নিতাইকাকাকে একপ্রকার জোর করেই ভেতর নিয়ে গেলাম।যদিও ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে শুরুতে ও লোক ভেতরে ঢুকতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, না বসে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা ছাড়া সম্ভব নয় বলে হাত ধরে একপ্রকার জোর করতেই ও লোক আর আপত্তি করলেন না। উল্লেখ্য বয়সের পার্থক্য আমাদের মধ্যে অনেকটাই। সেকারণে আমরা ওনাকে কাকা বলেই ডাকি। যদিও সামনাসামনি 'তুমি' বলে সম্মোধন করলেও উনার প্রতি একটা অন্তরের শ্রদ্ধা সতত বহমান ।এ প্রসঙ্গে শুরুতে ওনার সম্পর্কে দুচার কথা না বললেই নয়।
পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোকের পুরো নাম নিতাই সামন্ত। সাদা কাটা ধুতি লুঙ্গি করে পরা,গায়ে একটা হাফ হাতা সাদা পাঞ্জাবি,পায়ে রাবারের চপ্পল,বড়বড় চুল রাখা, পিছনের লম্বা চুল ঘাড়ের উপর পর্যন্ত পড়ে যেন দোল খাচ্ছে। নীচের দিকটা আবার কোঁকড়ানো বটে। চুলের ব্যাপারে ভদ্রলোক বরাবরই খুব সৌখিন। মিষ্টভাষী মানুষটাকে দেখলে মনে হবে নিজের যাবতীয় শখশান্তি বাহারী চুলের পরিচর্যা করেই মিটিয়ে নিচ্ছেন।চুলে জায়গায় জায়গায় পাক ধরাতে নিয়মিত কালো রং করে থাকেন। এই সকালেও মনে হলো তেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়িয়ে তবেই বের হয়েছেন। এহেন নিতাইকাকার বহিরাবরণে সামগ্রিক বেশভূষায় মধ্যে কিছুটা বাউল সাধকের সাদৃশ্য মেলে।
শ্যামলা রঙের, গোঁফ দাঁড়ি কামানো মানুষটা নিজের রাজনৈতিক অবস্থানে সময়ে সময়ে লোক সংস্কৃতি নিয়ে মেতে থাকেন।গান লেখেন।পথ নাটিকাও লেখেন।যে কারণে নিজেকে শিল্পি বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। আগ্রহের বাহুল্যে কখনো কখনো আমরা নাট্যকার বললে, স্মিত হাস্যে নিজের পরিতুষ্ট মনের পরিচয় দেন।
তবে ওনার আসল পেশা শীতের মরশুমে সবজির চারাগাছ তৈরি করা। গ্রীষ্মেও করেন তবে সেটা পরিমাণে খুবই কম। এজন্য একটা ফার্ম হাউসকে কেন্দ্র করে কয়েক বিঘা জমি লিজ নিয়ে রেখেছেন।অত্যন্ত ভালো মানের চারা তৈরি হয় সেখানে। আধুনিক পদ্ধতিতে জলের যোগান ও পোকার উপদ্রব প্রতিহত করা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে পলিথিনের শেড দিয়ে অনেকটা গ্রীন হাউসের মতো কৌশলে বিভিন্ন সবজির চারাগাছ তৈরি করেন। আমি একজন বিলাসী ছাদবাগান চাষী। দিনের প্রথমার্ধে বাগানের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ছুটে যাই নিতাইকাকার কাছে। শুধু আমার মতো স্থানীয়রা নন, বাইরের দূর দূরান্ত থেকেও বহু লোক আসেন উনার কাছ থেকে চারাগাছ নেওয়ার আশায়। সুযোগে পেলে মাঝে মাঝে অপরাহ্নে আমার মতো জুনিয়রদের সময় কাটে গ্রীন হাউসে নিতাইকাকার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মেরে।
