প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা। দুইবছর সেশন জ্যাম ঠেলে কোন রকম বিশ্ববিদ্যালয় লাইফ শেষ করেছি, উদ্দেশ্য একটা চাকুরী। এদিক ওদিক শুধু চাকুরীর জন্য সিভি দিয়ে গেলাম। তৎকালীন বিডিজবস, পত্রিকার পাতা কাটাকুটি চলছে। গণহারে সব চাকুরীতে এপ্লাই করা শুরু করলাম।
প্রথম ইন্টারভিউ ডাক পেলাম গুলশানের একটা মার্কেটিং কোম্পানী থেকে যতটুকু মনে পড়ে "মার্কেট এক্সেস"।যদিও এটা আমার সাবজেক্ট রিলেটেড না, কিন্তু আমি চেয়েছিলাম চাকুরীর ইন্টারভিউর অভিজ্ঞতা নিতে। অভিজ্ঞতাটাও খারাপ হল না। সকালে গেলাম, দেখি প্রায় ৩০-৪০ জন হাজির, তারা সবাই ইন্টারভিউ দিতে এসেছে।একে একে ৫-১০ মিনিট করে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। তারপর কেউ চলে যাচ্ছে না। পরে বুঝলাম, সবাইকে থাকতে বলা হয়েছে। তারা দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে খাওয়ার ব্যবস্থা করল। কিন্তু প্রথম দিনে সবার ইন্টারভিউ শেষ করতে পারলো না, তাই ২য় দিন আবার সবাইকে যেতে বলল। এরপর বলা হলো, দুপুরে ২ ঘন্টার ট্রেনিং, লাঞ্চ। তারপর বিকালের দিকে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হলো। আমাকে একটা পোস্টে সিলেক্ট করা হলো, কিন্তু সেটা আমার পছন্দ হলো না। আসলে ট্রাক ভিন্ন ছিল, তাই চাকুরীতে জয়েন করা হয় নাই।
আরেকটা চাকুরীর ইন্টারভিউর কথা মনে পড়ছে, এটা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী যাদের পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবসা আছে, যারা ৩-৫ বছরের অভিজ্ঞতা চেয়েছিল। তারপরও আমাকে ডেকেছিল। সকাল ১০টার সময় সবাইকে ডেকেছে। যাওয়ার পর এক কাপ চা দিয়েছিল। ১২টা বাজে ইন্টারভিউতে লাঞ্চ ব্রেক। অফিসের সবাই লাঞ্চ করবে। পরের সেশন শুরু হবে দুপুর আড়াইটা বাজে। এইবার বাইরে হাটাহাটি, বনানীর মত এলাকাতে একজন বেকারের পক্ষে দুপুরে লাঞ্চ করারটা কষ্টকর। দুইঘন্টা রোদে বাইরে হাটাহাটি করে আবার হাজির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। আমাকে ডাকা হলো বিকাল চারটার দিকে। তাদের সময়জ্ঞান নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। সবাইকে একই টাইমে ডাকার কোন মানে ছিল না। গেলাম ইন্টারভিউ রুমে, তারপর নানা প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিলো, আপনাকে আমরা কেন রিক্রুট করবো, সেটা জানান।ঐ বয়সে এইসব প্রশ্নের উত্তর জানানো কঠিন ছিল। আমরা ও এক্সপেরিয়েন্স কাউকে চেয়েছিলাম, আপনার তো কোন অভিজ্ঞতা নাই। পরে দেখলাম, আমাদের পরিচিত এক বন্ধু (সে নিজেও ফ্রেশ) ঐ চাকুরীতে জয়েন করেছে।
এরপর একটা চাকুরীর রিটেন টেস্ট দিলাম রূপচাঁদা সয়াবিন তেল এ। এটা একটা সিঙ্গাপুরী কোম্পানী। তারা ডেকেছিল মাত্র ১৫-২০ জনকে। সবার আগে রিটেন টেস্ট নিলো, আইকিউ, জেনারেল নলেজ, এনালাইটিক্যাল সলভিং এই টাইপের প্রশ্ন। ২ দিন পর আবার ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকলো। মাত্র ৫ জন এইবার। আমাকে নিয়ে বসলো ২ বিদেশী, নানা প্রশ্ন, ফ্যাক্টরীতে গোলমাল হলে কিভাবে সামলাবো? লেবারদের হ্যান্ডেল করবো কিভাবে? ব্ল্যা ব্ল্যা ব্ল্যা। প্রায় ২০ -২৫ মিনিট পর তারা বললো, রিটেন টেস্টে এ আমার স্কোর ৫০ এ ৪৮, কিন্তু আমার লেবার হ্যান্ডেলিং এর কোন অভিজ্ঞতা নাই। তারা এক্সপেরিয়েন্স কাউকে চাচ্ছে। তারা তেমন কাউকে না পেলে তবেই আমাকে ডাকবে। পরে আর ডাক পাই নাই।
