শাইখ হাসান আলী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আলেম, শাইখ, ব্রিটেনের সাফার একাডেমির শিক্ষক; প্রায় ২৬ বছর যাবৎ এ ধারার শিক্ষায় সংযুক্ত আছেন। তিনি মুসলিমের ভিতরে মাজহাব ও উপদলগুলো সম্পর্কে অতীব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন যা, YouTube এ আছে। আমি তার ইংরেজিতে দেয়া পূর্ণ বয়ানের বঙ্গানুবাদ করে পাঠকের কাছে তুলে ধরলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, আমাকে জানালে সংশোধন করে দিতে পারবো।
===============
আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ। আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজিম, বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। ওয়া মাখাতালাফা ফীহি ইল্লাল্লাজিনা উতুহু মিম বা'দি মা জা-আতহুমুল বাইয়্যিনাতু বাগইয়াম বাইনাহুম, ফা হাদাল্লা হুল্লাজিনা আ-মানু লিমাখতালফু ফীহি মিনাল হাক্কী বি-ইজনিহ; ওয়াল্লাহু ইয়াহদী মাই-ইয়াশা উ-ইলা সিরোত্বিম মুস্তাকীম।
অর্থাৎ: বস্তুতঃ কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করেনি; কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক জেদবশতঃ তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ ঈমানদারদেরকে হেদায়েত করেছেন সেই সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপারে তারা মতভেদ লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, সরল পথ বাতলে দেন। [সূরা বাকারা 2:213]
শ্রদ্ধেয় ভাই ও বোনেরা এবং আরো যারা শুনছেন, আল্লাহ এই মজলিসকে দ্বীনের নিকটবর্তী হওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা হিসেবে কবুল করুন, সত্য ও কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কথা বলার তৌফিক দান করুন এবং মিথ্যা বা নিজস্ব ধারণা প্রচার থেকে রক্ষা করুন।
আলোচনা শুরুর আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন, এখানে আমরা সবাই বা অধিকাংশই জন্মসূত্রে মুসলিম। প্রত্যেকেই আমরা নিজস্ব পরিবার, সমাজ, দেশ এবং পিতামাতার আদর্শ ও ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত হই। মুসলিম হিসেবে জন্মানোর কারণে ছোট থেকে আমাদের ইসলামী বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনায় এই প্রভাবগুলো প্রবলভাবে পড়ে। আমি সমাজ/সংস্কৃতির ধারণার কথা বলছি না বরং ধর্মের ভিতরেই কিছু নিজস্ব বিশ্বাস - যার দ্বারা আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন উপদলে বিভক্ত মুসলিম। আমি আপনি ছোট থেকে বড় হতে এ পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন ধাপ পার করে এসেছি। ১) পিতামাতা, ২) প্রতিবেশী বা পিতামাতার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ - মামা, চাচা, খালা, দাদা,নানা প্রমুখ আত্মীয়। এই মানুষগুলোর প্রভাব আমাদের জীবনে এতটাই বেশি যে, জন্ম থেকে প্রথম পাঁচ বছর পর্যন্ত যখন ভালো/মন্দের পার্থক্য বুঝতাম না তখন থেকেই তাদের অনুসরণ করতাম, তাদের কথা মেনে চলতাম। তখন থেকেই তারা আমাদেরকে শিখিয়েছেন কি করতে হবে, কি করা যাবে না, কার সাথে বন্ধুত্ব করবো ইত্যাদি সকল বিষয়। তারপর আসি মাদ্রাসার জীবন - কোন মসজিদ/মাদ্রাসায় পড়েছি, কে শিক্ষক ছিলেন, কোন ধারণা বা মতবাদে তিনি বিশ্বাস করতেন এর একটা বড় প্রভাব আমাদের চিন্তাভাবনা/বোধশক্তির উপর পড়ে। এগুলো বিবেচনায় মানুষ মোটামুটি তিন ধরণের - ১) যা বলা হবে, কোনো প্রমাণ ছাড়াই তা বিশ্বাস করবে, ২) কিছু বলা হলে, প্রমাণ দেখানোর আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করবে না, প্রমাণ পেলে সন্তুষ্ট ৩) যাই বলা হোক বিশ্বাস করবে না এমনকি প্রমাণ পেলেও নাহ। স্বাভাবিকভাবেই প্রথমটি শিশু, দ্বিতীয়টি তরুণসমাজ এবং তৃতীয়টি আমাদের “চাচাজান”। মুরুব্বি/বয়োজ্যেষ্ঠ সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ৫০/৬০ বছর বয়স্ক কিছু মানুষ আছে তাদেরকে যত প্রমাণই দেওয়া হোক বলবে “শোনো, আমার বাপ-দাদা থেকে বংশ পরম্পরায় হাদীস শুনে আসছি, এই হাদীস কখনো শুনিনি; তুমি তোমার কথা ফিরিয়ে নাও”। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যম দলের লোকগুলো।
এটা খুবই স্পর্শকাতর একটি আলোচ্যবিষয়, সাধারণ নয়; আপনি নিজে কতোটা সঠিক সেটা প্রমাণের জন্যে যদি এই বক্তব্য শুনতে বসেন তাহলে তা আমার জন্যে খুবই কঠিন হবে - কারণ আমি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারবো না। সবাইকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টাও যদি করি তাহলে শেষে আমাকেই ধরবেন “আপনিই ভুল, আমরা সবাই ঠিক হই কিভাবে? অসম্ভব!” আপনি বক্তৃতা শুনছেন আর ভাবছেন ওমুক শায়খ তো এমনটা বলেননি অথবা আমি তো জানতাম বিষয়টা এমন না - এটা করলে জ্ঞানলাভের পথ সংকুচিত হয়ে যাবে। তাই আমার অনুরোধ, প্রত্যেকে আপনাদের নিজস্ব পূর্বধারণা/সংস্কৃতিগুলোকে সরিয়ে রেখে খোলা মনে আমার কথাগুলো শুনুন। এবং আমার কথা নিজের কথা নয়, অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণে। হয়তো বলবেন আমি নিজেও তো আপনাদের মতোই পিতামাতা, মাদ্রাসা শিক্ষকদের দ্বারা প্রভাবিত, নিজস্ব উপদলের পক্ষে। তা সত্য, কিন্তু আমি কিছুটা বুঝ হওয়ার পর থেকেই কুরআন-সুন্নাহর ব্যাপারে খোলা মনের থাকতে চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। আমি মাদ্রাসার ওস্তাদদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছি বহুবার। একদম ছোট বয়সে সেই সাহস হয়নি কিন্তু ধীরে ধীরে আমি অনুভব করেছি, সন্দেহ জেগেছে তিনি ঠিক বলছেন না, আমি আপত্তি করেছি। তারা ধীরে ধীরে আমার কথাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, হয়তো সত্যের প্রমাণ দিয়েছেন নাহয় ভুল স্বীকার করেছেন। একটা পর্যায়ে অনেক অনেক ধারণার ভিড়ে আমি নিজের মতকেও চ্যালেঞ্জ করেছি। আমি যা বোঝাতে চাইছি, আমার এক ওস্তাদ বলেছিলেন “কুয়ার ব্যাঙ হয়ো না”। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম “কুয়ার ব্যাঙ কি জিনিস?” তখন বুঝালেন একটি ব্যাঙের জন্ম কুয়াতেই এবং সেখানেই থাকতো। ঐ কুয়াটাকেই সে সবকিছু ভাবতো। ঢেউয়ের তোড়ে আরেকটা ব্যাঙ এসে কুয়ায় পড়লো, সে বলতে লাগলো সমুদ্র কতোবড়, এতে অনেক বেশি পানি। কুয়ার ব্যাঙ বলল “না, হতেই পারে না! এইটার চেয়ে বড় জলাধার থাকা অসম্ভব”। অর্থাৎ, আপনি যে পরিমান জ্ঞানার্জন করেছেন ওটাকেই সমগ্র জ্ঞান ভেবে নেওয়া বোকামি। মনকে উদার রাখতে হবে, চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
ইসলামী জ্ঞানার্জনের পথে যতই এগোবেন, এই জ্ঞানসমুদ্রে নিজের সীমাবদ্ধতা ততোই আবিষ্কার করতে পারবেন। ইসলামী আইনশাস্ত্র ফিকহ এত সহজ বিষয় না, আমি বোর্ডিং মাদ্রাসায় ফিকহ পড়েছি নয় বছর। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত মোট একুশ বছর (২০১১ সালে) যাবৎ ফিকহ নিয়ে পড়ছি, তবুও মনেহয় তেমন কিছুই শিখতে পারলাম না, এখনও ভুল করি। ফিকহ জানার জন্যে অনর্গল আরবী বলতে ও বুঝতে পারা আবশ্যক। এজন্যে আমাকে শিখতে হয়েছে আরবী পড়া, আরবী বুঝা, বাক্যের গঠনতন্ত্র বুঝা, চৌদ্দশ' বছর আগে বাক্যগঠনের ধরণ কি ছিলো, তেরোশ’, বারোশ’, এগারোশ’ বছর আগে যুগে যুগে পরিবর্তন কিরূপে হয়েছে সেসব, আধুনিককালের আরবী ভাষা কেমন, সহীহ বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আবু- দাউদ,তিরমিজি, ইবনে-মাজাহ গ্রন্থের সকল হাদীস উৎস ও ব্যাখ্যাসহ জানা, এ ছাড়াও আরো বহু হাদীস আছে (মুয়াত্তা, তাহাউই, তাবরানী) সেগুলা জানা, কুরআনের প্রতিটি আয়াতের অর্থ ও তাফসীর জানা, কুরআনের প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত ও প্রতিশব্দের (synonym) অর্থ জানা। এছাড়াও বহু আলেম ও শায়খের সান্নিধ্যে থেকে শিখেছি। আপনি সহীহ বুখারী পড়েছেন মানেই আপনি মানুষকে বলেন কোনটা করা উচিত বা অনুচিত (!) প্রত্যেকেই যদি একটি করে মাজহাব খুলে বসে তবে ভয়ানক অবস্থা দাঁড়ায়, তখন মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করে না; এসব ব্যাপারে খুব সাবধান থাকুন!
