মাসল স্ফীতি বা মাসল গেইন নিয়ে যে আলোচনা আমরা শুরু করেছিলাম গত ৪র্থ কিস্তিতে তার একটা আপাত শেষ টানার চেষ্টা করেছি। সেখানে কোন প্রশ্ন থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্লগেই করতে পারেন, এতে প্রসঙ্গের একটা ধারাবাহিকতাও রক্ষা হবে। এই কিস্তিতে কথা বলবো ফিটনেস নিয়ে। ধরে নিচ্ছি আপনি কিস্তি ১ থেকে ৪ পর্যন্ত পড়েছেন। তার আলোকেই পরবর্তী আলোচনা শুরু করার ইচ্ছা রাখি। পূর্বের কিস্তি গুলোর সঙ্গে এই কিস্তির বেসিক কিছু তফাত আছে। আগের কিস্তি গুলোতে আমাদের আল্টিমেট টার্গেট ছিল পেশী বা মাসল গেইন করা। কিন্তু এই কিস্তির মূল লক্ষ্য হচ্ছে ফ্যাট নিয়ন্ত্রন ও ফিটনেস। ফিটনেস বলতে সেটাই বুঝাতে চাচ্ছি যেখানে মূললক্ষ্য মাসল গেইন বা বডিবিল্ডিং নয়, বরং শরীরের অপ্রয়োজনীয় ফ্যাট দূর করে একটা সুঠাম কাঠামো মেইনটেইন করা। এই কাঠামো গড়ে তুলতে কিছু মাসল গেইনের দরকার হলেও হতে পারে, সেটাও ফিটনেস কার্যক্রমের আওতার মধ্যেই আমরা ধরে নিব। নীচে এক এক করে পয়েন্ট আকারে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। কোনো অংশে সমস্যা থাকলে প্রশ্ন করবেন। প্রথমে ওভার অল কনসেপ্ট ও সেই সঙ্গে প্রচলিত কিছু মিথ নিয়ে কথা বলবো। ধারনাটা পরিস্কার হলে করনীয় বিষয় নিয়ে কথা পাড়বো। এক পোস্টেই লিখে ফেললাম, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়বেন আশা রাখি। চাইলে মাঝে বিরতি নিতে এক কাপ চা খেয়ে আসতে পারেন । তাহলে শুরু করি।
১।ফ্যাট সম্পর্কে বেসিক কিছু আলোচনা
কয়েক বিলিয়ন ফ্যাট সেল ছড়িয়ে আছে আমাদের গোটা শরীর জুড়ে। বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে এর পরিমান বিভিন্ন। যেমন পেটে, গালে যে পরিমান ফ্যাটসেল আছে সে পরিমান সেল আমাদের থাই বা লেগ মাসলে নাই। আমাদের হার্টের যে আর্টারি বা নালী সেখানেও এটা বর্তমান। ফ্যাট সঞ্চিত হয়ে এই আর্টারিগুলো যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন আমরা একে বলি হার্ট এটাক। মস্তিস্কের সুক্ষাতিসুক্ষ রক্তনালীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা ফ্যাট জমে নষ্ট হয়ে গেলে এই নালি গুলো রক্তের স্বাভাবিক চাপ নেবার ক্ষমতা হারায় । ফলশ্রুতিতে মস্তিস্কের অভ্যন্তরে তা ফেটে গিয়ে যা ঘটে তার নাম স্ট্রোক। আমাদের একটা ভুল ধারনা, ফ্যাটের গন্তব্য মনে হয় পেট বা ভুঁড়ি। বস্তুত এই অংশে ফ্যাট সেলের পরিমান যেহেতু বেশী তাই পরিবর্তনটা এখানেই আগে লক্ষনীয় হয়ে উঠে। আসলে এই ফ্যাটসেল গুলো শরীরের সব জায়গায় কমবেশী বিদ্যমান। আমরা যে খাবার গ্রহন করি, শরীরের ক্ষয়পূরন ও বৃদ্ধি সাধনের পর একটা অংশ ফ্যাট হিসাবে গোটা শরীরে ছড়ানো ফ্যাট সেলে গিয়ে জমা হয়। জমা হয় আর্টারির ভেতরে, ত্বকের নীচে, পেটে, গালে, হাতে, পায়ে চোখের নীচে, চেস্টে সব জায়গায়, যেখানে যেখানে ফ্যাটসেল বিদ্যমান সেখানে সেখানে।
২। একে বার্ন করার উপায় কি?
