এক
ক্যাম্পাসে সামনের দিকটা প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত ঝমজমাট থাকে । অন্য দিকে পেছনের দিকটা যেন সন্ধ্যা হতেই নিঝুম হয়ে যায় । অবশ্য না হয়ে উপায়ও নেই । ক্যাম্পাসের পেছনটা এই পাশ কেবল গাছ-গাছালি আর বেশ কিছু পুকুর আছে । এখানে বোটানী আর ফিশারী ডিপার্টমেন্টের প্রাকটিক্যাল ক্লাস হয় । দুপুর থেকে বিকেলের দিকে কিছু কপোত-কপোতি এখানে বসে বসে প্রেম করে । কিন্তু সন্ধ্যার পরপরই জায়গাটা একদম ফাঁকা হয়ে যায় !
আমি দাড়িয়ে আছি একটা পাতাবাহার গাছের আড়ালে । আমার হাতে দুইটা ইটের টুকরো । ইটের টুকরো গুলো আমার হাতে বেশ ভাল ভাবেই ফিট হয়ে গেছে । আমি ঠিক যেভাবে ক্রিকেট বল ধরে সেভাবে । আসার সময় সত্যি বলতে কি আমি আর অন্য কিছু পাই নি । নিনা কাছ থেকে মেসেজ পাওয়ার পরে আমি আর মোটেই দেরি করতে পারি নি । কেবলই মনে হয়েছে ওর সাহায্য দরকার ।
সোজা চলে এসেছি এখানে । এটা ক্যাম্পাসের শেষের দিক । একটু এগিয়ে গেলেই পেছনে ক্যাম্পসের সীমানা শেষ । এরপরই কিছু পুরানো বাসা আছে । কিছু মানুষ সেখানে বাস করে তবে বেশির ভাগ বাসাই ফাঁকা আর পরিত্যাক্ত। নিনার বাসা ঠিক এখানেই । এখানে একা একটা বাসা নিয়ে থাকে ও । পুরানো হলেও মোটামুটি অন্যান্য বাসা থেকে সেটা বেশ ভাল । আমি বেশ কয়েকবার গেছি সেখানে ।
আমার একটু সামনেই আমি চারজন লোককে দেখতে পাচ্ছি । তিনজন পুরুষ একজন নারী । দুই পুরুষের উচ্চতা মাঝারী আর বাকি একজনের গায়ের গঠন দৈত্যের মত । লম্বায় কম করে হলেই সাট ফুট তো হবেই । গায়ে স্বাস্থ্যও তেমন । ছোট খাটো একটা দৈতই বলা চলে । আমি আবারও আমার হাতের ইটের দিকে তাকালাম । দুটো ইট দিয়ে কোন মতে দুজনকে ঘায়েল করা যাবে কিন্তু এই তিন নাম্বারকে কোন ভাবেই কাবু করা যাবে না । মেয়েটা আর কেউ না, নিনা নিজে ।
আমি চাঁদের আলোতে চারজনকে খুব ভাল করেই দেখতে পাচ্ছি আড়াল থেকে । কিভাবে এগোনো ঠিক হবে সেটা নিয়ে ভাবছি । দুইজন মাঝারি উচ্চতার মানুষের একজন নিনা শক্ত করে ধরে রেখেছে । একটু আগেই নিনা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু এখন আর করছে না যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে । শান্ত ভাবেই দাড়িয়েই আছে ।
নিনা আবারও চিৎকার করে বলে উঠলো
-আমাকে ছেড়ে দাও !
সামনে সেই দৈত্যের মত লোকটা যেন হিসহিস করে উঠলো । বলল
নিনা প্রায় কেঁদে উঠলো । বলল
- প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও । আমি কারো কোন ক্ষতি করি নি কোন দিন । তোমরা যা করছো সেটা ভুল !
-চুপ থাকো । অনেক কথা বলেছো । আর না । সামনে পূর্নিমা । একেবারে উপুযুক্ত সময় । তুমি জানো তোমাকে নিয়ে আমরা কি করবো !
এর বলতে বলতে লোকটা নিজের কোমড় থেকে কিছু বের করে আনলো লম্বা মত । চাঁদের আলোতে সেটা আমার চিনতে মোটেও কষ্ট হল না । একটা ছুরি । আমরা করবানীর ঈদের সময় যে লম্বা ছুরি দিয়ে গরু জবাই করি সেটা থেকে অল্প একটু ছোট হবে । সেটার ফলাটা চাঁদের আলোতে আবারও চকচক করে উঠলো ।
নাহ ! আর দেরি করা যায় না ।
নিনাকে বাঁচাতে হবে ।
আমি পাতাবাহারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম । লোক গুলো এখনও আমাকে দেখতে পায় নি । আসলে ওরা নিনা কে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে আমার দিকে লক্ষ্য দেওয়ার সময় নেই । হাতের দুটি ইটের ভেতরে একটা ইট নিয়ে প্রস্তুতি নিলাম । সামনে লাভ হবে কি না আমি জানি না ! তবুও চেষ্টা করতে হবে !
