শাইখ হাসান আলী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আলেম, শাইখ, ব্রিটেনের সাফার একাডেমির শিক্ষক; প্রায় ২৬ বছর যাবৎ এ ধারার শিক্ষায় সংযুক্ত আছেন। তিনি রূহের্ ছয়টি জীবন সম্পর্কে অতীব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন যা, YouTube এ আছে। আমি তার ইংরেজিতে দেয়া পূর্ণ বয়ানের বঙ্গানুবাদ করে পাঠকের কাছে তুলে ধরলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, আমাকে জানালে সংশোধন করে দিতে পারবো।
===============
আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজীম, বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। কাইফা তাকফুরুনা বিল্লাহি ওয়া কুংতুম আমওয়াতাং ফাআহ’ইয়াকুম, সুম্মা ইউমিতুকুম, সুম্মা ইউহ’ঈকুম, সুম্মা ইলাইহি তুরজাউন। অর্থাৎ: কেমন করে তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে কুফরী অবলম্বন করছ? অথচ তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ। অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে প্রাণ দান করেছেন, আবার মৃত্যু দান করবেন। পুনরায় তোমাদেরকে জীবনদান করবেন। অতঃপর তারই প্রতি প্রত্যাবর্তন করবে। [সূরা বাকারা, 2:28]
প্রথমেই সবাইকে সালাম জানাচ্ছি, আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমরা এখানে সমবেত হয়েছি "রূহ বা আত্মার ভ্রমণ" সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে। আপনারা এখানে যারা বসে আছেন এবং সাধারণভাবে সবাই ভাবেন "এটাই আমার জীবন, জীবন নিজস্ব গতিতে চলবে এবং একসময় থেমে যাবে। যেখানেই থামুক, আমার জীবন মূলতঃ এইটাই, আমি আমার পরিবারের সদস্য বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে অনেক অনেক লম্বা একটি জীবন কাটাতে চাই। মোদ্দা কথা, আমরা এটাকেই মূল জীবন বলে ভাবি,,, স্বেচ্ছায় কেউ ছেড়ে চলে যেতে রাজি নই। যখন কেউ এই জগৎ ছেড়ে চলে যায়, আমাদের ধারণা “এটাই তার জীবনের সমাপ্তি, সবকিছু শেষ। তার মৃত্যু ঘটেছে, সে চলে গেছে।
কিন্তু যখন কুরআন অবতীর্ণ হলো তখন জীবনের নতুন এক সংজ্ঞা আমরা খুঁজে পেলাম। মৃত্যু বা মউত কুরআনেও উল্লেখ আছে, কুল্লু নাফসিং যা-ইকতুল মাউত। অর্থাৎ: প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে [সূরা আম্বিয়া, 21:35]। কিন্তু মৃত্যুকেই সবকিছুর শেষ বলা হয় নি, আরো উল্লেখ আছে তোমাদেরকে স্থানান্তর করা হবে এক ভিন্ন নতুন জগতে; তুমি ভ্রমণ করছো। কুরআনের এই বক্তব্যে বুঝা যায়, মৃত্যুই আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি নয়। আমরা মৃত্যুবরণ করবো কিন্তু পরবর্তী জীবনের দিকে ধাবিত হবো; থেমে থাকবো না।
এক জীবন থেকে অন্য জীবনে স্থানান্তরিত হবো, তা মৃত্যু দিয়েই সর্বপ্রথম - বিষয়টা এমন নয়। এর আগেও তা ঘটেছে, পৃথিবীতে আমাদের জন্মের আগেও আরো দুটো জীবন পার করে এসেছি আমরা। মৃত্যুর পরেও একাধিক জীবনে আমাদেরকে ভ্রমণ করতে হবে। ভাই ও বোনেরা, অনুগ্রহ করে দুনিয়ার জীবনটাকেই একমাত্র জীবন এবং মৃত্যুকেই জীবনের শেষ ভাববেন না। আমরা সবাই ৬টি ভিন্ন ভিন্ন জীবন-যাপন করবো, এর জন্যে মোট ৫বার স্থানান্তর ঘটবে। দুনিয়ার জীবন রূহের জীবনগুলোর মোট দৈর্ঘ্যের তুলনায় খুবই সামান্য অংশ। সত্যিকার অর্থে আমি-আপনি সুবিশাল এক অনন্ত জীবনের বিভিন্ন ধাপ পার হচ্ছি। কোনো একসময় আল্লাহ সুবহানাল্লাহি তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন; আমি পৃথিবীতে জন্মের কথা বুঝাইনি, রূহের জন্ম! রূহ সৃষ্টির পর থেকে দুনিয়ার একমাত্র মৃত্যু ছাড়া বাকী জীবনে পূর্বে/ভবিষ্যতে এর কোনো মৃত্যু নেই।