কুরআন ও হাদীসের মূলনীতি বুঝে সে অনুযায়ী ইসলামী জ্ঞান চর্চা করতে হবে। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে: আর তোমার পালনকর্তা যদি ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই সব মানুষকে একই জাতিসত্তায় পরিনত করতে পারতেন আর তারা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হতো না। তোমার পালনকর্তা যাদের উপর রহমত করেছেন, তারা ব্যতীত সবাই চিরদিন মতভেদ করতেই থাকবে এবং এজন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আর তোমার আল্লাহর কথাই পূর্ণ হল যে, অবশ্যই আমি জাহান্নামকে জ্বিন ও মানুষ দ্বারা একযোগে ভর্তি করব। [সূরা হুদ 11:118-119] অর্থাৎ মানুষে মানুষে মতভেদ খুব স্বাভাবিক বিষয়। আরও বর্ণিত আছে: ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগুল মুবীন - পরিস্কারভাবে আল্লাহর বাণী পৌছে দেয়াই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব। [সূরা ইয়াসীন 36:17] তার অর্থ কি দাঁড়ায় “সবাই এই বাণী বিশ্বাস করবে এমন নয়”। কুরআনের আরো বহু স্থানে বলা হয়েছে তাদের অধিকাংশই এ বাণীকে গভীরভাবে অনুধাবন করবে না, অধিকাংশই তা জানবে না, বিশ্বাস করবে না। মূলতঃ আমাদের কিছু বিতর্কের বিষয় এমন যা কিয়ামতের দিন ছাড়া পূর্ণাঙ্গ সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আল্লাহ এও বলেনঃ তারা যে বিষয়ে মত বিরোধ করছে, আপনার পালনকর্তাই কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ফয়সালা দেবেন। [সূরা সাজদাহ 32:25]
কিছু মানুষ ভাবে সে সমস্ত মতানৈক্য দূর করে দিতে সক্ষম। এ যাবৎ পৃথিবীর ইতিহাস বলে, আপনি যদি মিশন হাতে নেন যে এমনকিছু করবেন যাতে সবাই একই জিনিসে মতৈক্যে পৌঁছবে, তাহলে আমি বলছি তা একেবারেই অসম্ভব মিশন; এটা কখনোই হবে না। সূরা তওবায় স্পষ্টভাবে বলা আছে: আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে। [সূরা তওবা 9:122] অর্থাৎ, আল্লাহ চান মুমিনদের একাংশ দ্বীনি জ্ঞানলাভে লিপ্ত থাকবে এবং অন্য অংশ দ্বীনকে রক্ষাসহ অন্যান্য কাজ করতে বের হবে। এতে করে তারা একে অপরের সহায়ক হতে পারবে। দ্বীনকে রক্ষা ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত লোকদের সময় নেই জ্ঞান অর্জনের, তারা পরবর্তীতে মিলিত হয়ে “জ্ঞান লাভকারী দল” থেকে জ্ঞান শিখে নিবে এবং তারাও যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা বাকিদের কাছে বর্ণনা করবে। আল্লাহ এই উম্মাতকে তৈরী করেছেন মতানৈক্য দিয়ে; চৌদ্দশ’ বছরে আমরা যেসব জিনিসের কোনো একক সমাধান পাই না, হয়তো আরো চৌদ্দশ’ বছরেও তা পাওয়া সম্ভব হবে না। হয়তো বিভেদ আরো বাড়বে, ঈসা (আঃ) নবী (সাঃ) এর উম্মত হিসাবে নেমে আসার পর অবস্থা কিছুটা পরিবর্তন হবে, আল্লাহই জানেন কতকাল পর। আর ঐসব লোকের কথা মোটেই বিশ্বাস করবেন না যারা বলে “ইমাম মাহ্দী’র জন্ম হয়েছে, কিছুকাল পরেই ঈসা (আঃ) নেমে আসবেন, কিয়ামাত নিকটেই”। আমি গত ২০-৩০ বছর ধরেই এসব শুনে আসছি; ইমাম মাহ্দী বেড়ে উঠতে এত বছর সময় কেন নিচ্ছেন (!) সেটাই বুঝি না - হা হা! আমার মতে তাঁর জন্মই হয়নি, কারণ হাদীসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত কা’বার কাছে লোকজন তাঁকে খুঁজে পাবে। উনি কবে আসবে এই চিন্তা করে অপেক্ষা করার আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।
আমাদের প্রসঙ্গে ফিরে আসি, কুরআন নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। ১) আকীদা বা বিশ্বাস, ২) ইবাদাত এর পদ্ধতি, ৩) সামাজিক জীবন, ৪) আর্থিক লেনদেন, ৫) চরিত্র ও নৈতিকতা, ৬) রাষ্ট্র পরিচালনা তথা রাজনীতি। কুরআন এই ছয়টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, এটা বিশ্বাস না করলে সেই ব্যক্তি ঈমানদার থাকবে না। কেউ যদি বলে “ইসলামে রাজনীতি বলতে কিছু নেই” তাহলে তাকে সাবধান করা উচিৎ কুরআনে সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ধারণা বর্ণিত হয়েছে; সরাসরি রাজনীতি শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। মুসা ও ফিরাউন কুরআনে ১৩৭ বার উল্লেখ আছে, প্রত্যেকবারই সেটা কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে। গভীরভাবে চিন্তা করলে খুঁজে পাবেন। উদাহরণ দেই, মুসা (আঃ) ফিরাউনকে বললেন বনী ইসরাইলিদের মুক্ত করে দাও। সে দাম্ভিকতার সাথে উত্তর দিলো কে তুমি? আমি তোমাকে বিশ বছর লালনপালন করেছি, তুমি আমার একজনকে হত্যা করে পালিয়ে গিয়েছিলে এখন এসেছো কথা বলতে? ফিরাউন উঁচু মাপের রাজনৈতিক নেতা ছিল, বেঁচে থাকলে এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের হার মানাতো - তার কথা ও জনবলের দ্বারা। আল্লাহও মুসা (আঃ) কে রাজনৌতিক জ্ঞান শিখিয়ে দিলেন তার মোকাবিলার জন্যে এবং তিনিও সেভাবেই তার সাথে কথা বললেন। কুরআনে এসেছে: ....এরপর আমার পালনকর্তা আমাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং আমাকে পয়গম্বর করেছেন। আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহের কথা বলছ, তা এই যে, তুমি বনী-ইসলাঈলকে গোলাম বানিয়ে রেখেছ। [সূরা আশ শুয়ারা 26:21-22] অর্থাৎ, তাদেরকে গোলাম বানিয়ে রেখে, তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ থেকে আমার প্রতিপালন করেছ। তখন ফিরাউন হতভম্ব হয়ে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলো: ফেরাউন বলল, বিশ্বজগতের পালনকর্তা আবার কি? [সূরা আশ শুয়ারা 26:23]
যখন আখলাক বা সচ্চরিত্রের কথা বলা হচ্ছে তখন বারংবার আল্লাহকে স্মরণ করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কুরআনে বলা হয়েছে: মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। এবং সকাল বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর।[সূরা আহযাব 33:41-42] যারা আরবী নিয়ে লেখাপড়া করেন তারা জানেন, এই আয়াতে একাধিক শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহকে স্মরণ করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এখন যদি কেউ বলে “যারা সবসময় আল্লাহর যিকর করে তাদের মাথায় সমস্যা আছে - তাহলে সে কুরআনের মৌলিক আদেশ থেকে বিচ্যুতির দিকে এগিয়ে গেল। কুরআনের কিছু আয়াত সুস্পষ্ট এবং কিছু শব্ধ রূপক বা দ্বৈত অর্থযুক্ত। উক্ত আয়াতটি সুস্পষ্ট, এর থেকে ভিন্ন অর্থ বের করার সুযোগ নেই। বলা নেই, দিনে রাতের কখন বেশি/কম স্মরণ করতে হবে, সবসময় আল্লাহকে স্মরণে রাখতে হবে। আমি আলোচনা করেছি সিয়াসা বা রাজনীতি, আখলাক এবং যিকর নিয়ে, আধ্যাত্মিক উন্নতি নিয়ে। এমনকি আত্মিকতা বা আত্মার পরিশুদ্ধি কুরআনে সুস্পষ্ট বর্ণনা করা আছে। আল্লাহ তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সূরা মু'মিনুন [23:4] ওয়াল্লাজীনা হুম লিজ-যাকাতি ফা-ই’লুন: যারা তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধি করে। এখানে “যাকাত” দিয়ে যাকাত আদায় বুঝানো হয়নি। এই সূরা মক্কায় অবতীর্ণ অথচ যাকাতের হুকুম এসেছে মদীনায়। এবং তাফসীর বিদগণের সর্বসম্মতিক্রমে প্রমাণিত এ আয়াতে তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আরও জানতে তাফসীর পড়ুন। আধ্যাত্মিক চর্চার দ্বারা আত্মাকে হিংসা, ঘৃণা, ক্রোধ ইত্যাদি রিপু থেকে মুক্ত রাখার কাজটি দ্বীনের অংশ।
বেচাকেনা বা লেনদেন নিয়ে কুরআনে সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে। ইবাদাত স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন: আকীমুস সলাত অর্থাৎ, নামায কায়েম কর [সূরা মুজ্জাম্মিল 73:20] সমস্যা হচ্ছে কুরআনে বর্ণনা নেই কিভাবে রুকু, সিজদা করতে হবে, কোথায় হাত বাঁধতে হবে ইত্যাদি। এখানে মতভেদ হওয়ার অবকাশ আছে। মুসলিম হিসেবে নামাজ ফরজ কিনা তা নিয়ে কোনো সন্দেহ বা মতভেদ থাকতে পারে না। কোনো মুসলিম যদি বলে আমি বিশ্বাস করি না যে নামাজ পড়া ফরজ তাহলে ইসলামী স্কলারদের সর্বসম্মতিক্রমে ঐ ব্যক্তি ঈমান হারা হয়ে যাবে। কেউ অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে যে, নামাজ ফরজ কিন্তু অলসতাজনিত কারণে নামাজ পড়ে না, সেই ব্যক্তি পাপী হলেও মুসলিম, ঈমানহারা নয়।
