somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিশোর বিদ্রোহী স্মরণে...

১৫ ই আগস্ট, ২০১০ ভোর ৫:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় হাতে স্কুল কর্তৃপক্ষের দেয়া বহিষ্কারাদেশ নোটিশ নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেনীর মধ্যম সারির এক ছাত্র। সময় টা ঊনিশশো বিয়াল্লিশ। কলকাতা ।
ছেলেটার কিছু ভয় বোধহয় হয়।আবার ভাবে,ভালোই হলো। পড়ালেখার মত বিচ্ছিরি আর হয় না। এই একটা ব্যপারে রবীন্দ্রনাথের আগাগোড়া ভক্ত সে।
কয়েকছত্র লিখে ও ফেলেছিলো একবার...

এক যে ছিলো আপন ভোলা কিশোর
ইস্কুল তার ভালো লাগতো না
সহ্য হত না পড়াশুনার ঝামেলা
আমাদের চলতি লেখাপড়া সে শিখল না কোনকালেই
অথচ সে ছাড়িয়ে গেল সারাদেশের সব পান্ডিত্যকে।


প্রকৃতপক্ষে ছেলেটার মধ্যে ছিলো বইয়ের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক। সেই পঞ্চম শ্রেনীতে থাকাকালেই,যখন সে কমলা মন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র, পড়ে ফেলেছিলো বিভূতিভূষনের পথের পাঁচালী। বিভূতিভূষণ, বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল, রবীন্দ্র রচনাবলির মুগ্ধ এই পাঠকের ভালো লাগত ব্রাউনিং,ভালো লাগত শেলি।
এই পাঠাভ্যাস পিতামহের কারণে। দাদু সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী।নিজ বাড়িতেই গড়ে উঠে সংস্কৃত সাহিত্যচক্র। সেখানকার সাহিত্য সভার নিয়মিত সভ্য ছিলো সে।

না।স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে পাঠ্যবইয়ে অমনোযোগিতার দরুন বহিষ্কারদেশ দেয় নি। অতটুকুন বয়সে ছেলেটা মার্কসবাদের ভক্ত হয়ে উঠে। অনুরক্ত হয়ে উঠে লেনিনের।লিখে ফেলে আস্ত কবিতা...

লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।
আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।
বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
- আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।
সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,
কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।
বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,
দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে।
দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি
আজো যায় শোনা,
দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।
পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।
আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে
লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;
ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন,
যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।
অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ
অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;
দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,
অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত
বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ-
এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।
লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।
মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।


কেবল কবিতা লিখে শান্ত থাকলে কোন সমস্যা ছিলো না।অই বয়েসে কম্যুনিজমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। যোগ দেয় বাম রাজনীতি তে।

পরের দুই বছরে অন্য স্কুল থেকে দুই দুই বার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসেও পাশের দেখা না পেয়ে পড়ালেখার ইতি ঘটে তার। রাজনীতি তে আরো জড়িয়ে পড়ে। ততদিনে সে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য।আঠারো বছরের উন্মাদনায় পেয়ে বসে থাকে।ভেঙেচুরে দেবার আকাংখায় পেয়ে বসে।

আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

তার হাতে গর্জাতে থাকে কবিতার কামান। একেকটা শব্দের গোলা ছুটে যেতে থাকে বেনিয়া ব্রিটিশ দম্ভমিনারে।লিখে ফেলে অসামান্য এক কবিতা..

এদেশ বিপন্ন আজ; জানি আজ নিরন্ন জীবন-
মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ
রক্তের আলপনা আঁকে,কানে বাজে আর্তনাদের সুর;
তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষুধিত মজুর
আমার সম্মুখে আহ এক শত্রুঃ এক লাল পথ
শত্রুর আঘাত আর বুভুক্ষায় উদ্দীপ্ত শপথ।
কঠিন প্রতিজ্ঞা-স্তব্ধ আমাদের দৃপ্ত কারখানায়,
প্রত্যেক নির্বাক যন্ত্র প্রতিরোধ সংকল্প জানায়।

কেবল ব্রিটিশ বেনিয়া নয়, সামাজিক বুর্জোয়া দের বিরুদ্ধে ও তার কলম হয়ে উঠে প্রতিবাদ মুখর।

বেরিয়ে এসো শক্তিমান আর অর্থলোভীদের দল
সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে।
গর্তের পোকারা!
এইতো তোমাদের শুভক্ষণ,
গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো
আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা
বড় আর মোটা সাপেদের যারা ঘিরে থাকে।


মূলত এই সময় টাতে তার কলম ফেটে রক্ত বের হতে থাকে,যেমন টা তার হৃদয় বিদীর্ন হয়ে যায় অবিরাম ক্ষুধা দারিদ্রের সাথে যুদ্ধরত মানুষ গুলোর দুর্দশার চিত্র।

....কবিতা তোমায় আজকে দিলাম ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি!

কিংবা...

খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বার বার চেষ্টা ক'রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচন্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে-
'প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার'!


কখনো কখনো বীতশ্রদ্ধ ছেলেটা তাকাত নিজেদের ভেতর।ভেতরে ডুব দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠত ঘৃণায়,প্রতিবাদে আর অদম্য সাহসে...

তবুও নিশ্চিত উপবাস,
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস-
আমি দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃসহ দেখি,মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।

তবুও ছেলেটা স্বপ্ন দেখত একদিন আবার পৃথিবী বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।সব জঞ্জাল সরিয়ে মুক্ত আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠবে পরের প্রজন্ম।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ,মৃত আর ধ্বংস স্তুপ-পিঠে
চলেযেতে হবে আমাদের।
চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্ব কে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

কিন্তু ছেলেটা তার যুদ্ধ শেষ করতে পারে নি।মাত্র একুশ বছর বয়সে উনিশশো সাতচল্লিশের তেরই মে টিউবারকুলোসিস রোগে হারিয়ে যায় না ফেরার দেশে।

এই অসাধারণ মানবপ্রেমী মুক্তিকামী কবি আমাদের আজন্ম তারুণ্যের প্রতীক,কিশোর কবি সুকান্ত ভ্ট্টাচার্য।
উনিশশো ছাব্বিশ সালের পনেরই আগষ্টে জন্ম নেয়া এই কিশোর বিপ্লবীর আজ চুরাশিতম জন্মবার্ষিকী।
২৩টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×