ফ্যাট কি, কোথায় থাকে সেটা বোঝা হলো, কিন্তু একে বার্ন করার উপায় কি? ফ্যাট মানেই সঞ্চিত শক্তি বা ফুয়েল। ভবিষ্যতের প্রয়োজনে সিস্টেম জমা করে রেখেছে। তাহলে এই ফুয়েল কে বার্ন করতে হলে আমাদের শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। যদি আমরা ৫০০ কিলো ক্যালরী সমপরিমান কাজ করি যেমন এক ঘন্টা বেশ জোরে হাঁটি, শরীর তার সঞ্চিত ফ্যাট বার্ন করে ৫০০ কিলো ক্যালরী শক্তি জোগাবে। দেখা গেছে ১০০০ গ্রাম ফ্যাট বার্ন করে পাওয়া যায় আনুমানিক ৯০০০ কিলোক্যালোরী পরিমান শক্তি। তার মানে একঘন্টা জোরে হাঁটা মানে মাত্র ৫৫ গ্রাম ফ্যাট বার্ন করা!! আমাদের প্রতিদিনের শরীরবৃত্ত্বীয় কাজের জন্যও কিন্তু বিশাল পরিমান শক্তি ব্যয় হয়। আর তা আসে আমাদের সঞ্চিত ফ্যাট বার্ন করে। আমরা যদি কাজ কর্ম না করে ২৪ ঘন্টা ঘুমও পাড়ি, তাহলেও আমাদের প্রায় ১৭০০->২২০০ কিলোক্যালোরী পরিমান শক্তি খরচ হয় শুধু বেঁচে থাকার জন্য। তার মানে আমি যদি আজকে কায়িক শ্রম করে ৪০০ কিলোক্যালোরী শক্তি বার্ন করি তবে সারাদিনে আমার মোট ক্যালরী বার্ন হবে প্রায় ৪০০+(১৭০০->২২০০)= ২১০০->২৬০০ কিলোক্যালোরী। এই শক্তি জোগাতে শরীর বার্ন করবে প্রায় ২৭৫ গ্রাম ফ্যাট। ওক্কে। এখন যদি রাতে একটা বড় সাইজের খাশির চাপ কিংবা সিনার মাংশের কিছু শাহী টুকরা খেয়ে ৩০০ গ্রাম ফ্যাট আহরন করি তবে আজকের সব কসরতই বৃথা।
৩।শরীরের কোন অংশের ব্যায়াম কি শুধু সে অংশেরই লোকাল ফ্যাট বার্ন করে?
ফ্যাট কমিয়ে স্লিম হবার কথা আসলেই আমরা ধরে নেই ভুঁড়ি কমানোর কথা হচ্ছে বা আমাদের আগ্রহটা ভুঁড়ি কেন্দ্রিক। আসলে এমন কোন সিস্টেম নাই যে শরীরের বাকী অংশের ফ্যাট অপরিবর্তনীয় রেখে শুধু পেটের ফ্যাট কমিয়ে ফেলবে। এটা এরকম নয় যে আমার ব্যাবসার জন্য কয়েক টন খাদ্যশস্য বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে মজুদ আছে, এই বছরে বিক্রীর সময় আমি সাভার কিংবা গাজীপুরের স্টোরটা আগে খালি করবো, বাকী গুলা পরে। আসলে পরিশ্রমের সময় খরচকৃত শক্তির জোগান দিতে সিস্টেম তার নিজেস্ব হিসাব মতো সব অঙ্গ প্রতঙ্গ থেকেই সঞ্চিত ফ্যাট খরচ করবে। পেটের ব্যায়াম করছি মানে শুধু পেটের ফ্যাটই বার্ন হচ্ছে, কিংবা দৌড়াচ্ছি তাই লেগ আর থাই এর ফ্যাট ক্ষয় হচ্ছে চেস্ট গলা বা পেটের সঞ্চিত ফ্যাটের উপর কোন আসর হচ্ছেনা এটা ভুল ধারনা। আর তাই পেটের ফ্যাট কমাতে বিশেষ কিছু পেটের ব্যায়াম, চেস্টের ফ্যাট কমাতে বিশেষ কিছু চেস্টের ব্যায়াম বা গালের ফ্যাট কমাতে শক্ত চিউং গাম ২৪ ঘন্টা চাবানো এগুলো মিস লিডিং ধারনা। এরকম ধারনা যদি বিভিন্ন টেলিশপিং এডের কল্যানে আমাদের উপর আসর করে থাকে তবে এখনি সময় একে জড় সহ গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা। আসলে শক্তির জোগান দিতে গিয়ে কোথাকার ফ্যাট কতটুকু বার্ন করবে তার শেষ হিসেব করবে আপনার সেন্ট্রালাইজড সিস্টেম। এটা সেই অঙ্গের কোন লোকাল ডিসিশন নয়। পরিশ্রম দেহের যে