প্রথম জীবন: রূহের জগৎ বা আলামুল আরওয়াহ। সুবহানাল্লাহ, ভাবা যায় আমরা সবাই একসময় রূহ ছিলাম? আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য রূহ সৃষ্টি করেছেন - এর কোনো একটা আমি ছিলাম, অন্যটা আপনি। আগত-অনাগত সকল রূহ কে তিনি আলামুল আরওয়াহ তে সংরক্ষিত রেখেছেন। আল্লাহ আদম (আলাইহি ওয়াসসালাম) কে সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি হিসেবে। তাঁর মেরুদণ্ডে তিনি স্থাপন করে দিয়েছেন আগত-অনাগত সকলের বীজ। সকল মানব অর্থাৎ পৃথিবীর বর্তমান ৬০০ কোটি লোক, প্রায় ৩০ হাজার বছরে যারা গত হয়েছেন এবং পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব পর্যন্ত যারা আসবেন। আদম (আঃ) এর মেরুদণ্ডে স্থাপিত বীজগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্মতে প্রবাহিত হয়ে মানবজাতির বংশধারা বজায় রেখে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় আমার বা আপনার রূহের পালা আসলো যা একটি দেহ হিসাবে প্রকাশ পেল। আমরা কেউ জানি না কখন কার ডাক পড়েছিল, আল্লাহই ভালো জানেন। অর্থাৎ রূহ সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে আমাদের সবার রূহগুলো একত্রে রাখা ছিল। আমরা অনেকসময় অপরিচিত কাউকে দেখেও খুব পরিচিত মনে হয়, কিন্তু স্মরণ করতে পারি না তাকে কোথায় যেন দেখেছিলাম; বস্তুতঃ তাকে দেখিনি। এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বর্ণনা করেছেন হতে পারে এমন যে, আলামুল আরওয়াহতে তাকে দেখেছিলে। সেখানে আমরা লক্ষ্ কোটি বছর অবস্থান করেছি, আল্লাহই জানেন কত দীর্ঘসময়! রূহদের সেই মহা সমাবেশে আমরা কেউ কারো আত্মীয় ছিলাম না। এমনকি নারী/পুরুষ বা কোনোকিছুই ছিল না, শুধুই রূহ বা আত্মা। কাউকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি এমনকি আদম (আঃ) ও হওয়াকে সৃষ্টির পূর্বে কোনো একসময় আল্লাহ তায়ালা সকল রূহকে একত্রে একটি প্রশ্ন করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত: আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্টদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং নিজের উপর তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই ? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কেয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। [সূরা আ’রাফ, 7:172] সেই জগতে আমরা শুধুমাত্র আল্লাহকেই চিনতাম, আর কিছু না। আমাদের আশেপাশে আরো আত্মাকে দেখতে পেতাম, কিন্তু ফেরেস্তাদের মতো শুধু আল্লাহর যিকরই তখন একমাত্র কাজ ছিল। তিনি তখনই আমাদের কাছ থেকে রব হিসেবে স্বীকারোক্তি রেখে দিয়েছেন যেন কিয়ামতের দিন আমরা বলতে না পারি যে, আমরা আল্লাহর পরিচয় জানতাম না, পূর্বপুরুষরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। আল্লাহ অতঃপর আদম (আঃ) ও হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠালেন। যখন তাদের প্রথম জোড়া সন্তান হবে (তাদের দুটো করে সন্তান জন্ম নিতো) তখন অসংখ্য রূহের মধ্য থেকে দুটি রূহকে নিলেন যারা হাওয়ার ভ্রূণে স্থাপিত হবে। সেই ভ্রূণ পূর্ণাঙ্গ দেহে রূপান্তরিত হবে, সেই দেহে রূহ অবস্থান করবে আল্লাহ যতদিন না তা বের করে আনেন। এভাবে রূহের জগৎ থেকে বিদায় করে দেওয়া হলো। কিন্তু রূহের জগতেই তো আমরা আরামে ছিলাম, দ্বিতীয় জীবন তথা মায়ের গর্ভে আমরা স্বেচ্ছায় যেতে চাইবো না। আল্লাহ তাঁর ইচ্ছায় যখন যে রূহ কে নির্বাচন করে পাঠান; কোন রূহ যাওয়ার জন্যে নির্বাচিত হবে, তা সে কিছু আগেও জানতে পারে না।
