আগেই বলেছি ছবির মত সাজানো স্টেশন বোরগ। কালকা থেকে গুনে গুনে ছয় নম্বর স্টেশনে আমরা প্রবেশ করেছি। একটা কথা না বললেই নয়, টয় ট্রেনের গতিবেগ সাধারণ ট্রেনের তুলনায় অনেকটাই কম হয়। কাজেই কালকা থেকে বোরগ পর্যন্ত আসতে আমাদের অনেকটা সময় লেগে যায়। সেই সকালবেলা এক ট্রেন থেকে নেমে আরেক রকম ট্রেনে ওঠা, তারপর অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ট্রেন ছাড়া, মাঝে লাগেজপত্র ধরাধরি, এসবের ফলে মধ্যপ্রদেশে চিনচিন ব্যথা অনুভব করি। বুঝতে পারি বেশ ক্ষিধে পেয়েছে। একটু আগে শ্বেতাও জানিয়েছিল ওরও খুব খিদে পেয়েছে। সঙ্গে স্নাক্স ছিল ঠিকই কিন্তু কাঁহাতক বা শুধু শুধু স্নাক্স খেয়ে কাটানো যায়। মনে হয় এই ট্রেন রুটে যাত্রীদের এমন সমস্যার সঙ্গে ট্রেন কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই পরিচিত। সম্ভবত সেকথা ভেবেই তাদের অসুবিধা দূর করতে হালকা টিফিন করার সুযোগ দিতেই ট্রেনটি কিছু বাড়তি সময় এখানে থামবে জেনে খুশি হই। আগের স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের ওঠানামা করতে যেটুকু সময় লাগছিল ততক্ষণই কেবল ট্রেনটি থামছিল।তাই চোখের সামনে একেরপর এক নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলেও নেমে পড়ে বা দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগ হচ্ছিল না।এই কারণেই বোরগ স্টেশনে ট্রেনটি বেশিক্ষণ থামবে জেনে আনন্দিত হয়েছিলাম। যাইহোক ট্রেনটি থামতেই আমরা ঝপাঝপ নেমে পড়ি। একজন মানুষের টিফিন করতে তো আর বেশি সময় লাগার কথা নয়। কাজেই বেশি সময় পাওয়া যাবে না ভেবে পাগলের মতো একনাগড়ে ফটো তুলতে থাকি। নিজেরা নিজেদেরকে তাড়া দেই। যে করেই হোক ট্রেন আবার শুরু করার আগেই যেন আমাদের যাবতীয় ফটোশুট শেষ হয়। মাঝে স্টেশনেই একটা টি শপে ঢুঁ মারি। কিন্তু দাম শুনতেই শ্বেতার চোখ কপালে উঠে, আমারও ক্ষিধে যায় উধাও হয়ে। বুঝে যাই এখানকার খাবারদাবার আমাদের জন্যে নয়। অবশ্য দামের জন্য আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। বাইরে ঘুরতে এসে একটুআধটু বেশি খরচপাতি জায়গা বিশেষে লাগতেই পারে বলে মনে মনে সব ক্ষেত্রে তৈরি ছিলাম। কিন্তু শ্বেতা রাজি না হওয়াতে অগত্যা ওসব কিছু মাথা থেকে দূর করে ওর পিছু অনুসরণ করতে থাকি। অনেক্ষণ ধরে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে অবশেষে যখন আবার ট্রেনের সিটে এসে বসি তখনও দেখি সহযাত্রীদের অনেকেই বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন।
প্রসঙ্গতক্রমে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়,তখন যেহেতু ছবি তোলার মাধ্যম ছিল স্টিল ক্যামেরা কাজেই ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা বাড়ছিল যেন রিল একদম শেষ না হয়ে যায়। সেদিন আমাদের ফটো তোলার যা গতি ছিল তাতে আশঙ্কায় ছিলাম সিমলায় যাওয়ার আগেই না ফিল্মগুলো শেষ হয়ে যায়। এই কারণে শেষের দিকে বারে বারে চোখ যাচ্ছিল রিলের সংখ্যার দিকে।তাই একটা জায়গায় এসে আমরা ফটো তোলা শেষ করি,যখন রিলে সামান্য কিছু ফিল্ম অবশিষ্ট ছিল। পরবর্তী লক্ষ্য ছিল সিমলায় নেমে ফটোর দোকান খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত হাতে কিছু জমিয়ে রাখা। কাজেই তাড়া ছিল ওখানে পৌঁছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার রিল ভরতে হবে।