আকীদা, যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক দেখা যায়। কুরআনে আকীদা খুবই সহজ ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। যদি কুরআনে আকীদা সংক্রান্ত আয়াতগুলোতে যা আছে তাতে স্থির থাকা যায়, তাহলে এ দুনিয়ার কোনো স্কলার নেই যে তা ভুল বা ভিন্নমত প্রমাণ করতে পারবে বা বলবে যে এ আকীদা জান্নাত লাভে সক্ষম না - আমি এই বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করতে পারি। মতভেদ শুরু হয় যখন কুরআনের বাইরে হাদীস ও অন্যান্য উৎসবের ব্যবহার করা হয়। সরল বিশ্বাসী মনের মুসলিম যদি হন, ইন্নাল্লাহা আলা কুল্লি শাইইং কদির (আল্লাহ সর্বশক্তিমান) কিংবা কুল হুয়াল্লাহু আহাদ (বলুন আল্লাহ এক)। পড়লেন, বিশ্বাস করলেন কোনো সমস্যাই নেই। এখন যদি ভাবেন কিভাবে তিনি সর্বশক্তিমান বা আল্লাহ কেন এক, দুই নন কিভাবে, আল্লাহর বৈশিষ্টগুলো কি কি, তাঁর সত্তার ভিতরে আরো যা আছে এসমস্ত যুক্তিপ্রমাণ ও ব্যাখ্যা নিয়ে তারপর সন্তুষ্ট হবেন - তাহলেই মতভেদের দ্বার খুলে গেলো। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন: তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেনঃ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এই সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। [সূরা আলে ইমরান 3:7] আকীদা নিয়ে বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে মানুষ যেন অদৃশ্য এক বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় যার গুলি হচ্ছে “কাফির" শব্দটি; সে তার আশেপাশে লোকদের কেবল কাফির আখ্যা দিতে ব্যস্ত থাকে। সেই একমাত্র পাক্কা ঈমানদার(!) এবং বাকি সবারই আকীদায় কমবেশি সমস্যা তাই তারা সবাই কাফির - নাউজুবিল্লাহ। বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে: রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি কাউকে কাফির বলল এবং আদতে সেই ব্যক্তি কাফির নন, তাহলে সেই কাফির আখ্যা প্রথম ব্যক্তির উপরে বর্তাবে। আল্লাহ মাফ করুন। আমাদের এ ব্যাপারে খুব সাবধান হতে হবে কারণ আমার আপনার কথা না, রাসূল (সাঃ) থেকে সতর্কবাণী এসেছে। তবে কথা হচ্ছে, কেউ আকীদার একদম মৌলিক বিষয়ে অবিশ্বাস করলে তার ঈমান থাকবে না, এ বিষয়ে একটু পরে বলছি।
আকীদার বিভিন্ন অংশ আছে: ১) যেগুলা একেবারে সুস্পষ্ট, কোনো সন্দেহ নেই, ২) কিছুটা দ্বৈত অর্থপূর্ণ এবং ৩) স্পষ্ট নয় তাই বিতর্কের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। তাই আপনি আকীদার কোন অংশ নিয়ে আলোচনা করছেন, সেটা মাথায় রাখা জরুরি। কেউ যদি বলে মুসলিমের যাকাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তাহলে সে কুফরী করলো। রাসূল (সাঃ) এর ইন্তিকালের পর আবুবকর (রাঃ) এর সময়ে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। মুসাইলামা ও তার বাহিনী যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ওমর (রাঃ) সহ প্রখ্যাত সাহাবীগণও দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন “ওরা তো আমাদের মতোই ঈমানদার, আযান দেয়, নামাজ পড়ে, কুরআন পড়ে, সাওম পালন করে -- তাই যাকাত অস্বীকার করার কারণে কি তাদের বিরোধিতা করা ঠিক হবে”? আল্লাহ তায়ালা আবুবকর (রাঃ) গভীর বোধশক্তি দিয়েছিলেন। তিনি সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, “ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলোর কোনো একটাকে অস্বীকার করলেই তার ঈমান থাকবে না। যাকাত তো দিবেই, ওরা যদি উট যাকাত দেয় কিন্তু রশি দিতে অস্বীকার করে তাহলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো”। আকীদার মৌলিক বিষয়গুলো জানা সহজ:
ঈমানে মুফাসসাল: আমান্তু বিল্লাহি, ওয়া মালা-ইকাতিহি, ওয়া কুতুবিহী, ওয়া রুসূলিহি, ওয়াল ইয়াওমিল আখিরী, ওয়া ক্বদরি খইরিহী ওয়া শাররিহী মিনাল্লাহি তায়ালা, ওয়া বা'সি বা'দল মাওত।
অর্থঃ আমি বিশ্বাস করি ১) আল্লাহতে, ২) ফেরেস্তায়, ৩) সকল আসমানী কিতাবের অস্তিত্বে ও কুরআনের সমুদয় আয়াতে, ৪) নবী-রাসূলে, ৫) শেষ দিবসে, ৬) ক্বদর বা ভাগ্যের ভালোমন্দ আল্লাহ নির্ধারণ করেন ও ৭) মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে। আকীদার মৌলিক বিষয়গুলোতে সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে কোনো কিছু বললে বা বিশ্বাস করলে নিঃসন্দেহে তার ঈমান থাকবে না।
কেউ যদি আল্লাহর সম্পর্কে অসম্মানজনক কিছু বলে, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করে তাহলে সে ঈমান হারা হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ কিছু উদ্ধৃতি দিতে হচ্ছে, নাউযুবিল্লাহ। এগুলো যে বলে বা বিশ্বাস করে তার ঈমান থাকবে না:
- কিছু কিছু কাজ আল্লাহর ক্ষমতারও বাইরে
- আল্লাহ ছাড়াও আরো কেউ প্রভু আছে
- ফেরেশতা বলে কিছু নেই
- কোনো একটি আসমানী কিতাবকে অস্বীকার করে [যেমনঃ অরিজিনাল তাওরাতও আল্লাহ থেকে আসেনি]
- কুরআনের একটি আয়াত বা আয়াতের অংশবিশেষ অস্বীকার বা অবিশ্বাস করলে
- কেউ কেউ এমনও বলে, কুরআন ত্রিশ যুজ বা পারা; এ ছাড়াও আরো কিছু ছিল, হারিয়ে গেছে
- নবীরাসূলের মধ্যে কাউকে অস্বীকার করে বা রাসূল (সাঃ) এর পরেও কোনো নবী এসেছে বলে বিশ্বাস করে
- গুলাম আহমাদ কাদিয়ানীসহ যুগে যুগে বহুমানুষ নবুওতের মিথ্যা দাবী করেছিল
- পুনরুত্থান, আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো এবং হিসাব এইগুলোর কোনটি অস্বীকার করে
- ভাগ্যের ভালোমন্দ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়, এটা বিশ্বাস না করলে
এতক্ষণ যা বললাম তা হচ্ছে একদম মৌলিক বিষয়। কিন্তু এর বাইরের কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো অতটা স্পষ্ট নয়। রাসূল (সাঃ) ইন্তিকালের পর উত্তরাধিকারসূত্রে সাহাবীগণের উপর দায়িত্ব ছিল ইসলাম প্রচার ও সংরক্ষণের। তাঁদের সময় নতুন প্রজন্মের লোকজন দ্বীনের নতুন ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো; সবকিছুর অতিরিক্ত যৌক্তিক আলোচনা দাঁড় করাতে লাগলো। তারা বলল:
কবরে আজাব বলে কিছু নেই
রাসূল (সাঃ) মিরাজে যাননি
বিচার দিবসে আল্লাহকে দেখতে পাওয়া অসম্ভব - আল্লাহ কোনো নির্দিষ্ট দিকে নন, কিভাবে দেখবো?
মিজান বা হিসাবের পাল্লাকে অস্বীকার করলো - কাজের ওজন মাপা কিভাবে সম্ভব?
এরকম আরো বেশকিছু বিষয় তারা অস্বীকার করলো
এক্ষেত্রে সাহাবাগণ কি সিদ্ধান্ত নিলেন, এটা আমাদের জন্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষণীয়। এবার কিন্তু সাহাবীগণ যাকাত অস্বীকারকারীদের মতো তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করলেন না, তাদেরকে কাফিরও বললেন না; কারণ এগুলো মৌলিক আকীদার বিষয় না। তাঁরা বললেন “যে কবরের আজাবে বিশ্বাস করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয় - অর্থাৎ সিরাতল মুস্তাকীমে অবস্থান নেই"। “সিরাতল মুস্তাকীম” বা সরলপথ কি? সাহাবীগণ রাসূল (সাঃ) কে অনুসরণ করেছেন, সাহাবীদের ঈমান ও আকীদাকে পরবর্তী সময়ের লোকদের জন্যে মাপকাঠি বা আদর্শ হিসাবে বলা হয়েছে। আমরা মাপকাঠি অনুযায়ী বিশ্বাস করে নিলে সেইটাই সরলপথ এবং এতেই রয়েছে হিদায়াত। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে: ফা-ইন আমানু বিমিসলি মা আমানতুম বিহী ফক্বদিহতাদাও - অতএব তারা যদি ঈমান আনে, তোমাদের ঈমান আনার মত, তবে তারা সুপথ পাবে। [সূরা বাকারা 2:137] এসব ঘটনার পর মুসলিম স্কলাররা আকীদার বই লিখে তাতে সবকিছু সুস্পষ্ট করে লিপিবদ্ধ করা শুরু করলেন। ইমাম জাফর আত-তাহাউই এক বিখ্যাত বই লিখলেন আকীদা আত-তাহাউইয়্যা। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে শ'খানেক বিবৃতি দিলেন যেমনঃ
* আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ এক ও তাঁর কোনো শরীক নেই
* তাঁর মতো কোনোকিছুই নেই
* তাঁকে কোনোকিছু অভিভূত করতে পারে না
* আমরা বিশ্বাস করি কবরের আজাব আছে ইত্যাদি।
এই বইটি লিখা হয়েছিল ৩০০ হিজরীর দিকে; সবাই আকীদার উপর সবচেয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য বই হিসেবে স্বীকারও করে। তার বই অল্প ও সহজ কথায় লিখা ছোট বই। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল: ইমাম জাফরের পরবর্তী লোকেরা উনার ছোট বইয়ের একেকটা স্টেটমেন্টের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, গবেষণা শুরু করে দিল, যে যার মতো গবেষণা করে বড় ও জটিল বই লিখলো। তারপর শুরু হলো আমার বই তোমার বই থেকে ভিন্ন কেন? তোমার আকীদায় সমস্যা আছে, তুমি কাফির, ও কাফির, সে কাফির - আমিই একমাত্র মুসলিম(!) ইমাম জাফর বলেছেন তাঁর পূর্বসূরি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর অনুসারীদের অনুসরণে তিনি এই বই লিখেছেন, অথচ আজব ব্যাপার এই চরমপন্থী দলগুলো ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) কেই পথভ্রষ্ট আখ্যা দিচ্ছে!