আদ্যোপান্ত কমিউনিস্ট। আলোচনায় বসলে একথায় সেকথায় বর্তমান রাজনীতি ও কম্যুনিস্ট পার্টির প্রসঙ্গ তুলবেনই। অবশ্য সাম্প্রতিক রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ মানুষটি দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে বলে প্রায়ই দুঃখ প্রকাশ করেন।জন্মস্থান সুবর্ণ রেখার তীর ছেড়ে সুদূর ছাব্বিশ পরগানার এক প্রত্যন্ত গ্রামে চলে আসার ইতিহাসটাও খুবই করুণ হৃদয়স্পর্শী। নিজের সম্পর্কে কমিউনিস্ট স্বত্বার বাইরে কিছু বলতে নারাজ। কিন্তু দীর্ঘদিন আমরা ওনার পাশে থেকে ঘেটে ঘেটে যেগুলি জানতে পেরেছি। সত্তরের দশকে কম্যুনিস্ট পার্টির সংগঠন করার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পালিয়ে আসেন আমাদের এই জেলায়। তবে সেই ইতিহাস খুবই দীর্ঘ।
দক্ষিণবঙ্গের বিপ্লবের আঁতুরঘর বলে পরিচিত মেদনীপুরে ওনার জন্ম। ঠাকুরদা ছিলেন গান্ধীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাজেই বলা যায় ওনার মগজে কিংবা রক্তে মিশে আছে আন্দোলন।গান্ধিজির আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ গোটা দেশের সঙ্গে সমানে আছড়ে পড়েছিল সুবর্ণরেখার তীরেও। সেই তরঙ্গে সামীল হয়েছিলেন এলাকার তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ।যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নিতাইকাকার ঠাকুরদা। ভদ্রলোক অসম্ভব গান্ধি ভক্ত ছিলেন। একবার গান্ধিজি আসছেন শুনে শুধু চোখের দেখা দেখার জন্য ছাপ্পান্ন মাইল পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছিলেন। দীর্ঘ রাস্তা যেতে আসতে নাকি একসপ্তাহের মতো সময় লেগে গিয়েছিল। যাইহোক আন্দোলন দমনের কৌশল বৃটিশের অজানা ছিল না। তারাও আন্দোলন দমন করতে বদ্ধপরিকর ছিল।ফলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। লাঠিচার্জ, গ্রেফতার সমানে চলতে থাকে। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে উনিও গ্রেপ্তার হন সেসময়ে।সেই শুরু তারপর আরও কয়েকবার ওনাকে শ্রীঘর দর্শন করতে হয়েছিল। তবে স্বাধীনতা উনি দেখে যেতে পেরেছিলেন এটাই পরমপ্রাপ্তি। সাতচল্লিশের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে নেহেরুজির দেওয়া ভাষণের একটা অংশ ওনার ঠোটে লেগে থাকত। প্রায়ই বলতেন কথাটি ''when the world sleeps, India will awake to life and freedom.'মধ্যরাতে বাকি বিশ্ব যখন ঘুমাবে ভারত তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে জেগে থাকবে। প্রত্যাশী ছিলেন দেশ থেকে হিংস্রতা, নিরন্নতা, দারিদ্রতা হাহাকার দূরীভূত হবে। দেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে স্বাস্থ্য শিক্ষায় সমান সুযোগ পাবে।
তুলনায় বাবা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ।উনিও পিতৃদেবের অনুসৃত পথে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেও হেঁটেছিলেন সম্পূর্ণ উল্টো দিকে।বাবা রাজনীতি করেছেন স্বাধীন দেশে,শাসকদলের আনুকূল্যে । লক্ষ্য ছিল নিজেদের সহায় সম্পত্তি রক্ষা করা কিংবা সম্ভব হলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা। জীবন দর্শনেও ছিল রাজকীয় আদর্শ। কেতাদুরস্ত নবাবি চালে নাকি ঘোরাফেরা করতেন। যেখানে পার্শ্ববর্তী আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ছিল দরিদ্রতা নিত্যসঙ্গী সেখানে ওনার বাড়ির পরিবেশ ছিল বিলাস বৈভবে পরিপূর্ণ। বৃত্তশালী বাবার একরতি ছেলের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল আশেপাশের গরিবগুর্বো মানুষের নিরন্নতা দারিদ্র্যতা হাহাকার। তাই সুযোগ পেলেই সেই শৈশব থেকেই বাবার অগোচরে প্রতিবেশীদের লুকিয়ে চুকিয়ে চাল গম দিতে কসুর করতেন না।