আমি আমাদের ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট বোলার । অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ক্রিকেট টিমগুলো আমাদের টিমের আর কিছু দেখে ভয় না পেলেও আমার বোলিং দেখে সবাই ভয় পায় । আরেকটা জিনিস তারা খুব ভাল করেই জানে । আমার হাতে নিশানা কখনও ভুল হয় না । যখনই বল আমার হাতে যায় কিংবা আমার দিকে যায় তারা কেউ ভুলেও রান নেয় না । কারন আমি থ্রো করেছি আর সেটা স্ট্যাম্পে লাগে নি, আমার মিস হয়েছে এমন কোন দিন হয় নি । কেবল এই ভরসা নিয়েই আমি এই ইটের চাকা নিয়ে নিয়ে এখানে এসেছি কিন্তু মানুষ তিনজন থেকে একটু দ্বিধা কাজ করছিলো । কিন্তু এখন আর দেরি করে লাভ নেই ।
নিজের কাছেই একটু কেমন যেন লাগলো । জীবনের প্রথমবার থ্রো করার আগে আমি একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম । কিন্তু সেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য । এরপরেই শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে ছুড়ে দিলাম নিনাকে ধরে রাখা লোকটার মাথা বরাবর ।
সময়টা যেন স্লো হয়ে গেল । ধীরে ধীরে ইটের অংশ টুকু উড়ে চলল । আমি ঠিক ঠিক দেখতে পেলাম সেটা এগিয়ে যাচ্ছে লোকটার দিকে । এবং জানি কোথায় লাগবে । কয়েকটা মুহুর্ত তারপরই কোৎ করে একটা আওয়াজ হল । টুকরোটা যে মাথায় লেগেছে সেটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না । নিনাকে ধরে রাখা লোকটা মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ করারও সুযোগ পেল না । পরে গেল মাটিতে ।
সামনে দুজন লোকও এমন ভাবে চমকে গেল যে কি করবে কয়েক সেকেন্ড বুঝতে পারলো না । নিনার দিকে তাকিয়ে দেখি সে নিজেও খানিটা হতবিহব্বল হয়ে গেছে । বুঝতে পারছে না কি হল !
দাড়িয়ে থাকা তিনজনই আমার দিকে ঘুরে তাকিয়েছে ততক্ষনে । সময় থেমে গিয়েছিলো আমার জন্য কিন্তু সেটা মুহুর্তেই ফিরে এল । দৈত্যের মত লোকটা বলল
-কে ওখানে ?
আমি কোন কথা না বলে আরও একটু সামনে এগিয়ে এলাম । আমার হাতে অন্য ইটের টুকরাটা তখনও রয়েছে ।
লোকটা আবারও বলল
-কি চাই এখানে ?
আমার বুকের ভেতরে যদিও একটু ভয়ভয় করছে তবুও সেটা আমলে দিলাম না । আমি জানি আমি খুব একটা এগিয়ে যেতে পারবো না । দুজনের বিপরীতে আমি একা কিছুই করতে পারবো না । আর এখন ওরা দুজনেই সজাক । ইট দিয়ে খুব একটা সুবিধাও হবে না ।
আমি সেসব আমলে না নিয়ে বলল
-তোমরা এখানে কি চাও ! নিনাকে ছেড়ে দাও । কোন ঝামেলা হবে না !
-ছেড়ে দিব ?
লোকটা এমন ভাবে কথাটা ভলে উঠলো যেন আমি হাসির কোন কথা বলেছি । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এখনই এখান থেকে চলে যাও তাহলে প্রাণে মারবো না কিন্তু একটা মুহুর্ত যদি বেশি থাকো তাহলে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না !
লোকটার কন্ঠটা ঠিক বাঙ্গালীদের মত না । কেমন একটা ইংলিশ ইংলিশ টান আছে । স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে বাংলা শিখেছে । চাঁদের আলোতেও তার লাল ফর্শা ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আর শরীরটাও মাশাল্লাহ ! আমাদের দেশীও পুরুষেরা এমন হয় না মোটেও । ইউরোপের কোন দেশ থেকে এখানে এসেছে ।
কিন্তু কেন ?
আর নিনাকেই বা কেন মারতে চাচ্ছে !
আচ্ছা কদিন আগে ঐ মেয়েটাকেও কি এরা মেরেছে । পত্রকায় লিখেছিলো একটানে কেউ গলা কেটেছে ধারালো কিছু দিয়ে । এই ছুরি টা দিয়েই কি । এটা দিয়ে এখন আমার নিনার গলাও কাটবে ! নিনা ঐ মেয়েটার লাশ দেখে বেশ বিচলিত হয়ে গেছিলো ।
লোকটা বলল
-ওয়েল । ইয়োর টাইম ইজ ওভার ! রোলে, এইটাক ধরে রাখো আমি ওর ব্যবস্থা করে আসছি ।
বলেই লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এল । আমি ইটের টুকরাটা হাতে নিতেই লোকটা হেসে বলল
-এটা দিয়ে তুমি আমার সাথে লড়বে ? কি হবে এটাতে ?