টয় ট্রেনে আমাদের সিট ছিল পিছনের কম্পার্টমেন্টে। শুরুতে এই পেছনের কম্পার্টমেন্টে সিট পেয়ে হতাশ হয়েছিলাম। সেসময়ে মনে হয়েছিল সামনের কম্পার্টমেন্টে যারা সুযোগ পেয়েছে তারা কতই না ভাগ্যবান, কত সুন্দরভাবে তারা সামনে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু কিছুটা ট্রাভেল করে বুঝতে পারি ভাগ্যিস পিছনে আসনে বসার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই এহেন ভৌগলিক অবস্থান আমাদের পক্ষে সাপে বর হয়েছিল। ট্রাভেল করতে করতে মনে হয়েছিল, এটাই টয় ট্রেন জার্নির পক্ষে আদর্শ জায়গা।পাশ থেকে দেখতে দেখতে ভালো লাগলে যতক্ষণ চোখ যায় ততক্ষণ আমরা পেছনে দূর বহুদূর পর্যন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। সর্পিল ভঙ্গিতে পাহাড়ি পথ নদী ঝর্না গাছপালা ব্রীজ বিভিন্ন বাড়িঘর প্রভৃতির মতো দৃশ্য গুলো ক্রমশ আমাদের দৃষ্টিপটের বাইরে চলে চলে যাচ্ছিল।
বোরগ স্টেশনের সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয় হলো স্টেশন লাগোয়া রহস্যময় বোরগ টানেল। রহস্য এই কারণেই স্থানীয়দের কাছে টানেলটি ভূতুড়ে টানেল হিসেবেই পরিচিত।আর তা থেকেই টানেলটি সম্পর্কে মানুষের মনে হাজারো জিজ্ঞাসা, হাজারো প্রশ্ন। ভূতের ভয় পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে আমজনতার মধ্যে নানান গল্পগুজব চালু আছে। এক্ষণে পথে এমন একটি ভূতুড়ে টানেলের কাহিনী শুনে আমরা খুবই আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি। সেসময়ে বসে থাকা সহযাত্রীদের মধ্যে আলোচনার বিষয় ছিল বোরগ টানেল। কেউবা সিরিয়াস কেউবা রসিকতার ছলে কিছুটা রহস্যময় দৃষ্টিতে নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ভূতের আলোচনা করছিল।আগ্রহ না থাকলেও অবশ্য বেশিক্ষণ নিজেদেরকে অ্যালুফ রাখতে পারেনি। একসময় আমরাও আলোচনায় অংশ নিই। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছিল ওনারা বুঝি আমার জন্যেই এমন বেশি বেশি করে ভূতের আলোচনা করছেন। আমি ভীতু মানুষ; রাতবিরেতে একাকি বের হতে ভয় পাই। মনে হয় কোনো ভাবেই হয়তো ওনারা একথা জানতে পেরে আমাকে ভূতের ভয় দেখানোর জন্যেই বেশি বেশি করে তেনাদের নাম করছেন। ভেবে অবাক হই, বাড়ি থেকে দু-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে এসেও ভূত আমাকে পিছু ছাড়ল না বলে।আর ট্যুর কোম্পানির ছেলেগুলোর সঙ্গে কেই বা লাগিয়েছে যে আমি ভূতের ভয় পাই। যাইহোক আমার সন্দেহের তীর ছিল টুর কোম্পানির ছেলেগুলোর দিকে। তবে ভূতেরো বলিহারি সাহস। আমার মতো ভীতূর ডিমকে এভাবে অপদস্থ করার ফন্দি ফিকির না করে যারা বরং ভূতকে মানেন না তাদের দিকে যা নারে বাবা! আমি একটা কথা প্রায়ই ভাবি একজন ভীতু লোককে ভয় দেখানোর মধ্যে একজন ভূতের কোনো কৃতিত্ব নেই, নেই কোনো সার্থকতা। সে যদি প্রকৃত সাহসী ভূত হয় তাহলে যারা তার অস্তিত্ব মানেন না তাদের সামনে যায় না কেন? এ তো একধরনের শঠতা। যাইহোক নিজের ভয়কে অন্তরে লুকিয়ে ওরা রসিকতা করছে ভেবে জানিয়ে দেই,
-ঠিক আছে ভূত আসে আসুক। আমি ওসব কিছুর ভয় পাইনে।
হঠাৎ সবার সামনে আমার এমন করে বলাতে উল্টে বিপত্তি ঘটে। উপস্থিত বেশিরভাগ যাত্রীই কিছুটা রহস্যময় ভাবে মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারি ভুল একটা করে ফেলেছি। আগবাড়িয়ে নিজেকে আলোচনার বিষয় করা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। তবে ওনারা যাই ভাবুন না কেন মনে মনে এই কথা ভেবে সান্ত্বনা দেই,
