কলকাতা ভ্রমণ গাইড-২ (তথ্যমূলক পোস্ট)
হোটেল বুকিং
মারকুইস স্ট্রিটে নেমে আপনার প্রথম কাজ হবে হোটেল খুঁজে নেওয়া। পুরো মারকুইস স্ট্রিট এবং পার্ক স্ট্রিট জুড়ে অসংখ্য চলনসই হোটেল আছে। পেট্রাপোল (ওরা বলে, বর্ডার) থেকে আসা বাসগুলো যেখানে থামে সেখানে দাড়িয়ে আশেপাশে তাকালেই এর অনেকগুলো চোখে পড়বে। এসি, নন এসি, সব ধরণের রুমই আছে। সাধারণত ৫০০ থেকে ১০০০ এর ভেতরে ভাড়া। আরো বেশি ভাড়ার ভালো হোটেলও আছে। প্রথম দিনে আপনি পছন্দসই হোটেল নাও পেতে পারেন।
আমি বলি, প্রথম দিনের জন্য আপনি বরং সবচে কাছের হোটেল সম্রাট বা হোটেল ২১ এ উঠে পড়–ন, পরদিন খুঁজে নিতে পারবেন আপনার সাধ ও সাধ্যের মধ্যে থাকা হোটেলগুলো। তারপর একটা মোবাইল ফোনের সিম কিনে নিন। ১৫০ টাকা মত লাগবে, সাথে দুই কপি ছবি এবং পাসপোর্টের নিদৃষ্ট কিছু পাতার ফটোকপি।
এখানে একটা বিষয় বলা উচিৎ। ভারত আমাদের বৃহত্তম প্রতিবেশি হওয়ায়, অনেক ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা বেশি হওয়ায় এবং বাংলাদেশিদের বিদেশপ্রীতি আর খরচের বহর দেখে বাংলাদেশিরা এখন ভারতীয়দের কাছে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুধেল গাভীর মত হয়ে গেছে। কর্পোরেট সার্ভিসগুলোতে বাংলাদেশিদের এরা খুবই খাতির করে। শুধুমাত্র বাংলাদেশিদের এন্টারটেইন করার জন্য এখানকার প্রায় সব সেলফোন অপারেটরেরই বাংলাদেশ প্যাকেজ আছে। এইসব প্যাকেজের ফোন থেকে বাংলাদেশে যত কম খরচে কথা বলা যায়, ভারতের অন্যান্যা রাজ্যে তা যায় না। ভাবার কোন কারণ নেই যে, এটা আমরা যেমন বিদেশি দেখলে গলে গিয়ে কিছু একটা করে বর্তে যাই সেরকম কিছু, বরং এর সবটার পেছনেই টাকা।
এইসব প্যাকেজের সিম কার্ডের প্যাকেটে থাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ছবি। আবেগের ডিপো বাংলাদেশিরা সেইসব ছবি দেখে আপ্লুত হয়ে সাট সাট করে দেশে ফোন করে আর রেভিনিউটা চলে যায় ইন্ডিয়াতে।
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি, আমি আমার বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম শংকর নেত্রালয়ে। মাদ্রাজ কেন্দ্রিক এই চক্ষু হাসপাতালের সারা ভারতেই ভাল একটা গুডউইল আছে। সেই শংকরের রিসেপশনে ব্যাপক ভীড়। সিরিয়ালে দাড়িয়ে যখন সুদর্শন ষোড়শী অভ্যার্থনাকারিনীর সামনে আসতে পারলাম, জানা গেল এক থেকে দেড়মাস আগেই ডাক্তারের শেডিউল নিতে হয়। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে রিসেপশনিস্ট নিজ উদ্যোগে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে একটা শেডিউলের ব্যবস্থা করে দিল। একই ক্ষেত্রে একজন ভারতীয়ের বেলায় মেয়েটা সুন্দর ভাষায় রিগ্রেট করল।
