ফকির লালনের গানের আসল গভীর অর্থ:
অনেকে লালনকে সহজেই মানবতাবাদী বলে চিনে ফেলে। ফলে মানবতাবাদের গুমোর পর্দা সরিয়ে দেখে বিচার কাজ শুরু করব। তা নাহলে লালনের "অধরা" পর্যন্ত পৌছান যাবে না।
মানবতাবাদের গোড়াটা কোথায়?:
দার্শনিক ইতিহাসের গুরু, জর্মন দার্শনিক হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) বরাতে জেনেছিলাম, সবাই ঈশ্বরের সন্তান, সে গুণে সবাই, সব মানুষ সমান। মানুষের সাম্য। হেগেল বলছেন, "খ্রিষ্ট ধর্মই হচ্ছে চূড়ান্ত স্বাধীনতার ধর্ম, একমাত্র খ্রিষ্টান দুনিয়াতেই মানুষ তার অসীম ও সার্বজনীন (universal) সত্তা হিসাবে স্বীকৃত"। আবার বলছেন, "জর্মন জাতি খ্রিষ্ট ধর্মের প্রভাবে সেই চৈতন্য লাভ করতে সক্ষম হল যে মানুষ মানুষ হিসাবে মুক্ত। চৈতন্যের স্বাধীনতাই তাঁর স্বভাব গঠন করে। এই চেতনা প্রথমে খ্রিষ্ট ধর্মেই আসে"। অর্থাৎ হেগেলের কথা থেকে আমরা যা বুঝলাম: ১. সবাই আমরা ঈশ্বরের সন্তান, সে গুণে মানুষের সাথে মানুষের সাম্য - খ্রিষ্টীয় এই ধর্মতাত্ত্বিক বয়ান হেগেলের হাতে পড়ে দার্শনিক ও নতুন মানে দাঁড়াচ্ছে - নিজের দিব্যতা (divinity) সম্পর্কে জ্ঞান; আর চিন্তা (চৈতন্য বা স্পিরিট) হিসাবে মানুষের অস্তিত্ত্বের নিঃশর্ত স্বাধীনতা, সীমিত হয়েও অসীমকে ধারণ করার ক্ষমতা - এই দুইটা গুরুত্ত্বপূর্ণ কথায়। মানুষের চিন্তা নিঃশর্তভাবে স্বাধীন ও সীমিত হয়েও অসীমকে চিন্তায় ধারণ করার সক্ষম; এটাই এর মূল কথা। তবে, এখানে মানুষ মানে এক সার্বজনীন (universal) সত্ত্বা। ২. আল্লার মধ্যে প্রকৃতির গুণ বা লোকসমাজের গুণ বা শক্তির ধারণা বা আরোপ অথবা উল্টা করে প্রাকৃতিক সত্ত্বাকে ঈশ্বর গণ্য করে ভাববার মধ্য দিয়ে - মানুষের চিন্তার যে ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায় চলে আসছিল তা, ছাড়িয়ে মানুষ নিজের মধ্যেই ঈশ্বরের দিব্য উপস্হিতি টের পেতে ও প্রকাশিত হবার ইতিহাস হেগেল অনুধাবন করছেন। হেগেল দাবি করছেন একমাত্র পশ্চিমে ও খ্রিষ্টান ধর্মেই এটা ঘটেছে, চিন্তার এরকম জায়গায় পৌছানোর সুযোগ হয়েছে। (হেগেলের এ'দাবি কতটা বর্ণবাদী বা এতে পরিণতিতে পশ্চিমের লাভ না ক্ষতি হয়েছে সে আলোচনায় এখানে যাব না।) । উপরে ইটালিক করেছি আমার কথার সারমর্মটা দেখানোর জন্য।
কথা শুরু করেছিলাম মানবতাবাদ নিয়ে সেখানে ফিরে যাব। হেগেল শিখিয়েছিলেন, চৈতন্যের স্বাধীনতাই মানুষের স্বভাব গঠন করে, মানুষ অসীম ও সার্বজনীন সত্ত্বা। এই স্বাধীন চিন্তার ও মানুষের সার্বজনীন ধারণার উপর ভর করে মানবতাবাদের "মানুষ" ধারণার দাড়িয়ে আছে; মানবতার "মানুষ" সার্বজনীন (universal)।