আমি লোকজনকে বলি, যা কিছু সহজভাবে ভাবুন, এত জটিলতার এবং এত বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। ইমাম জাফরের এই সরল পুস্তিকা বুঝার জন্যে ছয় ইঞ্চি মোটা বই পড়ার কোনো মানে হয় না। একজন আমাকে বলল “আমি চার বছর ধরে আকীদা পড়েছি। আকীদা স্টাডি আপনি কিভাবে করেন”? আমি বললাম “আকীদাকে সরল ও সাধারণভাবে বুঝার জন্যে চার বছর সময় নষ্টের কোনো প্রয়োজন নেই”। দর্শক/শ্রোতারা আমাকে ভুল বুঝবেন না, চার বছর পড়াটা সমস্যা না - চার বছর “তাজবিদ”, চার বছর “ফিকহ", চার বছর “আকীদা” অনেকেই পড়েন। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য যদি এমন হয় যে, চার বছর আকীদা পড়া শেষে সেই “তাকফিরি বন্দুক" নিয়ে বের হবেন কাকে কাকে কাফির আখ্যা দেওয়া যায়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই আপনি অসুস্থ। অনেকেই (কিন্তু সবাই না) আকীদা আত-তাহাউইয়্যা বইয়ের>ব্যাখ্যার>ব্যাখ্যার>উপব্যাখ্যার>উপব্যাখ্যা পড়তে পড়তে নিজেকে ধর্মান্ধ বানিয়ে ফেলে। সত্যিই, আমি কৌতুক করছি না! এই অভ্যাস একসময় তাদের রোগে পরিণত হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিতে চাই, আপনার দ্বীনি শিক্ষা বিশেষত আকীদার ক্ষেত্রে একাধিক শায়খের কাছে শিখুন। তা নাহলে এক শায়খ কাউকে যদি মনগড়া কোনকিছু ৪/৫ বছর ধরে শিখায় এবং বলে যে, “যা বলছি তা মানলেই মুক্তি নচেৎ জাহান্নামের একদম নিচে হবে স্থান" - তখন তার আর কোনো শায়খকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহসও হারিয়ে ফেলে। সে অন্ধভাবে তার উপদলের সমস্ত চিন্তাধারা বিশ্বাস করা শুরু করে। সামনে কোনো সত্য আসলেও তাকে গ্রাহ্য করে না। নিজের উপদলটিকে সেই ১টি কামিয়াব দল ভাবে এবং বাকি সবাই পথভ্রষ্ট ৭২ কাতারের সদস্য(!)
এখন আসি ভিন্ন এক প্রসঙ্গে, কিছুক্ষণ আগে বলেছিলাম কুরআন আকীদা, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছু নিয়ে আলোচনা করেছে। রাসূল (সাঃ) ছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব; একাধারে তিনি ছিলেন - শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ব্যক্তি, শ্রেষ্ঠ সেনানায়ক, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, শ্রেষ্ঠ স্বামী যিনি সকল স্ত্রীকে সমানভাবে সুখী রেখেছেন, শ্রেষ্ঠ বন্ধু, শ্রেষ্ঠ ইমাম, শ্রেষ্ঠ নেতা যিনি পাবলিক রিলেশন বজায় রেখেছেন ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের সাথে, মুনাফিকদের থেকে সতর্ক হয়ে চলেছেন, সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ ও সফল ইসলাম প্রচারক যিনি বহু বিপত্তির মধ্যেও ইসলামের প্রচার অব্যাহত রেখেছেন। মোদ্দাকথা, একটি মানুষের মধ্যে এতগুলো শ্রেষ্ঠ গুন পৃথিবীতে আর কাউকে পাওয়া যাবে না। সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁর (সাঃ) মত সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ হতে পারেননি। তাঁরা মৌলিক বিষয়ে অনড় ছিলেন, যেমন নামাজ, কুরআন, যাকাত, হজ্জ্ব, কিছু হাদীস জানা, আখলাক। কিন্তু একেকজন একেক বিষয়ের উপর পান্ডিত্য অর্জন করেছেন। তাই তাঁরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে সামগ্রিকভাবে মুসলিম উম্মাহর খিদমাত করে গেছেন। যেমনঃ আবু হুরাইরা (রাঃ) ছিলেন হাদীসের সনদ বা উৎস বর্ণনাকারী, তিনি ৫০০০ এরও বেশি হাদীস বর্ণনা করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) তিনি বিখ্যাত ছিলেন বীর যোদ্ধা হিসেবে। আলী (রাঃ) বিচারক ছিলেন, তাঁর আরো গুণও ছিল। ইবনে মাসউদ (রাঃ) ফকীহ বা আইনজ্ঞ ছিলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) শ্রেষ্ঠ মুফাসসির বা কুরআন বিশ্লেষক ছিলেন। একেকজন একেক ভূমিকায় কাজ করেছেন। তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, দ্বীন একটি গাছের মতো এবং সবগুলো ক্ষেত্র তার শাখা-প্রশাখা। আল্লাহ কুরআনে বলেন: তুমি কি লক্ষ্য কর না, আল্লাহ তা’আলা কেমন উপমা বর্ণনা করেছেনঃ পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। [সূরা ইবরাহীম 14:24] রাসূল (সাঃ) ছিলেন বৃক্ষ এবং সাহাবীরা তাঁর শাখা, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীনরা প্রশাখা। সাহাবীদের কাউকে দেখা যায়নি একটি হাদীসের ব্যাখ্যা নিয়ে একজন আরেকজনকে পথভ্রষ্ট ডাকতে কিংবা ইবনে আব্বাস (রাঃ) কখনো ইবনে মাসউদ (রাঃ) কে ফিকহ ছেড়ে এসে তাফসীরে সাহায্য করতে ডাকেননি। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর কাছে বাকি সাহাবীরা কৃতজ্ঞ থাকতেন, তিনি ঐদিক সামলাচ্ছেন বলেই ইনারা তাফসীর বা ফিকহ চর্চার সময় পাচ্ছেন। আলী (রাঃ) বিচারক হিসেবে আবু হুরাইরা (রাঃ) এর কাছে কৃতজ্ঞ থাকতেন তাঁর বিচারকার্যের পর হাদীসের উৎস সংরক্ষণের সময় থাকতো না। এভাবে তাঁরা প্রত্যেকে অন্যজনের অবদানকে সন্মান করতেন। এটাই মুসলিম উম্মাহর একতা হওয়া উচিৎ।
তিরমিজি শরীফের প্রসিদ্ধ হাদীস: রাসূল (সাঃ) এর বলেন ইয়াহুদীরা ৭১টি উপদলে বিভক্ত হয়েছিল, খ্রিস্টানরা ৭২টি এবং এই উম্মত ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ছাড়া বাকি সব জাহান্নামে যাবে। সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করেছেন কোন দল? তিনি উত্তর দেন, আমি ও আমার সাহাবী বা সঙ্গীসাথীরা যে দলে আছে। এখানে বুঝার আছে যে, ১টি দল সফলকাম হবে সেটা কি আক্ষরিক অর্থেই ১টি দল নাকি অন্যকিছু! কোনো শায়খ ১টি মাত্র দল সফলকাম হবে বললে, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি তিনি ভুল বলছেন। কেন বলছি? আপনি যদি রাসূল (সাঃ) এর সময় থেকে এ পর্যন্ত গণনা করেন ৭৩টির অনেকবেশি দল পাবেন। প্রকৃতপক্ষে, ইমাম শাহ রোস্তানি লিখিত আকীদার বই আল-মিলাল ওয়ান-নিহালে তিনশ' উপদলের উল্লেখ আছে; সেটাও এখন থেকে এগারোশ’ বছর আগে লেখা। তাহলে রাসূল (সাঃ) বললেন ৭৩টি দল কিন্তু আমরা পাচ্ছি হাজারেরও বেশি; কিভাবে?! উত্তর সহজ, ৭২টি পথভ্রষ্ট দল বলতে তিনি বুঝিয়েছেন ৭২টি প্রধান দল, তাদের আরো বহু শাখা প্রশাখা থাকা সম্ভব। একেকটি প্রধান/বড় দল পথভ্রষ্ট হয়েছে একেকটি বিষয়ে মতভেদ করার জন্যে। রাসূল (সাঃ) কে শেষ নবী হিসেবে স্বীকার করে না, এমন একটি বৃহৎ দলের কথায় আসি, স্বয়ং রাসূল (সাঃ) বলেছেন ত্রিশজন মিথ্যাবাদী নবুওতের দাবী করবে। তাহলে “শেষ নবীকে অস্বীকারকারী” ত্রিশজন যার যার অনুসারী নিয়ে ত্রিশটি ভিন্ন শাখা-প্রশাখা গড়ে তুলবে, যারা আদতে একটি বড়দলের আওতায় পড়ে। এভাবে পথভ্রষ্টতা কত ধরণের হতে পারে তা গণনা করলে ৭২টি প্রধান দল পাবো। অনুরুপভাবেই রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীদের অনুসরণে সিরাতল মুস্তাকীমের পথেও একটিমাত্র দল পাওয়া যাবে না; একটি বড়দলের ছাতার নিচে বহুদল থাকতে পারে যারা প্রত্যেকেই মৌলিক বিশ্বাসে একতাবদ্ধ কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ কিছুবিষয়ে তাদের ভিন্নমত আছে। সুফী,শাফীয়ি, মাতুরিদী, হানাফী, ওয়াহাবী, মালিকী, আসারি, আহলে হাদীস, হাম্বলী, দেওবন্দী, জামাতী, বারেলভি, মাদখালী, ইখওয়ানী, তাবলীগী, সালাফি, আশ’আরি -- আমার বিশ্বাস ইনশাল্লাহ আমরা সবাই সিরাতুল মুস্তাকিমের মূলধারারই অংশ। এইমাত্র যা বললাম তা শুনেই হয়তো অনেকে মসজিদ ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন, কিন্তু এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও আমি দিব, একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে।
