মুজাহিদের বক্তব্য তারা জানেন না অথবা বুঝেননি এই বিবৃতিজীবীরা হিংসা-বিদ্বেষ দ্বারাও পরিচালিত হন। এই কারণেই তারা কে বলল এটা দেখেন, কি বলল এটা শোনা বা জানার প্রয়োজনবোধ করেন না। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বক্তব্য নিয়ে এই কাণ্ডই তারা ঘটিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন টক শো ও পত্রিকায় তাদের বক্তব্য প্রমাণ করছে, হয় তারা জনাব মুজাহিদ কি বলেছেন তা আদৌও জানেন না, না হয় তারা জনাব মুজাহিদের বক্তব্য পাশ কাটিয়ে যা ইচ্ছা তা বলে যাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, বিবৃতিজীবীরা যদি মুজাহিদ সাহেব কি বলেছেন তা জানতেন এবং বিদ্বেষা না হতেন, তাহলে তারাও মুজাহিদ সাহেবের কথার সাথে একমত হয়ে বলতেন যে, বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই, কোন স্বাধীনতা বিরোধী নেই এবং যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন, তারা সংবিধানের বিরুদ্ধেই বলছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির যারা ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক তারাও বলছেন যে জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল তিনটি বিষয়ে যে কথাগুলো বলেছেন, সেটাই ইতিহাসের বাস্তবতা।
ইতিহাসের দিকে অংগুলি সংকেত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ও পাকিস্তান বাহিনীর সারেন্ডারের পর সারেন্ডারকৃত পাকিস্তান বাহিনীকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৯৭৩ সালের এপ্রিলের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন ভারত সফর করেন। এই উপলক্ষে ভারত-বাংলাদেশের একটা যুক্তঘোষণা প্রকাশ করা হয়। এই ঘোষণাতেই প্রথম মানবিক কারণে পারস্পরিক ভিত্তিতে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের স্বদেশে পাঠানো ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলা হয়। (উড়পঁসবহঃ ড়ভ ওহফরধ-ইধহমষধফবংয-চধশরংঃধহ জবষধঃরড়হং উবপ. ’৭১্তঔঁহব ’৭৪, অহ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঝবৎারপব ড়ভ ওহফরধ চঁনষরপধঃরড়হ, ঝৎবব ঝধৎধংধিঃর চৎবংং খরসরঃবফ, ঈধষপঁঃঃধ, চধমব-৪৩). এই ঘোষণায় যুদ্ধাপরাধীদের কোন সংখ্যা বলা ছিল না। এই ১৭ এপ্রিল তারিখেই বাংলাদেশ সরকার প্রথম বারের মত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত একটা সংবাদ-বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। তাতে যুদ্ধপরাধীদের সংখ্যা বলা হয় ১৯৫ জন। (ঐ, পৃ. ৪৩-৪৪) এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ২ দিন পর ১৯ এপ্রিল ডক্টর কামাল হোসেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বলেন যে, ভারত-বাংলাদেশ একমত হয়েছে যে, মানবিক কারণে যুদ্ধাপরাধী ছাড়া যুদ্ধ বন্দীসহ অন্যান্য আটকে পড়াদের রিপ্যাট্রিয়েশনের ব্যবস্থা করা হবে। (ঐ, পৃঃ ৪৫-৪৬)
অন্যদিকে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২৪ এপ্রিল তারিখে ভারতীয় পার্লামেন্টে জানান, সিমলা চুক্তিতে উল্লেখিত সব ব্যাপার নিয়ে আলোচনায় পাকিস্তান আগ্রহী নয়। তারা প্রথমে যুদ্ধবন্দী বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। পাকিস্তান বলেছিল যে, তাদের এক হাজার কিংবা তারও বেশী সৈন্য ও অফিসার যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ আছে, তাদের বিচার বাংলাদেশ করলে তা তারা মেনে নেবে এই শর্তে যে, অন্যান্য সৈন্য ও অফিসারদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান এখন বলছে তাদের কোন সৈন্যের বিচার তারা করতে দেবে না।-----আমি আশা করি সমস্যার সমাধান হবে।’ (ঐ, ৪৭,৫০,৫১)-এর চার মাস পরে ২৮ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান ও ভারত একটা ‘ঔড়রহঃ অমৎববসবহঃ’ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ রাজি হয়েছে যে, যুদ্ধবন্দীসহ আটকে পড়াদের রিপ্যাট্রিয়েশনের গোটা সময়কালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা করবে না। রিপ্যাট্রিয়েশনের পরে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এক সাথে বসে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে এবং বাংলাদেশ সে আলোচনা করবে সম-অধিকারের ভিত্তিতে।’ (ঐ, ৫৯, ৬০) এর পাঁচ মাস পর ১৯৭৪ সালের ১৩ থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরনসিং বাংলাদেশ সফর করেন। এই সফরের পর যুক্ত ঘোষণায় অনেক বিষয়ের সাথে বলা হয় যে, ‘উভয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা করেন পাকিস্তান ‘দিল্লী এ্যাগ্রিমেন্ট’ (২৮ আগস্ট, ১৯৭৩) এর সব বিষয় বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে পালন করবে। উভয়ে আরও আশা করে, সিমলা চুক্তি ও দিল্লী এ্যাগ্রিমেন্টের ভিত্তিতে উপমহাদেশে সুসম্পর্ক ও স্থিতিশীল শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হবে।’ (ঐ, পৃঃ ৬৩)
এই ঘটনার ২ মাস পর ১৯৭৪ সালের ৯ই এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে ১৬টি ক্লজ আছে। এর প্রথম বারটি ক্লজে যুদ্ধবন্দীসহ আটকেপড়াদের রিপ্যাট্রিয়েশনের ক্ষেত্রে যেসব আলোচনা, অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন হয়েছে তার বিবরণ দেয়া হয়। চুক্তির ১৩, ১৪ ও ১৫নং ক্লজে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আলোচনা ও ক্ষমা ঘোষণা স্থিরিকৃত হয়। ১৩নং ক্লজে যুদ্ধাপরাধীদের আলোচনা প্রসঙ্গে উপমহাদেশে শান্তি, সমঝোতা ও বুত্বপূর্ণ পরিবেশের কথা বলা হয়। এই আলোচনায় বাংলাদেশ পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, আইন ও আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রয়োজন। অন্যদিকে পাকিস্তানের দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদ বলেন, কোন অপরাধ ঘটে থাকলে তার জন্যে পাকিস্তান সরকার গভীরভাবে দুঃখিত এবং এর তীব্র নিন্দা করছে। ১৪নং ক্লজে বলা হয়, তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টাকে তিন দেশের সুসম্পর্ক ও সমঝোতার দৃষ্টিতে দেখছেন। তারা বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের জনগণের কাছে অতীতের ‘ভুলকে’ ’ঋড়ৎমরাব ধহফ ঋড়ৎমবঃ’ এর দৃষ্টিতে দেখার জন্যে আবেদন করেছে। তার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “ডরঃয ৎবমধৎফ ঃড় ঃযব ধঃৎড়পরঃরবং ধহফ ফবংঃৎঁপঃরড়হ পড়সসরঃঃবফ রহ ইধহমষধফবংয রহ ১৯৭১ ঃযধঃ বি ধিহঃবফ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ঃড় ভড়ৎমবঃ ঃযব ঢ়ধংঃ ধহফ ঃড় সধশব ধ ভৎবংয ংঃধৎঃ, ....চবড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয শহব িযড় িঃড় ভড়ৎমরাব.’ ১৫ই ক্লজে বলা হয়, উপরোক্ত অবস্থার ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশী জনগণের কাছে পাকিস্তান সরকারের ক্ষমার আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে: "বাংলাদেশ সরকার ক্ষমার নিদর্শন হিসাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্মতভাবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী অন্যান্য যুদ্ধবন্দীদের সাথে দেশে প্রত্যাবর্তন করবে।" (ঐ, পৃ. ৬৫-৬৮)।
এই হলো যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ঘোষণার কাহিনী। বিষয়টি একটু বিস্তারিত আলোচনা করা হলো এই জন্যে যে, যুদ্ধাপরাধী চিহিßত হওয়া এবং ক্ষমার বিষয়টি রাতারাতি বা গোপনে হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ও দেশে ফেরত পাঠানো ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও আলোচনার ফল এবং সবকিছুই ছিল প্রকাশ্য। ক্ষমা ঘোষণার এই দলিলে স্বাক্ষরকারী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আজিজ আহমদ বেঁচে না থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এখনও বেঁচে আছেন।
