-স্যার আসবো?
জমির উদ্দিন নিজের ভাবনাতে ডুবে ছিলেন তখনই স্যার ডাকটা তার কানে এল । ডাকটা শুনতেই মনের ভেতরে একটা অস্বস্তির ভাব বয়ে গেল । তাকিয়ে দেখলো তার সেক্রেটারি নাদিম দরজায় দাড়িয়ে রয়েছে । ভেতরে আসার অনুমূতি চাইছে । এই ব্যাপারটা জমির উদ্দিনের সব সময় ভাল লাগে । এই মানুষ জন তাকে সম্মান করছে, ভেতরে আসার জন্য অনুমূতি চাইছে তারপর সমীহ করে কথা বলছে এসব সে এখন অভ্যস্ত হয়েছে । চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে সে অন্য সবার থেকে একটু উচু পর্যায়ে ভাবা শুরু করেছে । এখন অন্য সবাইকে আর তার নিজের সমান মনে হয় না । মনে হয় সে এখন অন্য সবার থেকে আলাদা । তার অবস্থা অনেক উপরে। অনেক এলিট সে ।
-স্যার আসবো !
আবারও সেই অস্বস্তিটা ফিরে এল মনে ।
-হ্যা এসো । কী ব্যাপার !
নাদিম ঘরে ঢুকেই একটা ফাইল এগিয়ে দিল । তারপর বলল আমির আলী এসেছে স্যার । আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে স্যার !
নাদিম এই মোট তিন বার স্যার বলে ডাকলো তাকে । তিনবারই শব্দটা শুনে সে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করেছে । এই ব্যাপারটা নিয়ে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছে তার ।
নাদিমকে একটা কড়া ধমক দেওয়া দরকার । এতো স্যার স্যার করার দরকার কি বেটার !
নাদিম আবারও বলল, স্যার আমিল আলীকে কি ভেতরে পাঠিয়ে দিব।
একটু অস্বস্তি নিয়েই জমির উদ্দিন বলল, হ্যা পাঠিয়ে দাও !
মিনিট দুকে পরেই আমীর আলী ঘরে ঢুকলো । জমির উদ্দিন নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠলো না ।
আমীর আলী সামনে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, বসবো স্যার?
জমির উদ্দিনের এই অস্বস্তিটা আবারও বাড়লো । আমীর আলী তাকে স্যার বলছে । এবং তার চোখে মুখের একটা কৌতুকের ছায়া দেখতে পাচ্ছে সে । যেন তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে । এই মাস দুয়েক আগে এই আমীর আলি তাকে ভাই বলে ডেকেছিল বলেই এই পুরো দুইমাস সে তার ফাইলটা আটকে রেখেছিলো । চাকরিতে প্রবেশের পর থেকে মানুষের মুখে স্যার ডাকাটা শুনেশুনে সে অভ্যস্ত । যে কেউ যখন তাকে স্যার বলে না ডাকতো তখন তার মনে হত যেন তাকে সে সঠিক সম্মানটা দিচ্ছে না । এটা তাকে রাগিয়ে তুলতো । এতো এতো পড়াশোনা করে এতো এতো কষ্ট করে সে আজকে এই পজিশনে এসেছে আর এরা তার কষ্টটাকে সম্মান করছে না । অবহেলা করছে ! এটা জমির উদ্দিনের মোটেই সহ্য হয় না । যারা যারা তাকে স্যার বলতো না তাদের প্রতি জমির উদ্দিনের মনভাব হত রূঢ় আর তাদের কাজও সে করে দিতো না । কোন প্রকার সাহায্য করতো না । তবে প্রথম থেকে যে স্যার স্যার বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলতো তাদের বেলায় একটু নমনীয় মনভাব দেখাতো ! তার পরেও কেউ কেউ তাকে ভাই ডেকে ফেলতো । তাই একবার বাধ্য হয়ে জমির উদ্দিন নিজের অফিসের বাইরে একটা ব্যানার টাঙ্গিয়ে দিলেন । নিজের পদবী যোগ করে লিখলেন যে তাকে ভাই চাচা ডাকা নিষেধ ।
এরপর অবশ্য সমস্যা একটু সমাধান হয়েছিলো । তাকে আর কেউ ভাই চাচা ডাকতো না । স্যারই ডাকতো !