এ দলগুলোর কোনটি আইনশাস্ত্রের ব্যাপারে, কারো উম্মাহকে পুনর্জাগরণ করা নিয়ে, কারো আকীদা নিয়ে, মতভেদ আছে, মূলতঃ এই তিন বিষয়েই মতভেদ। চতুর্থ জ্ঞানের ধারা নিয়েও মতভেদ থাকতে পারে। যেমনঃ
১। আইনশাস্ত্র নিয়ে মতভেদ আছে - শাফীয়ি, হানাফী, মালিকী, আহলে হাদীস, ওয়াহাবী, সালাফি
২। আকীদা নিয়ে মতভেদ আছে - আশ’আরি, মাতুরিদী, আহলে হাদীস, সালাফি
৩। উম্মাহকে পুনর্জাগরণ কিভাবে করতে হবে তা নিয়ে মতভেদ আছে - ইখওয়ানী, তাবলীগী, বারেলভি, জামাতী
আইনশাস্ত্র নিয়ে মতভেদ: রাসূল (সাঃ) এর সময়ে আইনশাস্ত্র নিয়ে কোনো মতভেদ হলে সাহাবীরা সরাসরি তাঁর কাছে গিয়ে সমাধান করে নিতেন। তারপরেও রাসূল (সাঃ) কিছুক্ষেত্রে দেখিয়েছেন যে তাঁর বক্তব্যেও আমাদের ভিন্নমত হতে পারে এবং এতে দোষের কিছু নেই। হয়তো ভাবছেন আমি এখন একটা দূর্বল হাদীস শোনাবো, না না, বুখারী শরীফের সহীহ হাদীস: রাসুল (সাঃ) আহযাবের যুদ্ধ শেষে মদীনা ফিরছেন, এ সময় জিব্রাইল (আঃ) এসে বললেন, নবী আপনি মদীনা যাবেন না, বর্ম খুলবেন না, সরাসরি কুরাইযাতে চলে যান। সেখানের ইয়াহুদীরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, ওখানে গিয়ে যুদ্ধ শুরু করুন। রাসূল (সাঃ) সাহাবীদের কে বললেন, লা তুসল্লু আল-আসর হাত্তা তাসিলু বাণী-কুরাইযা। অর্থাৎ, তোমরা কুরাইযাতে না পৌঁছে আসর নামাজ পড়বে না। রাসূল (সাঃ) আগে চলে গেছেন, সাহাবীদের রওয়ানা দিতে কিছু দেরি হয়েছে। তাঁরা কুরাইযা পৌঁছানোর আগেই দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন - আসরের সময় শেষ হয়ে আসছে। কেউ কেউ বলল নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে নামাজ পড়ে নিই, বাকিরা বলল রাসূল (সাঃ) কুরাইযা না পৌঁছে আসর পড়তে নিষেধ করেছেন, যখন পৌঁছবো তখন পড়বো। প্রথম দল বলল, নামাজ নির্দিষ্ট সময়ে পড়তে হবে, হয়তো রাসূল (সাঃ) ভেবেছেন আমরা আসরের সময়ের মধ্যে কুরাইযা পৌঁছে একত্রে নামাজ পড়ব। এ অবস্থায় কেউ কেউ নামাজ পড়ল, বাকিরা পড়ল না। কুরাইযা পৌঁছে সবাই রাসূল (সাঃ) কে এ ব্যাপারে বললেন, তিনি কাউকেই কিছু বললেন না, চুপ ছিলেন। এখানে শিক্ষণীয় বিষয় দুটো: ১) তিনি চুপ ছিলেন অর্থাৎ কোনো দলই ভুল করেনি। রাসূল (সাঃ) কখনোই অবৈধ বা ভুল কিছুতে মৌন থাকতে পারেন না এবং এটি তাঁর নবুয়্যতের দায়িত্বের পরিপন্থী, তাই তাঁর মৌনসম্মতিও সুন্নাহ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ২) তাঁর একটি বক্তব্যের দুটি অর্থ উম্মতরা ভাবতেই পারে - কেউ আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করবে, কেউ গভীরে চিন্তা করবে। চিন্তাভাবনার বিভাজন কিন্তু তখন থেকেই শুরু হয়ে গেল এবং এটা দোষের কিছু না। রাসূল (সাঃ) বেঁচে থাকা পর্যন্ত বিষয়গুলো সহজ ছিল। যখন ইবনে মাসউদ (রাঃ) ইরাকে গেলেন, আলী (রাঃ) ইয়েমেনে, আমর বিন আস (রাঃ) মিশরে, আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) মদিনায় থাকলেন, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) মক্কায় গেলেন। তখন উনারা নিজ নিজ এলাকার সবচেয়ে বড় ইসলামী রেফারেন্স হয়ে গেলেন। ইরাকের জনগণ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কে চিনে, বাকি সাহাবীদের হয়ত তারা দেখেওনি। ইসলামী শরীয়তের উৎস বলতে তিনিই ছিলেন। তিনি তার জনগণের কাছে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সাঃ) কে কি করতে দেখেছেন, কি শুনেছেন ইত্যাদি। একইভাবে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্নভাবে তার পরিপ্রেক্ষিতে ও অভিজ্ঞতা থেকে নিজের জনগণের কাছে দ্বীন প্রচার করেছেন।
সহীহ হাদীস থেকে উদাহরণ দিব, আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূল (সাঃ) কে দেখেছি নামাজে হাত উঠিয়ে হাত বাঁধতে এবং রুকুর আগে আবার হাত তুলতে। ঐ একই ব্যক্তি আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) অন্য হাদীসে বলেছেন, আমি রাসূল (সাঃ) কে দেখেছি নামাজে একবার হাত উঠিয়ে হাত বাঁধতে এবং পরে আর হাত তুলেননি। যারা হাদীস নিয়ে স্টাডি করেন না, তারা ভাববেন এ কি করে সম্ভব! হ্যাঁ সম্ভব, কারণ তখন ছিল শরীয়াত গঠনের সময়। বিভিন্ন হুকুমে পরিবর্তন আসছিলো। কে জানে, নবী সর্বশেষ কোন পদ্ধতিতে নামাজ পড়েছেন? আর সর্বশেষটাই শরীয়ত হিসেবে নিতে হবে, সবসময় তা এমনও না। এমনও তো হতে পারে, ঐ সাহাবী মদিনা ছেড়ে যাওয়ার আগে রাসূল (সাঃ) কে যা করতে দেখেছেন তারপরে কোনো পরিবর্তন এসেছে এবং তিনি তা জানেন না। এখানেও সাহাবীর দোষ নেই। কারণ, শরীয়তের বিধান পূর্ণতা পাওয়ার আগে সাহাবীরা রাসূল (সাঃ) কে ছেড়ে যাওয়া যদি দোষের হত, তবে তিনি (সাঃ) শরীয়তের বিধান পূর্ণতা পাওয়ার আগে কাউকে অন্য কোথাও যেতে দিতেন না। সহীহ হাদীসে আছে, রাসূল (সাঃ) এর জীবনের শেষ বছর (তখনও কুরআন নাজিল সম্পূর্ণ হয়নি এবং আরো হাদীস এরপরে বর্ণনা হয়েছে) মুআজ (রাঃ) কে ইয়েমেনে যেতে দিয়েছেন, তার উটের রশি ধরা অবস্থায় রাসূল (সাঃ) বলেছেন “মুআজ তুমি মদিনা ফিরে আসবে তখন হয়ত আমি জীবিত থাকবো না, আমার মসজিদ ও কবর থাকবে। মুআজ (রাঃ) কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঠিক তাই ঘটেছে, মুআজ (রাঃ) যখন ফিরে এসেছেন ততদিনে রাসূল (সাঃ) ইন্তিকাল করেছেন। তাহলে রাসূল (সাঃ) ওহী মারফত জানতে পেরেও মুআজ (রাঃ) কে অন্যত্র প্রস্থানের অনুমতি দিয়েছেন। সহীহ মুসলিমের একটি হাদীসে এসেছে, এক সাহাবী যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি যে পর্যন্ত দেখেছেন, সে অনুযায়ী নামাজ পড়েন। তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে পাশের ব্যক্তিকে সালাম দিলেন, কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। বাকিরা তাঁর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, কারণ ইতোমধ্যে নামাজের ভিতর কথা বলা রোহিত হয়ে গেছে। তিনি নামাজ শেষ করে অবাক হয়ে ভাবছেন, ওরা আমার দিকে এভাবে তাকালো কেন? তখন রাসূল (সাঃ) বুঝিয়ে বললেন, এখন থেকে নামাজে কথা বলা যাবে না।
এখন আমাকে বলুন, নিচের কোনো একজন সাহাবীর কথায় কি আপনি সন্দেহ পোষণ করেন?