-এতোক্ষণ ধরে চেনাজানা সহযাত্রীদের সঙ্গে গল্প গুজব করে আমরা অনেকেই ক্লান্ত। এমতাবস্থায় মাঝে যদি কিছু সময় ট্রেনে নতুন অতিথি, ভূত মহাশয়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তাহলে তার সঙ্গে না হয় গল্পগুজব করে কিছুটা পথ এগোনো যাবে বৈকি।
মনকে সান্ত্বনা দিলেও ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়।সাপ আর ভূত এই দুটি শব্দের নাম শুনলেই আমার কেমন গা ছমছম করে ওঠে। সেদিনও এর অন্যথা হয় নি।বলতে বলতেই ট্রেনটি হঠাৎ দুলে ওঠে। বুঝতে পারি সময় শেষ। ট্রেনটি আবার যাত্রা শুরু করেছে।কেন্নোর মতো মন্থর গতি নিয়ে তিরতির করে ট্রেনটি ক্রমশ টানেলের মধ্যে প্রবেশ করছে। অন্ধকার টানেল, ভেতরে প্রবেশ করতেই আর একবার গাছমছম করে উঠলো। হঠাৎ সহযাত্রীদের মধ্যে অদ্ভুত এক নীরবতা লক্ষ্য করি। সবাই একদম চুপচাপ।যেন ভূতের আগমন দৃশ্যকে পরখ করতে সবাই ঘার বেঁকিয়ে যে যার চতুর্দিকে খেয়াল রাখছে। সবার যেন তাকে সুস্বাগতম জানাতেই প্রস্তুত। আমার দৃষ্টি ছিল সহযাত্রীদের দিকে। সেদিন ভূতের আগমনকে পরখ না করতেই দৃষ্টি যাত্রীদের দিকে নিবদ্ধ রেখেছিলাম। লক্ষ্য ছিল যেনতেন প্রকারই হোক আমার চোখে যেন ভূতের আগমন দৃশ্য ধরা না পড়ে।একটা দমবন্ধকর পরিবেশে প্রায় পাঁচ-ছয় মিনিট ধরে অন্ধকার টানেলের মধ্যে দিয়ে ট্রেনটি চলছে অথচ টানেল যেন আর শেষ-ই হচ্ছে না। অবশেষে একদম শেষে যখন সকলের চোখে মুখে হতাশা ফুটে উঠেছে,ভূতের দর্শন বুঝি এবারের মতো পন্ড হয়ে গেল বলে; ঠিক তখনই একবার টানেলের পিছিনের দিকে চোখ পড়তেই শিউরে ওঠি।
-কি আশ্চর্য! একটা আলোর দ্যুতির মতো অস্পষ্ট একটা ভূত কুকুর হাতে নিয়ে লাইন ধরে ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
যাত্রীদের মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ফিসফিসিয়ে কয়েকজন বলে উঠলো,
-ওই যে ট্রেনের পিছনে! ভূত আসছে।
ক্রমশ পরিষ্কার হলো, ট্রেনের আবছা ফেলে আসা আলোয় দূরে এক ব্যক্তি একটি কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে টানেলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ এগিয়ে আসছেন......
বিজ্ঞান যাই বলুক বোরগ সাহেবের এই পথচলা আজকের নয়,
১৯০১ সালে টানেলের কাজ সময় মতো সম্পন্ন করতে না পারার জন্য ট্রেন কোম্পানি থেকে তিরস্কৃত হয়ে এক টাকা জরিমানা হওয়ায় আত্ম গ্লানিতে নিজের সার্ভিস রিভলভার দিয়ে নিজেকে শুট করেছিলেন টানেল নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার বোরগ সাহেব। শেষ মুহূর্তে সঙ্গে ছিল নিজের প্রিয়তম পোষ্যটি।বোরগের মৃত্যুর পর কোম্পানি স্থানীয় একজনকে সহযোগী করে অপর একজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ করে দুই দিক থেকে খননকরা টানেলের সংযোগস্থল মিলিয়ে দেখেন বোরগের হিসেব একদম যথার্থই ছিল। খামোখা অহেতুক কোম্পানির রোষানলে পড়ে আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন একজন মানুষের জীবন চলে গেল।পরে এই কারণে রেল কোম্পানি স্থানটির নামকরণ করেন মিস্টার বোরগ সাহেবের নামে। কিন্তু বোরগ চলে গেলেও আজও ওনাকে বিশেষ ঐ স্থানে দেখতে পাওয়া যায়। অন্ধকার টানেলের মধ্যে কখনও কখনও তাই যাত্রীদের চোখে পড়ে কুকুর নিয়ে মিস্টার বোরগ লাইন ধরে এগিয়ে আসছেন।
আজ এত বছর পরও যেন অন্ধকার টানেলের মধ্যে রেল সহ যাত্রীদের নীরব পথপ্রদর্শক হিসেবে নিজের বিরামহীন কর্তব্য পালন করে চলেছেন।