অংশেই হোক, সকল অংগ প্রত্যঙ্গের সঞ্চিত ফ্যাটের উপর তার সুপষ্ট প্রভাব পড়বে, কিছু কম বা বেশী। তাই ফ্যাট বার্ন করতে হলে খেয়াল রাখতে হবে টোটাল কি পরিমান ক্যালরী আমি পোড়াতে পারবো, কোন অঙ্গের পরিশ্রম হলো এটা বড় কথা নয়। দেখা গেছে জোরে হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা এগুলি বেশ ভাল রেটে সারাদেহের ফ্যাট বার্ন করতে পারে কারন বড় বড় মাসল এই কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
৪।শুধু কায়িক পরিশ্রম করে ফ্যাট নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়না?
শুধু কায়িক পরিশ্রমই যথেষ্ট নয় । কেন নয় বলি। আসলে আমাদের কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার যে বৈশিষ্ট্য তাতে খুব দ্রুত ক্যালরী বার্ন করে প্রচুর শক্তি উৎপন্নের ক্ষমতা আমাদের নাই। আরকেটু ব্যাখ্যা করি। একটা চিতা বাঘের কথা ধরেন। তার দরকার এক্সিলারেসন, মানে স্থির অবস্থা থাকে খুব দ্রুত স্পীড তোলার ক্ষমতা। এরপর ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার স্পীডে মিনিট দশেক শিকারের পিছনে দৌড়ানোর সক্ষমতা। কিভাবে তোলে সে এই পরিমান স্পীড? নেচার এদের কোষগুলো এমনভাবে তৈরী করেছে যে এরা খুব দ্রুত সঞ্চিত ফ্যাট বার্ন করতে পারে। বার্ন করে উৎপন্ন শক্তি তার ৫০ থেকে ৬০ কেজির শরীরকে ১০০ কিলোমিটার স্পীডে শিকারের দিকে টেনে নিতে সাহায্য করে। তাই শক্তিশালী পেশী থাকলেই হবেনা, সেই পেশীতে দ্রুত ফুয়েল বার্ন করে শক্তি সরবরাহের নেচার প্রদত্ত ক্ষমতাও থাকতে হবে। দুঃখজনক মানুষের সেটা নাই। সে চাইলেও অন্যসব প্রানীর মত দ্রুত ফ্যাট বার্ন করতে পারেনা। তার কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্যালরী বার্ন করার ক্ষমতা সীমিত। চিতা বাঘের মতো মাইটোকন্ড্রিয়া যদি তার থাকতো তবে আধা ঘন্টা দৌড় দিলেই কেল্লাফতে, খাওয়া দাওয়ার অতিরিক্ত অংশ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু ছিলনা । আধা ঘন্টার দৌড়ে ১০০০ কিলোক্যালরী খতম । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আধা ঘন্টা দৌড় দিয়ে মানুষ ২৫০ কিলোক্যালরী পোড়াতে পারে কিনা সন্দেহ। ধরেন আপনি একঘন্টা দ্রুত হেঁটে আসলেন, বেশ ক্লান্ত, সিড়ি দিয়ে শরীরটা আর উঠেনা, মনে মনে ভাবছেন সারাদিন যা খেয়েছেন রাস্তায় আজ সব পুড়ায়ে দিয়ে এসেছেন। ভুল ধারনা। আসলে এই একঘন্টার প্রানান্তকর পরিশ্রমে আপনি দুখানা ডিমে যে পরিমান এনার্জি আছে তার চেয়েও কম পরিমান শক্তি ব্যয় করে এসেছেন!! কষ্ট হচ্ছে ভাবতে? কিন্তু ফ্যাক্ট। কি আর করবেন, পরের জন্মে রয়েল বেঙ্গল টাইগার হয়ে জন্ম নিয়েন। পরিশ্রম সেরে ক্লান্ত শরীরে কি করি আমরা? ঘন্টা খানেক হেঁটে এসে ভাবি যা ধকল গেছে দুখানা বড় দেখে হাঁসের ডিম সিদ্ধ করতে দেয়া যাক । সামান্য একটু খিদাও তখন লাগে। ব্যাস। যেটুকু পুড়ায়ে আসলাম তারচেয়ে বেশী গ্রহণ করার আয়োজন শুরু করলাম। আর তাই বছরের পর বছর রমনা আর সংসদ ভবনে হাঁটছি কিন্তু পেট আর গাল যেরকম ছিল সেরকমই থেকে যাচ্ছে। থাকবেনা কেন ? এতো অঙ্কের সরল হিসাব। এনার্জির আয় আর ব্যায়ের সমতা যদি না আনতে পারি তবে উদ্বৃত্ত এনার্জিটুকু যাবে কোথায়? যাবে ফ্যাটসেলে।