ধরুন, আমার রূহকে নির্বাচন করা হলো। ততদিনে আমার মায়ের গর্ভে ভ্রূণের বয়স ৪মাস হয়ে গেছে। [সূরা মু'মিনুন 23:12-14] ও সহীহ বুখারীর হাদিসের বর্ণনা থেকে পাওয়া, ভ্রূণের বয়স ১২০ দিন হওয়ার পর তাতে রূহ দেওয়া হয়। আল্লাহ একটি সম্পর্ক তৈরী করে দেন, এখানে আমাকে থাকতে হবে যতদিন না তিনি এ থেকে বের করেন - উনি আমার মা। লোকটা আমার বাবা। আমার আগে/পরে এই গর্ভে যারা এসেছে তারা আমার ভাইবোন। কিন্তু এর কিছু আগেও আমি শুধুই একটি রূহ ছিলাম, কোনো সম্পর্ক/পরিচয় ছিল না। হাদিসে বর্ণিত আছে, যথাসময়ে ফেরেস্তারা এসে ভ্রূণের মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়। যদিও দেড় মাসের মধ্যেই ভ্রূণের হার্টবিট শুরু হয়ে যায় কিন্তু রূহ দেওয়ার আগ পর্যন্ত তা জীবনের শুরু নয়। এমনও বিরল ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, রোগীর হার্টবিট, পালস সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে; ক্লিনিক্যালী ডেড; জানাজা দেয়া হয়েছে, দাফনের সময় নড়ে উঠলো। অর্থাৎ তার রূহ দেহ থেকে চলে যায়নি বলে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার হয়েছে। ফেরেস্তারা ভ্রূণের মধ্যে রূহ ফুঁকে দিলো, আমি এর মধ্যে আটকা পড়ে গেলাম। চারদিকে শুধু লাল (গর্ভ) ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না, মায়ের গর্ভে শুয়ে থেকে কিছু নড়াচড়া করছি, আর কোনো কাজ নেই। একটি নল দিয়ে সরাসরি পাকস্থলীতে খাবার চলে যাচ্ছে, আমাকে কিছু করতে হচ্ছে না।
এখন একটি কাল্পনিক কাহিনী আপনাদের সাথে বলবো, যার সাথে তুলনা করবো একটি শিক্ষণীয় বাস্তবিক বিষয়। ধরুন ৫/৬ মাস বয়সী যমজ দুটি ভ্রূণের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। এদের একজন বিশ্বাস করে যে, একসময় গর্ভ ত্যাগ করে দুনিয়ায় আসতে হবে। সে তার ভাইকে বর্ণনা করতে থাকে, আমরা এক নতুন দুনিয়ায় যাব, আমাদেরকে নিজে নিজে খেতে হবে, মুখ দিয়ে খেতে হবে, হাঁটাচলা করতে হবে, অনেক রঙিন সেই দুনিয়া। অপর ভাই তার যুক্তিখণ্ডন করে চলে: তুমি নিজে দুনিয়া দেখেছো? তুমি কি কাউকে যেতে দেখেছো দুনিয়াতে? কেউ কি সেখান থেকে ফিরে এসে তোমাকে বলেছে দুনিয়া কেমন? আমাদেরকে এখানে খাওয়ানো হয়, নিজে নিজে খেতে যাবো কেন? আমি তোমার এইসব গল্প বিশ্বাস করি না। আসলে আমরা তো জানি এখানে প্রথম বাচ্চার কথাগুলিই সঠিক। তেমনিভাবেই যুগের পর যুগ নবী-রাসূলগণ মানুষকে মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে বলেছেন আর অবিশ্বাসীরা চাক্ষুস প্রমাণ চেয়েছে, অহেতুক প্রশ্ন করেছে, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে, পাগল বলেছে। এমনকি কিছু দুর্বল ঈমানদার মুসলিমও নাস্তিকতায় প্রভাবিত হয়ে বিচারদিবসকে অস্বীকার করতে চায়, বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়। নবী-রাসূল, আসমানী কিতাবসহ অজস্র প্রমাণ পেয়েও যারা অবিশ্বাস করছে, তারা একটি বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে। ফিরাউনের সভাসদের মধ্যে একজন ঈমান নিয়েছিল এবং তা সে গোপন রাখতো। তার ভাষ্য ছিলো মুসা ও হারুনের কথা যদি মিথ্যা হয় আমরা মৃত্যুর পরে কোনো জীবন না পেলেও তো ক্ষতি কিছু হচ্ছে না। কিন্তু যদি সত্য হয় তাহলে তো আমরা নিশ্চিত আল্লাহর আযাবে পতিত হবো। কুরআনে এসেছে, ফেরাউন গোত্রের এক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, সে বলল, তোমরা কি একজনকে এজন্যে হত্যা করবে যে, সে বলে, আমার পালনকর্তা আল্লাহ, অথচ সে তোমাদের পালনকর্তার নিকট থেকে স্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের নিকট আগমন করেছে? যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে তার মিথ্যাবাদিতা তার উপরই চাপবে, আর যদি সে সত্যবাদী হয়, তবে সে যে শাস্তির কথা বলছে, তার কিছু না কিছু তোমাদের উপর পড়বেই। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারী, মিথ্যাবাদীকে পথ প্রদর্শন করেন না। [সূরা গফির, 40:28] ভাবার বিষয়, মুসলিমের মনের মধ্যেও এইধরণের উদ্ভট বিতর্ক কেন জন্ম নিচ্ছে? আমরা ইন্টারনেটে যা পড়ছি, যা দেখছি তা নিয়েই মেতে উঠি। গুগল কি - একটি সার্চ ইঞ্জিন; লক্ষ লক্ষ ওয়েবসাইটে যে যা খুশি প্রচার করছে গুগল সেটা অল্প সময়ে খুঁজে নিয়ে আসে, এইটুকুই। এখন এই সার্চ রেজাল্ট তো ভালো-মন্দ বা সত্য-মিথ্যা বুঝে না। যেমন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার যথেচ্ছ ব্যবহার করলে এর সামনে যাই পড়বে টেনে নিবে, তেমনিভাবে সার্চ ইঞ্জিন সবসময় যে সে সঠিক তথ্য দিবে তার নিশ্চয়তা নেই। টিভি চ্যানেলেগুলোর উপরও খুব বেশি ভরসা করা ঠিক না। তারা যা প্রচার করতে ইচ্ছুক, সেই ধরণের মতবাদে বিশ্বাসী লোকদেরকেই বক্তা হিসেবে আনে। প্রশ্ন হলো: আমরা কেন যা সামনে পাবো (যাচাই না করে) তাই দেখে, শুনে, পড়ে নিজের ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্থ করবো? হয়তো বলবেন, “সামনে চলছিল, ভাবলাম দেখি কি বলে ওরা”। কিন্তু এ ধরণের বিপথগামী অর্থহীন বিতর্ক দেখতে দেখতে কখন মনের অজান্তে নিজের ক্ষতি করে ফেলছেন ভাবতেও পারবেন না। যা ক্ষতি করার হয়তো করেছেন, এখন “অসুস্থ মন"কে সুস্থ করে তোলার জন্যে এসেছেন, কাজটি খুব সহজ নয়। সুতরাং সাবধান থাকুন। ইসলামের জ্ঞান পেতে হলে তাঁদের সান্নিধ্যে বেশি বেশি থাকুন, তাঁদের কথা শুনুন যারা আলেমের সান্নিধ্যে থাকে, যাদের শিক্ষকরাও আলেমের সান্নিধ্যে ছিল, তাঁদের শিক্ষকদের শিক্ষকরাও সেই ব্যক্তিদের অনুসরণ করতেন যাদের সাথে পর্যায়ক্রমে একটি চেইন-লিংক সাহাবীগণ হয়ে রাসূল (সাঃ) পর্যন্ত পৌঁছেছে।
দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু, স্ত্রী-পুত্র, সামাজিক অবস্থান, বুদ্ধিমত্তা, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তা করার জন্যে মন, স্বাধীনতা, চলার ক্ষমতা, সৌন্দর্য, দক্ষতা আরও কত কি! আমরা যতদিন বাঁচি ততবেশি জিনিসের স্বত্বাধিকারী হই; দুনিয়ার মায়া ততই বেড়ে যায়। দুনিয়া ছেড়ে যেতে ইচ্ছাই হয় না। আলামুল আরওয়াহ তে আমরা আরামে ছিলাম, যেতে চাইনি, মাতৃগর্ভেও আরামে ছিলাম যেতে চাইনি, কিন্তু পরবর্তী জীবনে যেতে বাধ্য হয়েছি। এই দুনিয়ার মোহে যেন আমরা আমাদের সত্যিকারের গন্তব্য ভুলে না যাই তাই আল্লাহ আমাদেরকে সালাত, সাওম এই ইবাদাতগুলো দিয়েছেন। ৫ ওয়াক্ত সালাত দিনের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হয়েছে, যেন রূহ নির্দিষ্ট বিরতির পর পর আল্লাহর সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে। একজন আমার কাছে বললো, আমি অফিসে কাপবোর্ডের পিছনে গোপনে নামাজে দাঁড়াই, কেউ দেখে ফেললে বুঝতে দেই না যে আমি নামাজ পড়ছিলাম। এভাবে প্রায় সময় নামাজ পড়াই হয় না। আমি বাসায় এসে জোহর, আসর, মাগরিব ও ঈশা যদি একত্রে পড়ি তাহলে চলবে? মোটেই চলবে না - নামাজ লুকিয়ে পড়তে হবে কেন?! যেজন্যে ৫ ওয়াক্ত নামাজ দেওয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্যই সাধন হবে না একত্রে সব পড়লে। খুব ভোরে উঠে আমরা যদি ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও ডিনার একত্রে সেরে নেই - ব্যাপারটা কি অবান্তর ও হাস্যকর নয়? আমরা আয়-রোজগার করবো, ভোগ করবো, জমা করবো, জীবনকে সবরকম উপভোগ করবো - এইটুকুতে আল্লাহ আমাদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। উদ্বৃত্ত সম্পদের শতকরা ২.