সূর্য ডুবে যাওয়ার ক্ষণে নিজেকে আয়েশীভাবে প্রকৃতিতে বিলিয়ে দিতে প্রায়শই একাকী ছাদে হাঁটে শিউলি। পুরো নাম নুসরাত জাহান শিউলি। বিকালের সোনাঝরা রোদ তার গায়ে পড়ে অদ্ভুত এক মায়াবী আবহ সৃষ্টি করে । পাতাবাহার গাছে সে ঝর্ণা দিয়ে পানি ঢালে আবার সেই পানি হাতে নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলা করে। এ খেলা যেন তার হারিয়ে ফেলা শৈশবকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
পাশের বিল্ডিং থেকে রোহান অানমনে দুরন্ত শিউলিকে খেয়াল করে। তার চঞ্চলতা, হাটার ছন্দ, শরীরের ঢং, সবকিছু লুকিয়ে অবলোকন করে সে মিটিমিটি হাসে। যাকে আমরা 'চোরা চাহনি' বলে থাকি। দুই বাসার বারান্দার দুরত্ব হাত-পাঁচেক। তাই সহজেই শিউলি বারান্দায় এসে রোহানের স্ত্রী রুহীর সাথে প্রায়শই গল্পে মজে ওঠে।
এক শুক্রবার বিকেলে শিউলি রুহীকে জিজ্ঞেস করে-
আজ কী কী রান্না করলেন ভাবী ?
- আর বলো না, তোমার ভাইয়া তো ঠিকমতো বাজারসদাই করে না। ঘুম থেকে ওঠেই অফিস যায় আর ফিরে রাত ন'টায়। বাসায় এসে আবার চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে যায়। বাজার করার সময় কই !
- চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে যায় মানে ?
- ও তুমি জানো না ? সে গল্প লিখে, কবিতা লিখে।
- ও মা তাই !
তাদের কথা চলতে থাকে। কথার মাঝে রোহান খালি গায়ে রুহীর পাশে এসে দাঁড়ায়। ওপাশে শিউলি উসখুস করে। অস্বস্তি লাগে তার। রোহান শিউলির চোখের দিকে আনমনে তাকায়। তিনজনের মুখেই যেন পাথর চেপে বসে তখন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মুহূর্তকে পাশ কাটিয়ে শিউলি তার রুমের দিকে পা বাড়ায়।
রুহী রোহানের দিকে অগ্নি চোখে তাকায়। তাদের দুজনের মধ্যে এভাবে রোহানের অনুপ্রবেশ তার ভাল লাগেনি। এমন কসাই মার্কা শরীর নিয়া মানুষের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা করেনা তোমার। এই শরীর মানুষকে না দেখালে শান্তি পাওনা তুমি ! রুহী কপালে ভাজ তুলে মিনমিন করে রোহানকে বলে। রোহান কথা না বাড়িয়ে পাথরের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে তার রুমের দিকে এগোতে থাকে।
রুহীকে একা দেখে শিউলি আবার বারান্দায় ফিরে আসে। রোহান তার রুমে এসে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপিচুপি শিউলিকে দেখছে। শিউলি অবলীলায় রুহীর সাথে হাসছে, কথা বলছে। চোখ-মুখ-শরীর থেকে যেন ঐশ্বরিক কোনো আলো পুরো বারান্দায় ছড়িয়ে পড়ছে তখন।
রোহান চোরা চোখে শিউলিকে দেখে আর বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলে-
আহ ! মানুষ এতো সুন্দর হয় !
নানাজাতের ফুল দিয়ে স্ট্যাজ সাজানো হয়েছে। আলোচকরা ইতিমধ্যে আসন গ্রহণ করেছেন। রোহানের কবিতার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আজ। একেকজন আলোচক তার কবিতা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করছেন।
হলরুমের দর্শকসারিতে বসে রুহী কবিতার বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। শেষ ফ্ল্যাপে রোহানের ছবিটা দেখে গর্বে বুকটা ফুলে উঠছে তার। তবে পৃষ্ঠা উল্টাতেই উৎসর্গ পাতায় চোখদুটি থমকে যায়। সবকিছু কেমন জানি ঝাঁপসা লাগছে । খুব তাচ্ছিল্যভাবে, নিষ্ঠুরভাবে, দুটো বাক্য তার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করছে যেন !
কোনো এক শিউলিকে।
ফুল অথবা ফুলের মতো মিষ্টি এক বালিকা !
রুহী মিনমিন করে বলে - অহ গড, এ ও সম্ভব !!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৮ দুপুর ২:১১