আমার পৌঢ় বাবা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সেই মুগ্ধতার সাথে যোগ হল ডাক্তারের আন্তরিক ব্যবহার। বারবার বলতে লাগলেন ঢাকার ডাক্তারদের সাথে তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। ভারতীয়দের সম্পর্কে কোন সফট্ কর্নার না রাখা আমার বাবার সেই মুগ্ধতা কাটেনি দেশে ফিরেও। আশেপাশের সবার কাছেই ভারতীয় চিকিৎসাসেবার মার্কেটিং করে যাচ্ছেন। লাভের মধ্যে লাভ হল সেই ভারতীয় হাসপাতালগুলোরই। তারা নতুন আরো কিছু দুধেল গাভি পাবে। বাংলাদেশিরা ভারতীয় চিকিৎসার প্রতি কি পরিমাণ আসক্ত, তা বেনাপোল বর্ডারে গেলেই বুঝতে পারবেন। ব্যবসায়ীর জাত ভারতীয়রাও এটাকে ধরেছে ঠিক মতই। বাংলাদেশিদের আরো কাছাকাছি আসতে ফর্টিস, রুবি, শংকর, ডিসান, সুনেত্রা’র মত বড় বড় হাসপাতালগুলো কলকাতাতে বাংলাদেশমুখী একটা উইন্ডো খুলে বসেছে। স্থানটাও দেখুন না, বেনাপোল থেকে কলকাতায় যেতে কলকাতায় ঢোকার মুখে মুকুন্দপুর, সন্তোষপুর, অজয়নগর এলাকায়। এখন আর কষ্ট করে মাদ্রাজ, ভেলোর, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ যাওয়ার দরকার নেই।
প্রসঙ্গে আসি। পার্ক স্ট্রিট এলাকাটা কলকাতা নিউ মার্কেটের (ওরা বলে, মার্কেট) পাশেই। যায়গাটা একটু ঘিঞ্জি। তবে আপনি যদি কলকাতাতে ট্যুরের জন্য এসে থাকেন বা চেন্নাই-ভেলোর-মাদ্রাজ-হায়দ্রাবাদ যাওয়ার ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চান এবং এখানে আপনার পরিচিত কেউ যদি না থাকে, তাহলে থাকার জন্য এই এলাকাই ভালো। বাংলাদেশ বাংলাদেশ গন্ধ লেগে আছে। খেতে ঢুকলে বা রাস্তাতে নোয়াখালি, চাটগাঁ, রংপুর, পুরান ঢাকা, সব ল্যাংগুয়েজই শুনতে পাবেন। মুসলিম প্রধান এলাকা হওয়ায় মুসলিম হোটেলও আছে একাধিক। কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশন এখানে। সোনালী ব্যাংকের একটা শাখাও রয়েছে পার্ক স্ট্রিটের ওয়ান্ডারল্যান্ডের পাশে, পার্ক ম্যানসনে। পার্ক স্ট্রিট থেকে কলকাতার দর্শনীয় স্থানগুলোও থাকবে আপনার নাগালের ভেতরে। ট্যাক্সি, বা রুট নাম্বার জেনে নিতে পারলে ট্রাম ও পাবলিক বাস ব্যবহার করতে পারবেন সহজেই।
আর যদি চিকিৎসার জন্য আসেন, সেক্ষেত্রে সেন্ট্রাল কলকাতায় না থেকে বাই পাস বা মুকুন্দপুর-সন্তোষপুরের আশেপাশে থাকাই ভালো। হসপিটালগুলোর বেশিরভাগ এ এলাকাতেই। আর থাকার খরচও কম।
কিছু টিপস-
*মারকুইস স্ট্রিট থেকে দর্শনীয় স্থানগুলো-
# নিউ মার্কেট- হাটা পথের দূরত্ব। আমাদের গাওসিয়া, চাঁদনি চক, ধানমন্ডি হকার্স, নিউমার্কেট, নিলক্ষেত, বাবুপুরা এবং গাউসুল আজম মার্কেট এর মিলিত আয়তনের সমান হবে, আর চরিত্রে কোন পার্থক্য নেই। সেই একই ভিড়।
# ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম- হাটা পথের দূরত্ব।
# ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল- ২ কিমি। ইন্ডিয়ার ইতিহাস এখানে সচিত্র সংরক্ষণ করা আছে।
# বিড়লা প্লানেটোরিয়াম- ২ কিমি। আমাদের ভাসানি নভো থিয়েটার।
# সায়েন্স সিটি- ৭ কিমি। বাচ্চা কাচ্চাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক।
# নিক্কো পার্ক- ১২ কিমি। মিরপুরের বোটানিকাল গার্ডেন।
# বিড়লা মন্দির-৪ কি.মি. (এইখানে আমি যাইনি)
# ইডেন গার্ডেন- ২ কিমি
# রেসকোর্স (ওরা বলে, ময়দান)- ২ কি.মি.
# কফি হাউজ- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে, তবে আহামরি কিছু না। মধুর ক্যান্টিনের মত গেলেই ধাক্কা খেতে হয়। মান্নাদে’র গানে ছাড়া কলকাতার আমজনতা এর নাম জানে না।
# এ্যকোয়াটিকা- ১৫ কিমি। সমূদ্রতলদেশের একটা ডামি করার চেষ্টা করা হয়েছে।
হাওড়া ব্রিজ, শিয়ালদহ এবং মহাকরণও রাখতে পারেন তালিকায়।
* মেট্রো রেলে একটা ট্রিপ দিতে পারেন। এখানে মনে রাখতে হবে, ইন্ডিয়ানরা মেট্রো স্টেশনে ঢোকার সাথে সাথে চরিত্র বদলে ফেলে। এর ভেতরে এরা সুশৃংখল, নিয়মানুবর্তি এবং সৎ।
*কলকাতাতে ঘুরতে গেলে গ্রুপে যাওয়াই ভালো। অনেক দিক দিয়ে সাশ্রয় হবে।
*সাধারণত ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ধান্ধাবাজি করেনা। তবুও আগে ভাগে বলে নেওয়াই ভালো। মিটার এবং রিজার্ভ, দু’ভাবেই যাওয়া যায়। মিটারে গেলে যা বিল আসে তার ডাবল দিতে হয়। এখানে মিটার থেকে বিল পেপার প্রিন্ট হয়ে আসে।
*সারা ইন্ডিয়াতেই সরকারি দর্শনীয় স্থানগুলোতে ইন্ডিয়ান এবং নন ইন্ডিয়ান টিকেটের মূল্য দুই রকম। যেমন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ইন্ডিয়ানদের জন্য ১০ রুপি এবং নন ইন্ডিয়ানদের জন্য ১৫০ রুপি। অনেক পার্থক্য। কিছু হিন্দি জানা থাকলে বা সাথে কোন ইন্ডিয়ান থাকলে এক্ষেত্রে সুবিধা পাবেন।
* আর যদি চিকিৎসার জন্যে দূরে কোথাও যাবার প্লান থাকে, তাহলে দেরি না করে ট্রেনের টিকেট বুক করে ফেলুন। স্টেশনে গিয়ে নিজেই করতে পারেন। বিদেশিদের জন্য আলাদা কাউন্টার আছে। ইন্ডিয়ার ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেমের মূল চালিকা শক্তি হলো রেল। তাই এদের রেল ব্যবস্থা অতি উন্নত না হলেও সিস্টেমেটিক। সমস্যা হওয়ার কথা না। তারপরও বাসের কাউন্টারে নেমে হেলপ নিতে পারেন, সেক্ষেত্রে পকেট থেকে কিছু খসবে।
*কলকাতা থেকে কেনাকাটা না করাই ভাল। আমাদের দেশের চেয়ে বিশেষ উন্নত কিছু পাওয়া যায় না, তাছাড়া দামও বেশি।
ফিরতি বেলা
ফেরার সময়ে শুধু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ইন্ডিয়ান সময় ৫টায় বর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। সেভাবে সময় নিয়েই আসবেন। আসার সময়ে দু’পাশের কাস্টমসেই বেশ ঝামেলা করে, বিশেষ করে বাংলাদেশ কাস্টমসে। উপরওয়ালা দিয়ে ফোন না করিয়ে, বা টাকা না দিলে আপনার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত ডিওডোরান্টটাও রেখে দিতে পারে। আবার টাকা দিলে লাগেজ চেকও হয় না।
ইন্ডিয়ান কাস্টমসে সাধারণত ডলার থাকলে ফেরত দিতে চায় না। ডলার ভাঙানোর সার্টিফিকেটের সাথে এন্ডোর্স করা ডলারের পরিমাণ মিলিয়ে দেখে। তবে, কাস্টমস এ ব্যাপারে যতটা না তৎপর, পেট্রাপোল বাজারের প্রতিটা মানুষ আরো বেশি তৎপর। বিভিন্ন কথা বলে আপনাকে আতংকিত করে ফেলবে এবং আপনার সাথে ফেরত আসা ডলার এক্সচেঞ্জ করানোর জন্য চেষ্টা করবে। এসব ব্যাপারে বাসের সুপারভাইজারের সাহায্য নিতে পারেন। আর এমিগ্রেশনে ঢোকার মুখে দাড়িয়ে থাকা কুলিদের সাহায্য নিলে লাগেজ চেকিংয়ের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
