গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি এদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে (পড়ুন ক্ষমতায় ফিরতে) আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে গত আওয়ামী রেজিমে চরম নির্যাতিত ও নিপীড়িত দল ছিল বিএনপি। বিএপির অসংখ্য নেতাকর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম খুন, কারাদণ্ড ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে। দিনের পর দিন নিজ বাড়িতে থাকতে পারেনি নেতা কর্মীরা।
কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে খুনী হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে সফল না হলেও শেষের দিকে এসে বিএনপি ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা সৃষ্টি করতে পেরেছিল বলে মনে হয়। মহানগরভিত্তিক সমাবেশগুলোতে দুদিন আগে থেকেই কর্মী-সমর্থক-জনতাকে চিড়ামুড়ি নিয়ে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হতে দেখা গেছে। এ রকম একটা অবস্থায় জুলাই গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যখন গণহত্যাকারী হাসিনার পতন হয় এবং শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়, তখন বিএনপি ছাত্র জনতার এই বিজয়কে তাদের নিজেদের বিজয় হিসেবে ধরে নেয় এবং কিছুদিনের মধ্যে তারাই ক্ষমতায় যাচ্ছে ভেবে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় বিএনপির উর্ধ্বতন নেতৃত্ব থেকে সকল পর্যায়েই। দ্রুতই আওয়ামীলীগের ফেলে যাওয়া কার্যালয়, পরিবহন খাত, চাঁদাবাজি সাম্রাজ্য এবং বাজার সিন্ডিকেটসহ সকল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপির নেতা কর্মীরা। এমনকি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন যায়গায়। প্রথমদিকে বিএনপির নেতৃত্ব এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থাও নিয়েছে। শামা ওবায়েদ এর মত হেভিওয়েট নেতার পদ স্থগিত করার মত পদক্ষেপ নিয়েছে।
অন্তবর্তীকালীন সরকার দ্রুত নির্বাচন দিবে এবং সে নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে- এ রকম একটা ভাবনা থেকে বিএনপি জাতীয় সরকারে অসম্মতি প্রদান করায় শেষ পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ক্রমেই বিএনপি দেখছে যে তারা যেমনটা ভেবেছিল, ঘটনা পুরোপুরি তেমনটা ঘটছে না। এ কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বিএনপি এক ধরনের প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে বলে আমার মনে হয়; যার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে বিএনপির অবস্থানকে আমরা দেখতে পারি।
সম্প্রতি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার দোহায় দিয়ে রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বিএনপি নেতৃত্ব মনে করছে যে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি অপসারণ হলে অন্তবর্তীকালীন সরকার দীর্ঘ সময়ের জন্য থেকে যাবে এবং বিভিন্ন ধরনের সংস্কার করবে, যেটা পরবর্তী সরকার হিসেবে আখেরে বিএনপির জন্য শুভ হবে না।
এই যায়গাতে বিএনপি জুলাই গণঅভ্যূত্থানের মূল সুর ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যূত্থান কেবল একটা সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন হিসেবে সংঘটিত হয়নি বরং যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরাচার ও দুর্নীতিবাজ শাসক তৈরি করে, যে ব্যবস্থা মত প্রকাশ ও বিচার পাওয়ার স্বাধীনতা হরণ করে, যে ব্যবস্থায় দেশের সকল প্রতিষ্ঠান কেবল অকার্যকরই হয় না, বরং জনগণের উপর নিপীড়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়, সর্বোপরি শাসক দলের সদস্য এবং তাদের সুবিধাভোগী অলিগার্কগোষ্ঠী ব্যতিত বাকি সবাইকে যে ব্যবস্থা ডিহিউম্যানাইজড করে ফেলে তার পরিবর্তন এবং প্রতিরোধে স্থায়ী সমাধানের জন্যই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে দেশের শ্রমিক-মজুর-কৃষক-শিক্ষক-ব্যবসায়ী-ধনী-গরীব-নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধসহ সর্বস্তরের জনগন রাজপথে নেমে এসেছিল। হ্যাঁ এ আন্দোলনে বিএনপিসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকরাও ছিল, তবে সেটা কতটুকু দলীয় সিদ্ধান্তে আর কতটুকু ব্যক্তিগত তাড়নায় সেটা তারাই বলতে পারবে।
চাকুরিতে কোটা সংরক্ষণবিরোধী একটা আন্দোলন হঠাৎ করেই তো আর সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়নি, তার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজ গত এক দশকের বেশি সময় ধরেই করে গেছে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং বিভিন্ন গ্রুপ। কিন্তু মূল কাজটা হয়েছেই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে।