-তোমার হবে না সত্যি । কিন্তু ওর হবে !
আমি রোলে নামার লোকটার দিকে তাকালাম । লোকটা তখন নিনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । তার পূর্ন মনোযোগ তখন নিনার দিকে । আমার ইটটা যে ওর দিকে কখন এগিয়ে গেল সে সেটা টেরই পেল না । আগের জনেরটা লেগেছিলো মাথার পেছনে । রোলে নামের লোকটার লাগলো ঠিক নাক আর চোখের মাঝে । এতো জোড়ে ভোতা আওয়াজ হল যে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গেলাম ।
আর দেখার দরকার ছিল না । রোলে কদিন আর ঠিক মত চোখে দেখতে পাবে না । চিৎকার করতে করতে সে মাটিতে পড়ে গেল । আমি নিনার দিকে জোরে চিৎকার করে বলল
-নিনা তুমি দৌড় দাও । আমি এটাকে দেখি কতক্ষন আটকে রাখতে পারি !
দৈত্য আর নিনা দুজনেই খানিকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । দৈত্য ভাবতে পারি নি যে আমি ওকে আক্রমন না করে রোলের দিকে ইট ছুরে মারবো আর নিনার পালিয়ে যাওয়ার পথ করে দেব । নিনাও সেটা ভাবতে পারে নি ।
দৈত্যের মুখটা রাগে বিকৃত হতে দেখলাম ।
-এবার তোমার যাওয়ার পালা । তারপর ঐ ডায়নিটাকে ধরবো । ও বেশি দুর যেতে পারবে না !
আমি নিজেও তাই জানি । ঐ ছুরি আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই । আমি দুই হাত সামনে নিয়ে ঠেকানোর প্রস্তুতি নিয়েছি । দৈত্য আমার দিকে এগিয়ে আসছে । মাথার ভেতরে ঝর চলছে । একবার মনে হল পেছনে ঘুরে দৌড় দেই কিন্তু সেটা করলেো খুব একটা লাভ হবে না মনে হচ্ছে । আমি সামনা সামনা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলাম !
তখনই আমার চোখ গেল নিনার দিকে । নিনা নিজের পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট ছুরি বের করে আনলো । সেটা দিয়ে নিজের হাতের তালু কেটে রক্ত বের করলো । আমার চোখ তখনও নিনার দিকে । এদিকে দৈত্য যে আমার একদম কাছে চলে এসেছে সেদিকে লক্ষ্য নেই ।
দৈত্য যখন ছুরিটা আমার মাথা বরাবর চালাবে তখনই একটা অবাক করা কাজ হল । দেখতে পেলাম নিনার সেই কাটা হাতের রক্ত থেকেই কিছু একটা খুব দ্রুত এগিয়ে এল দৈত্যের দিকে । এক ফোটা থেকে একটা স্রোতের মত, মুহুর্তের ভেতরেই। সমুদ্রে যেমন করে ঢেউ আসে ঠিক সেরকম করে ।
আমার কাছে পৌছানোর আগেই দৈত্যকে ঘিরে ফেলল পানি স্রোত । একেবারে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল । তারপর হঠাৎ করেই স্থির হয়ে গেল আমার কয়েক হাত দুরে ।
চোখের সামনে কি হল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না । নিনা যখন আমার সামনে এল তখন যেন বাস্তবে ফিরে এলাম । তাকিয়ে দেখি দৈত্যটার মুখের ভাব কেমন রাগান্বিত হয়ে আছে । সে ক্রোধে ফেলে পড়লো কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্য । আস্তে সেটাও জমে গেল । আমি কাছে গিয়ে হাত দিয়ে দেখি সেখানে নিরেট বরফ জমে গেছে, একটু আগেও সেখানে পানি ছিল । সেই সাথে জমিয়ে দিয়েছে দৈত্য কেও।
নিনা আমার কাছে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর বলল
-তুমি না আসলে আজকে সত্যিই সত্যি আমি মারা যেতাম ।
-আর তুমি না থাকলে আমি শেষ হয়ে যেতাম ।
নিনা হাসলো । তারপর বলল
-হয়েছে । চল এখন থেকে । এখানে আর থাকা নিরাপদ নয় । এখানে কেন শহরে থাকাটা নিরাপদ নয় !
-কোথায় যাবা ?
-জানি না তবে এখান থেকে দুরে । চল ।
-আমিও !
-তুমিও । তুমি আমাকে বাঁচিয়ে ওদের শত্রু হয়ে গেছো !
-কাছের শত্রু হয়েছি ? এরা কারা ? আর তোমাকে মারতে চায় কেন ?
