আজ আমরা সভ্যতার উচ্চশিখরে, বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর সীমাহীন ভোগ বিলাসের সকল উপায় উপকরণ মানুষের হাতের নাগালে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে আজ মানুষের অভিযান চলছে অভিরাম। নতুন নতুন আবিস্কারের নেশায় পৃথিবীর মস্তমাথা ওয়ালারা ব্যস্ত। অনেকে বলে থাকে এটাই হলো গ্লোবালাইজেশনের যুগ, সারা পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। দূর যতই হউক তা যেন হাতের নাগালে, যখন যা প্রয়োজন স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তার আয়োজন করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু এসব কিছু এমনিতেই হয়ে যায়নি, এর পিছনে দিতে হয়েছে রক্ত পানি করা শ্রম। কেউবা তার মেধা, যোগ্যতাকে বিনিয়োগ করেছেন আবার কেউ দিয়েছেন কায়িক বা শারীরিক শ্রম। সভ্যতার এই যুগে এসেও আমরা মেধা বা যোগ্যতার মর্যাদা কম বেশী যাই দেইনা কেন একজন শ্রমিক, যে অতশত বুঝেনা কিন্তু তার শ্রমের উপর ভিত্তি করে আমাদের সভ্যতা রচিত হয়েছে তাকে কিন্তু আমরা এখনো মূল্যায়ন করতে পারিনি। আমাদের ঢাকা দিন দিন আসলেই ঢেকে যাচ্ছে ইট পাথরের দালান কোটায়, মুক্ত আকাশের দেখা পাওয়া হবে দুস্কর। সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে বিশাল বেল্ডিং নির্মাণে যে ব্যক্তি সপরিবারে ইট ভাঙ্গার দায়িত্বটি নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন হয়তো সেই পরিবারটিই রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে দিনের পর দিন অনায়াসে কাটিয়ে দিচ্ছেন। সে হয়তো জানেইনা আসলে সভ্যতা কি জিনিস!
আজব এই সভ্যতার যুগে মানুষ অনেক বড় হয়েছে কিন্তু মানুষে মনুষ্যত্ববোধ যেন আদিমই রয়ে গেছে। হাজারো শ্রমিকের রক্তের উপর দাড়িয়ে মাথামোটা বুড়িওয়ালারা আজ সভ্যতা জয়গান গাচ্ছে। অথচ শ্রমজীবি মানুষের সুখ-স্বপ্ন আজো অধরাই রয়ে গেল। পহেলা মে কতিপয় কাকপক্ষিকে সুখের পায়রা সেজে শ্রমিকদের পক্ষে গলা ফাটাতে দেখা যাবে বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যায় তাদের অনেকের বাসার ছোট্ট কাজের শিশু শ্রমিকটি সারা দিন খেটেই চলছে পেটে একমুঠো ভাতও জুটেনি। উল্টো অযথা তার উপর নির্যাতনের বিভৎ সচিত্র পিঠের উপর পরিলক্ষিত হয়। পিচ ঢালা পথে চলতে আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে সকল নারী-পুরুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা উত্তপ্ত রাস্তায় ধোঁয়াটে পরিবেশে কাজ করতে করতে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটাকে টেনে হিচড়ে রাস্তার পাশে পলিথিনের ছোট্ট খুপরিতে নিয়ে ছিন্নবস্ত্রে ক্ষুধায় তাড়িত প্রাণাধিক সন্তানকে বুকে জড়িয়ে প্রবোধ দেয় এইতো আমাদের জীবন। আমরা গড়ার জন্য ভোগ করার জন্য না। সভ্যতার দিপ্রহরে ইঙ্গ-মার্কিন মনিবদের অমানবিক বর্বর আচরণের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে উঠেছিল শ্রমিক সমাজ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল বলে নিজেদের অস্তিত্বের কথা চিন্তা না করে বজ্রধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাপিয়ে তুলেছিল তারা। ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও আত্মাহুতি জাতির বিবেককে আলোড়িত করেছিল।
আজ এদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় কিন্তু বিশ্বের প্রায় সব দেশে পালিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এইদিনটি পালিত হয় না। 'শ্রমিক' - সভ্যতার প্রতিটি ইট,বালু, পাথরে যাদের ফোটা ফোটা ঘাম জড়িয়ে আছে তারা কিন্তু কখনোই সভ্যতার স্বাদ ভোগ করতে পারেনি। আজ আমাদের যারা মানবাধিকার শিখাচ্ছেন মে দিবস তাদের শোষণের ফসল। তাদের হাতে শ্রমিকরা তখনো শোষিত, সপ্তাহে ৬ দিনের প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টার অমানবিক পরিশ্রম করে যা পারিশ্রমিক পেতো তা জিবিকার জন্যও যথেষ্ট ছিল না, তারা যা পেতো তা দিয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিভানো তো দুরের কথা বরং তা বহুগুনে বাড়িয়ে দিতো। অনিরাপদ পরিবেশে রোগ-ব্যধি, আঘাত, আর তাতে মৃত্যুই ছিল তাদের নির্মম সাথী। ১৮৬০ সালে শ্রমিকরাই মজুরি না খেটে দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম নির্ধারণের প্রথম দাবি জানায়। কিন্তু কোন শ্রমিক সংগঠন ছিলনা বলে এই দাবী জোরালো করা সম্ভব হয়নি। এই সময় সমাজতন্ত্র শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। শ্রমিকরা বুঝতে পারে বণিক ও মালিক শ্রেণীর এই রক্ত শোষণ নীতির বিরোদ্ধে তাদের সংগঠিত হতে হবে।
