জাতীয়তাবাদের অনুভূতির উৎস হল মানুষের সংঘবদ্ধ হবার প্রবণতা । ঊর্ধ্বতনের এক বিবর্তনীয় কৌশল হল সংঘবদ্ধ বা গুষ্টির সংহতি হওয়া । এছাড়াও জাতীয়তাবাদ একটি আদর্শ যেখানে জাতীকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করে অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শকে পরে স্থান দেয়া হয় । কিন্তু আদতে জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনীয়তা কতোখানি তা বিবেচ্য বিষয় ।
স্বদেশপ্রেম হচ্ছে স্বভাষা-ভাষী এবং ভৌগোলিক বিবেচনায় একই অঞ্চলে বসবাসরত মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আত্মকেন্দ্রিক স্বজাত প্রবৃত্তি এবং নিজেকে অন্য জাতি বা গুষ্টি থেকে আলাদা করে দেখার যে মন-ভাবনার উত্থান বা মননশীলতার সৃষ্ট হচ্ছে স্বদেশ প্রেম । যা সার্বজনীন বিশ্ব নাগরিক, বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতার ও শান্তির আদর্শে বিশ্বাসী একটি বৈশ্বিক মতবাদে ভর না করে বরঞ্চ একটি সঙ্কীর্ণ ও অন্ধ দৈশিক বা জাতীয় চেতনার বলয়ে আবদ্ধ থাকে, কিন্তু প্রকৃত ব্যক্তির চিন্তা, মানস ও দৃষ্টিকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে তথা শক্তিকামী আন্তর্জাতিকতায় উপনীত হওয়াই সমসাময়িক কর্তব্য ।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন জাতীয়তাবাদের উপর ভর করে নিজেদের শোষণ দমন নিপীড়ন থেকে মুক্তির স্বাদ মিলেছে তেমনি সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সম্প্রসারণবাদের মরণ নাশক বিধ্বংসী ছোবলের হাত থেকে রেহায় মিলেছে । ঠিক তার বিপরীতে বুর্জোয়া শ্রেণী পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম বর্তমান ক্রিকেট বাণিজ্য । ক্রিকেটকে যেখানে নিছক বিনোদনের সীমানায় সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ সেখানে প্রতিনিয়ত উগ্র জাতীয়তাবাদী বিজ্ঞাপনে বাম্পার বীজের বুনিয়াদে ব্যাপক ফায়দা লুটছে, যা দিনকে দিন জাতিগত বিদ্ধেস, আত্মকেন্দ্রিক অসুস্থ মননশীলতায় উদ্বোধ হচ্ছে । স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী মন-ভাবনার উত্থানের জন্য যেমন জাতীয়তাবাদে ভর করে ফায়দা লুটে নেওয়া যায় ঠিক তার পরবর্তীতে সেই জাতীয়তাবাদকে পুঁজি না করে সার্বজনীন চিন্তা করায় বিবেচ্য বিষয় ।
জাতীয়তাবাদ ঐতিহাসিক কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায় যখন এর উদ্বর্তনী মূল্য থাকে । ১৯৭১ সালের বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধ ঠিক তেমনই এক ঐতিহাসিক কারণ । পাকিস্তান জাতি কর্তৃক বাঙ্গালী জাতীকে আক্রমণ হিসেবে দেখে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়াটাকে আক্রমণ প্রতিহত করা ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এক শক্তিশালী প্রেরণার উৎস বা উদ্বর্তনী কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু তাই বলে পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী চেতনা বা স্বদেশপ্রেম নিয়ে লজ্জিত বা গর্বিত বোধ করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুলের বেপার হচ্ছে পরবর্তীতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে জাতীয়তাবাদ বা স্বদেশপ্রেমকে মুখ্য ও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে একটি জাতীকে তার মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কীর্ণ ভাবনায় গড়ে তুলে যা অন্য জাতি থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দাবীদারে অথবা নিজ স্বদেশে অন্য নৃগুষ্টিকে ছোট করে দেখার প্রবণতায় হয়ে থাকে বিভুর মাতোয়ারা ।
যদিওবা রাষ্ট্রহীন এক পৃথিবী এক অলীক বস্তু, তারপরেও প্রত্যেকের উচিত সীমান্ত বিহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা, উপরন্তু এই ভাবনার ছড়িয়ে দেয়ার ফলে বেশ কিছু দিক দিয়ে সমাজ রাষ্ট্র উপকৃত হবে যেমন বর্ডার বাহিনীর নৃশংসতা দূরীকরণে মনস্তাত্ত্বিক সংস্কারে, বিশ্ব মানবিকতায় উদ্বোধতা অথবা আন্তর্জাতিক সহমর্মিতার যোগান দিয়ে যাবে প্রতিনিয়ত । বর্তমান ভিয়েতনামের দৃষ্টান্ত উদাহরণ টেনে বললে বলা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে মার্কিন আগ্রাসন ও আধিপত্যের অধীনে থেকে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও তাদের সংবিধানে জাতীয়তাবাদের উল্লেখ্য নেই । সংবিধানে বিভিন্ন উপজাতির স্বকীয়তাকে সংরক্ষিত করার উপর জোর দেয়া হয়েছে, সবাইকে ভিয়েতনামী হয়ে যেতে হবে বলা হয় নি ।
দেশপ্রেম অথবা জাতীয়তাবাদ ব্যক্তি বা সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থের উপরে উঠে দেশের সামগ্রিক স্বার্থকে স্থান দেয় । সেই অর্থে দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ মনে হতে পারে সার্বজনীন ভাবে স্বীকৃত মহান গুন বা আদর্শ । কিন্তু আদতে নিজ দেশকে অন্য দেশ থেকে আলাদা করে এক বিশেষ স্থান দেওয়া বা আনুকূল্য দেয়া, যা গুনাগুণ বিচার না করেই দিনকে দিন ভিন্ন দেশের প্রতি সংকীর্ণমনা, গোঁড়ামি, উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবনায় রূপ দিয়ে যাচ্ছে, যা অন্যসকল রাষ্ট্রের প্রতি স্বজনপ্রীতি সৌভ্রাতৃত্ববোধ তো দূরের কথা যা অনাস্থা আর ঘৃণার অণুঘটক হয়ে কাজ করছে স্বদেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ । তাই নিজেকে বিশ্ব নাগরিক অথবা সার্বজনীন মানবতার দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদের চর্চায় নিজ নিজ স্ব ভাষা ভাষী সকল আঞ্চলিকতার হাত ধরে এগিয়ে যাওয়াই প্রকৃত মানুষ ও সুস্থ মননশীলতার বহিঃপ্রকাশ ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:১৯