৫।আচ্ছা শুধু খাদ্যগ্রহন কমিয়ে দিয়ে ফ্যাট কমানো যায়না?
খুব যায়।শুধু ফ্যাট কেন, দিনের পর দিন প্রয়োজনের চেয়ে কম খেয়ে পেশীগুলো ক্ষয় করে হাসপাতালেও যাওয়া যায়। এনার্জির ব্যায় যদি আয়ের চেয়ে বেশী হয় তবে যা হবার তাইই হবে। বেঁচে থাকার জন্য যে ১৭০০ থেকে ২২০০ কিলোক্যালরী সেটা তো কমপক্ষে জোগান দিতে হবে। শুধু কম খেয়ে পাতলা থাকা ক্রুড একটা পদ্ধতি, সায়েন্টিফিক নয় ,দেহের জন্য ক্ষতিকর। এতে পাতলা দেখায় কিনা জানিনা তবে অপুষ্ট দেখায়। রোগ ব্যাধি বাসা বাধে। আমরা নিশ্চয় অপুষ্ট কাঠামোর জন্য এত কসরত করছিনা। যাহোক, এর মানে মনের সুখে আমরা খেতে থাকব এরকম কোন ম্যাসেজ এখানে দেয়া হচ্ছেনা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন। আসলে এনার্জির আয় আর ব্যায়, এই দুয়ের সমতা না হলে সব মাটি। ৭ নং পয়েন্টে খাদ্য তালিকা নিয়ে কিছু কথা বলা যাবে।
৬।আচ্ছা আন্ডার ওয়েট, ওভার ওয়েট বলে একটা কথা প্রায়ই শুনি এটা কি?
হ্যাঁ, বয়স অনুযায়ী হাইট আর এক্সপেক্টেড ওজনের একটা চার্ট আছে বটে তবে এটাকে এতো সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই। শুধু চার্ট দেখে বলে ফেললাম আমি আন্ডার ওয়েট বা ওভার ওয়েট বা এক্কেবারে ফিট ব্যাপারটা এতো সোজা না। এর পেছনে কিছু কথা আছে। চার্ট হচ্ছে এভারেজ একটা গাইড লাইন। এর কমবেশী হওয়া যাবেনা বা ডেভিয়েশন এর চেয়ে বেশী হলে সমস্যা বা চার্ট অনুযায়ী ওজন থাকলে আমি একেবারে ফিট এরকম দাবি মেডিকেল সায়েন্স কখনো করেছে বলে আমার জানা নাই। যে ওজন আপনি মাপছেন সে ওজনটা কি থেকে আসছে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার। ধরলাম বয়স আর উচ্চতা অনুসারে জলিল আর রফিকের ওজন এভারেজ ৬৮ কেজি থাকা দরকার, তাদের সেটাই আছে। তার মানে কি উভয়েই ফিট? নাও হতে পারে। জলিলের শরীরে পর্যাপ্ত ফ্যাট থাকতে পারে। ফলে জলিলের যে ওজন সেই ওজনের বেশিরভাগ আসছে তার ফ্যাট থেকে। আর রফিকের শরীরে ফ্যাট কম তাই তার ওজনটা আসছে মাংশপেশী থেকে। তার মানে চার্টের সঙ্গে মিললে আমি ফিট আর না হলে নই ব্যাপারটা এরকম না। আমরা কখনই চাইনা আমাদের ওজন ফ্যাট দিয়ে কভার হোক। ওজন যদি বাড়াতেই হয়, কিছু মাংশপেশী গেইন করা উত্তম যাতে ওজনটা মাংশপেশী থেকে আসে। কিছু পেশী অর্জন করতে চাইলে কিস্তি ১ থেকে ৪ ফলো করতে পারেন। ওজনটা যদি মাংশপেশী থেকে আসে তবে শারীরিক কাঠামোর মধ্যে বেশ একটা ঝড়ো ভাব আসে, এর সঙ্গে শরীরের বেসিক মেটাবলিক রেটও বেড়ে যায়। শরীরের জন্য ভাল।
৭।দীর্ঘ মেয়াদে ফ্যাট নিয়ন্ত্রন