১৮৮০-৮১ সালের দিকে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organized Trades and Labor Unions of the United States and Canada [১৮৮৬ সালে নাম পরিবর্তন করে করা হয় American Federation of Labor]। এই সংঘের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো শক্তিশালী হতে থাকে। ১৮৮৪ সালে ৮ ঘন্টা দৈনিক মজুরি' নির্ধারণের প্রস্তাব পাশ করে এবং মালিকও বণিক শ্রেণীকে এই প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। তারা এই সময়ের মধ্যে সংঘের আওতাধীন সকল শ্রমিক সংগঠনকে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংগঠিত হওয়ার পুনঃ পুনঃ আহবান জানায়। প্রথম দিকে অনেকেই একে অবাস্তব কল্পনাভিলাষ, অতি সংস্কারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু বণিক-মালিক শ্রেণীর কোন ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদি হতে থাকে। এ সময় এলার্ম নামক একটি পত্রিকার কলাম 'একজন শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘন্টাই করুক, সে দাসই' লেখাটি যেন জ্বলন্ত আগুনে কেরোসিন ঢালে। শ্রমিক সংগঠনদের সাথে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রপন্থী দলও একাত্মতা জানায়। ১লা মে কে ঘিরে একদিকে শ্রমিকদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর অপরদিকে বণিকশ্রেণী প্রশাসনের ছত্রছায়ায় দমন পীড়নের আয়োজন। আর শিকাগো হয়ে উঠে এই প্রতিবাদ প্রতিরোধের উত্তেজনাপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। মালিক-বণিক শ্রেণী অবধারিতভাবে শ্রমিকদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। ১৮৭৭ সালে শ্রমিকরা একবার রেলপথ অবরোধ করলে পুলিশ ও ইয়ুনাইটেড স্টেটস আর্মি তাদের উপর বর্বর আক্রমন চালায়। ঠিক একইভাবে ১লা মে কে মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রস্তুতি চলতে থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিকাগো সরকারকে অস্ত্র সংগ্রহ ও দমন নীপিড়ন চালাতে শুধু উৎসাহই দেয়নি প্রচুর অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য শিকাগো বাণিজ্যিক ক্লাব ইলিনয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ২০০০ ডলারের মেশিন গান কিনে দেয়।
১লা মে - সমগ্র যুক্ত্ররাষ্ট্রে প্রায় ৩০০,০০০ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে এদিন রাস্তায় নেমে আসে। শিকাগোতে শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়, প্রায় ৪০,০০০ শ্রমিক কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। অগ্নিঝরা বক্তৃতা, মিছিলে, মিটিং, ধর্মঘট, বিপ্লবী আন্দোলনের হুমকি সবকিছুই মিলে ১লা মে উত্তাল হয়ে উঠে শিকাগোর রাজপথ। পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পীজ, লুই লিং সহ আরো অনেকেই শ্রমিকদের মাঝে পথিকৃত হয়ে উঠেন। ধীরে ধীর আরো শ্রমিক কাজ ফেলে আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনকারি শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১লক্ষ। আন্দোলন চলতে থাকে। ৩ মে (কারো কারো মতে ৪মে) ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। আগস্ট স্পীজ শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হয় এবং ১১ জন আহত হয়, পরে আরো ৬জন মারা যায়। পুলিশবাহিনীও শ্রমিকদের উপর অতর্কিত হামলা করে সেই সাথে পুরো শিকাগোতে শুরু জয় রায়ট। এতে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশ আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করে। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুই লিং একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তর আত্মহত্যা করেন, অন্যএকজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, "আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে"।
২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের "দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার" দাবী সারা বিশ্বে স্বকৃতি লাভ করে। আর পহেলা মে বা মে দিবস ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস হিসেবে। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজো অনেক সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু নারী শিশু শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ আজো আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয়নি। সেই সাথে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে বর্তমান যে নোংরা রাজনীতিকে ব্যবহার করা হয় তার অন্যতম উপাদান হিসেবে শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিক দিয়ে মালিক শ্রেণী আইনের সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে, অন্য দিকে শ্রমিক নেতাদের মাধ্যমে নির্যাতনের ষ্টিমরোলার চালানো হয়। পেটের দায়ে কাজ করতে এসে শিশু শ্রমিকরা গৃহকর্তীর নির্মম নির্যাতনে শিকার হওয়ার চিত্র আমাদের সমাজে নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। সুতরাং সভ্যতার এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আমরা কি পেরেছি শ্রমিকের ঘাম মুছে যাওয়ার পূর্বেই তার পারিশ্রমিক প্রদান করতে? আমরা কি পেরেছি প্রতিদিন আমি যা খাই আমার ঘরের কাজের লোকটিকে তা খাওয়াতে? আমরা কি পেরেছি আমি যে মানের কাপড় পড়ি সেই মানের না হলেও কাছাকাছি মানের কাপড় গৃহকর্মীকে দিতে? আমরা এসবের ধারে কাছেও নেই এমতাবস্থায় মে দিবসের জমকালো অনুষ্ঠান কতটা অর্থবহ তা চিন্তাশীল বিবেকবানদের একটু ভাবা উচিত ॥