somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আফগান ক্রিকেটে ভারতীয় আশির্বাদ আর আমাদের কূটনৈতিক দৈন্যতা

০৪ ঠা জুন, ২০১৮ সকাল ১০:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রায় অনুমিতভাবেই গতকালকের টি টোয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে গিয়েছে আফগানিস্তানের সাথে। শতাধিক টেস্ট, সাড়ে তিনশ ওয়ানডে ও আশিটার মত টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা পাত্তা পায়নি বারুদের গন্ধে বেড়ে ওঠা নবীন একটা দলের মানসিক দৃঢ়তার কাছে। মেধা, টেকনিক, অভিজ্ঞতা পাশে রেখেও দিন শেষে ক্রিকেট একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই-ই।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের ঐক্যবদ্ধতার মূল যায়গা এই ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে আশির্বাদের হস্ত উজাড় করে দিচ্ছে পরাক্রমশালী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। গতকাল প্রথম আলোয় সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন মারফত জানা গেল শারজাহকে বাদ দিয়ে ভারত এখন আফগান ক্রিকেটের হোম ভেন্যু। আইপিএল-এ আফগান খেলোয়াড়রা সুযোগ পাচ্ছে বেশি, ভারতে থেকে আফগানারা ম্যাচ প্রাকটিস করতে পারবে আবার ভারত সরকার কান্দাহারে একটা স্টেডিয়াম নির্মাণ করে দিয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো- ভারত সফরকারী প্রত্যেকটি দলের সাথে আফগানিস্তানের একটা প্রস্তুতি ম্যাচ হবে বলে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে!!

আপাতদৃষ্টিতে মহান এই পদক্ষেপ উদার ভারতীয় মানসিকতার প্রতিচ্ছবি নয় মোটেও, বরং উপমহাদেশীয় ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ভারতীয় কূটনৈতিক কূটচাল। সম্প্রতি আনন্দবাজারে ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে পশ্চিমে আর পুবে-দুদিকেই পাকিস্তান নিয়ে ঘর করতে হবে ভারতকে’ বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে, আফগান ক্রিকেটের প্রতি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের উদার হস্ত হওয়ার পেছনে সেই একই দর্শন কাজ করেছে। একদা পাকিস্তানের সখ্যতায় থাকা আফগানিস্তানের মন জয় করতে ভারত ওখানে বিভিন্ন ধরণের কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবেই ক্রিকেট কূটনীতিও চালিয়ে যাচ্ছে। উনিশশ একাত্তুরে যেমন পিংপং ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে চিন ও যুক্তরাষ্ট্রর মধ্যকার সম্পর্ক জোড়া লেগেছিল, ভারত-আফগানিস্তানের এই ক্রিকেট ডিপ্লোমেসিও সেই একই সূত্রে গাঁথা। এখন ভারতকে পুব ও পশ্চিমে পাকিস্তানকে নিয়ে ঘর করার টেনশন নিতে হবে না, বরং দুইপাশে দুটি ভারতের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকতে হবে পাকিস্তানকেই।

আমরা এখানে স্মরণ করতে চাই যে নিকটতম প্রতিবেশি হিসেবে আমাদের ক্রিকেটের উন্নয়নে ভারত ঠিক কতটুকু উদার হতে পেরেছিল। সেক্ষেত্রে শুধু হতাশাই থাকবে আমাদের জন্য। ভারতকে আমাদের হোমগ্রাউন্ড বানানোর প্রয়োজন পড়েনি, আমাদের সুন্দর কিছু স্টেডিয়ামও আছে, আইপিএল-এ আমাদের প্লেয়াররা খেলবে কি খেলবে না, সেটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। কিন্তু আমাদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক হলো, টেস্ট মর্যাদা লাভের দীর্ঘ সতের বছর পর আমরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি ভারতের মাটিতে প্রথম টেস্ট খেলার আমন্ত্রণ পাই!!

আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতাটা এখানেই। ভারত তার নিজের স্বার্থে যেটা প্রয়োজন সেটা করবেই। সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু কথা হলো আমরা কি করছি? ভারত আমাদের এটা দিলো না, সেটা দিলো না বলে নাকি কান্না করে তো লাভ নেই, মূল কথা হলো আমি কি আদায় করতে পারছি।

আমাদের কূটনীতিবীদরা এখানে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক কলকাতা সফর শেষে ঢাকার সাংবাদিক মিটে যে কথা বলেছেন, কূটনৈতিক মানদণ্ডে সেগুলো নিতান্তই শিশুসুলভ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, সেটা ভারত সারা জীবন মনে রাখবে। অতীতের গুলি, বোমাবাজি-আমরা কিন্তু তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে। আমরা কোনো প্রতিদান চাই না। তবে হ্যাঁ, স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কোনো প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে এখানে? কারও কাছে চাওয়ার অভ্যাস আমার একটু কম, দেওয়ার অভ্যাস বেশি।’

এভাবে বলে হাততালি পাওয়া সম্ভব, কিন্তু নিজের দেশের ন্যায্য পাওনা আদায় সম্ভব নয়। দুটি দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক কোন মামা-ভাগ্নের বিষয় নয়। মান অভিমানেরও কোন যায়গা এখানে নেই। এখানে চিরকালীন শত্রু-মিত্র বলেও কোন কথা নেই। আপনার আপাত শত্রু বা আপাত মিত্র, সবাইকেই একই চেহারা দেখাতে হবে যদি মনে অন্য কথা থাকেও।

ডিপ্লোমেসিতে যেটুকু কথা হবে, সেটা হবে পুরোমাত্রায় পেশাদার কথা। কূটনীতিতে আপনার প্রতিপক্ষ হাসতে গিয়ে যদি চারটি দাত বের করে, তবে আপনাকেও জবাবে ওই চারটি দাত বের করেই হাসতে হবে, বত্রিশ পাটি বের করার কোন সুযোগ নেই। কূটনৈতিক সম্পর্কে মোনাকোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এলে যেমন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবেন, ঠিক তেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলেও তাঁদের কাউন্টার পার্ট হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই অভ্যর্থনা জানাবেন, প্রধানমন্ত্রী নন। একইভাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী উগান্ডা যান আর রাশা যান, তাঁকে যেন তাঁর কাউন্টারপার্টই এসে অভ্যর্থনা জানান, কূটনৈতিক দরকষাকষিতে সেই মর্যাদা অর্জন করে নিতে হবে।

কিন্তু আদৌ কি আমরা তা পারছি? নিশ্চয় না। যথাযোগ্য মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারলে তো আসানসোলের অপ্রস্তুত বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান কেন নামানো হলো হতো সে প্রশ্ন উঠতো, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ঠিক কি প্রটোকল উনি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পেলেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠতো। হ্যাঁ, যদিও এটা সরকারি সফর ছিলো না, তবুও এই প্রশ্নগুলো থেকেই যায়; যেগুলো এমনকি ভারতীয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। অথচ আমাদের নতজানু গণমাধ্যম এই প্রশ্নগুলো খুব সযতনে এড়িয়ে গেছে বরাবরের মত।

এই যে নিজের দেশের মর্যাদার চেয়ে দলের বা ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে, সেটা আর যাই হোক জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা নিশ্চিত করে না। আর করে না বলেই ভারতের কাছ থেকে আমরা আলাদা করে কোন মনোযোগ আদায় করতে পারি না, যতটুকু পারে আফগানিস্তানের মত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশও। যতদিন আমরা দেশকে সবার উপরে দেখতে না পারবো, নিজের চাওয়াটুকু কূটনৈতিকভাবে জোরালো কন্ঠে না বলতে পারবো, ততদিন নাকি-কান্নাই করতে পারবো, কোন কিছু আদায় করতে পারবো না বরং তার বিপরীতে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হওয়ার ভড়ং করতে পারবো।

এই সংক্রান্ত সংবাদসমূহ
আনন্দবাজার
টাইমস অব ইন্ডিয়া
প্রথম আলো

ছবিসূত্র: গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৮ সকাল ১০:২১
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×