এ ব্যাপারে কিছুটা পাশে পেয়েছিলেন মাকে। কিন্তু উনি ছিলেন সাবধানী। বারবার সতর্ক করে বলতেন,রাসভারী বাবার বিরুদ্ধাচরণ না করতে। গোটা বাড়িতে বাবার অসম্ভব দাপট ছিল। কারোর সাহস ছিল না ওনার বিরোধিতা করার। যাইহোক বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে তো আর সবদিন পার পাওয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই ধরা একদিন পড়তেই হতো। কপালে জুটল বেদম প্রহার। কিন্তু তাতেও না দমে উল্টে আরও জেদি হয়ে উঠলেন। তখন থেকেই ভাবনা শুরু। বালক বয়সে সেটা আরো পরিণত রূপ পায়। কাজেই ছোট্ট বালকের হৃদয়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে নিজের জন্য নয় বেঁচে থাকতে হলে জনগণের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা শক্তি। ফলতো আরেকটু বড় হতেই স্বার্থান্বেষী জাতীয়তাবাদী বাবার সঙ্গে মানসিকতায় ফাটল স্পষ্ট হয়। একসময় মনোমালিন্য প্রকাশ্যে চলে আসে।
সত্তরের দশকে কমিউনিস্ট আদর্শ তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।আর এই কম্যুনিস্ট আদর্শের মধ্যেই নিতাইকাকা নিজেকে নুতন করে আবিষ্কার করেন। খুঁজে পেলেন বেঁচে থাকার নুতন রসদ। বাবার বিরুদ্ধে হেঁটে নাম লেখালেন কম্যুনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু শুধু নাম লেখালেই তো চলবে না। সংগঠন করতেও হবে।এ যেন এক লড়াই যেখানে পিতা ও পুত্র একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। পিতার প্রভাবকে ফিকে করতে পথে নামলেন স্বয়ং পুত্র। পুরোদস্তুর সংগঠনে নেমে পড়লেন। নিজেদের জমিতে তো বটেই আশেপাশের ভূমিহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সঙ্ঘটিত করতে লাগলেন।বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। গোটা রাজ্যের সঙ্গে সুবর্ণরেখার তীরেও ভূমিহীন কৃষকের জমির দাবি ক্রমশ জোড়ালো হতে লাগলো। আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো শাসকের দুরাচার। বাবা পড়লেন কঠিন চ্যালেঞ্জে। নিজেদের জোতজমা রক্ষা করতে আর কালবিলম্ব না করে পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করেন। স্বাধীন দেশে শুরু হলো আরেকটা লড়াই। আগেকার বৃটিশের স্থলে এলো স্বদেশীয় শোষক শাসক শ্রেণী। জমিদার অনুগ্রহে পুষ্ট পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। অন্যান্য অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন সদ্য কৈশোরে উত্তীর্ণ নিতাইকাকাও।ফলে পুলিসি লক আপ থেকে গন্তব্য হয় জেলখানার অন্ধকারাচ্ছন্ন কঠুরিতে। এইভাবে কয়েকজনকে জেলবন্দির ফলে আন্দোলন সাময়িক স্তিমিত হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু পুরোপুরি উপড়ে ফেলা গেল না।