আমি ইন্দোনেশিয়ায় দেখেছি বিয়ারকে তারা মাদক মনে করে না। প্রথমে মনে করেছিলাম এটা মনে হয় শুধু জাকার্তার ব্যাপার। পরে গ্রামে গিয়ে দেখেছি একই চিত্র। গ্রামের মোড়ের দোকানটায়ও বিয়ারের একটা আলাদা সেলফ আছে। তাতে সাজানো আছে নানান স্থানীয় ব্রান্ডের বিয়ার। স্থানীয় কফি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বিয়ারও। আমাদের দেশে যেমন অনেকে দুধ চা আর অনেকে রং চা অর্ডার করে, ইন্দোনেশিয়ায়ও তেমনি রাস্তার মোড়ের ছোট্ট দোকানেও মানুষ কফি বা বিয়রের অর্ডার দেয়। অনেকের সাথে তর্ক করেছি, কিন্তু কেউ মানতেই চায়নি আমার কথা। ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের একই কথা, বিয়ার কোন অবস্থাতেই মদের মতো হারাম পানীয় নয়। যেমন সিগারেট মাদক নয়, হারাম নয়।
ইন্দোনেশিয়ার প্রায় সবাই ধুমপান করে। আমার মনে হয় পার্সেন্টেজ করলে ইন্দোনেশিয়াই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধুমপায়ীদের দেশ হিসাবে এক নম্বরে থাকবে। সারা বিশ্বের মতো আমাদের বাংলাদেশেও বিড়ি-সিগারেট কে কেউই মাদক হিসাবে ধরে না। মাদকের বিরুদ্ধে যত আইনই হোক বিড়ি-সিগারেট সেই আইনের বাইরে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে যে কারণে ইয়াবা, ফেন্সিডিল বা গাঁজাকে মাদক বলা হচ্ছে, তার সব কারণই বিড়ি-সিগারেটের মধ্যে বিদ্যমান। বিড়ি-সিগারেটে নেশা হয়। আর নেশা হয় বলেই একবার যারা ধরে তারা সহজে ছাড়তে পারে না। শারীরিক ক্ষতির দিক দিয়ে অন্য অনেক বাদকের চেয়ে বিড়ি-সিগারেট এগিয়ে। আর আর্থিক ক্ষতি, সময়ের ক্ষতি সেগুলোতো আছেই। বিড়ি-সিগারেটের আর একটা বড় খারাপ দিক হচ্ছে, ধুমপায়ীর পাশে থাকা অনেকেই ধুমপায়ীর মতো সমান শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়। একটা বড় বাসের মধ্যে একজন সিগারেট ধরালেই বাসের ভিতরের সকলেরই সিগারেট খাওয়া হয়ে যায় বলে একটা গবেষণার ফলাফল দেখেছিলাম। সেই সিগারেটকে আমরা কেউ হারাম বলি না, মাদকও বলি না, নেশাও বলি না। অথচ ধুমপানের নেশায়ই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ নেশাগ্রস্ত। অনেকে ধুমপানকে ছহিহ প্রমাণ করতে যুক্তি দেখাতে পারেন যে, ধুমপানে নেশা খুব সামান্য, ধুমপান করে কেউ মরার মতো পড়ে থাকে না বা পাগলামিও করে না। অথবা ধুমপানে শারীরিক ক্ষতি খুবই ধীরগতিতে হয়, আর্থিক ক্ষতিও তুলনামুলক কম। তাদের জন্য বলা ভাল যে, হুইস্কির চেয়ে রেড ওয়াইন অনেক কম এ্যাফেকটিভ, সাধারণত হুইস্কিতে এ্যালকোহলের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে রেড ওয়াইনের চেয়ে তাই মানুষ দ্রুত মাদকাশক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তাই বলে তো আর কেউ বলে না যে, রেড ওয়াইন বা লাল মদ আসলে কোন মাদক না।