সার্বজনীন মানে? মানে "মানুষ" যেই হোক যেই দেশ, যেই সময়ে দাঁড়িয়ে হোক আর ধর্ম বর্ণ গোত্র ভিন্নতা ইত্যাদি ভেদ ও গুণে যেই হোক - জন্মসূত্রে (by born) সে ঈশ্বরের সন্তান বা দুনিয়ার সন্তান বলে মনে করে এই "মানুষ" ধারণা। রাম, রহিম, জন, জেনি বা বড়ুয়া ইত্যাদি নামে আমাদের দেখা বিশেষ মানুষগুলোর থেকে "মানুষ" সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা বের করে আনতে চাইলে যা দাঁড়াবে সেই সাধারণ (generalised) ধারণার নাম সার্বজনীন (universal) "মানুষ", মানবতাবাদের
"মানুষ", সাম্যের "মানুষ" । এই "মানুষ" এরই অধিকার, মানবাধিকার, মানবতা, জাতিসংঘকে দিয়ে ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস' চার্টার ঘোষণা রক্ষা ইত্যাদি। (এর সাথে অর্থাৎ হিউম্যানিটি বা মানবতার সাথে মানবিকতা একটা মস্তবড় ফারাক আছে, আপাতত সেখানেও যাব না)। সাম্যের "মানুষ" এর এই সাধারণীকৃত (generalised) করে পাওয়া ধারণাকে লালনের বলতেন, "সামান্য" ধারণা। সামান্য মানে তুচ্ছ নয়। সাম্য বা সমান জ্ঞানে সাধারণীকৃত (generalised) করে পাওয়া, মানে "সামান্য" ধারণা। যেমন লালন বলছেন, "সামান্যে কি পাবে তাঁরে দেখা"। অতএব লালনের ভাষায় বললে, মানবতাবাদ একটা সামান্য ধারণা।
লালনের "মানুষ" এর এই সামান্য ধারণা মানেন না। লালনের "মানুষ" একই সঙ্গে সামান্য ও বিশেষ; অধরা মানুষ ও রক্তমাংসের মানুষ। অধরা মানুষ দেশকালপাত্রের অতীত, নিরাকার, অরূপ, অনন্ত সম্ভাবনাময়। এই অধরা আবার এক ও অদ্বিতীয় ফলে "পরম"। বিশেষ মানুষ সাথে সামান্য (এই সামান্য মানুষ মানে বিমূর্ত, সার্বজনীন বা universal ধারণায় পাওয়া মানবতাবাদের মানুষ নয় ) বা অধরা মানুষের সম্পর্ক দিয়ে মানুষ কী তা বুঝতে হবে। সম্পর্কের ভিতর দিয়ে বুঝতে হবে এজন্য যে সামান্য বা অধরা মানুষ তো দেশকালপাত্রের অতীত, নিরাকার, অরূপ, অনন্ত সম্ভাবনাময়। একদিকে মূর্ত না হলে তাহলে ধরতে বা বুঝতে পারব না আবার মূর্ত বলে ধরতে গেলে সে তো আর দেশকালপাত্রের অতীত, নিরাকার, অরূপ, অনন্ত সম্ভাবনাময় থাকল না - ওকে একটা সীমায় আবদ্ধ করে ফেললাম বা মনে করলাম। বিশেষ মানুষের কাছে এই হোল "অধরা"কে ধরার সমস্যা। অধরা শেষ বিচারে অচিন পাখি হয়ে থেকে যাবে।
এবার পপুলার অচিন পাখি গানটার মানে ধরা গেলেও যেতে পারে,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মনবেড়ী দিতাম পাখির পায়।
পাঠক চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