বাবা সাময়িক স্বস্তি পেলেন ঠিকই কিন্তু রণে ভঙ্গ দিলেন না। কঠিন পণ নিলেন যে করেই হোক আন্দোলনকে নির্মূল করতেই হবে; ভূসম্পত্তিকে সুরক্ষিত করতে হবে। উঠতি নেতাদের গ্রেফতারের সুফলকে কাজে লাগাতেই হবে।ওনারা মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে নিজের কুপুত্রের জামিন মঞ্জুর করতে কোনো ব্যবস্থা তো নিবেন না। উপরন্তু একটা টাকাকড়িও খরচ করবেন না নিজ পুত্রের পিছনে। পুত্রও কোনো অংশে কম যান না। সিদ্ধান্ত নিলেন একদিন নিশ্চয়ই ছাড়া পাবেন কোনো না কোনো উপায়ে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বাবার কাছ থেকে এক কানাকড়ি নিয়ে তিনি জামিন নেবেন না । অবশেষে কয়েকবছর পর সরকার তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।মুক্তি পেয়ে নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করে চলে যান প্রতিবেশী রাজ্যে উড়িষ্যায়।
এখানেই সংযোগ ঘটে নন্দন কাননে গাইড হিসেবে প্রশিক্ষণ নেবার। কিন্তু মনযোগ বসাতে পারলেন না। অকৃতকার্য হলেন।যদিও এই অকৃতকার্যতা পেশা গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। তবে এখানে মন না বসলেও দিন চলে যাচ্ছিল। তবে সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছু দিন পর পুরানো একটি মামলায় পুলিশ আবার ওনাকে গ্রেফতার করে। এখানে সন্দেহ করেন সম্ভবত বাবার কাছে আত্মসমর্পণ না করায় বাবা ভিন্ন পথে ছেলেকে বশে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার জেলযাত্রাতেও উনি বিচলিত হলেন না।উল্টে জেলে যাওয়াটাকে তিনি মরশুমী ঘুরতে যাওয়ার মতো আনন্দদায়ক হিসেবে দেখতে লাগলেন। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই সুর বদলে গেল। জীবনের সব ভাবনা সর্বদা সরলরেখায় চলে না। কখনো কখনো বক্ররেখা আমাদের ভাবনার নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। তখন ভাবনার স্বাধীনতায় সাময়িক ছেদ ঘটে। অপেক্ষা করতে হয় বক্রতা শেষ হবে কখন সেই প্রহরের জন্য। নিতাইকাকার ক্ষেত্রে তেমনই ঘটেছিল। এসময় তাকে ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। বাড়তি প্রাপ্তি ঘটে দৈহিক অত্যাচার। প্রতিদিনই যার বহর ক্রমশ বাড়তে থাকে।যার মধ্যে অন্যতম প্রাপ্তি ছিল মাঝে মাঝে বেত্রাঘাত। অগত্যা কোনো উপায় না পেয়ে বিকল্প ছক কষেন। একদিন সুযোগ বুঝে রাতের দিকে উঁচু পাঁচিল টপকে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু কোথায় যাবেন তেমন তো কোনো ঠিকানা নেই। মায়ের কথা মনে পড়েছিল ঠিকই কিন্তু দাপুটে বাবার কাছে শান্তশিষ্ট নিরীহ মাতৃদেবী যে বড় অসহায় তাই মায়ের মুখ তাকে আর ঘরমুখো করতে পারেনি। জেল পলাতক বন্দি কাজেই কোনো রাস্তায় না হেঁটে অচেনা খানাখন্দে ভরা জঙ্গলাকীর্ণ মেঠো পথকে বেছে নিলেন। কাজেই কোনো গাড়িঘোড়ার সওয়ারি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। প্রথমদিন রাতের বেলা যতোটা সম্ভব পায়ে হেঁটে ভোর বেলায় সূর্য ওঠার আগেই একটা বদ্ধ কচুরিপানার জলাশয়ে সারাদিন লুকিয়ে থাকলেন। এইভাবে পরের দিন ও রাতগুলোতে পায়ে হেঁটে অথবা কোনো ঝোপঝাড় বা বাদাবনে লুকিয়ে থেকে অবশেষে পৌঁছালেন আমাদের এই প্রত্যন্ত ভূতবেড়িয়া গ্রামে।
চলবে..