ইয়াসমিন আক্তার (১৮)। এইচএসসি শেষবর্ষের ছাত্রী। নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের পাঁচহাট গ্রামের বাসিন্দা তিনি। গত জুলাই মাসে রাজধানী ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। গুলিস্তান টু আবদুল্লাহপুর রুটের ৩নং লোকাল বাসের একটি চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হন ইয়াসমিন। বিজ্ঞাপনের ভাষাও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। “আপনি কি এসএসসি, এইচএসসি পাস? চাকরি খুঁজছেন? ‘মার্চেন্ডাইজিংয়ে প্রতিষ্ঠিত হোন- পার্ট টাইম, ফুল টাইম চাকরি খুঁজছেন? ফুল টাইম প্রতিমাসে ১৭,৫০০ টাকা। পার্ট টাইম ১১,৫০০ টাকা। কোন অভিজ্ঞতা ও জামানতের প্রয়োজন নেই।” বিজ্ঞাপনের ভাষায় প্রলুব্ধ হয়ে ইয়াসমীন আক্তার উত্তর যাত্রাবাড়ীর উল্লিখিত অফিসে দেখা করেন। তার মতো আরও অনেকেই সেই অফিসে দেখা করতে যান। সবাই এসেছেন চাকরির খোঁজে। তারা এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। প্রথমে ইয়াসমিনকে জানানো হয় মার্চেন্ডাইজিংয়ের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার। এজন্য ২৫ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। ৩ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে চাকরি নিশ্চিত। মাসে ১৭,৫০০ টাকা। অভাবী কৃষক ঘরের মেয়ে ইয়াসমীন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন পর গরিব কৃষক পিতার আর্থিক কষ্ট দূর করতে ধার-কর্জ করে ২৫,০০০ হাজার টাকা এনে তুলে দেন ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার পরিচয় দেয়া হাসানুজ্জামানের হাতে। এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করতে বলা হয় ইয়াসমীনকে। কিন্তু এক সপ্তাহ পর ওই ঠিকানার অফিসে গিয়ে উপস্থিত হয়ে হতভম্ব ইয়াসমীন। ঠিকানা ঠিকই আছে কিন্তু সেই অফিসটি নেই। আশপাশের কেউ বলতে পারলো না এ অফিস বা লোকজন তারা কোথায় কিভাবে গেল। ইয়াসমিন বুঝতে পারেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। শুধু ইয়াসমীন নয় রাজধানী ঢাকায় এ রকম আকর্ষণীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির প্রলোভনে পড়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এমনকি সর্বস্বও হারিয়েছেন কেউ কেউ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় চাকরির খোঁজে বা বেড়াতে আসা শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের প্রতারিত করার অভিনব স্টাইল এটি। তবে প্রতারণার এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই কোন তৎপরতা। ফলে পার্ট টাইম, ফুল টাইম ও আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি দেয়ার নামে এ প্রতারক চক্র তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেশ নির্বিঘ্নে। দীর্ঘ দিন ধরে। রাজধানীর প্রায় বেশিরভাগ লোকাল ও সিটিং বাসের জানালার পাশে, সামনের গ্লাসে, রাস্তায় দেয়ালে, অধিক জনসমাগম এলাকা, বিভিন্ন ওভারব্রিজ, ফুটপাতে, স্কুল-কলেজের সামনে, বিভিন্ন বাসের টিকিট কাউন্টারে এ রকম আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন শোভা পায়। বিজ্ঞাপনের ভাষাও প্রলুব্ধ করার মতো। “আপনি কি এসএসসি পাস? অথবা স্বল্পশিক্ষিত। চাকরি খুঁজছেন? পার্ট টাইম প্রতিদিন ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা, ফুল টাইম ৮ ঘণ্টা। অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী, বয়স্ক এমনকি গর্ভবতীরাও আবেদন করতে পারেন। কোন অভিজ্ঞতা ও জামানতের প্রয়োজন নেই। পার্ট টাইম...টাকা, ফুল টাইম...