এটা ২০২০ সালের মে মাসে লেখা করোনা প্যান্ডেমিকের সময় স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেমন হতে পারতো- তা নিয়ে একটা ভাবনা। গতবছর আমাদের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্ভবত কয়েকবার বলেছিলেন তারা নাকি প্রস্তুত ছিলেন না। অথচ জানুয়ারি থেকেই আমরা শুনে আসছিলাম যে আমরা নাকি প্রস্তুত এই প্যান্ডেমিক নিয়ন্ত্রণে। আসুন আমাদের দেখা সেই সময়ের ম্যানেজমেন্টের সাথে মিলিয়ে দেখি কী কী করা সম্ভব ছিল প্রস্তুতির জন্য। কে জানে! এক বছর পর আমাদের মন্ত্রণালয়গুলো এখন কতোটা প্রস্তুত! সেটাও মিলিয়ে দেখা যাবে কিছুদিন পর এই লেখার সাথে
আমি কিছু লিখেছি। আপনারা শুধরে দেবেন আশা করি। সাথে অবশ্যই আপনাদের আইডিয়া শেয়ার করবেন। হয়তো আমাদের এই আইডিয়াগুলোই হতে পারে এবং পারতো আদর্শ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা- এটা ভাবতে মন্দ লাগে না
১ঃ এলাকাভিত্তিক পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করাঃ
ক) সেপারেট এবং করোনা স্পেশালাইজড হস্পিটাল ইজ আ মাস্ট। মানে আলাদা আলাদা। যারা ক্রিটিকাল সিচুয়েশনের করোনা পেশেন্ট, তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল। সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই সহ পর্যাপ্ত বেডের পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ সিস্টেম থাকবে।
যারা প্রাইমারি স্টেজে করনায় আক্রান্ত তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল পর্যাপ্ত আইসোলেশন সুবিধাসহ থাকবে।
তবে ক্রিটিকাল পেশেন্ট এবং প্রাইমারি স্টেজের পেশেন্টদের জন্য একই হাসপাতালে সেপারেট ওয়ার্ড রাখলে সবচেয়ে ভালো হয়। সেক্ষেত্রে আইসিইউ সাপোর্ট সহজে পাওয়া যাবে।
আর যারা জেনারেল পেশেন্ট তাদের জন্য আলাদা জেনারেল হাসপাতাল।
এক্ষেত্রে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো (যেমন কিডনি ডিজিজ, হার্ট ডিজিজ- এধরণের) জেনারেলের আওতায় রাখতে হবে।
খ) প্রতিটা হাসপাতালে টেস্টের ব্যবস্থা থাকবে। টেস্ট করানোর পর প্রথমে পজিটিভ না নেগেটিভ সেই ভিত্তিতে পেশেন্ট আলাদা করে তারপর তাকে আইসোলেশন অথবা আইসিইউ হাসপাতালে পাঠাতে হবে (আবার উল্লেখ করি, সেপারেট হাসপাতাল/ ওয়ার্ড থাকতে হবে, অথবা এলোমেলো লেগে যাওয়ার সম্ভবনা থাকবে। এবং টেস্টের ব্যবস্থা থাকতেই হবে। উল্লেখিত সব ধরণের হাসপাতালে টেস্টের ব্যবস্থা থাকতে হবে)। একই হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড এবং আইসিইউ ব্যবস্থা থাকলে কোভিড পজিটিভ ব্যক্তিদের প্রথমে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখতে হবে।
গ) আইসোলেশন হাসপাতালগুলোর জন্য রোগের পর্যায় বিবেচনা করে ফাঁকা স্কুল কলেজগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। উল্লেখ্য, আইসোলেশনের জন্য অনেক বেশি জায়গার প্রয়োজন। করোনা টেস্টের রেজাল্ট আসতে দেরী হতে পারে, রেজাল্ট আসার পর যতক্ষণ না রোগি আলাদা হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে, ততক্ষণ তাকে আইসোলেশনে রাখা বাধ্যতামূলক।
ঘ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘরে ঘরে টেস্টের ব্যবস্থা করা। এরপরে হাসপাতালের ব্যাপার আসবে। আমাদের মূল টার্গেট হতে হবে মানুষ যেন কোনভাবেই আক্রান্ত না হয়।
এর জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি ইমার্জেন্সি হেল্পলাইন নাম্বার। সাধারণ এবং আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
ঙ) একই এলাকার হাসপাতালের ডাক্তারদের জন্য নিজ নিজ হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। টানা ১৫ দিন ডিউটি করার পর ১৫ দিনের কোয়ারেন্টাইন। প্রয়োজনে স্কুল ও কলেজের রুম গুলোতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে।
সব রকম স্বাস্থকর্মীদের এই ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে।
চ) হাসপাতালে পর্যাপ্ত কর্মচারী নিশ্চিত করতে হবে। ১৫ দিনের মাঝে সব রকম কর্মচারীদের প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন ভলেন্টিয়ার নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে ক্রান্তিলগ্নের জন্য স্বল্পমেয়াদী চাকরি দিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, এই শ্রেণির মানুষেরা কিন্তু এই লকডাউন অবস্থায় বিপদে রয়েছে। সুতরাং তারা বেতন পেলে চাকরি করতে রাজি হবে।
ছ) সব রকম স্বাস্থ্যকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের পর্যাপ্ত পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুয়িপমেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