তাহলে পয়েন্ট ১ থেকে ৬ এ ব্যপারটা যেটা দাঁড়ালো তা হোলো অতিরিক্ত ফ্যাট কে নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য দু্টোই দরকার, এক পরিমিত খাদ্য গ্রহন আর দুই সেই সঙ্গে নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম । এই দুইটির সঠিক সমন্বয় না হলে এটা নিয়ন্ত্রন করা কষ্টকর। খুব সহজ কথা, খেলাম বেশী আর বার্ন করলাম কম, তাতে লাভ টা কি? প্রাক্টিক্যালি দেখা গেছে শুধু পরিশ্রম করে একে নিয়ন্ত্রনে রাখা কষ্টকর। কেন কষ্টকর তা ৪ নং পয়েন্টে আলোচনা করা হয়েছে। পাঠক খেয়াল রাখবেন এখানে আমি এক্সারসাইজ বলছিনা বলছি পরিশ্রম মানে কায়িক পরিশ্রম, যাতে কমপক্ষে ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোক্যালোরী এনার্জি ব্যায় হবে। হতে পারে যে কোন পরিশ্রম যেমন ৪৫ মিনিট থেকে একঘন্টা দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো, সুযোগ থাকলে সাঁতার কাটা। প্রতিদিন পারলে খুবই ভাল না পারলে সপ্তাহে ৪ দিন তো মাস্ট। মনে রাখবেন হাঁপাতে হাঁপাতে খুব জোরে দৌড়ানোর দরকার নাই। একই পরিমান দুরত্ব আপনি দৌড়ে কভার করছেন না হেঁটে কভার করছেন তাতে ক্যালরীর উপর এমন বিশাল কিছু প্রভাব ফেলেনা। হাঁটতে চাইলে জাস্ট একটু জোরে হাঁটবেন ঘন্টা খানেক। তবে কমপক্ষে ৩-৪ কিলোমিটার। অনেককে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এরকম বলতে শুনি যে, আমার যে পেশা তাতে যে পরিমান পরিশ্রম হয় কিংবা পুরো সংসার সামলে বাচ্চাদের আনা নেওয়ায় যে দৌড়াদৌড়ি হয় কিংবা আমি বসবাস করি ৪ তলায়, প্রতিদিন উঠা নামা করতেই যে পরিশ্রম হয় তাতে অতিরিক্ত আর কায়িক শ্রমের প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। বেশ। আপনি যদি মনে না করেন তো তাই। আমি যুক্তি তর্কে যাবনা। কিন্তু এই আত্মতুষ্টি নিয়ে আপনি ফ্যাট কমাতে পারবেন, এরকমটা আমি মনে করিনা। এনিওয়ে যারা বাইরে একেবারেই বেরোতে চাননা তারা একটু খরচ করে ঘরে দৌড়ানো বা জোরে হাঁটার জন্য ট্রেডমিল মেসিন কিনে নিতে পারেন। মেসিন যখন বলবে যে আপনার ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোক্যালরী খরচ হয়েছে তখন থামুন। আবার আমাদের অনেকের ধারনা যেহেতু আমি জিমে ভার উত্তোলন বা ওয়ার্কআউট করি বা কমপক্ষে ফ্রি হ্যান্ড এসারসাইজ করা হয় তাই এই হাঁটাহাটি বা সাইক্লিং এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ভুল ধারনা। ফ্রি হ্যান্ড তো দুরের কথা,জিমে ভার উত্তোলন করে ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোক্যালরী খরচ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারন হচ্ছে এখানে এনার্জি খরচ হচ্ছে ডিসক্রিট টাইমে, পালস আকারে।যখন ভারটা উপরে বা নিচে নামাচ্ছেন শুধুমাত্র তখন। আর আপনি যখন জোরে হাঁটছেন তখন এনার্জি খরচ হচ্ছে নিরবিছিন্ন ভাবে, তার উপর থাই, হিপ, লেগ সংলগ্ন বড় বড় পেশী এই কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করছে। এর ফলে যখন পুরো একঘন্টার খরচকৃত এনার্জি আপনি একুমুলেট করবেন তখন দেখবেন জিমে কাটানো ঔ একঘন্টার খরচ, জগিং বা সাইক্লিং এর তুলনায় অতি নগন্য। আগেই বলেছি ভার উত্তোলন বা ওয়ার্কআউটের মেইন উদ্দেশ্য ফ্যাট বার্ন নয়, শরীর কে সিগ্ন্যাল দেয়া। সিগ্ন্যালের ব্যাপারে আরো পরিস্কার ধারনার জন্য দেখে নিতে পারেন কিস্তি ১ থেকে ৪। যারা খোলা যায়গায় দ্রুত হাঁটতে চান তারা চাইলে কিছু মোবাইল এপ্লিকেশনেরও সাহায্য নিতে পারেন।