নিনা কোন কথা না বলে হাটতে লাগলো পেছনে দিকে । ওর বাসাটা ওদিকেই ।
আমি ওর পেছন পেছন দ্রুত হাটতে বলললাম
-আচ্ছা কদিন আগে লিলিনের যে লাশ আমরা দেখেছিলাম । এটার পেছনেও এরা ছিল ?
নিনা বলল
-হুম ! এরাই ছিল !
-এরা কারা ?
-ইনফিউডেল ! ডেভিলস ওয়ারিওর বলে নিজেদেরকে ! এদের প্রধান কাজ হচ্ছে উইচ হত্যা করা !
আমি আর কথা বাড়াই না ! নিনার পেছনে হাটতে থাকি । ওর বাসায় পৌছাতে মিনিট তিনেক লাগে আমাদের । এর আগেও বেশ কয়েকবার ওর বাসায় এসেছি আমি কিন্তু আজকের পরিস্থিতি একদম ভিন্ন ! সামনে আমাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে । সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি । কেমন যেন একটা ভয়ভয় করছে ।
কারা এই ইনফিউডেল !
দুই
নিনাকে চিনি আমি হঠাৎ করেই । হঠাৎ করেই একদিন দেখা হয়ে গেল আমাদের । আরও ভাল করে বলতে গেলে আমি ওকে দেখতে পেলাম । ক্যাম্পাসের এই পিছন দিকটা আমার কাছে বেশ ভালই লাগতো । মাঝে মাঝে যখন ক্লাস থাকতো না, তখন আমি নিরিবিলি এখানে এসে বসতাম । সময় কাটাতাম । ক্লাসের হইচই আমার ঠিক ভাল লাগতো না !
সেদিনও বসে ছিলাম । আর চারিপাশের জুটিদের দিকে তাকাচ্ছিলাম । তারা কি করছিলো সেটা দেখছিলাম । আমার মজাই লাগছিলো । ওরা অবশ্য আমার দিকে খেয়াল করছে না । অত খেয়াল করার সময় কোথায় ওদের ।
হঠাৎই একটা হট্টগোল শুনতে পাই । আরেকটু উঠে গিয়ে খেয়াল করি সেটা আসছে আমাদের ক্যাম্পাসের পাশের গ্রাম থেকে । ক্যাম্পাসের শেষে যে বসতিটা আসে সেদিকেই এগিয়েই আসছে । কোন মহিলার কান্নার আওয়াজ । আমি আস্তে আস্তে আওয়াজটা শুনতে লাগলাম । এমন একটা ব্যাপার যেন সেটা একটু একটু বেড়েই চলেছে ।
ঠিক তখনই আমার ক্যাম্পাসের দিক থেকে একটা মেয়েকে বের হয়ে আসতে দেখলাম । সে সোজা আমার পাশ দিয়ে গাছ পালার ভেতরে দিয়ে হাটতে লাগলো দ্রুত । আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটাও আমার মত সেই হট্টগোল শুনে সেদিকে যাচ্ছে ।
কেমন জানি কৌতুল হল । আমিও মেয়েটার পেছন পেছন এগুলোতে লাগলাম । যতই এগোতে শুরু করেছি ততই আওয়াজটা বাড়তে লাগলো । একটা সময় আমি মহিলাটাকে দেখতে পেলাম । দুই হাতে ধরে একটা ৪/৫ বছরের ছেলেকে ধরে আছে । দৌড়ে আসছিলো । তার পেছনে আরও কিছু মানুষ । আমরা ততক্ষনে বসতির কাছে চলে এসেছি ।
ক্যাম্পাসের খুব কাছেই এই ছোট্ট বসতিটা । একটু দুরে আরও বড় একটা গ্রাম আছে । এখানে ঘর গুলো একটু পুরানো পুরানো । অল্প কয়েকটা পরিবার এখানে থাকে । আমি আরও কাছে যেতেই দেখলাম আমার সামনে যে মেয়েটা গিয়েছে মহিলাটা তার কাছেই এসেছে ।
চিৎকার করে কান্না করতে করতে যা বলল তার অর্থ হচ্ছে তার ছেলেটা পুকুরে পরে গিয়েছিলো এখন আর কিছুতেই জ্ঞান ফিরছে না । মেয়েটি ওকে শান্তনা দিয়ে বলল যে ও যা পারবে করবে !
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না । মেয়েটা কি ডাক্তার নাকি ? নাহ তাতো হওয়ার কথা না । এই তল্লাতে তো কোন মেডিক্যাল কলেজ নেই নেই কোন হাসপাতালও । আমাদের ক্যাম্পাসের একটা ছোট ক্লিনিং আছে সেটা যে ডাক্তার আছেন তিনি তো একজন বয়স্ক মানুষ । আর এই মেয়েটাকে তো আমাদের ক্যাম্পাসের কেউ হবে । কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে । এ কি করবে ?