ফলে মানুষ ধারণা লাভের একমাত্র পথ ১. বিশেষ আর সামান্যের সম্পর্কের মধ্যে রেখে ওকে ধরতে বা বুঝতে হবে। ২. একমাত্র বিশেষ দেশকালপাত্রে গুণসম্পন্ন রক্তমাংসের মানুষে মধ্যে যতটুকু তাঁকে সাকার, যে রূপ, যে প্রান্ত টেনে সম্ভাবনা হয়ে আবির্ভাব বা হাজির করানো সম্ভব হবে তাই দিয়েই ওর নিরাকার, অরূপ, অনন্ত সম্ভাবনাময় বিষয়ে ধারণা করতে হবে। ফলে বিশেষ ও সামান্যের সম্পর্কের ভিতর দিয়ে আমরা মানুষের একটা ধারণা লাভ করব ঠিকই তবু অধরা অনন্ত সম্ভাবনাময় হয়ে অধরাই থেকে যাবে।
আবার মানুষের বাইরে বা মানুষের আগে পরে বলে সামান্য বা অধরার কোন রূপ নাই।
অনম্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাই
বুঝি মানুষের উত্তর কিছুই নাই
মানুষের উত্তর বা উত্তরকালে মানে পরে আর কিছু নাই। সসীম, রূপ ও আকার সম্পন্ন জগতের এটাই শেষ প্রান্ত। রূপ আর অরূপ, প্রান্ত ও অনন্ত অথবা আকার ও নিরাকার এখানে মানুষে মধ্যে এসে একাকার হয়েছে। মনুষ্য দেহে প্রকৃতি ও পুরুষ (মানুষ) একাকার হয়ে আছে; দেহ ও ভাব একাকার হয়ে আছে। এই সম্পর্কটা উপলব্দি ও চর্চা করতেই সাধকের মানুষ হবার যাবতীয় সাধনা ।
মানুষ তাই সাকার ও রূপসম্পন্ন ঠিকই, কিন্তু নিরাকার অনন্ত ও অসীম হওয়ার সম্ভাবনা তার মধ্যে রয়ে গিয়েছে - এটাই তার "স্বরূপ"। নিরন্তর রূপ থাকে অরূপে, আকার থেকে নিরাকারে, সীমা থেকে অসীমে যাবার পিপাসাই তাঁর ধর্ম।
একএকটা বিশেষ দেশকালপাত্রে গুণসম্পন্ন হয়ে রক্তমাংসের মানুষে মধ্যে মানুষ যতটুকু তাঁকে সাকার, যে রূপ, যে প্রান্ত টেনে সম্ভাবনা হয়ে আবির্ভাব বা হাজির করানো সম্ভব হবে তাই দিয়েই ওর নিরাকার, অরূপ, অনন্ত সম্ভাবনাময় দিকের আরও একটা স্বরূপ হাজির হবে। এই দিয়ে মানুষের জীবনের সাফল্য বা অর্জন বিচার করা হবে। ওখানে রক্তমাংসের মানুষের দেহে নিরাকার সাকার হয়ে একাকার হয় ঠিকই নতুন মানুষের সম্ভাবনা কিন্তু শেষ হয়না। নিরাকার দেশকালপাত্রের অতীত অরূপ তো নিরন্ত, অন্তন্থীন। আবার একবার অন্য কোন দেশকালপাত্রে সাকার হয়ে উঠতে পারার সম্ভাবনায় সে অসীম। মানুষের মধ্যে নিরাকারের আকার, অরূপের রূপ লাভ ঘটে চলে নিরন্তর। মানুষ বস্তুময়, সাকার - এই রূপের মধ্যে ।
সেকারণে দেখা গেছে, দেবতারাও মানুষ রূপে জন্ম নেবার জন্য কামনা করে গেছে বলে আমরা শুনতে পাই। ফকির লালন বলছেন,
দেব দেবতাগণ করে আরাধনা জন্ম নিতে মানবে
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।
এবার ফকির লালনের এখানকার গানে ফিরে আসি।
লালন তাঁর সাধনায় রত থাকতে তাঁর ভাব আমাদের জানাচ্ছেন।
বলছেন, নূহ্ নামে এক নবীর কথা জানা যায় যে দুনিয়াকে প্লাবনে থেকে রক্ষা করেছিল। নইলে দুনিয়া শেষ হয়ে যেতো। নূহ নবীর বিশেষ দেশকালে মানুষের কী সম্ভাবনা, কী তাঁর করণ-কর্তব্য তা জানতে নিজেকে তৈরি করে রেখেছিলেন ও পেরেছিলেন। অকূল পাথারে কিনারা খুঁজেছিলেন ও পেয়েছিলেন। নিজ কর্তব্য সম্পন্ন করেছিলেন। নিজ কর্তব্য মানে? এই কর্তব্য মানে, একই সঙ্গে বিশেষ ও সামান্য মানুষের কর্তব্য। একইসঙ্গে জীব ও পরম - এই দুইয়ের কর্তব্য। নিজের সঙ্গে "স্রষ্টার"ও কর্তব্য। প্রাণের সংগ্রহ ও রক্ষার মধ্য দিয়ে নূহ নবী পরমের ভূমিকাও পালন করেছেন। অন্য কোন জীবের মধ্যে কিন্তু এই ধর্ম নাই। অথচ মানুষের মধ্যে এই গুণ আছে এবং কর্তব্যবোধও জাগতে পারে। সত্যিই এক আশরাফুল মুখলুকাত। আর আমাদের নূহ নবী।
নিজাম যার পেশা ছিল ডাকাতি, কিন্তু দেহচর্চা ও করণ গুণে সে বুঝে যায় এই জীবনের লক্ষ্য কী। যে অন্যের শরীর সর্বস্ব হরণ করত সে বুঝে যায় তাঁর পরমের কর্তব্য কী, ফলে সে পরমের পায়ে নিজেকে দান করে দেয়। তার সুমতি হয়, আউলিয়া নাম হয়ে যায়।
নবী মানে না যারা অর্থাৎ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কাজটা কী যারা বুঝে না, মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য লক্ষ্য কী, কী তার করণ কাজ - মানুষ ভজনা করে মানুষ হবার কাজ তাঁরা মানে না। তারা নিশ্চয় দোজখে যাবার কাজই করছে। আবার বুঝার চেষ্টার জন্য নিজেকে তৈরি করলে, কর্তব্য-করণ করলে কিন্তু তাদের মাফ পাবার উপায় আছে সম্ভাবনাও আছে। কারণ তাদের কাজ দুনিয়ার মানুষের কাছে স্বাক্ষ্য হয়ে থাকবে। পরবর্তীতে যার বিচার হবে।
লালন এবার নিজেকে নিয়ে ভাবছেন। তিনি কী তার যা সাধনা কর্তব্য-করণ করার ছিল তা কী তিনি ঠিক ঠিক করতে পারছেন? তার বেলায় কী হয় এনিয়ে তিনি ভয়ে ভয়ে আছেন, ভাবছেন!
পাদটিকা: এবার আমি ভাবছি, একজন বিপ্লবীর ক্ষেত্রও কী তাই হয় না? দুনিয়ায় এসে সে বিচার করতে বসে সে কে? দুনিয়ায় তার ভূমিকা কী? দেহের জায়গায় সমাজ-দেহে তাঁর অবস্হান ও কর্তব্য সে নির্ধারণ করে। দেহ ও ভাব একাকার করে নিজে ভাবতে বসে। এই সাধনাতেই নিজের জীবন ব্যয় উৎসর্গ করে দেয়। বিপ্লবী নিজের জীবের জীবন পরমের লক্ষ্যে যতটুকু উৎসর্গ করতে সক্ষম হয় ততটুকুই তাঁর সাফল্য। বাংলার ভাবের জায়গায় দাঁড়িয়ে অর্থাৎ জীব/পরমের ভেদ বিচারের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বিপ্লব ও বিপ্লবীকে বুঝার সম্ভবত একটা কর্তব্য আমাদের রয়ে গিয়েছে।
লালনের মত এসব প্রশ্ন আমারও মনে।