আর একটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়, ভারতে ফেন্সিডিল কোন মাদক নয়, একটা কাশির ঔষধ মাত্র। কিন্তু সেই কাশির ঔষধটাই কাটাতারের বেড়া গলে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেই হয়ে যায় ভয়ংকর মাদক, হারাম ইত্যাদি। ঠিক তেমনি ইয়াবার প্রধান সোর্স মায়ানমারেও ইয়াবা কোন নেশার নাম নয় (রোহিঙ্গারা অনেকেই ইয়াবায় আশক্ত বলে শুনেছি, তবে সামগ্রীক মায়ানমারের চিত্র ভিন্ন)। ইয়াবা বাংলাদেশে আসার পরেই সেটা হারাম মাদকে পরিণত হয়। ভারতের মাদকসেবীরা ফেন্সিডিল মাদক হিসাবে ব্যবহার করে না কারণ সেখানে মাদকসেবীদের অনেক সহজলভ্য এবং কম খরচের বিকল্প আছে। মায়ানমারের ক্ষেত্রেও সহজলভ্য বিকল্পই মূল কারণ ইয়াবা মাদক না হওয়ার পিছনে।
ফিলিপাইনের চিত্র আবার ভিন্ন। বাংলাদেশে যাকে মদ বলা হয় (ওয়াইন, এ্যালকোহল, স্পিরিট) ফিলিপাইনে তা সহজলভ্য এবং আইনসিদ্ধ। যে কোন গ্রোসারি শপে গেলেই আপনি চাল-ডাল-আলুর সাথে নানান দেশি-বিদেশী ব্রান্ডের ওয়াইন, এ্যালকোহল, স্পিরিট কিনতে পারবেন এবং সেটা অনেক সস্তা। কিছু কিছু ব্রান্ডের এ্যালকোহল এবং স্পিরিট কোকের চেয়েও সস্তা। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের মাদক বিরোধী অভিযান কিন্তু ওয়াইন, এ্যালকোহল, স্পিরিট সেবনকারী, আমরা যাদের সহজেই মদখোর বলি তাদের বিরুদ্ধে নয় বা মদ ব্যবসায়ী, উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও নয়। দুতার্তে মাদকাশক্ত বলতে হেরোইনখোর থেকে শুরু করে তার উপরের স্তরের মাদকসেবীদেরই বোঝান এবং তাদের উপরই গুলি চালাচ্ছেন। ফিলিপাইনের মানুষ ফেন্সিডিল বা ইয়াবা নামক মাদকের কথা হয়তো কখনই শোনেনি।
বিশ্বের অন্যতম আফিম উৎপাদনকারী দেশ আফগানিস্থান। আফিম থেকেই তৈরী হয় হেরোইন। আর আফগানিস্থানের কট্টোর ইসলামপন্থী তালেবান-আইএসের অর্থ উপাজর্নের প্রধান উপায়ই পপি উৎপাদন-পপি থেকে আফিম-হেরোইন তৈরী এবং তার ব্যবসা। যেখানে ইসলাম ধর্মমতে যে কোন মাদকবস্তু কেনা-বেচা এবং সেবন হারাম, সেখানে তালেবান-আইএস আফিম-হেরোইনের জমজমাট ব্যবসা পরিচালনা করছে বিশ্বব্যাপী। মাদক ব্যবসায় ধর্ম সেখানে বড় কোন বাঁধা নয়।
এখন কথা হচ্ছে বাংলাদেশে ইয়াবা-ফেন্সিডিলের তৃণমূল পর্যায়ের সরবরাহকারী এবং বিক্রেতাদের উপর দুতার্তের পুলিশের মতো হাসিনা সরকারের পুলিশও চড়াও হয়েছে। দুতার্তে খুন করেছেন হাজারে হাজারে আর হাসিনার পুলিশ শতকের ঘরের দিকে আগাচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন, পুলিশ মাদকের খুচরা বিক্রেতাদের ক্রসফায়ারের নামে খুন করছে আর পাইকাড়ী বিক্রেতা বা সরবরাহকারীদের সেলাম ঠুকছে। ঘটনা যাই হোক না কেনো, দুনিয়াতে এখনও একটাও দৃষ্টান্ত তৈরী হয় নি যে, মাদক বিক্রেতা বা মাদকসেবীদের হত্যা করে বা নির্যাতন করে মাদক সমস্যার সমাধান করা গেছে। বরং এই সত্য অনেক বার প্রমাণিত যে, মাদকের বিরুদ্ধে যে দেশ বা সমাজ যত বেশি কঠোর, যেখানে যত বেশি মাদকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, সেখানেই ততবেশি মাদকসেবী, সেখানেই ততবেশি মহামারীসম মাদক সমস্যা। তাই হলফ করেই বলা