আমি কৌতুহল দমাতে না পেরে দাড়িয়েই রইলাম । কিন্তু আমার জন্য সত্যি অন্য কিছু অপেক্ষা করছিলো । মেয়েটার হাতের চাবি দেখেই বুঝলাম মেয়েটা এখানেি থাকে । সব গুলো ঘর থেকে যে ঘরটা অপেক্ষাকৃত ভাল সেটাট সামনে গিয়ে সে তালাটা খুলল । তারপর ভেতরে চলে গেল । আমি আর মহিলা সহ সবাই দাড়িয়ে রইলাম বাইরেই । একবার মনে মহিলাকে বলি যেন তিনি দ্রুতই ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় । ছেলেটা হয়তো মরে যাবে । কিন্তু ছেলেটার চেহারা দেখেই মনে হল সেটা অনেক দেরি হয়ে গেছে । ছেলেটা যদি ইতি মধ্যেই মারা না গিয়ে থাকে তাহলে শহরে যেতে যেতে নিশ্চিত ভাবেই মারা যাবে ।
মেয়েটা ফিরে এল কয়েক মিনিট পড়ে । হাতে একটা বড় গামলা জাতীয় কিছু । সেখানে বিভিন্ন জিনিস পত্র । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি এখানে কি করছেন ?
-কিছু না ।
-তাহলে চলে যান !
-কেন থাকলে কি সমস্যা ?
-সমস্যা আছে । প্লিজ চলে যান !
-নাহ ! আমি যাবো না ! আমি দেখবো আপনি কি করেন !
মেয়েটা এবার অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনারা সবাই এখান থেকে চলে যান । এতো মানুষ থাকলে আমি কাজ করতে পারবো না ।
কিন্তু কারোই যাওয়ার লক্ষ্যন দেখলাম না ! মেয়েটি তখন বাচ্চা কোলে মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল
-রুহিলা আমার কিন্তু কিছু করার নেই । বেশি মানুষ থাকলে কাজ হবে না বলে দিলাম ।
বলতে না বলতেই রুহিলা নামের মহিলাটা অকথ্য ভাষা গালাগালি শুরু করে দিল । দেখতে দেখতে জায়গা পরিস্কার হয়ে গেল । আমার দিকেও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখন মেয়েটি বলল
-উনি থাকুক ! দেখতে যখন চেয়েছে ।
মেয়েটা আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে তারপর নিজের কাজে মন ছিল । আমি খানিকটা অবাকই হল ব্যাপারে । আমার থাকা টা মেয়েটি এতো স হজে নেমে নিল কিভাবে ।
আমাদের ঠিক পাশেই একটা ছোট কূল গাছ ছিল । আমাকে সরে যেতে বলল সেখান থেকে । তারপর গামলা থেকে একটা ছোট বস্তা বের করে আনলো । তারপর কুল গাচ টা কে ঘিরে সেই বস্তা থেকে কিছু ঢালতে লাগলো ।তাকিয়ে দেখি সেখান থেকে ছাই জাতীয় কিছু পড়ছে । এভাবে ঢেলে ঢেলে একটা সার্কেল আকলো । তারপর কুল গাছটার গোড়ায় গালমা থেকে আরও বেশ কিছু জিনিস পত্র ঢালতে লাগলো । আমি কেবল অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম ।
মানে মনে ভাবতে লাগলাম আসলে মেয়েটা কি করতে যাচ্ছে । যখন মনে হল সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে তখন রুহিলার কাছ থেকে ছেলেটি কোলে নিয়ে সেই সার্কেলের ভেতরে রেখে দিল । এরপর মেয়েটি সেই সার্কেল ধরে হাটতে লাগলো । একবার দুবার তিনবার .... এভাবে চলতেই থাকলো ....
আমি ৩০ পর্যন্ত গুনে, গোনা বাদ দিলাম । আরও কতক্ষন মেয়েটা এভাবে হাটবে আমি জানি না । একবার মনে হল এখানে কিছু হবে না । কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ততক্ষনে স্যার ক্লাসে চলে এসেছে । এখান যাওয়া আর না যাওয়া সমান। দেখি কি হয় । কতক্ষন অপেক্ষা করেছিলাম আমি নিজে বলতে পারবো না । পেন্ডুলামের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মানুষের যেমন ঝিমুনি চলে আসে আমারও বারবার ঐ সার্কেল ধরে ঘুরতে থাকা মেয়েটিকে দেখে কেমন যেন ঝিমুনি চলে এল । যখন ঝিমুনি কাটলো তাকিয়ে দেখি ছেলেটি একটু একটু নড়ছে । চোখের সামনে একটু পরেি ছেলেটি উঠে বসলো ।
আমি চোখ কঁচলে কিছুটা সময় কেবল তাকিয়ে রইলাম । আমার নিজের চোখ কে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । বারবার নিজের মন কে বললাম এমনটা হতে পারে না । কোন ভাবেই এমনটা হতে পারে না । আমি নিশ্চয়ই ভুল দেখছি । অথবা ছেলেটির তেমন কিছুই হয় নি । এমনি একটু পরে ছেলেটি ভাল হয়ে গেছে ।
কিন্তু তখনই আরেকটা জিনিস দেখলাম অবাক করার মত । যে কূল গাছ টা আমি দেখছিলাম সবুজ পাতায় ভরা সেগুলো সব শুকনো হয়ে গেছে । তাকিয়ে দেখলেি বোঝা যাবে গাছ টাতে আর প্রাণ নেই । মারা যাবে কিছুদিন পরেই । অথচ আমি একটু আগেই দেখেছি গাছ টা ভাল ছিল । সতেজ ছিল ।
কি হল এমন ?