দুর্দান্ত কিছু ফ্রি এপ্স এখন সব ওএস এর জন্যই আছে। তবে মোবাইলে জিপিএস থাকা লাগবে। এপ্লিকেশন বলে দিবে আপনি কত স্পীডে হাঁটছেন, কত কিলোমিটার হাঁটা হলো ইত্যাদি। তবে মোবাইল এপস ব্যাবহার জরুরী কিছু না। আপনার কাছে বাহুল্য মনে হলে লিভ ইট।
এবার খাওয়া প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি। প্রতি বেলা ভাত খাবেন চায়ের কাপের দুই থেকে তিন কাপ। ভাতের বদলে রুটি খেলে হাতে বানানো গোটা তিনচারেক পাতলা রুটি, মাছ মাংশ থাকলে দুই তিন টুকরোর বেশী নয়। নারীদের জন্য ভাত ও রুটির পরিমান আরেকটু কম। ভাত রুটি যাই বলেন এই শর্করা প্রয়োজনের থেকে বেশী গ্রহন করলে লিভার অতিরিক্ত অংশকে ফ্যাটে কনভার্ট করে ফেলবে। অনেকের ধারনা আমি তো ভাত রুটি খাচ্ছি ফ্যাট খাচ্ছিনা সুতরাং সমস্যা কি? ভুল ধারনা। লিভার এমন এক রাসায়নিক ল্যাবরেটরী যে অতিরিক্ত সব কিছুকেই ফ্যাটে কনভার্ট করে ফেলতে পারে। রান্না মাংশের ফ্যাট সমৃদ্ধ ঝোল এভয়েড করবেন। খাওয়ার সময় মনে রাখবেন একঘন্টা কসরত করে পুড়াতে পারবেন মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ গ্রাম ফ্যাট। ফ্যাট মানেই হাই এফিসিয়েন্ট কন্সেন্ট্রেটেড এনার্জি। অল্প তেলে রান্না ডাল ও সবজি খাবেন পরিমান মতো। কিছু ফ্যাটের দরকার শরীরের নিশ্চয় আছে। ডিম খেলে কুসুমটা বাদ দেয়ার চেষ্টা করবেন। সম্ভব হলে সালাদ , ফল ফলারি খাবেন। মাস খানেক ধরে রাখেন, দেখবেন অভ্যাস হয়ে গেছে। তখন এই পরিমান খেয়েই আপনার পরিতৃপ্তি আসবে। আমাদের স্টমাক বা পাকস্থলী আসলে একটা প্লাস্টিক ব্যাগের মত। দিনের পর দিন বেশী খেলে এটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। তখন অল্প খাদ্যে আর পরিতৃপ্তি আসেনা। তাই খাবার পরিমান কমিয়ে দিলে এটা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আকারে ছোটো হয়ে আসবে। তখন উপরে দেয়া খাদ্যেই আপনার পাকস্থলী পরিপূর্ণ মনে হবে। ধীরে ধীরে চিবিয়ে সময় নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাদ্য গ্রহন করেন। খাদ্য গ্রহনে মিনিট বিশেক সময় ব্যয় করেন। চলতে থাকুক বছরের পর বছর। সঙ্গে উপরে দেয়া কায়িক পরিশ্রম। বেশীদিন নয়, মাস দেড়েকের মধ্যেই আপনি পরির্তনের আলামত বুঝতে পারবেন। একটা ওজন মেশিন কিনে নিতে পারেন। প্রতি সপ্তাহে একবার করে মনিটর করলেন। তবে প্রতিদিন আপনি ওজন মেশিনে দাঁড়ায়ে আছেন এরকমটা ভাবতে আমার ভাল লাগবেনা। যা কিছু বাহুল্য তা বর্জনীয়।
৮।কায়িক পরিশ্রমের পাশাপাশি ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করলে কেমন হয়?