১। এক সাহাবী রাসূল (সাঃ) কে দেখেছেন নামাজে একবার হাত তুলতে, আরেকজন দেখেছেন বারবার হাত তুলতে
২। একজন সাহাবী রাসূল (সাঃ) কে উচ্চস্বরে আমীন বলতে শুনেছেন, আরেকজন নীরবে আমীন বলতে শুনেছেন
৩। একজন সাহাবী বলেছেন ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া লাগবে, আরেকজন বলেছেন ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া যাবে না
কেউ বলেছেন নাভির নিচে হাত বাঁধতে, কেউ বলেছেন বুকে, কেউ বলেছেন হাত না বাঁধলেও চলবে
সাহাবীগণ সত্যবাদী ছিলেন, তাঁরা যা দেখেছেন, শুনেছেন তাই বর্ণনা করেছেন। আপনি তাঁদের কাউকে সন্দেহ করলেন মানে দ্বীনের মৌলিক উৎসের উপর কুঠারাঘাত করলেন, নাউজুবিল্লাহ। সাহাবীগণের কথায় সন্দেহ করলে সে কাফির হয় না কিন্তু সে নিশ্চিতভাবে ফাসিক বা গুনাহগার।
এখন আপনি কি করবেন, কোনটা মেনে চলবেন? হাত যেখানেই বাঁধেন, আমিন জোরে বা আস্তে বলেন, যদি তার সমর্থনে হাদীস থাকে তাহলে আপনার নামাজ শুদ্ধ - এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি আমিন জোরে বলবেন, তাই অন্য যে কেউ আস্তে আমিন বললে তাকে ভুল বলা বা তার নামাজ বাতিল বলার কোনো অধিকার আপনার নেই। কোন সাহসে আপনি তা করবেন যখন ঐ সংক্রান্ত হাদীসটাও আছে! অর্থাৎ উভয়পক্ষই সঠিক যতক্ষণ পর্যন্ত না সে মনগড়া কিছু করছে।
এইগুলা বিষয় নিয়ে তর্ক করা একেবারেই বোকামী। শয়তান আমাদের মনের ভিতর এসব বিবাদ ঢুকিয়ে দেয়। সাহাবী তাবেয়ী কারো যুগেই এইগুলা কোনো বিতর্কের বিষয়ই ছিল না; যদি থাকতো ইতিহাসে আমরা দেখতে পেতাম। শয়তানের কাজ আমাদেরকে এইসব কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিবাদে লিপ্ত রাখা যাতে মসজিদের বাইরে নব্বই শতাংশ মানুষ নামাজেই আসে না সেসব নিয়ে আমরা চিন্তা না করি। বরং উল্টা যে নিয়মিত নামাজ পড়তে আসছে তার সাথে প্রতিবেলাতে বিবাদে লিপ্ত হচ্ছি।
সাহাবীদের মধ্যেও বিবাদ হয়েছে, তবে এসব বিষয়ে নয়; কুরআন নিয়ে। সহীহ মুসলিমে এসেছে, একজন সাহাবী একভাবে কুরআন পড়ছেন অন্যজন আরেকভাবে। তখন প্রায় বিবাদ লেগে যায় এমন অবস্থায় তারা জানতে পারলেন জিব্রাইল (আঃ) রাসূল (সাঃ) এর কাছে সাতটি ভিন্ন ধরণে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। সবগুলোই গ্রহণযোগ্য। সাহাবীরা উসমান (রাঃ) এর কাছে ছুটে আসলেন, আপনি কিছু করুন। তখন তিনি সংকলন করে এমনভাবে লিখলেন যাতে একই টেক্সটই সাত রকমে পড়া যায় - নুক্তা দেননি, এক শব্দকেই “ইয়া'লামুন” বা “তা'লামুন” উভয়ই পড়া যায় এমন। কুরআন সংকলন কিন্তু রাসূলের (সাঃ) জীবদ্দশায় ঘটেনি। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইন হচ্ছে, কুরআন ও হাদীসে যা পাওয়া যাবে না তা বাতিল এবং বিদ’আহ -- কিন্তু কিছুক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে সতর্ক থাকা উচিৎ। আমি এমন কিছু জিনিসের প্রমাণ দিতে পারবো যার হুকুম কুরআন ও সুন্নাহতে নেই, তারপরেও ইসলামে সমর্থিত। সবচেয়ে বড় প্রমাণ, লিখিত বই আকারে এই কুরআন। রাসূল (সাঃ) এর সময় কুরআন একত্রিত একটি বই আকারে ছিল না। আবুবকর (রাঃ) তা একত্রিত করে একটি পুস্তকে রূপ দিয়েছেন। আবুবকর (রাঃ) এমন সাহাবী ছিলেন যিনি রাসূল (সাঃ) এর সান্নিধ্যে ছিলেন না, এমন ঘটনা খুবই বিরল। সহীহ বুখারীর হাদীস: রাসূল (সাঃ) এর ইন্তিকালের পর ইয়ামামার যুদ্ধে সত্তুরজন সাহাবী ইন্তিকাল করেছিলেন যারা সম্পূর্ণ কুরআন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাফসীরসহ মুখস্ত, বহু হাদীসের সনদ বা উৎস জানা এবং দ্বীনের গভীর বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। এমতাবস্থায় যখন ওমর (রাঃ) এসে আবুবকর (রাঃ) কে বললেন, কুরআনের সমস্ত অংশকে একত্রিত করে একটি পুস্তক তৈরী আবশ্যক - তা নাহলে ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের মতো আমরাও আমাদের আসমানী কিতাব কুরআনকে হারাবো। আবুবকর (রাঃ) বললেন আমি কিভাবে সেই কাজ করি যা কুরআনেও উল্লেখ নেই বা রাসূল (সাঃ) বলেও যাননি করতে! আবুবকর (রাঃ) নিজেও যদি না শুনেন অন্য কেউ শুনে থাকতে পারেন, তখন তিনি পরামর্শ সভা ডাকলেন - এ ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) এর কোনো নির্দেশনা কারো জানা আছে কি না; সবার কাছেই নেতিবাচক উত্তর পেলেন। ওমর (রাঃ) বারবার অনুরোধ করেই যাচ্ছিলেন। তখন আবুবকর (রাঃ) বললেন ওমর (রাঃ) যেভাবে বুঝেছিলেন আমার মনের দরজা যখন খুলে গেলো তখন আমিও অনুধাবন করতে পারলাম। অবশেষে সম্পূর্ণ কুরআনকে একটি পুস্তকে রূপ দেওয়া হলো। তখন পর্যন্ত নুক্তা, ফাতহা, কাসরা, দাম্মা (যের, যবর, পেশ) মাদ, কিছুই ছিল না। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো এবং অনারব (non-Arabs) দের জন্যে এভাবে কুরআন পাঠ করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তখন সহজ ও বোধগম্য করার জন্যে এগুলো সংযোজন করা হয়।
আমি কিছুক্ষণ আগে বলেছিলাম শাসনতন্ত্রের অংশহিসেবে সাহাবীরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ) ইরাকে গিয়েছিলেন, তিনিই ছিলেন সেখানকার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইসলামী উৎস। কুরআন, তাফসীর, হাদীসের শুদ্ধতা যাচাই সবদিক দিয়ে ইরাকবাসীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। লোকজন যেকোনো প্রয়োজনে প্রধান স্কলার হিসেবে তাঁর কাছে যেতেন। ঐ অত্র এলাকায় আরো স্কলার থাকলেও মূলত তিনিই ছিলেন প্রধান এবং সেসব স্কলাররাও জটিল সমস্যা তাঁর কাছে এসে সমাধান করে নিতেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আলকামা ছিলেন অনন্য। তাঁর ইন্তিকালের পর আলকামা ঐ অঞ্চলের প্রধান স্কলার হন। একইভাবে আলকামার ছাত্রদের মধ্যে ইবরাহিম আন নাসাঈ সেরা ছিলেন। আলকামার পরে সেই অবস্থানে ইবরাহিম আন নাসাঈ উপবিষ্ট হন। ইবরাহিম আন নাসাঈ এর পর আসেন তাঁর ছাত্র আবু হানিফা (রহঃ)। ওমর (রাঃ)> আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর> নাফী’> ইমাম মালিক (রহঃ), তাঁর ছাত্র ইমাম শাফী’ (রহঃ) এবং তাঁর ছাত্র ইমাম হাম্বল (রহঃ)। অনেক অনেক মাজহাব আছে। মাজহাব শব্দ শুনেই আঁতকে উঠবেন না। শত শত মাজহাব ছিল - আওযায়ী, সুফিয়ানা সৌরি, ওয়াকি’। একটি বড় ব্র্যান্ড সুপারশপের কাছে যেমন ছোট দোকানগুলো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, তেমনিভাবেই তাঁদের জ্ঞান সমুদ্রের কাছে বাকি মাজহাবগুলো নগন্য ছিল, তাদের ধারা কেউ বজায় রাখেনি, কোনো বইপুস্তকে লিখিত হয়নি এবং ধীরে ধীরে ইতিহাসে ঐ মাজহাবগুলো হারিয়ে গেছে। জাফর সাদিকও প্রখ্যাত ইমাম ছিলেন, আমরা সুন্নীরাও তাঁকে ফিকহের বৈধ উৎস হিসেবে মানি, কিন্তু তাঁর পরবর্তীতে কিছু লোক সেই ধারা কে বিবর্তিত করে এমন অবস্থায় দাঁড় করায় যে, “শিয়াদের একাংশ” আকীদার মূল অংশ থেকে বিচ্যুত তথা নন-মুসলিম; ভুল বুঝবেন না শিয়াদের সবাই অমুসলিম নয়, একাংশ।
এক ভাই আমার কাছে তালাকের মাসআলা জানতে আসলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম হানাফী, সাফী, মালিকী নাকি হাম্বলী কোন মাজহাব অনুসারে মাসআলা জানতে চান? তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, মাজহাব দিয়ে কি হবে, কুরআন-সুন্নাহ থেকে বলুন। আমি তাকে বুঝালাম, আপনি কোনো সমস্যায় পড়লে কার বই পড়েন? তিনি বললেন শায়খ আলবানী, শায়খ বীনবাজ, শায়খ ফুলান, শায়খ ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল ক্বাইয়িম। তাহলে আপনিও তো একই কাজ করছেন, এই শায়খদের মাজহাব অনুসরণ করছেন। মাজহাব কী - দিকনির্দেশনা ছাড়া আর কিছুই না। কেউ হানাফী মাজহাব মানে এর অর্থ এই নয় যে, সে যেভাবেই হোক আবু হানীফাকে মনে-প্রাণে মেনে চলে। বরং সে আবু হানীফার মতামতটাকে মেনে চলে যা তিনি তাঁর শায়খ ইবরাহিম আন নাসাঈ থেকে পেয়েছেন, নাসাঈ শিখেছেন আলকামা'র কাছ থেকে, আলকামা ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে। এবং ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর শিক্ষক স্বয়ং রাসূল (সাঃ)। কুরআন সুন্নাহ কেবল মুখে আওড়ালে হয় না, কুরআন-সুন্নাহর বৈধ উৎস পেতে হলে রাসূল (সাঃ) পর্যন্ত বিশ্বস্ত চেইন-লিংক থাকা বাঞ্চনীয়।
তারপরেও আমি সবাইকে গ্রহণ করার মতো মন-মানসিকতা নিয়ে চলি। মাজহাব মেনে চলা ভালো, যে না চায় তাকে বাধ্য করার কিছু নেই। আমি হানাফী মাজহাব মেনে চলি, এতে আমি লজ্জিত/ক্ষমাপ্রার্থী নই। হানাফী মাজহাবে শুধু আবু হানীফা আছেন তা নয়। উনার পূর্বে ও পরে হাজার হাজার স্কলার হাদীস কুরআন নিয়ে গবেষণা করে এ পর্যন্ত ধারা বহন করে চলেছেন। বাকি মালিকি, শাফী ও হাম্বলীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মাজহাব মানার উপকারিতা হলো, এটা মনকে তথা আমিত্ব (ego) কে নিয়ন্ত্রণ করে।
১। বছরের কিছুসময় লন্ডনে ঈশার সময় হয় রাত ১০:৪৫ এর দিকে আর ফজর ৩:০০ টায়। তখন খুব আলসেমি লাগে, ঈশা ও সুন্নতের পর বিতর ফাঁকি দিতে মন চায়। হানাফী মাজহাবে বিতর পড়া ওয়াজিব, আজকের মতো অন্য মাজহাব হয়ে গেলাম(!)