কিভাবে হল !
না না ! কোন ভাবেই এটা হতে পারে না ! আমি কেবল অবিশ্বাসের চোখে একবার গাছটার দিকে আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকিয়েই রইলাম । মেয়েটার মুখ টা কেমন ক্লান্ত মনে হচ্ছে । তবে সেখানে একটা সুক্ষ আনন্দের হাসি দেখতে পাচ্ছি । রুহিলা তার ছেলেকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছে । একটু আগে সেটা ছিল হাহাকারের কান্না সেটা এখন আনন্দের কান্না পরিনত হয়ে গেছে ।
সবাই চলে গেলেও আমি দারিয়েই রইলাম । আমার মাথার ভেতরে কিছুই ঢুকলো না । মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি চাইলে আমার ঘরে এসে এক কাপ চা খেতে পারো !
-এতোক্ষন কি হল ?
-তুমি বললে বিশ্বাস করবে না । তাই বলে লাভ নেই ।
-না বল প্লিজ !
-আমার মনে হয় তুমি গেস করতে পারছো কি হল !
-তার মানে বলতে চাচ্ছো যে এই গাছের প্রাণটা তুমি ছেলেটার ভেতরে দিয়ে দিছো !
-অনেক টা তাই !
-কাম অন ! এই যুগেও তুমি আমাকে এই কথা বিশ্বাস করতে বল !
-আগেই বলেছি তুমি বিশ্বাস করবে না ! তবে তুমি যদি আমার সাথে ঘরের ভেতরে আসো তাহলে হয়তো আমি তোমাকে কিছুটা বিশ্বাস করাতে পারবো !
তিন
নিনার ব্যাগে জিনিসপত্র ভরতে খুব বেশি সময় লাগলো না । আমি একপাশে বসেই ছিলাম । যা নেওয়ার সেই নিচ্ছিলো । আমার কি কি নেওয়া উচিৎ আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । আমার এখন হলে যেতে হবে । সেখান থেকে কয়েকটা জামা কাপড় নিতে হবে । তারপর কিছু টাকাও নিতে হবে । নিনা বলল
-তোমার কিছু নিতে হবে না ।
-তুমি কিভাবে বুঝলে আমি কিছু নেওয়ার কথা........
কথাটা বলতে গিয়েও আমি চুপ করে গেলাম । আসলে আমার এই প্রশ্ন করাটা বোকামী । এর উত্তরটা আমি জানি । তবুও মাঝে মাঝে মুখ ফসকে অনেক কিছুই বের হয়ে যায় । আমি এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না মেয়েটার ভেতরে অন্য রকম কিছু ক্ষমতা আছে । এতোদিন ওর পাশে থাকার পরেও আমি জিনিসটা ঠিক মেনে নিতে পারি না । কেমন যেনো অন্য রকম লাগেই ।
ঐদিনের পর থেকেই নিনার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতে থাকলো । আরেকটু ভাল করে বললে মেয়েটা আগ্রহ নিয়ে আমার সাথে কথা বলতো । আমি নিজেও প্রচন্ড কৌতুহলবোধ করতাম । আমরা এক সাথে না পড়ালেও আমার পাশের ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টে পড়তো নিনা । অন্য সবার সাথেই তার স্বাভাবিক আচরন এমন কি আমি খোজ নিয়ে জানতে পেরেছি অন্য কেউ নিনার এই ব্যাপারে কিছু জানেও না তবে ওর গ্রামের আসে পাশের কিছু মানুষ নিনার শক্তির ব্যাপারে জানে । তাদের বিভিন্ন ঝামেলা নিনা তাদেরকে সাহায্য করে বলে তারা নিনাকে খুব পছন্দ করে । তাছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা জানে না । নিনা খুব সতর্কতার সাথে তার এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছে । আমি বুঝলাম না আমার কাছে কেন সে এই ব্যাপারটা লুকিলো না ।
