আগের দিনের গল্পের পর থেকে শুরু করছি ।
রাতে খাওয়া শেষ করে আমাদের গ্রুপ লিডার ঠিক করলেন যে গতদিনের মত আমাদের সকাল সকাল রওয়ানা দিতে হবে । তবে আজকে আমার ভোর তিনটার সময় ওঠার দরজার নেই । কারণ পথে আমাদের আর্মির সাথে দেখা হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই ।
সকাল বেলা তার একটু দেরি করে আমরা বের হলাম । তখনও যদিও অন্ধকার । আজকে আমাদের ভেতর থেকে একজন পাড়াতেই রয়ে গেল । কালকে হেটে তার শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে । আমরা মোট ৫জন এবং সাথে আমাদের গাইড রওয়ানা দিলাম ভোর সোয়া ৫টার দিকে ।
পাড়া থেকে বের হয়েই আমরা কিছু দুর যাওয়ার পরেই আমাদের গাইড বলল আমরা কেউ যেন কোন কথা না বলি । কারণ আর্মির ক্যাম্প না থাকলেও বিজিবির ক্যাম্প আছে । আমরা একেবারে নিশ্চুপ ভাবে হাটতে শুরু করি । আমাদের মনে যদিও ভয় ছিল না । কারণ যদি বিজিবির হাতে ধরা পড়ি তবে খুব একটা বড় কিছু হবে না । বিজিবি কেবল আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিবে । তারপরেও একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিলো মনে ।
এমন একটা স্থান এল যেখানে বিজিবি ক্যাম্পের বেড়া দেখা যাচ্ছিলো । যদিও সেখান থেকে কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো না । যদি এই সময়ে কেউ এই বেড়ার ওপাশে চলে আসে আমাদের দেখে ফেলবে কোন সন্দেহ নেই । আমরা দ্রুত পায়ে জায়গাটা এগিয়ে চললাম । একটা সময়ে আমরা নিরাপদ স্থানে চলে এলাম ।
এরপর মূলত আমাদের পাহাড়ে ওঠা শুরু হল । আমরা এতো সময়ে বলতে লেগে তুলনা মূলক ভাবে সমতল এলাকাতেই হেটে পার হয়েছি । ঘন্টা খানেকের উপরে হাটার পরে আমরা পাহাড় চড়া শুরু করলাম ।
দুই বছর আগে যে পথে আমরা যোতলংএ উঠেছিলাম এই বার খেয়াল করে দেখলাম যে আমরা অন্য পথে যাচ্ছি । এমনটা আসলে স্বাভাবিক ব্যাপার । সব সময়ই পাহাড়ে ওঠার পথা গাইডেরা পরিবর্তন করে ।
তবে একটু পরেই সেই আগের ফিলটা পাওয়া শুরু করলাম । একের পর এক পাহাড়ে উঠছি তো উঠছি যেন শেষ নেই । পাহাড়ের এই রাস্তা গুলোতে হাটতে আমার বরাবরই পছন্দে । দুর দুরান্তে আসলে কোন মানুষজনের দেখা নেই । সামনে কাউকে যে দেখতে পাবো এমন কোন সম্ভবনা নেই । কেবল পাহাড়ে কখনো উপড়ে ওঠা আবার কখনো নিচে নামা । এভাবে এগিয়ে চলতে হবে ।
আজকে আমাদের টিমের সবাই বেশ চটপটে । কাউকে খুব বেশি পেছনে ফেলে যেতে হচ্ছে না ।
আমি সব সময় এগিয়ে থাকি । আমার থিউরি হচ্ছে যদি আমি খুব দ্রুত হাটতে পারি তাহলে আমি আগে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাই । ধরেন একটা পাহাড়ে উঠতে কারো ২০ মিনিট লাগে । আমি সেটা দ্রুত হেটে ১০/১২ মিনিটে উঠে পড়ি । তারপর সেখানে গিয়ে ৮ মিনিট বিশ্রাম করি । এই রকম করেই পাহাড়ে চড়তে ভাল লাগে আমার ।
আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা হেটে চললাম । কখনো উচু আবার কখনো নিচু । এই উঠছি আবার এই নামছি । তবে এবার পথ আগের বারের থেকে একটু সহজ ছিল । আমরা যখন আবারও যোতলংয়ের চুড়ায় পৌছালাম তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে এগারোটা । এতো জলদি যে উপরে উঠে যাবো বুঝতে পারি নি ।
চুড়ায় বসে সময় কাটালাম কিছু সময় । সাথে করে নিয়ে আসা খাবার খেলাম । ছবি তুললাম । সামিট নোট লিখলাম । তারপর আবারও রওয়ানা দিলাম । তবে এবার আমরা ফেরার পথে নয় বরং অন্য পথে যাবো । আমরা যাবো এবার আয়ানত্লাংয়ের দিকে । আয়ানত্লাংয়ের চুড়াটা মূলত যোতলং হতে যোগীর যাওয়ার পথের মাঝের একটা চুড়া ।