সব শেষ করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ুন, দেখবেন বুকের ভেতরে কেমন নতুন এক শক্তি এসে ভর করবে। নিজের দেশ বলে কথা।
আমার গাইডিং এখানেই শেষ, যেগুলো আমি বলতে পারিনি বা আদতেই জানি না, সেগুলো আপনারা আইকিউ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারবেন আমি জানি।
এবার কলকাতা নিয়ে কিছু ফিউশন
আমি বেশ কয়েকবার কলকাতা গিয়েছি। লম্বা একটা বিরতির পর এবার গিয়ে আমার যতটা খারাপ লেগেছে, তা আগে কখনও হয়নি। সর্বশেষ ২০০৪ এ গিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট থেকে। তখনও কলকাতা এবং ঢাকার ভেতরে খুব একটা পার্থক্য চোখে পড়েনি। বরং কলকাতার মানুষের আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক-খাদ্যাভ্যাস দেখে ক্ষ্যাত ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। লোকজন হাটছে চিপা প্যান্টের সাথে বেঢপ সাইজের সার্ট বা টি শার্ট পরে। রাস্তায় ব্যাঙের মত সব গাড়ি, যখন ঢাকার রাস্তায় চলে মার্সিডিজ, লিমোম ভলভো।
এবার কলকাতাকে দেখে আমার মনে হয়েছে কলকাতা যেখানে ছিল, সেখান থেকে শুধুই এগিয়েছে আর আমরা শুধুই পিছিয়েছি। প্রতিটা পয়েন্টে। কলকাতার রাস্তায় সেই ব্যাঙের মত এ্যাম্বাসেডরের পাশাপাশি এখন চলছে সুজুকি, হোন্ডা, টয়োটা, ফোর্ড, শ্রেভলে। মার্সিডিজও দেখেছি একটা, আর ওদের টাটা, মারুতি, মাহেন্দ্র, এগুলোতো আছেই। হাজার হাজার গাড়ি। আমাদের ঢাকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তার সাথে আছে ট্যাক্সি ক্যাব, সিএনজি (ওরা বলে অটো), অসংখ্য সিটি বাস আর রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলা ট্রাম। এত এত গাড়ি, কিন্তু সবার ভেতরেই ট্রাফিক সিগনাল মানার একটা প্রবণতা তৈরী হয়েছে। প্রায় প্রতিটা রাস্তারই একপাশে গাড়ি পার্ক করা আছে। তবে তা সারিবদ্ধভাবে, একটার পেছনে অন্যটা। ট্রাফিক জ্যাম তাই সহনীয় পর্যায়েই থাকছে। ফুটপাথগুলোও আমাদের ঢাকার মত অবৈধ দখলে নেই, ফুটপাথ ধরে তাই হাটতে পারছে হাজার হাজার মানুষ। তবে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কলকাতা শহরে রাস্তার পরিমাণ ঢাকার তুলনায় অনেক বেশি। সাথে রয়েছে বেশ অনেকগুলো ফ্লাইওভার। ওরা পরিকল্পিতভাবে এর সুব্যবহারও করতে পারছে। অধিকাংশ রাস্তাই এখানে ওয়ানওয়ে।
আমরা এবং ওরা
বয়স এবং সময়ের কারণে হোক বা কলকাতা নিয়ে লিখব বলে হোক, এবার কলকাতাকে খুটিয়ে দেখার একটা চেষ্টা ছিল। আর সেই চেষ্টা থেকে কলকাতা এবং এর জনগণের যে ছবি আমি দেখেছি তার সাথে আমাদের ঢাকা এবং বাংলাদেশের মানুষের যোজন যোজন দূরত্ব। আমরা কত বেশি আত্মধ্বংশপ্রবণ, তা বুঝতে ভারতের উন্নত রাজ্যে যাবার প্রয়োজন নেই, শুধু পাশের কলকাতাতে গেলেই চলবে। কলকাতাকে মনে হয়েছে বনেদি একটা শহর। এখানে ভূমিখেকো শাহ আলম-বসুন্ধরা, বাবুল-যমুনা, বা পঙ্গপালের মত অপরিণামদর্শী ডেভেলপারের দল নেই। সেন্ট্রাল কলকাতাতে আমি কনস্ট্রাকশন দেখেছি কদাচিৎ। তার বদলে রয়েছে সেই বৃটিশ সময়ের স্থাপনাগুলোকে অবিকৃত রাখার প্রচেষ্টা। গালিব স্ট্রিটে আমি বৃটিশ আমলের গ্যাস বাতির স্ট্যান্ডগুলো দেখেছি। শহরের ভেতরের রাস্তাগুলোর দুপাশে, মোড়ে মোড়ে, বাসার কম্পাউন্ডে রয়েছে অসংখ্য বয়স্ক গাছ। ছায়া দিচ্ছে। শহরটাকে সবুজ আর শীতল রাখছে। এখানে গাছ কাটতে হলে কর্পোরেশনে আবেদন করতে হয়। তারপর যদি কর্পোরেশন উচিৎ মনে করে, তবেই আপনার গাছ আপনি কাটতে পারবেন। আর আমাদের এখানে সরকার, কর্তৃপক্ষ, কর্পোরেশন নিজেরাই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গাছ কেটে শহরটারে ন্যাড়া করে দিচ্ছে।