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে এই ১৯৫ জনের বাইরে কি যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশে ছিল? ঐ ১৯৫ জনের সকলেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিক। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এইসব অফিসার ও সৈনিক ছাড়াও বাংলাদেশে অন্য কোন যুদ্ধাপরাধী কি ছিল? মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছাড়াও সে সময়ে গঠিত একাধিক বাহিনী সহায়ক যোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছে। তাদের মধ্যে কি যুদ্ধাপরাধী ছিল কিনা? এর সুস্পষ্ট উত্তর হলো, না। কারণ ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭৩, বাংলাদেশ সরকার তদন্ত অনুষ্ঠানের পর যুদ্ধাপরাধী চিহিßত করে তাদের বিচারের যে ঘোষণা দেয়, তাতেই একথাও পরিষ্কার বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সে ঘোষণায় বলা হয়: "পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা যে অপরাধ করেছে তার তদন্ত প্রায় সমাপ্ত। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৫ জনকে গুরুতর অপরাধের জন্যে বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঢাকায় সুপ্রীমকোর্টের বিচারকের সমপদমর্যাদার বিচারকদের দ্বারা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার হবে।”
বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা মাত্র ১৯৫ এবং তদন্ত অনুসারে বাংলাদেশে বিচারযোগ্য আর কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। সে সময় দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী না থেকে থাকলে, এখন আসবে কোত্থেকে? সুতরাং দেশে এখন কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। জামায়াত সেক্রেটারি জনাব মুজাহিদ এই সত্য কথাটাই সেদিন বলেছেন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী নেই এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ব করা সংবিধান বিরোধী, জনাব মুজাহিদের এই বক্তব্যগুলোও ঐ একইভাবে আইন, সংবিধান ও বাস্তবতার ভিত্তিতে সত্য। স্বাধীনতা বিরোধিতা একটা মারাত্মক অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ধারা ১২১, ১২১ক, ১২২, ১২৩, ১২৩ক, ১২৪, ১২৪ক ইত্যাদি ধারা মতে স্বাধীনতার বিরোধিতামূলক সকল অপরাধ বিচার্য। কেউ যদি ‘স্বাধীনতা বিরোধী আছেন’ বলেন, তাহলে শুধু বলা নয়, অপরাধী চিহিßত করে তাকে ধরিয়ে দিতে হবে। জনাব মুজাহিদের কাছে এমন কোন ব্যক্তির সান ছিল না বলেই তিনি বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী নেই বলেছেন। এখন কেউ যদি বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী আছে, তাহলে তাকে ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তারই, জনাব মুজাহিদের নয়। সর্বশেষে আসে ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সংবিধানবিরোধী’ হওয়ার কথা। সংবিধানে বর্ণিত একটি মূলনীতি হলোঃ ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি’। এছাড়া ‘ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয়েছে। তাছাড়া সংবিধানের একটি মূলনীতি ‘গণতন্ত্র’ সকলের সকল মানবিক অধিকার সংরক্ষণ করেছে। এসব নীতিই প্রমাণ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে তা হবে সংবিধানের খেলাফ। সংবিধানের খেলাফ দাবি তোলা অবশ্যই সংবিধানবিরোধী। জনাব মুজাহিদ মাত্র এই কথাই বলেছিলেন, বেশি কিছু নয়।
‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। বিবৃতিজীবীদের ‘চোরা’ বলছি না, বলা উচিত নয়, কিন্তু ধর্মের কাহিনী মানে ভালো কথা, যুক্তির কথা, নীতির কথা, আইনের কথা শোনার যোগ্য বিবৃতিজীবীরা নন, এ কথাই সত্য। এই সত্য তারাই প্রমাণ করছেন তাদের আচরণে। সূত্র