চমৎকার হয়। তবে এই ব্যায়াম কোনভাবেই উপরে উল্লেখিত কায়িক পরিশ্রম, মানে ৩-৪ কিলোমিটার জোরে হাঁটা, সাঁতার বা সাইকেল চালানোর বিকল্প নয়। আপনি ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করেন আর নাই করেন ,উল্লিখিত কায়িক পরিশ্রম আপনাকে জারি রাখতেই হবে যদি আপনি মোকামে পৌঁছাতে চান (পয়েন্ট ৪ ও ৭ এ এর ব্যাখ্যা আছে)। প্রতিদিন ৬ সেট ১০ রেপ পুসআপ (বুক ডন) করতে পারেন। উঠাবসা করেন একই ভাবে। পরে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী সেট ও রেপ (কিস্তি ১-৪) বাড়িয়ে নিতে পারেন। কিছু স্ট্রেচিং ও করতে পারেন। আসলে বাসার মধ্যে এই ব্যায়াম শরীরকে স্ট্রং ও ঋজু করে তুলবে। ৩০ মিনিট এনাফ, এর চেয়ে বেশী করে অতিরিক্ত কোন লাভ নাই। জাস্ট সময়ের অপচয়। বরং আপনার জীবন যুদ্ধের জন্য বাকী সময়টা কাজে লাগান। উপরে দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাট নিয়ন্ত্রনের যে পদ্ধতি বললাম এর সঙ্গে এই ফ্রিহ্যান্ড যোগ করতে পারলে দেখবেন আপনাকে বেশ ফ্রেশ ও স্ট্রং দেখাবে। এমনকি সামান্য কিছু মাসলও আপনি গেইন করে ফেলবেন। তবে ঐ একটাই কথা ধরে রাখতে হবে।
পরিশেষে-
কিছু রুটিন ওয়ার্ক আর খাওয়া দাওয়ার চার্ট দিয়ে দিলেই হয়তো চলতো, কিন্তু উপরে বিস্তারিত আলোচনার উদ্দেশ্য একটাই, সঠিক ও স্বচ্ছ কনসেপ্ট গড়ে তোলা । যে কোনো কাজই হোক, একবার কনসেপ্ট বা মেকানিজমটা বুঝে নিতে পারলে তা মেনে চলা বা আমল করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে উঠে। আসলে উপরে যা আলোচনা হয়েছে তা মেনে চলা কঠিন কিছু নয়। একটাই চ্যালেঞ্জ, এটা ধরে রাখা। যেটুকু বলা হলো সেটুকুই নিয়ম মত ফলো করেন, এর বাইরে অতিরিক্ত কিছু করে দ্রুত ফল লাভের চেষ্টা না করাই উত্তম। মূল কথা হচ্ছে এটা আমাদের সারা জীবনের রুটিন, একে ধরে রাখতে হবে, তাই যা কিছু বাহুল্য যা কিছু অতিরিক্ত সেটা বর্জন না করে যে উপায় নাই। আপাতত এই প্রসঙ্গে একটা ইতি টানি। কমেন্টে বাকী আলোচনা হতে পারে।
কিস্তি-৪ কিস্তি-৩ কিস্তি-২ কিস্তি-১
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:৩০