এভাবেই চলছিলো বেশ ভাল ভাবেই । তারপর মাস খানেক আগে থেকে একটা বিস্ময়কর ঘটনা লক্ষ্য করলো । মানুষজন আশে পাশে সবাই সবাইকে কেমন স্যার বলে ডাকছে । মানুষ আগে দোকানদার কিংবা রিক্সাওয়ালাকে মামা/চাচা বলে ডাকতো তার বদলে স্যার বলে ডাকছে ।
প্রথম প্রথম ভেবেছিলো বুঝি এটা তেমন কিছু নয় কিন্তু পরে আসল ব্যাপারটা খেয়াল করলো । ফেসবুকে একজন একটা ক্যাম্পেন চালু করেছে । সেখানে গনহারে সবাইকে স্যার ডাকতে আহবান জানানো হয়েছে । এবং মানুষ জন সেটাতে সাড়াও দিচ্ছে । গন হারে সবাইকে এখন স্যার বলা হচ্ছে । আজকে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দেখতে পেল তাদের বাসার এক ভাড়াটিয়ার ছেলে তার দারোয়ানকে বল, স্যার দরজা একটু খুলে দিন ।
একই সাথে সেই দারিয়ান তাকে দেখে বলল, স্যার স্লামুয়ালাইকুম !
ব্যাপারটা মনে আসতেই জমির উদ্দিন মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেল । এটা কোন কথা । দারোয়ানকে যে নামে ডাকা হচ্ছে তার মত এতো বড় অফিসারকেও সেই একই নামে ডাকা হচ্ছে । এটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না । আজকে যেমন এই আমির আলী তাকে স্যার ডাকছে তার মনে হচ্ছে তাকে সে মোটেই সম্মান দিচ্ছে না । এর থেকে যে সে গতবারের মত ভাই ডাকতো তাহলেই বুঝি ভাল হত ।
আমির আলী আরো দশবারের মত তাকে স্যার ডাকল । প্রতিবার সেই অস্বস্তিটা ফিরে ফিরে আসতে লাগল ।
এরপরের আরও একটা মাস যেন পুরো দেশ জুড়ে এই ক্যাম্পেইনটা আরো জোরদার হতে শুরু করলো । মানুষ তার আশে পাশের মানুষজনে স্বভাব ভাবে স্যার ডাকা শুরু করলো । মামা ডাকটা একেবারে যেন উঠেই গেল । মামার বদলে স্যার । চাচার বদলে স্যার । সবাই এখন কেবল স্যার ডাকে । এমন কি পাড়ার ভিক্ষুককেও ভিক্ষা না দেওয়ার সময় বলে, স্যার মাফ করেন । স্যার অন্য খানে দেখেন।
এটা নিয়ে অবশ্য কারো কোন সমস্যা ছিল না । সবাঈ এটাকে বেশ উপভোগ করতে শুরু করলো । কেবল জমির উদ্দিনের মনে শান্তি নেই । সে কিছুতেই এখন আর স্যার ডাকটা সহ্য করতে পারে না । যে কেউ তাকে স্যার ডাকলেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় । তার এখন কেবল মনে হয় এতো পড়া শোনা করে এতো বড় চাকরি সে অর্জন করলো অথচ মানুষজন তাকে স্যার ডেকে তাকে অপমান করছে । তাকে যথাযত সম্মান দিচ্ছে না ।
বাধ্য হয়ে সে আবারও নিজের কেবিনের বাইরে একটা নোটিশ টাঙ্গালো । সেখানে লেখা ''স্যার ডাকা নিষেধ''
এই লেখার আইডিয়া উৎস
ছবি উৎস