এরমাঝে একবার চট্টগ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম, কাকতালীয়ভাবে তার একদিন পর চট্টগ্রামের এক কোম্পানী থেকে ইন্টারভিউ এর জন্য ফোন দিল। তাড়াহুড়ো করে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কোন পোস্টে এপ্লাই করেছিলাম।আমি কিছুই বলতে পারলাম না। পুরোই বেইজ্জতি। কোন পোস্টে এপ্লাই করেছিলাম, সেটাও মনে নাই।
এরপর গেলাম একটা শিপইয়ার্ডের ইন্টারভিউ দিতে। তারা তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করলো না, শুধু বললো, জাহাজের খোলের ভিতর কাজ করতে পারবে? আমি বললাম, বুঝতে পারছি না। পরে তারা শিপইয়ার্ডের ঠিকানা দিলো, নারায়ণগঞ্জে। বললো, আগে নিজে গিয়ে দেখে আসো, যদি পছন্দ হয়, তবে পরের দিন থেকে জয়েন করতে পারো। কিন্তু সেখানে কাজের পরিবেশ পছন্দ হয় নাই। (যদিও আমি তেমন নাক উঁচা না।)
বায়োম্যাডিকেল ইকুইপমেন্ট এর বিজনেস করে এমন একটা অফিসে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে। ইন্টারভিউ শুরু করার আগেই রিসিপসনে বসে একজন জিজ্ঞাসা করলো, ৫ বছরের বন্ড দিতে রাজী আছি কিনা। জানতে চাইলাম, কোন ধরণের বন্ড? বললো, সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। যদি রাজী না থাকেন, তবে ইন্টারভিউ হবে না। ইন্টারভিউ না দিয়ে চলে আসলাম।
আরো কয়েকটা চাকুরীর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, বেশিরভাগই ফ্যাক্টরী বেজড, ময়মনসিংহ কিংবা গাজীপুর এলাকাতে।সপ্তাহে সাতদিনই ফ্যাক্টরীতে থাকা লাগবে, তাই আর জয়েন করা হয় নাই। কেন জানি বন্দি মনে হত।
তারপর ইন্টারভিউ দিলাম একটা জেনারেটর কোম্পনাীতে, ধানমন্ডীতে। তারা তেমন কিছু জানতে চাইলো না, স্যালারী খুবই কম। আমি তখন ২ টিউশনী করে যত পেতাম, তার থেকে ১ হাজার টাকা বেশি মাত্র। তারপরও এটাতে জয়েন করলাম, জাস্ট একটা স্ট্যাটাস দরকার ছিল। পাস করে ৩ মাস বেকার, এটা ভালো লাগছিল না।
প্রথম চাকুরীতে ঢুকার পর ইপিজেড এর একটা বিদেশী কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। স্যালারী প্রথম চাকুরীর ৩ গুণ। কিন্তু চাকুরীটা করা হলো না। সপ্তাহে ৬ দিন। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অফিস। প্রথম তিনমাস কোন ট্রান্সপোর্ট দিবে না। তখন আমি এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলাম, গোড়ান এলাকাতে। এত দূর থেকে কোনভাবেই এই অফিস মেইনটেইন করা সম্ভব ছিল না।
এর পর গুলশানের এক অফিসে গেলাম, বিকালের ইন্টারভিউ ছিল। আমি প্রায় ৩০ মিনিট লেট। কিন্তু পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম, ইন্টারভিউ শেষ হয় নাই। একেকজনকে প্রায় ৩০ মিনিট করে প্রশ্ন করছে। আমি ছিলাম শেষ জন। সন্ধ্যা প্রায়, তাই আমার ইন্টারভিউ হলো ৪-৫ মিনিট। বোর্ডের ৩ জনের একজন প্রশ্ন করলো, ৩ বছরের বন্ড দিতে পারবে? আমি বললাম, পারবো। আরেক জন জানতে চাইলো, অনেস্টলি বলো, বিদেশের কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য এপ্লাই করেছো? বললাম, না। ব্যাস, ইন্টারভিউ শেষ।
