেও ‘তুই’ করে বলেন। রাধানাথবাবুর সৌম্য চেহারা মনে হয় বাধ সাধল। তাঁকে তিনি ‘আপনি’ করে বললেন।
গল্পের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে রাধানাথ বাবুর এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। সবচেয়ে অবাক বিষয় জানা যায় তখন, যখন দেখা গেল আদর্শলিপি ছাপাখানার মালিক, মৃত রাধানাথ বাবু উইলে তার প্রিয়ভাজন শফিককে (উপন্যাসের একজন প্রধান চরিত্র) যাবতীয় সম্পত্তি দান করে গেছেন। সে সম্পত্তির ধরন এ রকম- ধানমণ্ডি তিন নম্বর রোডে একতলা বাড়িসহ দশ কাঠার একটি জমি, মোহাম্মদপুরে বিশ কাঠার একটি প্লট, সাভারে দশ একর যায়গা নিয়ে একটা বাগানবাড়ি, আদর্শলিপি ছাপাখানা, একটি নতুন ভক্সওয়াগন ও একটা পিকআপ ভ্যান এবং ব্যাংকে জমা একুশ লাখ ছাব্বিশ হাজার টাকা।
রাধানাথ বাবুর অস্তিত্ব বাস্তবেও ছিল বলেই মনে হয়, কারণ বইয়ের এক যায়গায় হুমায়ূন আহমেদ বলেন- নীলহাতি বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী খুঁজতে গিয়ে আমার আদর্শলিপি প্রেসের শফিকের সঙ্গে পরিচয়।
উপরের বর্ণনায় একটা ‘হিন্ট’ আছে। সেটা হলো বিশাল দেশ ইন্ডিয়া এমন সব মানুষকে রাধানাথ বাবুর বর্ণিত ‘প্রক্রিয়া’য় যুক্ত করে যারা সাধারণত সৌম্য চেহারার (সমাজে গ্রহণযোগ্যতা আছে) এবং বুদ্ধিবৃত্তির সাথে (আদর্শলিপি প্রেস) জড়িত।
ছাঁপা হয়ে আসার আগেই হুমায়ূন আহমেদ এর ‘দেয়াল’ নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। ধারণা করি পাণ্ডুলিপিতে এমন কিছু তথ্য ছিল যা ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পছন্দ হচ্ছিল না। যথারীতি এটা আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং হাইকোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী সংশোধিত উপন্যাস (পছন্দ না হওয়া তথ্যগুলো বাদ দিয়ে) প্রকাশিত হয়। এখন বাজারে যেটা পাওয়া যায় সেটা ওই সংশোধিত সংস্করণই। আমার বক্তব্য হলো রাধানাথ বাবুর ঘটনার মত বিষয়গুলো এতটায় বাস্তব যে এত এত সরকারি যন্ত্র এবং তাবড় তাবড় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীকুলের ছাকুনি পার করার পরও এই ঘটনাটা উপন্যাসে রয়েই গিয়েছে।
উপরের বর্ণনাকে ফুটনোট হিসেবে যদি আমরা বর্তমান সময়ের ঘটনাপ্রবাহ দেখি, তাহলে ‘বিশাল দেশ ইন্ডিয়ার ওই প্রক্রিয়ায়’ আমাদের দেশের কোন ধরনের নাগরিক যুক্ত থাকতে পারে এবং তারা কি কি করতে পারে, সে বিষয়ে পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায়।
স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন গোষ্ঠী যেভাবে একের পর এক দাবি দাওয়া নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ধারাবাহিক চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে গত পনেরো বছরে এই প্রক্রিয়া আমাদের সমাজে কি বিশালভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। বিশেষত খুনী হাসিনার পতনকে যখন পার্শ্ববর্তী দেশ নিজের পরাজয় হিসেবে ধরে নিয়েছে তখন এ ধরনের পরিস্থিতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি বরং ধন্যবাদ দেব এই ‘নড়বরে’ অন্তবর্তীকালীন সরকারকে। একের পর এক আসা বহুমুখী আক্রমণ তারা সামলেছে নিরবে, কিন্তু দক্ষতার সাথে এবং এ যায়গাটাতে এই সরকার এখন পর্যন্ত সফল।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বহু আগে থেকেই স্বীকৃত একটি বিষয়। এটা থাকবেই। কিন্তু ঘটনা হলো একটা দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের বৃহত্তর অংশ যখন গণভাবে নিজ দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে উদার হয়ে পড়ে, তখন সে সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ নিয়ে খুব সহজেই প্রশ্ন উঠে যায়।
গত আওয়ামীলীগ রেজিম আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষত শিশুদের মূল্যবোধের এই যায়গাগুলো ধ্বংস করতে নিবিড়ভাবে কাজ করে গিয়েছে এবং আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা সফলও হয়েছে। যার ফলে ওই সময়ে এমন কিছু মানুষ শিক্ষা ও সংস্কৃতির মোড়ল হয়ে উঠতে পেরেছিল, যারা নিজেরা চরম লোভী এবং নিজেদের আদতে কোনো মূল্যবোধ ছিলনা কোনোকালেই। এই শ্রেণি সবসময় সবকিছুতে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে অন্যদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে তৎপর ছিল।
অতিতে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ করা হতো; বিপরীতে আওয়ামীলীগ এবং তার প্রপাগান্ডা মেশিন ‘এই যুগে দেশ কিভাবে বিক্রি হবে?’ বলে টিটকারি করতো। অথচ গত দশকে পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে গোপনে করা দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলোর কোনোটিই দেশের স্বার্থকে রক্ষা করেনি। উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে নেয়া কর্ণফুলি টানেলের মত প্রকল্পগুলো করাই হতো দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে চোর বাটপার রাজনীতিবিদদের পকেট ভরতে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাংক দখল করে দেশকে দুর্বল করে দেয়। দেশ আসলে এভাবেই বিক্রি করা হয়। কিন্তু আওয়ামীলীগের গান্ডুরা না বুঝলেও দেশের তরুণ সমাজ বুঝে গিয়েছিল যে দেশ কিভাবে বিক্রি হয় এবং আওয়ামীলীগ ও তার দোসররা কিভাবে তা সম্পন্ন করেছে।
ঠিক এ যায়গাতে এসেই কোনো একটা দেশের দীর্ঘদিন থেকে বিনিয়োগ করা সব সম্পত্তি সুদাসলে জলে চলে গেছে। যার ফলে তারা কি পরিমাণ প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় সে দেশের গণমাধ্যম এবং মাহাজন শ্রেণির একটা অংশের বক্তব্যে।
আশার বিষয় হলো জুলাই গণঅভ্যূত্থানের পর বাংলাদেশের মানুষ ট্যাবু ভাঙতে শিখেছে, তারা কোনো ফরমায়েশি ন্যারেটিভ আর নিচ্ছে না এখন।
ছবিসূত্র:
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:০৫