যায় যে, দুতার্তের হাজার হাজার মাদকসেবী-মাদকব্যাবসায়ীদের খুন করার পরেও যেমন ফিলিপাইনের মাদক সমস্যার তেমন কোন পরিবর্তন হয় নি, তেমনি বাংলাদেশে শুধু খুচরা ইয়াবা-ফেন্সী ব্যবসায়ী কেনো, মাদকের পাইকাড়, মাদকের সরবরাহকারী এবং উৎপাদনকারীদের সবাইকে হত্যা করলেও মাদক সমস্যার আমূল পরিবর্তন হওয়ার তেমন কোন সুযোগ নেই। হাজার বছর আগে যখন মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই মাদকসেবী-মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে পারলেই তলোয়ারের এক কোপে ধড় থেকে মাথা নামিয়ে ফেলা হতো জনসমক্ষে, তখনও নির্মূল তো দুরের কথা মাদকসেবীদের সংখ্যা কমানোও সম্ভব হয়নি। মাদক সমস্যা দুনিয়ার সব দেশে আগেও ছিলো, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, মাদক সমস্যার ধরণ পরিবর্তন করে মাদকের ভয়াবহতা কমিয়ে আনা সম্ভব, মাদক সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব এবং উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই এর উদাহরণ।
মানুষ নানান পরিস্থিতির শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়, এটাই বাস্তবতা। স্বভাবগতভাবেও মানুষ নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে। আর হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় যদি হাতের কাছে নিষিদ্ধ জিনিষ পাওয়া যায়, দামটা যদি সাধ্যের মধেই থাকে, মানুষ সাধারণত নিষিদ্ধ জিনিষটা তখন একবার হলেও চেঁখে দেখে। আর নেশাটা সাময়িক হলেও যদি মানুষকে একটু শান্তি দেয়, হতাশা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেয়, তখনই মানুষ নেশাগ্রস্ততার দিকে এগিয়ে যায়। মানুষ হতাশাগ্রস্ত হবে এবং নেশাগ্রস্তও হবে এবং এটা আনএ্যাবয়ডেবল। এই নেশাগ্রস্ততাকে যদি শুধুমাত্র বিড়ি-সিগারেটের মধ্যেই বেঁধে রাখা যেতো?? তবে এটা সত্য যে বিড়ি-সিগারেট আছে বলেই মাদকের মহামারী থেকে আমরা দুরে আছি। বিড়ি-সিগারেটের নেশা যে কত লক্ষ কোটি মানুষকে হতাশা, গ্লানি, মানসিক যন্ত্রণা থেকে একটু শান্তি দেয় সেটা অকল্পণীয়। কিন্তু বিড়ি-সিগারেট সবার আশা পূরণে ব্যর্থ। তাই কিছু মানুষ অন্য বিকল্প খোঁজে। হাতের কাছে ইয়াবা-ফেন্সিডিল সেই বিকল্প নেশা হিসাবেই সমাজে আসন গেঁড়ে বসেছে।
আমার মনে হয়, যদি সরকার বিয়ার এবং গাঁজা এই দুইটা নেশা লিগ্যাল করে দেয়। সিগারেটের খোলের মধ্যে গাঁজা দিয়ে ধুমপান, ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটা চায়ের দোকান, সিগারেটের দোকানের সামনেই হচ্ছে এবং সব সময়। সারা দেশের চিত্রও একই রকম। আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে এখন মেডিকেল ম্যারোয়ানার নামে গাঁজাকে বৈধতা দিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে। আমাদের দেশে গাঁজার ব্যাপক চল তো আছেই। যদি ওটাকে একটা ফার্মেসী পণ্য করে দেয়া য়ায়, আর্থিকভাবে সরকার ব্যাপক লাভবান হবে। বিয়ারের ক্ষেত্রেও সরকার