অতঃপর ঐ অফিস থেকে চাকুরীর লেটার পেলাম সপ্তাহ খানেক পর। চাকুরীতে ঢুকার ৩ মাস পর একটা বিদেশ ট্যুরের বিনিময়ে ১ লাখ টাকার বন্ড দিতে হয়েছিল কিংবা ৩ বছর চাকুরীর নিশ্চয়তা, যার কোনটাই দেড়বছর পর আর করা হয় নাই।
তারমাঝে কয়েকটা সরকারী চাকুরীর জন্য দরখাস্ত দিয়েছিলাম। তেজগাঁও তে তাদের বিশাল বড় অফিস, যারা টেস্টিং এর কাজ করে (অফিসের নাম বললাম না)। পোস্ট ছিল ইনেসপেক্টর/ পরিদর্শক। রিটেন টেস্ট হলো, রিটেন এ টিকলাম। এর পর ভাইভা। ভাইভাতে গেলাম। সর্বমোট ৫ জনকে ডাকা হলো ভাইভাতে। সবার ভাইভা শেষে তারা ৫জনকে আবার একসাথে ডাকলো। সরাসরি ফল ঘোষণা করবে। তারপর সবার সামনে ১-২-৩ পজিশন ঘোষণা করলো। ততদিনে আমি প্রাইভেট চাকুরী করি। স্যালারীও মন্দ ছিল না। ইন্টারভিউ বোর্ডের মেম্বাররা তাই হয়ত বলছিলো, যে প্রথম হয়েছে, সে হয়ত নাও জয়েন করতে পারে, কারণ সে এখন ভালো একটা চাকুরী করছে। তাই ২য় পজিশনের ক্যান্ডিডেটকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে বললো। সরকারী অফিসের চাকুরীর অফার লেটার হাতে পেয়ে দেখি ওটা ২য় শ্রেণীর একটা চাকুরী।
তখন (২০০৭) প্রাইভেট চাকুরীতে প্রায় ৩০,০০০ এর কাছাকাছি পেতাম। অনেক চিন্তাভাবনা করেও সাকুল্যে ১০,০০০ টাকা বেতনের চাকুরীটাতে জয়েন করি নাই। হঠাৎ এই স্যালারী পরিবর্তন হয়ত মানিয়ে নিতে পারবো না, সামনে বিয়ের চিন্তাও ছিল। যদিও নানা জন আমাকে নানা ভাবে প্ররোচিত করছিল। ঐ চাকুরীতে ঢুকলে মাসে নিদেন পক্ষে ১ লাখ ইনকাম করা যাবে। আমি আসলে কোন উপরি আয়ের পক্ষপাতি ছিলাম না।
* প্রথম জীবনে একটা স্টেবল চাকুরী জোগাড় করতে আমাকে প্রায় ১০০+ সিভি দিতে হয়েছিলো। ইন্টারভিউ দিয়ছিলাম প্রায় ২১টা। সবগুলোর সব ঘটনা মনে নাই। কিছু কিছু অফিসের নাম হয়ত মনে আছে, নাভানা, রহিম আফরোজ, বিওসি, ওয়ার্টসিলা,সিমেক্স ......
** আমার কোন মামা, চাচা, খালু ছিলো না রেফারেন্স দেওয়ার জন্য।
*** সরকারী চাকুরীটা হয়েছিল ফখরুদ্দীন এর কেয়ারটেকার আমলে। খুব তাড়াতাড়ি রিক্রুটমেন্ট হয়েছিল। কোন লবিং ছাড়া (বিশ্বাস করুন আর নাই করুন।) বাকী ৮-১০টা চাকুরীর মত আমি জাস্ট রিটেন টেস্ট আর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম
**** একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল, লবিং ছাড়া সরকারী চাকুরী হয় না, তাই সরকারী চাকুরীর জন্য তেমন চেষ্টা করি নাই।
***** একই কারণে বিসিএস দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হয় নাই।
যারা এখন চাকুরী খুজছেন, তাদের প্রতি
* নিজের উপর আস্থা রাখুন, নিজের ক্যাপাবেলিটি সম্পর্কে জেনে নিন।
** ইন্টারভিউ স্কিল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখতে পারেন
অনুপ্রেরণা- রাতুল শাহ
somewhereinblog এর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ব্লগ দিবসে। ব্লগ না থাকলে হয়ত আমার টুকরো ঘটনাগুলো ডায়েরী আকারে লিখা হতো না।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:০৯