২। রক্ত বের হলে ওজু ভেঙে যায়, হাতে একটু রক্ত দেখে ভাবলাম আজকে আমি শাফী’ হয়ে যাই, ঐ মাজহাবে তো হুকুমটা একটু শিথিল, হা হা হা।
৩। স্ত্রীকে স্পর্শ করেছিলাম। শাফী’ মাজহাবে তো এই ক্ষেত্রে ওজু ভেঙে যায়, আজকে হানাফী হয়ে গেলাম(!)
৪। হালকা তন্দ্রা গেছেন, উঠে ভাবলেন মালিকী মাজহাবে তন্দ্রায় ওজু ভাঙে না, আজকে আমি মালিকী(!)
মোদ্দা কথা, মাজহাব মেনে চলা এবং একটায় স্থির না থাকলে মানুষ সুবিধাবাদী হয়ে যায়, আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে নিজের খেয়াল খুশিমত চলতে শুরু করে। মাজহাব না মানলেও অন্ততঃ নিজের নীতিতে অটুট থাকুন, প্রলোভনে পড়ে বদলাবেন না, নিজের সাথে নিজে প্রতারণা করবেন না।
* যেসব ভাই আমাকে হাদিস শুনান “মেয়ের অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া বিয়ে যায়েজ না” কিন্তু আমি জানি হানাফী মাজহাব সেই অনুমতি দেয়। সেই একই ব্যক্তি ছয়/সাত বছর পর প্রেমে পড়েছেন, মেয়ের বাবার সম্মতি ছাড়াই বিয়ে করেছেন, তাদের সন্তানও আছে। নিজের নীতিও তো নিজে মানলেন না, সুযোগমতো মনের বাসনাই জয়ী হল।
* সফরে দুই ওয়াক্তের নামাজ একত্রে পড়ার ব্যাপারে হাদীস আছে, অন্য হাদীসে আছে তাঁরা একত্রে পড়েননি - ওয়াক্তের শেষ/শুরুর কাছাকাছি ছিল। হানাফী মাজহাবে দুই ওয়াক্ত জোড়া দেওয়ার অনুমতি নেই, তাই আমি সময়েরটা সময়ে পড়তে বাধ্য হই।
উম্মাহর ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মতভেদ: কেউ মুখে বা প্রিন্ট মিডিয়াতে ইসলাম প্রচার করছে, কেউ সফর করছে দূর-দূরান্তে, কেউ মুসলিমের ঈমানী শক্তি ও চর্চা বাড়াতে কাজ করছে, কেউ মাদক বা কু-অভ্যাস দূর করার জন্যে জনসচেতনামূলক কাজ করছে, কেউবা অমুসলিমের কাছে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরছে - তাবলীগ সেটা একভাবে করছে, ইখওয়ানী সেটা অন্যভাবে করছে। হ্যাঁ, কেউ একান্তই সত্যের বিরুদ্ধে কথা বললে তার সাথে বেশি না, পাঁচ মিনিট বসে সত্যটা ধরিয়ে দিন। যদি সে না মানে দরকার নেই, আপনি আপনার কাজে চলে যান। মনে রাখবেন, বাতিল (মিথ্যা/ভুল) ঝড়ো বাতাসের মত আসবে আবার কিছুক্ষণ পর নীরব হয়ে যাবে। এসব আস্ফালন বেশিদিন টিকে না।
আকীদার দিক দিয়ে মতভেদ: আশ’আরি, মাতুরিদী, আহলে হাদীস, সালাফি এদের মতভেদ আছে আকীদার দিক দিয়ে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহঃ) এর মত হন, তিনি খুব সুন্দর কথা বলেছেন: “প্রতিটি ভিন্ন মত/দল তাদের সময় অনুসারে প্রশ্নোত্তর বা সমাধান দিয়েছেন। একসময় তাঁরা বলেছেন, কুরআনে বলা হয়েছে এবং এটাই যথেষ্ট; জনগণ তাই মেনে নিয়েছে। একটা সময় পর লোকজন প্রমাণ দাবী করেছে। তখনকার স্কলাররা কুরআনের ব্যাখ্যা ও উচ্চতর বিশ্লেষণ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা ঐভাবে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে তারা দ্বীন থেকে সরে যেত। তাঁদের প্রত্যেককে সম্মান দিতে পারাই সত্যিকারের মুমিনের লক্ষণ। এভাবে সবাই মিলে আমরা মুসলিম উম্মাহ একটি দেহের মতো। রাসূল (সাঃ) বলেছেন মুসলিম উম্মাহ একটি দেহের মত, এর একাংশে ব্যাথা হলে পুরো দেহ কষ্ট অনুভব করে। নবী-রাসূল ও সাহাবীগণ ব্যাতিত কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নন, কোনো দল/উপদল নির্ভুল নয়। সাহাবীগণের ব্যাপারে কথা বলার আগে স্পষ্টভাবে মনে রাখুন, তাঁদের জীবনে কিছু ভুলত্রুটি ঘটেছে, যা প্রকারান্তে আল্লাহ আমাদেরকে ঐ অবস্থায় করণীয় শিখাতে চেয়েছেন। সর্বপরি এই মতভেদগুলোকে মেনে নিয়েই ঐক্যবদ্ধ থাকবো, নিজের সমর্থিত মতবাদ ছাড়া বাকিসব বাতিল বলবো না, তাহলে ঐক্য ফিরে আসবে।
সুফী, সুফীজম ইত্যাদি শব্দের প্রতিই অনেকের বিতৃষ্ণা কাজ করে। সত্যিকার সুফীরা উত্তম আখলাক ও নৈতিকতার অধিকারী, নম্র স্বভাবের। যদি তাদের অন্যকিছুতে আপনার আপত্তি থাকে, আপনি তাদের এই গুণগুলো গ্রহণ করতে পারেন। তাদের কিছু গ্রুপ খুবই ভালো আবার কিছু গ্রুপ একদম পথভ্রষ্ট - শিরক ও বিদাতে লিপ্ত। ঢালাওভাবে কারোরই সমালোচনায় জড়াবেন না। দেওবন্দী ও বেরেলভী এর মধ্যে দু’তিনটি ইস্যু নিয়ে মতভেদ। দুই গ্রুপের সাথেই আমি বসেছি, আমি দেখেছি দুই গ্রুপের একেক দিকের চরমপন্থী মনোভাব ছেড়ে মধ্যমপথে চললেই মতভেদ থাকে না। দেওবন্দীরা দাবী করে যে, “বেরেলভীরা নাকি বিশ্বাস করে রাসূল (সাঃ) আল্লাহর মতোই সমুদয় ভবিষ্যৎ জানা ছিল”। কিন্তু আমি হজ্জে তিনশ’ বেরেলভীর একটি দলের সাথে ছিলাম, সেখানে ইমাম ও শায়খদের সাথে আলাপ করেছি তারা এ ধরণের বিশ্বাস ধরে বসে নেই; তারাও বিশ্বাস করেন “আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সাঃ) কে যে পরিমান জানিয়েছেন, তিনি ততটুকুই জানতেন”। হ্যাঁ, ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায় কিছু বেরেলভী এ ধরণের বিশ্বাস করতো, সে অনুযায়ী বক্তব্য দিত। কিছু গুটিকয়েকের জন্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথভভ্রষ্টের কাতারে ফেলা অনুচিত। বেরেলভীরা দাবী করে যে, “দেওবন্দীরা নাকি ফরজ নামাজের পর সুন্নত পড়ে না”। এমনকি এক রাস্তার দুই পাশে দুই মসজিদ - এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের মসজিদে নামাজ পড়ে না। আমি কৌতুক করছি না, সত্যিই আমি দেখেছি। আমার পরিচিত একজন দেওবন্দীদের মসজিদে ঢুকে অবাক হয়ে গেল, “এরা তো দেখছি ফরজের পর সুন্নাতে মুয়াক্কাদা পড়ে!”
