জীবনের সব ক্ষেত্রেই কোনোনা কোনোভাবে নিত্যই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধিতে আসে। অধিক দুঃখে রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে, জীবনের কঠিন বাস্তবতায়-‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু।’ অতি আনন্দেও রবীন্দ্রনাথের কাছেই ধর্ণা দেওয়া, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’। শিশুকাল থেকেই আমাদের বাংলাদেশের বাঙালীদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান একেবারে অনিবার্য্য, সেই ছোট নদী চলে বাকেঁ বাকেঁর বাকঁ থেকেই। প্রথম শ্রেনী থেকেই বাধ্যতামূলক রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাথায় প্রবেশ করেছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। কাঠখোট্টাদের কাছে সাহিত্য যখন নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে চরম যন্ত্রণাময়, তখনো অবসরে কিংবা দুঃখ ভুলাতে মন গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের কাছে। প্রেমিকার মন ভুলাতে দুর্জন আমি মিথ্যাকরে বলেছি‘‘আমি নিশিদিন তোমায় ভালবাসি, তুমি অবসরে বাসিও’’। প্রতারণা বুজেও প্রিয়তমা তার বিবাহের আয়োজনের ব্যস্ততার মধ্যে আমাকে লিখেছে, ‘‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও, তারই রথ নিত্য উধাও, জাগাইয়াছে অন্তরীক্ষে হৃদয়ের স্পন্দন-----------বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মেধা, প্রভিতা, যোগ্যতা নিয়ে মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নেই-রবীন্দ্র গবেষকরাই ভালো বলতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাকে যদি কেউ বা কোনো গোষ্ঠি অপদস্ত করতে অগ্রসর হয় কেবল বাণিজ্যিক কারণে, তাহলে রবীন্দ্রপ্রেমী, গবেষকদের দায়িত্ব হবে এর বিরোদ্ধে সোচ্চার হওয়া, প্রতিবাদ করা। চলমান রবীন্দ্র জয়ন্তীতে অবিশ্বাস্যভাবে আমাদের মিডিয়া গুলোর এমন সব আয়োজন দেখে মনে হয়েছে, তারা রবীন্দ্রপ্রেমিক নন, তারা শ্রেফ রবীন্দ্র উপাসক। রবীন্দ্রউপাসক হলেও আপত্তি থাকতোনা-যদিনা তারা ভন্ডামী করে কেবল একদিনের জন্য এভাবে রবীন্দ্রনাথকে অতি আদর করতে গিয়ে নাজেহাল না করতো।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি চ্যানেল আজ সারাদিন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন আদিখ্যাতা দেখালো যে দর্শক হিসাবে আমরা যেমন ক্লান্ত, তেমনি রবীন্দ্রনাথও চেতনার মধ্যে থেকেই বিষাদগ্রস্ত। একটি চ্যানেলে দেখলাম রবীন্দ্রনাথের রান্না বিষয়ক একটি প্রোগ্রাম। যেখানে এক রবীন্দ্ররাধুনী রবীন্দ্ররান্না দেখাবেন। এই রাধুনীগবেষক রবীন্দ্রনাথকে রান্নাঘরে নিয়ে খুন্তিপেটা করছেন-এটা বাণিজ্যিক কারণেই হচ্ছে-বিস্তারিত আর নাই বা বললাম। আগামীদিনে কোনো নরসুন্দর যদি রবীন্দ্রগবেষক হিসাবে আর্ভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথের চুল/কেশকর্তন বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখান-অবাক হবোনা। কিংবা টাইলসের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ আসবে-তাতেও জাতি মহা উপকৃত হবে!!!
বাংলাদেশের চ্যানেল গুলোর যে পরিমান বাড়াবাড়ি, তাতে মনে হয়েছে সে তুলনায় ভারতীয় বাংলা চ্যানেলগুলোর তেমনি নির্বিকার অবস্থা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ কোনোভাবে এই দুই বাংলার দৃশ্য দেখতে পেতেন, তাহলে নিশ্চিত করে বলতে পারি-তিনি বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়ে এসব অতিভন্ডামী বন্ধ করার দাবী জানাতেন। আর ভারতীয় দাদাদের চ্যানেলগুলোর নির্বিকারদৃশ্য দেখে হতাশ হয়ে নাগরিকত্ব বাতিলের চিন্তা করতেন। সনি আট, জিবাংলা, ইটিভি, স্টার জলসা, সঙ্গীত জলসা-এদের কোনো রবীন্দ্রপ্রীতি আমার চোখে পড়েনি। কেবল তারা-বাংলা টিভিতে একটি প্রামান্যচিত্র চোখে পড়েছে-যা সত্যজিতের তৈরী। যাদের নাগরিক, যারা রবীন্দ্রমালিকানার গর্বিত মালিক তাদের কাছে এভাবে রবীন্দ্র উপেক্ষা কষ্ট দিয়েছে। একই সাথে বাংলাদেশে অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে আমাদের চ্যানেলগুলো রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড় বাঙালী সেজেঁ দিনব্যাপী রবীন্দ্রকাটাছেড়ায় অস্থির করেছে তাদের দর্শর্কদের। একই দিনে প্রায় একই সময়ে এই প্রীতিপ্রচারে নাকাল হয়ে কোনো অনুষ্ঠানই ঠিকমতো দেখা হলোনা। চ্যানেল গুলো যদি প্রতিমাসে অন্তত একটি করে নাটকও রবীন্দ্রনাথকে সন্মান করে প্রচার করতো-তাহলে দর্শক হিসাবে আমরা আজকের মতো বঞ্চিত হতাম না, ক্লান্তও হতাম না।
আমাদের রাষ্ট্রের সর্বোচচ পর্যায়েও রবীন্দ্রনাথকে যে পরিমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তার তুলনায় ভারতের সরকার চারআনাও করেছে বলে আমি জানিনা। যদিও দাওয়াত খেতে এসে প্রণববাবু রবীন্দ্রনাথকে ধন্য করেছেন। কিন্তু দুর্জনেরা বলে যে, প্রণববাবু রবীন্দ্রনাথের জন্য আসেননি, পর্দার অন্তরালে বহু অমিমাংসিত বিষয়ে সরকারকে শান্তনা দিতে এসেছিলেন। উদারহস্ত সরকার উজারকরে দিলেও যখন মমতার কাছে ধরাশয়ী, তখন প্রণববাবু ব্যাথানাশক মলম নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে।
একথা আজ নিশ্চিত করে বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথকে যদি বেচেঁ থাকতে হয়, তাহলে তাকে বাচঁতে হবে বাংলাদেশে। পৃথিবীর আর কোথাও রবীন্দ্রনাথের জায়গা আছে বলে মনে করিনা। আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথকে আসতে হবে সত্যের সন্ধানে, আলোকের রশ্মি হয়ে জীবনবোধকে আলোকিত করতে, অর্ন্তগত চেতনাকে আরো মানবিক করতে। চ্যানেলগুলোর রবীন্দ্রউপাসকতা কেবল বাণিজ্যের জঘন্যতম কৌশল, যার ভিতর দিয়ে শিল্পের বিকাশ হয়না, কেবল জন্ম নেয় শিল্পের বিকলাঙ্গ শিশু। ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১২ রাত ৯:০১