জ) আইসোলেশনে থাকা রোগি, আইসিইউতে থাকা রোগি, আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে এমন, এবং হোমকোয়ারেন্টাইনে রয়েছে, এদের সবাইকে ডাটাবেজের আওতায় এনে প্রতিদিন এদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজনে একদম স্বল্প মেয়াদী অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে টেকনিশিয়ান নিযুক্ত করতে হবে 'চ' নং পয়েন্টের মতো করে।
জরুরি যোগাযোগ, অ্যাম্বুলেন্সের প্রাপ্যতা ডেটাবেজের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
ঝ) ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।
২ঃ জনসাধারণকে বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করাঃ
ক) অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া বের হওয়া যাবে না। ত্রাণের গাড়ি, ডাক্তার, সংবাদকর্মী এবং অন্যান্য ফ্রন্টলাইন ফাইটাররা এর ব্যতিক্রম। তবে সঠিক কারণ থাকতে হবে।
খ) অন্যান্য পেশাজীবি যারা আছেন, তাদের কর্মস্থলে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানসমূহকে বাধ্য করবে তাদের চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে থাকার ব্যবস্থা করতে।
কর্মস্থলে ডিউটির ক্ষেত্রে ১৫দিন পর পর শিফটিং এর নীতি অনুসরণ করতে হবে। শিফট শুরু হওয়ার আগেই কর্মীদের আলাদা করে টেস্ট করিয়ে তারপর কর্মস্থলে যেতে দেয়া হবে।
ডিউটিরত অবস্থায় যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে তাদের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
যদি প্রয়োজন হয় তাহলে প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী যানবাহন ব্যবস্থা রাখতে হবে। চাকরিজীবীদের আনা-নেওয়া করার জন্য।
সরকার প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করবে।
গ) যারা অদরকারে বের হবে তাদের শারীরিক শাস্তির ব্যবস্থা না করে জরিমানা করতে হবে।
ঘ) বিদেশ ফেরত যাত্রীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে। উপরে উল্লেখিত ভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৩ঃ ত্রাণ ব্যবস্থাঃ
ক) নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এবং যারা লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন সহ নানা কারণে বাজার করতে পারছে না, তাদের নিয়মিত ত্রাণ ও বাজারের ব্যবস্থা করতে হবে। হোম সার্ভিসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অথবা যথাযথ নিয়ম মেনে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাজার করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
খ) ত্রাণ প্রয়োজন এমন সবার জন্য রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।
যদি ঘরেঘরে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে প্রতিটি মহল্লায় নির্দিষ্ট করে ত্রাণের প্যাকেট রাখা হবে। এখান থেকে যার প্রয়োজন সে নিয়ে যাবে। কেউ দাঁড়াতে পারবে না। এক পরিবারের ২-৩ দিনের খাবার থাকবে সেই প্যাকেটে।
রেশন কার্ডের সিস্টেম খুব সহজেই করা যায়। উদাহরণস্বরুপ, ধরা যাক, প্রতি তিনদিনের জন্য ত্রাণ হিসেবে কার্ড থাকবে। অর্থাৎ এক মাসে একটা পরিবার মোট ১০ বার ত্রাণ পাবে। সে ক্ষেত্রে তিনদিন পরপর নির্দিষ্ট তারিখের পাশে 'ত্রাণ গ্রহণ করেছি' নামের ঘর থাকবে। ত্রাণ নেয়ার পর দায়িত্বরত কর্মী সেটি পূরণ করে দেবেন।
গ) ত্রাণ খাদ্য সরবরাহ মৌলিক অধিকার- সরকারের দায়িত্ব। তবে সরকার প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকার সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাঝে সমন্বয় করে এদের সকলকে ছোটছোট দলে ভাগ করে দিবেন। এই দলগুলোর কাজ হবে এলাকাভিত্তিক খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। অর্থাৎ, আজকে এক সংগঠন এই এলাকায় ত্রাণ দিবে, পরের দিন অন্য এলাকায়, এই ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। দল এবং সংস্থাগুলো নিজ নিজ দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতেই প্রতিদিন বা নিয়মিত ত্রাণ বিতরণ করবে। এতে প্রতিটি এলাকার সবাই প্রতিদিন ত্রাণ পাবে।
এভাবে সমন্বিত কাজের আওয়তায় পুরো এলাকাকে নিয়ে আসতে হবে।
আমার টার্গেট পুরো জেলা, বা শহর, এলাকা, বিভাগ অথবা দেশ, যেটাই বলা হোক না কেন, তাকে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা। ছোট ছোট এলাকায় ভাগ করে একদম প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সাহায্য নিয়ে যাওয়া৷ এই সমন্বিত ব্যবস্থাপনা যদি সত্যিই কাজে লাগানো যায়, ভবিষ্যতে এর কার্যকরী প্রভাব পড়বে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২১ রাত ১০:৫১