একইভাবে রাসূল (সাঃ) নূরের তৈরী, আল্লাহর নূরের একাংশ পৃথক হয়ে সেখান থেকে তাঁর সৃষ্টি - নাউজুবিল্লাহ, এসব বিশ্বাস থেকে দূরে থাকুন। রাসূল (সাঃ) এর ছায়া পড়তো কিনা, তাঁর জন্মদিন কবে? আমি কখনও রাসূল (সাঃ) এর জন্মদিনে মিছিলে বের হইনি কিন্তু তবুও তাদের নিন্দা করতে চাই না - অন্ততঃ তাদের রাসূল (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা আছে। কিছু মানুষ মাত্র পাঁচটি বিষয়ের কারণে ইসলামের সাথে যুক্ত - পনেরই শা’বান, সাতাইশ রমাদান, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা এবং ঈদে মিলাদুন্নবী। যদি গিয়ে বলেন পনেরই শা’বান তো সহীহ হাদীসে নেই, সাতাইশ রমাদান ছাড়া অন্য বিজোড় রাতেও তো ক্বদর হতে পারে, সাহাবীগণ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করেন নি। তাহলে আপনি তার ইসলামের সাথে তিনটি সংযোগ কর্তন করে ফেললেন। তাকে এখন শুধুমাত্র দুই ঈদের নামাজ ছাড়া মসজিদে পাওয়া যায় না, ইসলামের কিছুই জানতে পারে না, নামাজে এসে বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা ও গল্প করাই তার মূল আকর্ষণ। কাকে কি বলছেন এই বিষয়টা মাথায় রাখবেন, কোনকিছু মানা করতে গেলে বিকল্প একটা ভালো কিছু শিক্ষা দিন। তা নাহলে সে যদি ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে তাহলে তার জন্যে আপনি দায়ী হবেন।
****
প্রশ্নোত্তর পর্ব
প্রশ্নঃ নামাজের সময় একজনের পায়ের পাতা আরেকজনের সাথে মিলিয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন আছে কি?
উত্তরঃ বেশিরভাগ স্কলারের মতে পায়ের পাতা মিলানোর দরকার নেই; কিছু সংখ্যকের মতে আছে।
ব্যাখ্যাঃ আপনি চাইলে করতে পারেন, যদি পাশের ভাই তা চান। পা এতবেশি ছড়াবেন না যে, পাশের জন আপনার ভয়ে চেপে দাঁড়াতে গিয়ে বিরক্ত হয়। “মাঝে শয়তান ঢুকে" এসব যুক্তি দিবেন না, কারণ শয়তান ছড়ানো দুই পায়ের মাঝখানে বারবার আসা-যাওয়া করতে পারে, হা হা।
প্রশ্নঃ এক মাজহাবপন্থী ইমামের পিছনে অন্য মাজহাবপন্থীর নামাজ হবে কি?
উত্তরঃ অবশ্যই নামাজ শুদ্ধ হবে। কোন শায়খ “হবে না” বলে থাকলে তিনি অবশ্যই ভুল বলছেন।
ব্যাখ্যাঃ আমি শাফী ইমামের পিছনে তারাবীহ পড়েছি, তিনি সূরা হজ্জ ৭৭ আয়াত পরে সিজদা দিয়েছেন, অনেক হানাফী মুক্তাদী আমরা সবাই সিজদা দিয়েছি, যদিও হানাফী মতে এই আয়াতে সিজদা নেই। তেমনি বিতর নামাজ, ঈদের নামাজে পার্থক্য থাকা সত্বেও আরেক ইমামের পিছনে নামাজ শুদ্ধ। এমনকি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) মদীনায় ইমাম মালিক (রহঃ) এর এলাকায় এসে সঙ্গীদের বলেছেন, ইমাম মালিক (রহঃ) যেভাবে নামাজ পড়েন তোমরাও এখানে সেভাবে পড়বে। ইমাম শাফী (রহঃ) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এর কবরের কাছে মসজিদে এসে দুই রাকাত নামাজ পড়েছেন হানাফী নিয়মে। এটাই উম্মাহর ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।
প্রশ্নঃ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত কি?
উত্তরঃ সবাই আমরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত এর অংশ।
ব্যাখ্যাঃ আবারও বলি এই নামগুলো নিয়ে তর্কে জড়াবেন না। কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের প্রদর্শিত পথে যেই চলুক সেই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সদস্য, সেই একটি সফলকাম বৃহৎ দলের অংশ।
প্রশ্নঃ ওয়াহাবীরা বিশ্বাস করে আল্লাহর হাত-পা আছে, তিনি কুরসীতে বসেন, এ আকীদা মানা উচিত?
উত্তরঃ এটি আকীদার মূল অংশ নয়, দুইপক্ষের কারোরই ঈমান ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।
ব্যাখ্যাঃ এগুলো নিয়ে যুগের পর যুগ গবেষণা ও আলোচনা চলছে। আমাদের ওলামা ফোরাম আছে - এমেরিকা, ক্যানাডা, ইউরোপ, আফ্রিকার প্রায় পাঁচশ’ আলেম নিয়ে। সেখানে এসব বিষয়ে অনেক লম্বা বিতর্ক হয়। এ পর্যন্ত যা বুঝা যায়. ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কাজের অনেক অপব্যাখ্যা যুগে যুগে করা হয়েছে, তার কাজে অনেককিছু পরে যোগ করা হয়েছে। তাই এইটুকু মাথায় রাখি, আমরা সবাই আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। বাকী এইসব বৈশিষ্টে বিশ্বাস করা/ না করা ঈমানের অংশ নয়।
প্রশ্নঃ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেছেন কুরআন ও সুন্নাহতে আমার কথার ব্যতিক্রম পেলে আমার মতবাদ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ো। তিনি আসলে কি বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ তিনি বুঝিয়েছেন যে, তাঁর মতবাদে কুরআন, সুন্নাহ বিরোধী কিছুই পাবেন না।
ব্যাখ্যাঃ যদি বিচারক আদালতে রায় ঘোষণা দেয়া শেষে বলেনঃ “আমার বিবেচনা মতে এটাই রায়, আপনারা আইনের সাথে কোনরূপ অসঙ্গতি খুঁজে পেলে আমার রায় ছুঁড়ে ফেলে দিন” - এটা কিন্তু চ্যালেঞ্জ বুঝায়। একজন বিচারক আইনজীবীদেরকে একথা বলা আর আমি আপনি পরস্পরকে বলার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) তাঁর সমসাময়িক চল্লিশজন বড় স্কলারের সাথে নিয়মিত দ্বীনের চর্চা করতেন, হাদীস, ফিকহ নিয়ে আলোচনা করতেন। বস্তুতঃ তিনি বুঝিয়েছেন তাঁদের সম্মিলিত গবেষণার ফলাফলে কুরআন-হাদীসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছুই খুঁজে পাবেন না।
প্রশ্নঃ ডাঃ জাকির নাইক বলেনঃ “নাভির নিচে হাত বাঁধার হাদীসটি দূর্বল” - আমরা তাঁর কথা মানা উচিত কিনা?
উত্তরঃ তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল, নাভির নিচে হাত বাঁধা সম্পর্কে অন্ততঃ চারটি পূর্ণাঙ্গ সহীহ হাদীস আছে।
ব্যাখ্যাঃ ডাঃ জাকির নাইক একজন শ্রেষ্ঠ দা’য়ী (ইসলামের দিকে আহ্বায়ক), আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন, তাঁর কাজে বরকত দিন, তাঁর চমৎকার স্মৃতিশক্তির দ্বারা ইসলাম প্রচারে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টাকে কবুল করুন, তাঁর মতো এত সুন্দরভাবে দাওয়াতের কাজ আমার দ্বারা অসাধ্য। তিনি একজন ভালো দা’য়ী কিন্তু তিনি যোগ্যতাসম্পন্ন ইসলামী স্কলার নন। আমার কথা YouTube এ থেকে যাচ্ছে, তিনি আমাকে কখনও চ্যালেঞ্জ করতে পারেন জেনেও আমি বলছি তিনি যোগ্যতাসম্পন্ন ইসলামী স্কলার নন। ফিকহ তাঁর আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়, তিনি ফিকহের বিষয়ে একের পর এক ভুল করে যাচ্ছেন, আমি নিজে তাঁর বহু ভুল বক্তৃতা দিতে শুনেছি। নাভির নিচে হাত বাঁধার ব্যাপারে দশজন সাহাবী থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়; যার আটটি নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বর্ণিত এবং সেই আটটির মধ্যে অন্ততঃ চারটি সহীহ হাদীস। (আরও জানতে পড়ুন) আমি বলব তিনি ফিকহ বিষয়ে তাঁর গবেষণা সম্পন্ন না করেই কথা বলেছেন। তাঁর কাছে আপনারা দাওয়াতের জ্ঞান শিখুন, ফিকহ শিখতে যাবেন না।
প্রশ্নঃ কুরআনে বলা হয়েছে মতবিরোধ হলে কুরআন ও সুন্নাহতে খুঁজতে, এ বিষয়ে কি বলার আছে?
উত্তরঃ কুরআনে বলা হয়েছে: হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। [সূরা নিসা 4:59] এখন আমি কিভাবে আল্লাহকে বা রাসূল (সাঃ) সরাসরি পাব যে সমাধান জিজ্ঞাসা করে নিবো? তার অর্থ, কুরআন ও সুন্নাহকে পেতে হলে সাহাবীগণের পথ এবং তাদের ধারা বজায় রেখে চলেছেন যাঁরা তাঁদেরকেই অনুসরণ করতে হবে।
প্রশ্নঃ কেউ কেউ শুধু কুরআন মানে, সুন্নাহতে বিশ্বাসী না। সেটা কি বৈধ?
উত্তরঃ কুরআন মানে কিন্তু হাদীস অবিশ্বাসী ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদারই নয়। কুরআন আল্লাহর সরাসরি সংক্ষিপ্ত বিধান, রাসূল (সাঃ) এর সমস্ত জীবন কুরআনের প্রয়োগ এবং সাহাবীগণ তাঁর দেখানো পথে চলে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠ হয়েছেন যাঁদের সিদ্ধান্ত আমাদের জন্যে নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২১