আমাকে সেদিন ঘরের ভেতরে নিয়ে পরিস্কার কন্ঠেই বলল যে সে একজন উইচ । আরও ভাল করে বলল হোয়াইট উইচ । সাদা ডাইনি ! আমি তখন কেবল অবিশ্বাসের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম । বিশ্বাস হচ্ছিলো না আবার একটু আগে সে ছেলেটাকে যেভাবে ঠিক করে দিল তাতে অবিশ্বাসও করতেও পারছিলাম না । কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম । নিজের নাম বলল নিনা হালতেনি । সে এখানকার মানুষও নয় । ওদের আদি নিবাশ নাকি ফ্রান্সে । তবে সেখানে কি একটা সমস্যা ছিল বলেই এখানে চলে এসেছে । এখানে এই সব বিষয়ে মানুষ জন ঠিক জানে না । এখানে কালো জাদু, বান মারা টাইপের কিছু কাজ হয় কিন্তু ডাইনি বিদ্যার চর্চা এখানে হয় না বললেই চলে । মানুষ এসব ব্যাপারে এখানে জানেই না বললেই চলে, আগে এক সময় নাকি এখানে কিছু কিছু এসব হত, তবে খুব গোপনে । তবে এখান তা নেই বললেই চলে । মানুষ এটা তাই তারা এখানে নিরাপদেই থাকতে পারে । ওর মত আরও দুএক জন নাকি এদেশে আছে ।
আমার মাঝে মাঝেই মনে হত নিনা আমার কাছে হঠাৎ করেই এসব কিছুই বলল কেন ? কেন আমার কাছে ওর সব গোপন কথা বলল এক নিমিষেই । তার উপর আমার সাথে খুব দ্রুত সাখ্যতা গড়ে তুলল । আমার মাথায় ঠিক আসছিলো না এই ব্যাপারটা আমি বেশ কয়েকবার এটা ওকে জানতে চেয়েছি । ও আমাকে কিছু বলে নি। কেবল হেসেছে । রহস্যময় হাসি ।
তবে আমি বলবো এই ক'মাসে ওর সাথে আমার সময় বেশ কেটেছে । নতুন অনেক কিছু জেনেছি অনেক রকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে । যা আমি বিশ্বাস করতে চাই নি অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি । ওর সম্পর্কে জেনেছি অনেক কিছু । জেনেছি ওর জীবন সম্পর্কে আরও ডাইনি বিদ্যা সম্পর্কে !
নিনার প্রস্তুতি শেষ হলেও ওর ঘর থেকে বের হয়ে এলাম । বাইরে তখনও রাতের আধার । চারিদিকে কেবলই নিশ্চুপতা । আমার কেমন জানি একটু একটু ভয় ভয় করতে লাগলো । মনে হচ্ছে একটু আগে যে মানুষ গুলোর সাথে আমরা লড়াই করে এলাম ওরা যেকোন সময় আমাদের কাছে চলে আসতে পারে । আর আসলেই এবার আমাদের সত্যিই সত্যিই খবর আছে । নিনা আবারও আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বলল
-জাজি এতোক্ষনে প্রায় আমার জাদু কাটিয়ে উঠেছে !
-হু ইজ জাজি ?
-দ্য জায়েন্ট ! মনে নেই একটু আগে যার হাতে মরতে বসেছিলে ?
-এখন ?
-সমস্যা নেই । এখানও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে নি । আর পুরোপুরি কাটিয়ে উঠার আগেই আমরা এখান থেকে পাগার পার হয়ে যাবো ।
-কিভাবে ? আমাদের তো যেতে হলে ওদের সামনে দিয়েই যেতে হবে, নাকি ? গ্রামের এদিক দিয়ে তো বের হওয়ার কোন উপায় নেই । ওপাশটাতে পথ নেই ।
আমার এই কথার জবাব না দিয়ে নিনা কেবল হাসলো । সেই আগের হাসি । ও আমার কোন কথার জবাব না দিতে চাইলেই এমন করে হাসে । আমি বুঝে যাই ও এই প্রশ্নটার উত্তর দিবে না । তাই আর জানতে চাওয়া হয় না । কিন্তু এই প্রশ্নটা আমি আরেকবার না করে পারলাম না । আমি আবার বললাম
-আমরা যাবো কিভাবে ?
নিনা আবারও আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে একটু দেওয়ালের দিকে ফিরলো । সেখানে ঠেস দেওয়া একটা লম্বা লাঠি মত হাতে নিল । তাকিয়ে দেখি সেটা একটা লম্বা ঝাড়ু । সিলিং পরিস্কার করতে আমরা যে ঝাড়ু গুলো ব্যবহার করে সেগুলো । আমি অবিশ্বাসের চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-ইউ আর কিডিং রাইট ?
-নো ! আই এম নট !
-নো ওয়ে !
