৭০০ বৎসর না হলে মায়ানমারে নাগরিকত্ব পাওয়া যাবেনা-এটাই চরম অমানবিক ভাবনা। প্রায় ৪০০/৫০০ বৎসর হলেও রোহিঙ্গারা সেখানে পরবাসী। ধর্মীয়ভাবে এরা মুসলমান, সেখানের প্রধান জনগোষ্ঠি নির্বাদী বৌদ্ধ-যাদের অন্যতম বানী হলো জীবহত্যা মহাপাপ, এমনকি মুরগী খাইলেও জবাই পযর্ন্ত করেনা। কিন্তু সময়ে সবার হায়েনারূপটি বেরিয়ে আসে। বৌদ্ধদের রক্তাক্ত দাঁতাল হাসি ও হাতে খুনের রক্তও আমরা দেখলাম-যা ছিলো অবিশ্বাস্য। নিজ দেশেও নাগরিকত্বহীন সাদাকার্ড এর মালিক-রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনাচরণে বাধ্য। উৎপাদিত ফসল পযর্ন্ত তারা ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারেনা। যাদের নেই কোনো দালাইলামা, নেই কোনো ডক্টরেটধারী বুদ্ধিজীবী, নেই কোনো শিক্ষিত জনগোষ্ঠি, নেই প্রবাসে কোনো প্রেসারগ্রুপ। তাইতো কেবল জীবন বাচাঁনোর একমাত্র ঠাঁই হতে পারে গরীব বাংলাদেশ-যারা একদিন স্বাধীনতার জন্য নিজ দেশছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলো। রোহিঙ্গাদের জন্য এখানে আছে ধর্মীয় আবেগ-মুসলিম হওয়ার বাস্তবতা-যদিও তা রাষ্ট্রের কাছে তেমন বিবেচ্য নয়।।
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ করলেও, নিবির্চারী মৃত্যুকে ঘৃনা করলেও রোহিঙ্গাদের জন্য দৃশ্যমান কিছু করা সত্যিই কঠিন। বিদ্যমান রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনিতেই বাংলাদেশ নানামুখী সমস্যায় আছে। বিদেশের চাকুরী বাজার সংকোচিত করতে এই রোহিঙ্গারা দায়ী, দেশে মাদকের বিস্তার, জঙ্গীবাদের সাথেও রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ থাকা, পতিতাবৃত্তিসহ নানান অপকর্মে রোহিঙ্গারা সম্পৃক্ত-এসব কর্মকান্ড দরিদ্র বাংলাদেশের জন্য গোদেঁর উপর বিষফোড়া। যদিও আমরা জানি শখে পতিতাবৃত্তি চলেনা, শখ করে কেউ নিজ বসতবাড়ী ছাড়েনা।
কয়েকটি জিজ্ঞাসাঃ
# রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ইমেজ নষ্ট করছে-সত্য। কিন্তু এটা বলার আগে আমাদের নিজেদের দিকেও তাকানো দরকার-যেখানে আমাদের নিজেদের বহু সন্তান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে আছে। তাই অন্যদের একবাক্যে অবৈধ বলার ক্ষেত্রে মানবিক বাস্তবতা মাথায় রাখা দরকার।
# বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদী ধ্বজ্জাধারী ব্যক্তিত্বদের সরবকণ্ঠ এখন রোহিঙ্গাদের বেলায় মিউমিউ শোনা যাচ্ছে-যা তাদের মানবতাবাদের দাবীকে কি হাস্যকর করে তুলেনা?
# সাইবেরিয়ার পাখিকে বাংলাদেশে ঢিল ছুড়াও যেখানে অপরাধ, সেখানে জীবন্ত মানুষের প্রতি নুন্যতম মমত্ববোধ না থাকাটা আমাদের চরম হিপোক্রেসি। কেবল রোহিঙ্গা নয়, পৃথিবীর যেকোনো স্থানের, যেকোনো জাতির এমন দূদর্শায় আমাদের কথা বলা কি নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা?
# বাংলাদেশ মাত্র ৬০/৭০ বছর আগে ভারতের নাগরিক বিহারীদের জায়গা দিতে পারলে, তাদের প্রতি নুন্যতম সহনশীলতা দেখাতে পারলে রোহিঙ্গাদের প্রতিও সেটা দেখানোর যোগ্যতা আছে বলে বিশ্বাস করা কি বেশী হবে?