একটু বেশি ট্যাক্স ধরে বিশাল অংকের টাকা কোষাগারে তুলতে পারে। গাঁজা আর বিয়ার বৈধ পণ্যের স্বীকৃতি পেলে আমার ধারণা বর্তমানে যারা ইয়াবা-ফেন্সীতে নেতাগ্রস্ত তাদের কমপক্ষে অর্ধেক ইয়াবা-ফেন্সী ছেড়ে গাঁজা-বিয়ারে চলে আসবে। আর তরুণ প্রজন্মের খুব কম লোকই প্রাথমিক নেশা হিসাবে গাঁজা-বিয়ার রেখে ইয়াবা-ফেন্সী ধরবে। অর্থাৎ নেশাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা যেমন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে, তেমনি নতুন নেশাগ্রস্ততা বৃদ্ধির হারও কমবে অনেক।
তবে, বিড়ি-সিগারেট এবং গাঁজা-বিয়ারও কিছু মানুষের হতাশা দুর করতে পারবে না। তারা অন্য বিকল্প খুঁজবে। যদিও তারা সংখ্যায় যথেষ্ট কম হবে। এক্ষেত্রে সরকার যদি আর একটু কনসিডার করে, যদি এ্যালকোহলটাকে বৈধ করে দেয়, আমার মনে হয় এটা বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবে। আমাদের দেশের চিনিকলগুলো ধুকছে, অনেকগুলো বন্ধ, বাকীগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। সরকার যদি এ্যালকোহল বৈধ করে দেয়, তাহলে চিনিকলগুলো আখের রসের গাঁদ ফেলে না দিয়ে তা দিয়ে বিপুল পরিমাণ এ্যালকোহল তৈরী করতে পারবে। পাশাপাশি গড়ে তুলতে পারবে এ্যালকোহলভিত্তিক নতুন শিল্প। এতেকরে চিনিকলের হাজার হাজার শ্রমিক, লক্ষ লক্ষ আখচাষি অচিরেই নতুন জীবন ফিরে পাবে। বন্ধ হওয়া চিনিকলগুলো খুলতে পারবে অচিরেই। চিনিকলের প্রধান এবং লাভজনক পণ্যই হবে তখল এ্যালকোহল। সরকার পাবে বিপুল অংকের ট্যাক্স। বাঁচতে পারবে লক্ষ লক্ষ কৃষক-শ্রমিক পরিবার। আর সেই সাথে চরম হতাশাগ্রস্ত কিছু মানুষ এ্যালকোহলে খুঁজে পাবে শান্তি। হেরোইন, আইচ বা ফেন্টানিলের ( ফেন্টানিল হেরোইনের চেয়ে পঞ্চাশগুণ বেশি শক্তিশালী) মতো মরণনেশার প্রতি খুব কম মানুষই ঝুঁকবে।
আগেই বলেছি মাদক সমস্যা নির্মূল কখনই সম্ভব নয়। এটা অনেকটা সমাজের ডায়াবেটিস যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, ভয়াবহতা কমিয়ে আনা সম্ভব কিন্তু নির্মূল সম্ভব নয়। মাদক সমস্যা নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে এমন কোন প্রমাণ মানব ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সরকারের বর্তমান মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ সেটা সাময়িকভাবে হয়তো কিছু পুলিশের অবৈধ ইনকাম বৃদ্ধি করবে, হেফাজতসহ সরকারের সাথে থাকা মৌলবাদীদের থেকে কিছু ভোট হয়তো আওয়ামী লীগের পক্ষে আসবে, কিন্তু মাদক সমস্যার কোন উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং বিয়ার-গাঁজা-এ্যালকোহলের বৈধতা প্রদান এবং সাথে সাথে হেরোইন, আইস, ফেন্টানিল ইত্যাদি ভয়াবহ মাদকের বাংলাদেশে প্রবেশ রোধে কার্যকর ব্যবস্থাই সরকারকে দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিতে পারে।
পাঠক লাল গোলদার
pathaklal@yahoo.com
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৮ সকাল ১১:০৮