টাকা। যোগাযোগ ০১...।” প্রতিষ্ঠানের নামও ব্যবহার হয় কোন কোন বিজ্ঞাপনে। স্কয়ার বায়িং হাউস, নিউ বসুন্ধরা বায়িং এ্যাপারেলস, ন্যাচারাল নিউট্রি ফুড গ্রুপ অব কোম্পানি, আনারকলি গ্রুপ অব কোম্পানি, মেঘনা মার্চেন্ডাইজিং হাউস, আমেরিকা-কানাডা বায়িং হাউস, আউট সোর্সিংয়ে বিট করা কাজ, প্রাইভেট বায়রা ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড, অনলাইনে ক্লিক করে ঘরে বসে আয়, ভারত, চীন, আমেরিকা, জার্মানি থেকে আমদানিকৃত ওষুধ, খাদ্যসামগ্রী বা প্রসাধনী বিক্রয়ের জন্য আকর্ষণীয় বেতনে প্রতিনিধি আবশ্যক ইত্যাদি নানা রকম বিজ্ঞাপনে প্রার্থীদের মুগ্ধ করা হয়। প্রত্যেক বিজ্ঞাপনের ভাষা প্রায় একই। শুধু যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন নম্বর ও অফিস লোকেশনের পরিবর্তন থাকে সবগুলো বিজ্ঞাপনে। আকৃষ্ট করা হয় বিদেশ ফেরত লোকজন, অল্প শিক্ষিত নারী, এসএসসি, এইচএসসিতে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী, গ্রাম থেকে চাকরির খোঁজে ঢাকায় আসা শিক্ষিত অল্পশিক্ষিত পুরুষ-মহিলা। জানা গেছে, এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণার এক অভিনব কৌশল গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তাদের কাজের ধরন ও প্রতারণার স্টাইল একই। শুধু অফিস স্পেসটা একেক দলের একেক জায়গায়। তবে এসব প্রতারক চক্র এক-দু’মাসের বেশি একই জায়গায় অবস্থান করে না। আর এজন্য তাদের অফিসে সাজসজ্জাও তেমন থাকে না। ০১৯১৯১৬৬৯১৯ এই নম্বরে যোগাযোগ করে ৮৪, বড় মগবাজারের নিউ এপারেলস নামের এ রকম একটি অফিসে সরজমিন গিয়ে দেখা যায় অফিসের সাজসজ্জায় তেমন চাকচিক্য নেই। এমনকি নেই অফিস পরিচিতিমূলক কোন সাইনবোর্ড বা ব্যানার। নিজেকে ম্যানেজার পরিচয় দেয়া রায়হান নামের ২৮ বছরের যুবক জানান, তাদের কাজের ধরন একটু ব্যতিক্রম। এখান থেকে যারা প্রশিক্ষণ নেবে সবাইকে তারা চাকরি দেবে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে। সেই চাকরি পেতে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন না থাকলেও কোম্পানির প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। চাকরির জন্য কোন জামানতের প্রয়োজন না হলেও প্রশিক্ষণের জন্য দিতে হবে নির্ধারিত মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু কি চাকরি, নিজেদের প্রতিষ্ঠানইবা কোথায় তা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। তার ভাষায় আগে ভর্তি তারপর সব জানা যাবে। প্রাইভেট বায়রা ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ০১৯২৮০৬৪৯৩১ যোগোযোগ করা হলে বলা হয় অফিসে আসার জন্য।
কিন্তু ঠিকানা মতো মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় গিয়ে এ রকম কোন কোম্পানির অফিসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই প্রতারকচক্র প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি থানার অফিসার ইনচার্জ নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পরপরই আমরা কয়েকজন ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ওইসব অফিসে হানা দিয়েছি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই নামে বা ঠিকানায় কোন অফিস থাকে না। কারণ, তারা কোন পরিচিতিমূলক কিছু ব্যবহার করে না। ফলে সহজেই তারা জায়গা পরিবর্তন করে ফেলে। এমনকি কোন কোন প্রতিষ্ঠানের সরকার কতৃক অনুমোদিত ট্রেড লাইসেন্স নম্বরও দেয়া থাকে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায় এই নামে কাউকে কোন ট্রেড লাইসেন্স বা সরকারি অনুমোদন দেয়া হয়নি। পুলিশ বিভাগের কয়েক জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ প্রতারকচক্র চাকরি দেয়ার নাম করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রার্থীদের ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। এ রকম অভিযোগও রয়েছে এ প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও জোনের ডিসি ইমাম হোসেন মানবজমিনকে জানান, এখন পর্যন্ত বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেননি। আর যারা অল্প টাকা প্রতারিত হয়েছেন তারাও নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করতে উৎসাহিত হন না। তাছাড়া এ প্রতারকচক্রের সদস্য যারা তারাও একই জায়গায় বেশিদিন অবস্থান করে না। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। View this link