কলকাতা শহর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য সবুজ মাঠ। খেলার মাঠ। ছেলে মেয়েরা খেলা করে। পুকুরও আছে। সায়েন্স সিটি’র পেছনের বিশাল পুকুরদুটোতে ভর দুপুরে কলকাতার মানুষ স্নান করে, সাতার কাটে। আর আমার দেশের মাঠগুলো দখল করে তৈরী হচ্ছে আকাশ ঢেকে দেওয়া উঁচু উঁচু সব বিল্ডিং। আর ঢাকায় পুকুরতো নেইই উল্টা লেক, নদী সব দখল করে, ভরাট করে, বর্জ্য ফেলে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।
সেন্ট্রাল কলকাতাকে দেখলে আমাদের ওয়ারি, রাংকিন স্ট্রিটের কথা মনে হয়। ইতিহাসের পাতার একটা শহর। ওরা মূল শহরটাকে ঠিক রেখে তৈরী করেছে নতুন নতুন উপশহর। সল্ট লেক, বালিগঞ্জ, রাজারহাট নিউ টাউন, এসবই অতি আধুনিক এলাকা। কিন্তু শহর থেকে দুরে হওয়ায় মূল শহরের উপরে চাপ পড়েনি একটুও। ওরা এগুলো তৈরী করে শহরটাকে বড় করেছে, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। আর আমরা আমাদের মূল শহরটাকে ধ্বংশ করে তারপর হাত বাড়িয়েছি বাইরের দিকে। ঢাকা জয় করে বাংলাদেশের সব শহরেই এখন ডেভেলপারদের জয়জয়কার!!!
পাশাপাশি দুটো দেশ। একই ভাষায় কথা বলি। একই গড়ন। একই রঙের মানুষ। অথচ কত বৈপরিত্য। ওদের মমতা ব্যানার্জি যখন বক্তৃতা করে, মনে হয় কবিতা আবৃত্তি করছে। আর আমাদের মহামান্যরা যখন কথা বলেন, মনে হয় টানবাজারে ঝগড়া লেগেছে। দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়ে। ৩৪ বছর একাধারে ক্ষমতায় থাকার পর নির্বাচনে হেরে গিয়েও মমতার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আসার মত উদারতা দেখাতে পারেন বুদ্ধদেব বসু, আর আমরা নির্বাচনে হারলেই সুক্ষ্ম কারচুপি, স্থুল কারচুপির অভিযোগ তুলে গোঁ ধরে বসে থাকি।
দেশের প্রয়োজনে ওরা যখন একাট্টা হয়ে যাচ্ছে, আমরা তখন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে দেশের বারোটা বাজাচ্ছি। নিজের মান ইজ্জত খুঁইয়ে বাইরের দেশে গিয়ে দেশ ও সরকারের বদনাম করছি।
ওরা যখন অপ্রয়োজনীয় খরচ বাচিয়ে (আমরা বলি কৃপণতা) নিজেদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে, তখন আমরা দেশের টাকাগুলোকে বিদেশে পাঠিয়ে বিদেশী পণ্য কিনে ঠাট বাড়াচ্ছি। ওরা যখন আইন শৃংখলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, নিজের দায়িত্বটুকু সুষ্ঠুভাবে পালন করে সুসভ্য এক জাতি হয়ে উঠছে (কলকাতার বাইরে অন্য রাজ্যগুলোতে মানুষের আইন মানার প্রবণতা আরো বেশি), আমরা তখন নিজের নিজের স্থান থেকে আইন ভাঙার মাধ্যমে, কাজ ফাঁকি দিয়ে বীরত্ব খুঁজে পাচ্ছি।
এভাবেই ওরা এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা পেছাচ্ছি প্রতিনিয়ত। ওদের দেশপ্রেম ওরা দেখাচ্ছে ওদের কাজ দিয়ে, সত্যিকারার্থে। আর আমরা শুধু ১৬ ডিসেম্বরে লাল সবুজ ড্রেস পরে বা ২১ ফেব্রুয়ারিতে সাদা কালো ড্রেস পরে খালি পায়ে শহিদ মিনারে গিয়েই দায়িত্ব শেষ করছি। আমি জানিনা, এভাবে আসলেই আমরা কোনদিনও বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারব কি না।