এই যোতলং হতে আয়ানত্লাংয়ের দিকে যাওয়ার পথটা সব থেকে বেশি দুর্গম । এতো সময় আমরা পাহাড়ি পথেই এসেছি কিন্তু এই পথ সম্পূর্ন বাঁশ ঝাড়ের পথ । তাও আবার বড় বাশ ঝাড় ন সব ছোট ছোট পথ । আমার পরনে ছিল হাফ হাতা টিশার্ট । এই কারণ হাতে প্রচুর খোঁচা খেতে শুরু করলাম । রাস্তা মাঝে এমন হচ্ছে যেখানে আমাদের হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে হচ্ছে । পুরোটা পথ আমাদের জন্য বেশ দুর্গম ছিল । ছিল কষ্টের । এখানে কাঠিন্যের মাত্রা আরও একটু বেশি ছিল গরমের কারণে । যোতলংয়ের ওঠার সময়টা ছিল সকালের দিকে তাই রোদের তেজ ছিল অনেক অল্প । তবে এখন তীব্র তেজে সূর্য দিল মাথার উপরে । গরম ছিল অনেক ।
তবে সকল কষ্টের যেমন শেষ আছে এই যাত্রারও শেষ হল । আমরা আয়ানত্লাং পৌছে গেলাম । ঘড়িতে সময় তখন দুইটা ৩৫। সেখানে একই ভাবে ছবি তুলে বিশ্রাম নিয়ে আবারও যাত্রা শুরু করলাম ।
এবারও কিন্তু যে পথে এসেছি সেই পথে ফিরছি না । আমরা গতদিন যোগীতে গিয়েছিলাম । আজকে এই আয়ানত্লাং থেকে যোগীতে গিয়ে হাজির হব । এখানে একটা রিজ লাইন রয়েছে । আমরা সেই পথেই যাবো । এখানেও পথ ঠিক আগের মতই দুর্গম আর বিরক্তিকর । আমরা এই নামছি তো এই উঠছি ।
গতদিনের পোস্টে বলেছিলাম যে পাহাড় কেটে পথ বানানো হচ্ছে । আমাদের মূল লক্ষ হচ্ছে সেই পথেই ওঠা । যোতলংয়ে ওঠার পর থেকে পাহাড় কাটা মেশিনের আওয়াজ আমাদের কানে আসছিলো । সময় যত এগিয়ে যেতে লাগলো সেই আওয়াজ ততই বাড়তে লাগলো । আমরা আসলে তত কাছে চলে আসছিলাম ।
একটা সময়ে অবশ্য সেই আর সেই আওয়াজ হল না । অর্থ্যাৎ কাজ শেষ করে ওরা চলে গেছে । আমরা যখন সেই মাটির রাস্তার নিচে পৌছালাম বিকেল চারটার মত বাজে । এখানেই সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার । আমরা যে পথে পাহাড়ে উঠবো বলে ঠিক করেছিলাম সেই পথটাই মাটি ফেলা হয়েছে আজই । মাটি এখানে একেবারে ঝুড়ঝুড়ে । আর গাছপালা কেটে, ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে । আমরা এখন উপরে উঠবো কিভাবে?
আমাদের গাইড বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলো । কারণ উঠার কোন রাস্তা নেই । সে পথ খুজতে লাগলো । আমি তার পেছন পেছন উঠতে শুরু করলাম । সেই ভেঙ্গে উপড়ে পড়া গাছ বেয়ে উপরে উঠছি । বুকের ভেতরে ধুপধুপ করছে । যে কোন সময় গাছ নড়ে উঠতে পারে আমরা নিচে পরে যেতে পারি । একটা সময়ে একেবারে কাছে চলে গেলাম কিন্তু উপরে ওঠার আর কোন রাস্তা নেই । নেই ধরার কোন কিছু যা ধরে আমি উপরে উঠতে পারি । তবে গাইড খুব চটপটে । সে এক লাফে উপরে উঠে গেল। তার পা পিছলে গেলে কয়েকবার । মাটি সরেও গেল । তবে তার ক্ষিপ্ততা অনেক বেশি । পা চালিয়ে উপরে উঠে গেল সে । তারপর আমাকে উঠতে নির্দেশ করলো । উপরে সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যদিও তা বেশ দুরে । আমাকে এখন বেশ কিছুটা সময় কোন কিছু না ধরেই যেতে হবে ।
আমি অনেক কয়বারই পাহাড়ে চড়েছি । পথ ছিল দুর্গম কিন্তু সব সময়ই ধরার কিছু না কিছুই ছিলই । তাই ভয় পাই নি কখনই । তবে এইবারের টা একেবারে আলাদা । এটার সাথে আসলে কোন কিছুর তূলনা চলে না । আমি উপরওয়ালার নাম দিয়ে উঠে পা বাড়ালাম । ভাগ্য ভাল যে গাইড আমাকে ধরেই টান দিল । একবার পা পিছলে গেলেও টানের কারণে উপরের দিকেই উঠে গেলাম ।
যখন উপরে উঠলাম তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে সত্যি সত্যি উঠে গেছি নিরাপদে । সুস্থির হতে বেশ সময় লাগলো । আমাদের গাইড আবার নিচে নেমে গেল তারপর একে একে সবাইকে তুলতে লাগলো । আমি উপরে ছিলাম তাদের টেনে তোলার জন্য । এই জন্য তাদের জন্য ব্যাপারটা আমার থেকেো একটু সহজ ছিল । এক আপু ছিল ডাক্তার । আমার থেকেও ১৫ বছরের মত বড় । যখন তাকে টেনে উপরে তুললাম । আমি বুঝতে পারছিলাম সে রীতি কাঁপছিলো । জীবনেও সে এমন কিছুর সাম্মুখিন হয় নি । নিচের ছবিতে দেখতে পারছেন আমরা সামনের ঐ নিচ থেকেউ এই পথে উঠে এসেছি ।
আজকের গল্প এখানেই শেষ হোক । বাকিটা আগামী পর্বে শেষ করা যাবে ।