৫% যাকাত দেওয়া ফরজ করা হয়েছে যেন নৈতিক দিক দিয়ে পথহারা হয়ে না পড়ি। ইসলাম বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড এর সম্পর্ককে সমর্থন করে না। কারো সাথে বন্ধুত্ব হলো, তাকে ভালো লাগলো, ছেলে-মেয়ে একসাথে ঘুরতে গেলো, এক সাথে খেলো, আনন্দ-ফুর্তি করলো, ঘনিষ্ট সময় পার করল - কিন্তু কোনো কিছুই তারা সিরিয়াসলি নিচ্ছে না, কোনো দায়িত্বেও নিজেকে জড়াচ্ছে না। আল্লাহ বিবাহকে হালাল করেছেন, কিন্তু এ ধরণের মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসাকে নিষিদ্ধ করেছেন যা মানুষকে তাঁর স্মরণ থেকে দূরে রাখে এবং অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত করে। বিবাহিত নবদম্পতি প্রথমদিকে একে অন্যের খুব সান্নিধ্যে থাকতে চায়, একে ওপরের প্রতি অনেকবেশি আবেগ ও ভালোবাসা কাজ করে। বিয়ের ৫/৬ মাস পর বা একবছর পর সেই আবেগীভাব অনেকটাই কমে আসে এবং একটি স্বাভাবিক ভালোবাসা বিরাজ করে। পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীলতা বাড়ে ও সাংসারিক জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় রত হয়। পুরুষের স্বর্ণ ও সিল্ক বা রেশমীকাপড় পরা নিষেধ, যেন জীবন এতবেশি উপভোগ্য না হয় যে তা পরবর্তী জীবন থেকে মানুষকে ভুলিয়ে রাখে। প্রথম জগৎ ছিল আলামুল আরওয়াহ বা রূহের জগৎ, দ্বিতীয় জগৎ মাতৃগর্ভ। এখন আমরা দুনিয়াতে বসবাস করছি তৃতীয় জীবনে। চতুর্থ জীবন হবে বারযাখ। মৃত্যুর পর থেকে শিঙ্গায় ফু দেওয়ার আগ পর্যন্ত এই জীবনের ব্যাপ্তি। কাউকে কবর দেওয়া হোক বা নাই হোক, আত্মাকে বারযাখের জীবন-যাপন করতে হবে। পঞ্চম জীবন হবে বিচার দিবস। ষষ্ঠ ও চূড়ান্ত জীবন হচ্ছে জান্নাত বা জাহান্নাম (আল্লাহ মাফ করুক)। দুনিয়ার জীবনে সর্বপ্রকার সাফল্যই আমাদের একমাত্র লক্ষ হওয়া উচিৎ নয়। আমাদের যাবতীয় অর্জন কিছুই সাথে যাবে না। আপনার গাড়িটি যত দামীই হোক না কেন, তা অবশেষে স্ক্র্যাপইয়ার্ডে যাবে এবং আপনি যেই হন না কেন মরার পর কবরেই রেখে আসা হবে। আদম (আঃ) ও হাওয়াকে দুনিয়ায় প্রেরণের সময় আল্লাহ 2:28 আয়াতে বলে দিয়েছেন, তিনি দুনিয়ার জীবন দিয়েছেন এতে তাদের মৃত্যু হবে এবং মহান আল্লাহর কাছেই আবার ফেরত যেতে হবে। বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস: রাসূল (সাঃ) এর সাহাবী হানজালা (রাঃ) বলেছেন, আমরা যখন আপনার কাছে থাকি তখন জান্নাত-জাহান্নাম যেন চাক্ষুস দেখতেই পাই - মনের অবস্থা এমন থাকে। কিন্তু যখন পরিবার-পরিজন স্ত্রী-সন্তানের সাথে মিলিত হই সেই ধরণের চিন্তাভাবনা মন থেকে অনেকটাই দূরে সরে যায়। আমাকে নিজের কাছে নিজেকে প্রতারক মনে হয়। রাসূল (সাঃ) তাঁকে আস্বস্ত করেন মনের এ দুইধরনের অবস্থা ঘটা স্বাভাবিক। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীন ও দুনিয়া দুইটাই দিয়েছেন বলেই এটা ঘটে। এবং হ্যাঁ, দুনিয়া উপভোগ করা মোটেই দোষের কিছু না, আমার কথাকে ভুলভাবে নিবেন না। কিন্তু দুনিয়ার মোহ যেন আপনাকে আচ্ছদিত করে না ফেলে।
যেই মুহূর্তে সময় শেষ হয়ে যাবে, মালাকুল-মাউত চলে আসবেন জান কবজ করতে তখন সকলেরই (বিশ্বাসী/অবিশ্বাসী) মনে পড়ে যাবে যে, সে একটি রূহ, কোথায় তার আদিবাস ছিল এবং দুনিয়া থেকে সে কোথায় যাচ্ছে! এও উপলব্ধি হবে যে দুনিয়ায় ফিরে আসার কোনো পথ নেই। আর এ কারণেই যে নিজের মৃত্যুর সময় ফেরেস্তাকে দেখতে পেল, তৎক্ষণাৎ তার জন্যে তওবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল; অন্তিম মুহূর্তে কারো তওবাই কবুল করা হয় না। মৃত্যু হওয়ার সাথে সাথেই দেহ থেকে রূহ পৃথক হয়ে যাবে, শুরু হয় চতুর্থ জীবন বারযাখ। পরিবার-পরিজন সবার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, দেহকে কবরে দাফন করে