সরকারের বর্তমান অবস্থান ও সম্ভাব্য করণীয়ঃ
এখন পযর্ন্ত সরকারের যে কৌশল রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে-সেটাকে কঠোর হিসাবে নিলেও এর বাইরে সরকারের যাওয়ার সুযোগ কমই ছিলো। সে বিবেচনায় সরকারী এই সিদ্ধান্তকে আপাত যথাযথ বলেই মেনে নিতে চাই। কিন্তু এর স্থায়ী সমাধানে সরকারকে অনেক কাজ করতে হবে। সরকারকে এই রোহিঙ্গাদের মানবিক বিষয়টিকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে হবে, বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জানাতে হবে, বিশ্ব সহযোগিতা প্রাপ্তিতে সব রকমের চেষ্টা চালাতে হবে। সম্ভব হলে আজই, মাকির্ন দূত, ইউরোপীয় দূতসকল, জাতিসংঘের প্রতিনিধি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এবং বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা ও বিশ্ব এনজিও গুলোর প্রতিনিধিদের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখানোর জন্য আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করছি।
১। ব্লগারদের করণীয়ঃ এই আন্তজাতিক সমস্যাটি নিয়ে আমাদের ব্লগারদের কিংবা সামাজিক শক্তি গুলোর দরকার আগার গাঁ-এ জাতিসংঘ ভবনের সামনে বিক্ষোভ করা, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কাযর্কর ব্যবস্থা নেওয়া। কেবল বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জায়গা দিবে জাতিসংঘের তথাকথিত এই বানী শুনে, এমনটা ভাবা দেশ ও সরকার উভয়ের জন্যই বিপদজনক হতে পারে এবং এরকম প্রতিবাদ দ্রত করা দরকার, রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর পর, ঘরবাড়ী হারানোর পর, সমুদ্রের নোনাজলে লাশ ভাসার পর এসব করে লাভ হবেনা। জাতিসংঘ ভবনের সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ মানবতার জন্যই করা দরকার-ধর্মীয় পরিচয় এখানে মূখ্য না হলেও চলবে।
২। সরকারের দরকষাকষির অবস্থানটি শক্ত করতে আমরা সরকারকে সহযোগিতা দিতে চাই-যেন বিশ্বের যেকোনো সংস্থা কিংবা জাতিসংঘের যেকোনো সংস্থার সাথে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়তি সহযোগিতাটা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু অতীতের মতো জাতিসংঘকে বিশ্বাস করে বাংলাদেশ যে বিপদে পড়েছে-সেখানে সরকারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের মিডিয়া, সচেতন নাগরিক, ব্লগার, বুদ্ধিজীবীসহ সকল পক্ষকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিতে সরকারকে সহযোগিতা দিতে হবে-কারণ এটি বিশ্বসমস্যা।
৩। সন্ত্রাসবাদের সাথে কিংবা জঙ্গীবাদের সাথে রোহিঙ্গারা জড়িত হলে আমাদের ক্ষতির সাথে সাথে বিশ্বের জন্যও সেটা মঙ্গলজনক হবেনা, যেমন ভারত পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র চীন কিংবা মায়ানমারের জন্যও সেটা মঙ্গলজনক হবেনা-এটা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষগুলোকে বুঝানো সরকারের দায়িত্ব। সন্ত্রাসবিরোধী কাযর্কলাপ হ্রাসে কোটি কোটি ডলার ব্যয়কারী আমেরিকার উপযুক্ত ভুমিকা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে থাকা উচিত বলে মনে করি। এখানেও সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে, কৌশলী হতে হবে।
৪। ভারত চায়নার যথাযথ অংশীদারিত্ব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে নিশ্চিত করা দরকার-এখানেও আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। জনগণ সরকারের পাশে থাকবে, মমত্ব দিয়েই জনগণ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক থাকবে। সরকারকে এখনই মায়ানমার, চীন ও ভারত সরকারকে এ বিষয়ে অবহিত ও কাযর্কর সমাধানে কাজ শুরু করতে কূটনীতি চালাতে হবে।
৫। রোহিঙ্গারা মুসলিম, তারা বিপদাপন্ন-আমাদের আরব রাষ্ট্রগুলোর বহুমাত্রিক দায়িত্ব আছে এই সমস্যা সমাধানে। দরিদ্র বাংলাদেশের পাশে দাড়াতে পারে আরব রাষ্ট্রগুলো সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে। বাংলাদেশের সাথে কূটনীতিতে অংশ নিয়ে জাতিসংঘ ও অপরাপর শক্তি গুলোকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এখানেও আমরা সরকারকে বলতে চাই, দ্রুত সকল পর্যায়ে যোগাযোগ ও কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা। জনগণ হিসাবে আমরা সরকারের পাশে আছি, রোহিঙ্গাদের পাশেও দাড়াবো
শেষ কথা-রোহিঙ্গাদের প্রতিঃ
বিপদাপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়াতে পারলে, তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, তাদের জান মাল নিরাপদ থাকলে, মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিলে আমরা বরং খুশী হবো। রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে নয়, কেবল মানুষ হিসাবে দেখতে চাই। কাল যদি নিন্মবর্র কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকও বাংলাদেশে জীবন বাচাঁতে প্রবেশ করে তবুও আমরা তাদের জীবন নিতে চাইবোনা, তাদের বিপদকে বুঝার হৃদয় বাংলাদেশের মানুষের থাকবে। এটাও সত্য আমাদের সীমিত সামর্্য, আন্তর্াতিক রাজনীতি,দেশের বর্ত জনসংখ্যা-এসব নিয়েই আমাদের সরকার গুলো যেখানে প্রবল চাপে থাকে, সেখানে বাড়তি জনসংখ্যা ও তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন বাস্তবতা।
একটি অনুরোধঃ
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, সহযোগি সংগঠন, বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক এনজিও গুলোর কাছে আমাদের দাবী-আপনারা আমাদের সরকারকে ন্যায্য সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসুন। আমাদের সীমিত সম্পদের রাষ্ট্রকে এই ভার বহনের আদেশ করার আগে- আমাদের সরকার ও জনগণের কাছে অঙ্গীকার করুন যে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে শেষ পযর্ন্ত আমাদের সাথে থাকবেন, আমাদের সরকারকে সহযোগিতা করবেন। আমরা আমাদের সরকারকে অনুরোধ করবো কৌশল ও মানবিকতা দিয়ে এই সমস্যা সমাধানে দ্রত উদ্যোগ নিন। যে ক্ষতস্থান থেকে রোহিঙ্গা নারী শিশুদের রক্ত ঝরছে-সেখানের রক্তস্রোতটি অন্তত বন্ধ করার বিষয়টি বিবেচনা করুন এবং তা দ্রুত। রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় নয়, কেবল মানুষ হিসাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বিবেচনা করার দাবী করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১২ সকাল ১১:৫৩