এ যায়গায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা ছিল বলে আমি মনে করি। বিএনপির অতীত দুর্নীতির ইতিহাস এবং স্বৈরাচারের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার ল্যাসপেন্সার দেশীয় গণমাধ্যমের এক পাক্ষিক বয়ানের বিপরীতে বিএনপি কোনো শক্তিশালী ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। যে কারণে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর সরকারবিরোধী আন্দোলনকে দেখেছে এক স্বৈরাচারের বিপরীতে আরেক দুর্নীতিবাজ সরকারের আগমনের আন্দোলন হিসেবে।
অন্যদিকে জুলাই বিপ্লবে আবু সাইদ এবং আরও অসংখ্য শিক্ষার্থী যখন খুনি হাসিনার পুলিশের গুলির সামনে দুহাত প্রসারিত করে নিজের জীবনের ভয়কে অগ্রাহ্য করে দেখাতে পেরেছে, তখন সাধারণ মানুষ এই ছাত্রদের মধ্যে নিজেদের এতদিনের জমানো ক্ষোভ, রাগ ও প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে এবং সে আন্দোলনে শরিক হয়ে নিজেরাও বিনাদ্বিধায় প্রাণদানে প্রস্তুত হয়েছে। একই সাথে নতুন প্রজন্ম এই দুর্নীতিপরায়ন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত পরিবর্তন করতে পারবে বলে বিশ্বাস করেছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টেই অকার্যকর হয়ে যাওয়া সংবিধান বা অন্যকিছুর দোহায় দিয়ে বিএনপি যদি প্রতিনিয়ত ছাত্র-জনআকাঙক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিতে থাকে, ন্যূনপক্ষে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত পরিবর্তনের লক্ষে ইতিবাচক কমিটমেন্ট না দেখাতে পারে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি’র অবস্থা বর্তমান আওয়ামীলীগের চেয়েও খারাপ হবে। এমনকি এ রকম দ্বিধার মধ্য দিয়ে গণঅভ্যূত্থানের আন্দোলনকারীদের মধ্যে যদি বিভক্তি এসে যায় তাহলে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ তার সুযোগ অবশ্যই নিবে এবং সেক্ষেত্রে বিএনপি’র সরকার গঠনের আশা, আশাই থেকে যেতে পারে।
কদিন আগে আরটিভির ‘দাবির মিছিল থামবে কবে?’ শীর্ষক টকশোতে একদম শেষে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দলোনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সঠিকভাবেই বলেছেন যে “এই গণঅভ্যূত্থান আসলে পিপল’স উইলকে সার্ভ করে। পিপল’স উইল একটা প্রত্যাশা করেছে যে মানুষ বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা আর চায় না। এটা হচ্ছে মানুষের আকাঙ্খা। আপনি যদি সেটা অনুভব করতে না পারেন, মানুষ আপনাকে ইনভ্যালিড করে দিবে, আজকে অথবা কালকে। যত রাজনৈতিক সংগঠন আছে, যারা আমাদের সিনিয়র সিটিজেন আছেন, অনেক বুঝদার ব্যক্তি, অনেক লম্বা লম্বা কথা বলতে পারেন। আমি এত লম্বা লম্বা কথা জানি না, আমি বায়োকেমিষ্ট্রি পড়ছি, আমি এত সংবিধান বুঝি না। কিন্তু আমি এটা বুঝি যে গত ১৫ বছর মানুষের সাথে যা হয়েছে.. .. আমাদের হলে.. .. ছাত্রদের .. .. কি বলবো? সে তো একটা স্টুডেন্ট, হয়তো তার ফার্স্ট হওয়ার ক্যাপাসিটি ছিল, ওই স্টুডেন্টকে সাফার করতে হয়েছে গণরুমে, রাত ৩টা বাজে তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হতো।
আজকে এসে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে। এটা কিন্তু আমাদের ভেতরকার আকাক্সক্ষা ছিলো যে আমরা এই ছাত্র রাজনীতি চাই না। একইসাথে আমরা এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাও চাইনা, যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরে দাঁড়িয়ে আপনারা লম্বা লম্বা কথা বলেন। হ্যাঁ, এখানে অবশ্যই আমরা জাতীয় ঐক্য চাই। আমাদের সবার মধ্যেই একটা ঐক্য লাগবে, এই সিস্টেমটাকে আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। এই অন্তবর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কোনো কিছুই পিপল’স উইলকে আন্ডারমাইন করতে পারবে না। মানুষকে সাথে নিয়েই আপনাকে চলতে হবে নাহলে মানুষ আপনাকে ছাপায়ে চলে যাবে, আমাকেও ছাপায়ে চলে যাবে।”
উমামা ফাতেমার এই কথাগুলোই আসলে অভ্যূত্থান পরবর্তী বাস্তবতা। এটা যদি কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল না বুঝতে পারে, তাদের জন্য সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। বিএনপি যত দ্রুত এই বাস্তবতা বুঝতে পারবে, ততই দেশ এবং বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে আমি মনে করি।
উমামা ফাতেমার বক্তব্য
ছবি কৃতজ্ঞতা
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৯