দেওয়া হয় আর কর্মফল অনুযায়ী রূহকে ইল্লিয়্যিন অথবা সিজ্জীনে নিয়ে যাওয়া হয়। পুণ্যবান রূহকে ইল্লিয়্যিনে এবং পাপী রূহকে সিজ্জীনে রাখা হবে;সূরা মুতাফফিফীন 83 এর অধিকাংশ জুড়েই উভয়ের বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা দুনিয়ার জীবনে পরিবার-পরিজন বন্ধুবান্ধব ছেড়ে চলে যাবো, তেমনি ইল্লিয়্যিনে একটি নতুন পরিবারের সাথে মিলিত হবো। রাসূল (সাঃ) বর্ণনা করেছেন, ইল্লিয়্যিনের সদর দরজায় থাকা ফেরেশতাদেরকে সেখানের অধিবাসীরা বার বার জিজ্ঞাসা করতে থাকে দুনিয়া থেকে কেউ এসেছে কিনা। যখনই নাম ঘোষণা করা হয়, তার পূর্বপুরুষ ও আগে মারা গিয়েছিলেন এমন রূহ সবাই স্বাগতম জানাতে সদর দরজায় ছুটে আসে। সে তখন উপলব্ধি করতে পারে এখানেই আসলে সবচেয়ে বড় পরিবার তার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। পূর্বপুরুষ যাদেরকে সে দুনিয়াতে দেখেছে শুধু তারাই নয় বরং প্র-প্র-পিতামহসহ সকল আত্মীয়ের এক মহা-পূণর্মিলনী ঘটবে। পূর্বের ওরা নতুনের কাছে সবার খবর জানতে চাইবে। তবে, এটা শুধুমাত্র ইল্লিয়্যিনের ক্ষেত্রেই হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ইল্লিয়্যিনে যাওয়ার সৌভাগ্য দান করুন, সবাই আমীন বলুন। সিজ্জীনে এধরণের সুখকর কিছুই ঘটবে না। কতই না দুর্ভাগ্য যার জীবন সিজ্জীনে এসে শেষ হয় - আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন, ক্ষমা করুন, সবাই আমীন বলুন। ইল্লিয়্যিনের রূহ্গণ সকলের সাথে মিলিত হয়ে আরামদায়ক জীবনযাপন করতে থাকে এবং দুনিয়ার লোকদের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে, আশাকরে যেন ইল্লিয়্যিনে আসে। দুনিয়ার কারো সাথে স্বপ্নের মাধ্যমে সাক্ষাৎ করার জন্যে আল্লাহর কাছে দুআ করে। আল্লাহ যদি সেই দুআ কবুল করেন, তাহলে দুনিয়ার ব্যক্তির ঘুমন্ত রূহের সাথে ইল্লিয়্যিনের ঐ রূহের সাক্ষাৎ ঘটান। প্রকৃতপক্ষে, আমরা প্রতিদিন ঘুমাতে গেলে আমাদের রূহ দেহ থেকে সাময়িকের জন্যে বের হয়। কুরআনে এসেছে, আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। [সূরা যুমার 39:42] কিছুসময় জীবিত মানুষকেও আমরা স্বপ্ন দেখি, তা নিছক কল্পনার কারণেও হতে পারে, তার অর্থ সবসময় এই নয় যে সেই রূহ গতরাতে আমার রূহের সঙ্গে ছিল! না না, আমাকে ভুল বুঝবেন না। কেবলমাত্র যখন এটা আল্লাহ-প্রদত্ত একটি সত্যিকারের স্বপ্ন, তখন আল্লাহ রূহগুলোকে আলামুল আল-আহলাম বা স্বপ্নের জগতে নিয়ে যান ও সাক্ষাৎ করান। এভাবেই আমরা মৃত মানুষকে স্বপ্নে দেখতে পাই।
যদি বলেন, কারো রূহ ইল্লিয়্যিনে আছে তার বাস্তবিক প্রমাণ দেখা সম্ভব কিনা, তবে শুনুন কিছু অলৌকিক বিষয় আল্লাহ মাঝে মাঝে দেখান। ঈমাম বুখারী (রহঃ) যখন ইন্তিকাল করেন, তাকে রাশিয়ার বুখারে সমাহিত করা হয়। তাঁর কবর থেকে শক্তিশালী সুবাস আসতে থাকে। সেই মাটি হাতে মাখলে হাত থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। মানুষের ঢল নামতো, প্রত্যেকে হাতে করে মাটি নিয়ে আসা শুরু করলো; এতে করে কবর খালি হয়ে যাচ্ছিলো। বার বার করে মাটি ভরাট করেও কুল পাওয়া যাচ্ছিলো না। তৎকালীন আলেমগণ দুআ করলেন “আল্লাহ এই অবস্থা বন্ধ করে দিন, কারণ লোকজন নতুন বিদাতে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিদিন কবরে মাটি দিয়ে ভরাট করেও পারা যাচ্ছে না”। তিনদিন পর এই সুঘ্রাণ বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরণের ঘটনা আরও ঘটেছে। মাওলানা আহমাদ আলী লাহোরী (রহঃ) তিনি অনেক বড়মাপের শায়েখ ছিলেন, আমি অনেক প্রশংসা শুনেছি - তবে দেখা হয়নি। ১৯৬২ তে তিনি যখন মারা গেলেন তাঁর লাশ কাঁধে নেওয়ার জন্যে মানুষ পর পর দাঁড়িয়ে ১৪ মাইল লম্বা লাইন হয়েছিল, সবাই একজন থেকে অন্যজনের কাঁধে লাশ শুধু পার করে দিচ্ছিলো; চিন্তা করুন কত মানুষ তাঁর জানাজায় অংশ নিয়েছিলো। যখন তাঁকে কবর দেওয়া হলো একই ঘটনা ঘটলো। বাংলাদেশে মুশাহিদ ব্যায়ামপুরী (রহঃ) ইন্তিকাল করলেন ১৯৭০ এর দিকে, তাঁকে কবর দেওয়ার পরও একই ঘটনা ঘটলো, সুঘ্রাণ বের হতে লাগলো, কয়েকদিন পর তা বন্ধ হলো। ৪০ বছর পর ২০১৪ তে আবার হঠাৎ করেই মুশাহিদ ব্যায়ামপুরী (রহঃ) এর কবর থেকে সুঘ্রাণ বের হতে শুরু করে এবং তা পুরো একদিন স্থায়ী ছিল। এই হচ্ছে চতুর্থ জীবন বারযাখ। প্রথম তিনটি জীবন ছেড়ে যেমন যেতে চায় নি, ইল্লিয়্যিনের সুখ ছেড়েও কেউ যেতে চাইবে না। কিন্তু সিজ্জীনের রূহ আজাব ও অশান্তির স্থান ছেড়ে বাঁচতে চাইবে। সিজ্জীনের আজাব চলতে চলতে হয়তো একটা মেয়াদ পর তা বন্ধ করে দিতে পারেন, আল্লাহই জানেন। এরপর কি হবে? আমরা হাশরের মাঠে উপস্থিত হবো। আল্লাহ ফেরেস্তাকে শিঙ্গায় ফু দিতে বলবেন। প্রথম শিঙ্গায় ফু দিলে দুনিয়ার যত প্রাণী মারা যাবে, ইল্লিয়্যিন ও সিজ্জীনের যত রূহ আছে তাদের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যাবে। আল্লাহ পৃথিবীর সবকিছু ভেঙে চুরমার একে সমতল করে পুনঃনির্মাণ করবেন। আল্লাহ আমার আপনার দেহ (যেখানেই ছিল) এনে ভূপৃষ্ঠের নিচে জমা করবেন, রূহগুলোকে যার যার দেহে ফেরত দিবেন। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফু দিবেন এবং আমরা সবাই জেগে উঠবো; পঞ্চম জগতে এসে পৌছাবো। মানুষ, জীন, পশুপাখি, পোকামাকড় সবাইকে একত্রে জড়ো করা হবে সেদিন এক অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। সদ্য জন্মানো শিশু যেমন নিজে থেকে কোনো কিছু করার ক্ষমতা থাকে না, তেমনি আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর খুব সীমিত পরিমান নিয়ন্ত্রণ থাকবে। আমরা কোনো এক শক্তির টানে নির্দিষ্ট দিকে হেঁটে কেয়ামতের মাঠে এসে মিলবো। এই মহামিলন খুবই অদ্ভুত, কে আমার মা, কে বাবা কেউ কারো খোঁজ করবে না, জানতেও চাইবে না। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, অতঃপর যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্নীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। [সূরা মু'মিনুন 23:101] আমরা সেইদিন কেউ কারো জন্যে সহানুভূতি অনুভব করবো না, কাউকে সাহায্য করতে চাইবো না, কাউকে দেখামাত্র দ্রুত পালাবো পাছে সে যদি আমাকে সাহায্যের অনুরোধ করে বসে। অতঃপর যেদিন কর্ণবিদারক নাদ আসবে, সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে উজ্জ্বল, সহাস্য ও প্রফুল্ল। এবং অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ধুলি ধূসরিত। তাদেরকে কালিমা আচ্ছন্ন করে রাখবে। তারাই কাফের পাপিষ্ঠের দল। [সূরা আবাসা 80:33-42] সেদিন আমি একটি রূহ, নিজের চিন্তায় নিজে ব্যস্ত থাকবো। লক্ষ বছরের রূহের জগৎ, হাশরের মাঠের পঞ্চাশ হাজার বছর ও অনন্ত-অসীম জান্নাত/জাহান্নামের তুলনায় - মাতৃগর্ভে কয়েকমাস এবং দুনিয়ার ৬০-৭০ বছরের জীবনকে খুবই খুবই নগন্য মনে হবে এবং আফসুস লাগবে। তাই কুরআনের বিভিন্ন স্থানে (রূহের এই সুদীর্ঘ জীবনের সাথে তুলনায়) দুনিয়ার ৬০-৭০ বছরের পুরো জীবনকে ১ দিন বা ১ বেলার সমান গণ্য করা হয়েছে। এখন হাশরের ময়দানের ওই পঞ্চাশহাজার বছরকে, আমলভেদে বিভিন্ন রকম অনুভত হবে। যদি পুণ্যবান হন, রাসূল (সাঃ) এর সান্নিধ্যে আরশের নিচে ছায়ায় কাওসারের পানি পান করবেন। আবুবকর, ওমর, উসমান প্রমুখ সাহাবীগণ (রাঃ) হবেন আপনার সঙ্গী। আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নবী রাসূলগণ একত্রিত হয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশে ঐসময়টুকু পার করবেন; পঞ্চাশহাজার বছরকে তখন ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজের মতো ছোট সময় মনে হবে। অন্যথায়, যারা পাপাচারী তারা ওই সুদীর্ঘ সময় খোলা মাঠে উদভ্রান্তের মতো ছুটাছুটি করবে। সূর্য মাথার এক বিঘৎ উপরে থাকবে। তারা এতটাই অস্থির থাকবে যে, তারা চাইবে ভালোমন্দ যাইহোক বিচার করে রায় দিয়ে দেওয়া হোক - এখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দরকার। আর এটাই প্রথমবার, যখন মানুষ এক জগৎ ছেড়ে পরবর্তী জগতে যেতে চাইবে। কেউ হাশরের মাঠে থাকতে চাইবে না - যে শাস্তি পাচ্ছে, সে পালতে চাইবে আর যে ভালোসময় কাটাচ্ছে সে জান্নাতে গিয়ে আরো ভালোসময় কাটানোর জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করবে।
ষষ্ঠ জীবন তথা চূড়ান্ত অনন্ত সময় হচ্ছে জান্নাত বা জাহান্নাম। আল্লাহ পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ জীবনে স্থানান্তরিত করবেন ভিন্ন ভিন্ন দেহে - জান্নাতির দেহ ও জাহান্নামির দেহ একরকম হবে না। জাহান্নামির দেহ বড় হবে, যেন শাস্তির ভোগান্তিও বেশি হয়। সেখানে সীমাহীন আজাব চলতে থাকবে। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং এ থেকে রক্ষা করুন, বলুন আমীন। ঈমানদার কেউ জাহান্নামে গেলেও শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে জান্নাত পাবে। জান্নাতে যাওয়ার আগে তাকে মা-উল হায়াতের পানি ঢেলে পরিশুদ্ধ করা হবে, এটা মানুষকে অনন্ত হায়াৎ দিবে। আল্লাহ একটি নতুন সুন্দর দেহ দিবেন, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান বর্ণনা শুনেনি এবং কোনো হৃদয় কখনো কল্পনাও করতে পারে নি। জান্নাতে সবাই উৎসবমুখর সময় কাটাবে, খাওয়া ও গল্পে মশগুল থাকবে। এ সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা কুরআনে পাওয়া যায়, তাদের জন্যে রয়েছে নির্ধারিত রুযি। ফল-মূল এবং তারা সম্মানিত। নেয়ামতের উদ্যানসমূহ। মুখোমুখি হয়ে আসনে আসীন। তাদেরকে ঘুরে ফিরে পরিবেশন করা হবে স্বচ্ছ পানপাত্র। সুশুভ্র, যা পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু। তাতে মাথা ব্যথার উপাদান নেই এবং তারা তা পান করে মাতালও হবে না। তাদের কাছে থাকবে নত, আয়তলোচনা তরুণীগণ। যেন তারা সুরক্ষিত ডিম। অতঃপর তারা একে অপরের দিকে মুখ করে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তাদের একজন বলবে, আমার এক সঙ্গী ছিল। সে বলত, তুমি কি বিশ্বাস কর যে, আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনও কি আমরা প্রতিফল প্রাপ্ত হব? আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি তাকে উকি দিয়ে দেখতে চাও? অতপর সে উকি দিয়ে দেখবে এবং তাকে জাহান্নামের মাঝখানে দেখতে পাবে। সে বলবে, আল্লাহর কসম, তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছিলে। আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ না হলে আমিও যে গ্রেফতারকৃতদের সাথেই উপস্থিত হতাম। এখন আমাদের আর মৃত্যু হবে না। আমাদের প্রথম মৃত্যু ছাড়া এবং আমরা শাস্তি প্রাপ্তও হব না। নিশ্চয় এটাই মহা সাফল্য। [সূরা আস-সফ্ফাত 37:41-60] প্রিয় ভাই, বোন, বন্ধুগণ আমি আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করতে যাচ্ছি। আমরা দুনিয়ার যা কিছুকেই সাফল্য ভাবি না কেন চূড়ান্ত সাফল্য হচ্ছে বারযাখে আরামে থাকা, হাশরের মাঠে রাসূল (সাঃ) এর সান্নিধ্য পাওয়া এবং জান্নাতে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ। সবাই বলুন ইনশাআল্লাহ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৫৮