আমি আগেই বলেছি আমার এতোদিনে ওর সাথে থেকে এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু আমি ঠিক এখনও হতে পারে নি । তাই এটা হজম করতে একটু সময় লাগলো ।
ছোট বেলাতে আমরা যত ডাইনির গল্প, কমিক পড়েছি কিংবা কার্টুন দেখেছি সেখানে ডাইনিদের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট ছিল যে তারা উড়তে পারে এবং সেটা একটা লম্বা ঝাড়ুর সাহায্যে । ঝাড়ুর মুখটা থাকে তাদের পেছন দিকে । নিনা ওর ব্যাগটা আমার কাধে দিল । তারপর ঝাড়ুটাকে নিজের দুই পায়ের ফাঁকে নিয়ে দাড়ালো । লম্বা ঝাড়ুটার সামনের দিকে ধরে আছে । পেছন দিকে অনেকটা অংশ বেড়িয়ে রয়েছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কই এসো । সময় নেই হাতে !
-নো !
-আসো প্লিজ ! সময় নেই । জাজি চলে আসবে যে কোন সময়ে ।
আমি জাজির শরীরটার কথা আরেকবার চিন্তা করলাম । তারপরই মনে হল এখানে থাকলে নির্ঘাত মারা পড়বো । আর কথা না বাড়িয়ে সেই ঝাড়ির দুই পাশে পা দিয়ে দাড়ালাম ।
ব্যাপারটা নিজের কাছে সত্যিই হাস্যকর মনে হল । মনে আছে আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এরকম লম্বা লাঠি নিয়ে বাইক বানাতাম । তারপর পুরো গ্রাম সেটা চালিয়ে বেড়াতাম । লম্বা লাঠিটা থাকতো আমাদের দুই পায়ের মাঝে । এখন যে কেউ আমাদের দেখলে সে রকমটাই মনে করবে ।
নিনা বলল
-তুমি চাইলে চোখ বন্ধ করে রাখতে পারো । তবে একটা কথা মনে রাখবে কোন ভাবেই আমার কোমর ছাড়বে না । শক্ত করে ধরে রাখবে !
-আমি তো তোমার কোমর ধরিই নাই ।
-এখন ধর ।
-ধরবো ?
-ধর । আর চোখ বন্ধ কর !
আমি আক্ষরিক অর্থেই নিনাকে জড়িয়ে ধরলাম বেশ শক্ত করেই । তারপরই চোখ বন্ধ করে ফেললাম । কয়েক মুহুর্ত কোন কিছুই মনে হল তারপরেই মনে হল আমার নিজের ওজন কেমন হালকা হয়ে উঠেছে । গায়ে বেশ বাতাস লাগা শুরু করলো ! মাটি থেকে আমার পা উঠতেই আমি আরেকটু শক্ত করে নিনাকে চেপে ধরলাম । নিনা বলল
-আরে আস্তে । দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো তো !
-সরি !
তারপর আস্তে আস্তে নিজের চোখ খুলে তাকালম । অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য দেখলাম । আমার নিচে কোন মাটি নেই । এবং আমি আমার শরীরের কোন চাপ অনুভব করছি না । যেন বাতাসে ভেসে চলছি । এক ভাবে রাতে ছুটন্ত ট্রেনের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলে যেমন দৃশ্য দেখা যায় আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ঠিক তেমন কিছু দেখতে পেলাম । কিভাবে চলছে আমি জানি না । জানতে অবশ্য চাইও না ।
চার
ঠিক কবে এই ডাইনি কালচারটা শুরু হয়েছে এটা সঠিক ভাবে কেউ বলতে পারবে না । তবে প্রথম দিকে উইচদের দেখে সবাই খুব ভয় পেত । সংখ্যায় খুবই কম ছিলো তারা তবুও লোকে ডাইনিদের এড়িয়ে চলতো, ভয় করে চলতো । ডাইনিরাও সাধারন মানুষের কাছে আসতো না । কিছু ছিল যারা মানুষের উপকার করতো, সাদা ডাইনি । যদিও তাদের কে মানুষ ভয় পেত তবুও রোগে শোকে তাদের কাছেই সাহায্যের জন্য তারা আসতো । তারা সেটা করতোও । তবে কিছু সাধারন মানুষদের কে একদম দেখতে পারতো না, কালো ডাইনি । তারা মাঝে মাঝে মানুষের ক্ষতি করতো, মাঝে মাঝে অনেককে মেরেও ফেলতো !
এসব ঝামেলা নিয়ে একটা পর্যায়ে যুদ্ধ লেগেই গেল দুই গ্রুপের ভেতরে । অন্যান্য সব প্রাণীর মত ডাইনিদের কিছু দুর্বলতা আছে । সেই দুর্বলতার কথা যখনই মানুষজন জানতে শুরু করলো তখনই তাদেরকে আক্রমন করতে শুরু করলো । একটা পর্যায়ে মনে হল তারা হয় আর টিকতে পারবো না । তাই তারা সবার চোখের আড়ালে চলে গেল ।
তারপর অনেক দিন আমরা চোখের আড়ালেই ছিলাম । তখনকার সব প্রচলিত ধর্মে আমাদের কালচার চর্চা করাটা নিষিদ্ধ ছিল । তবে তবুও কিছু কিছু মানুষ আমাদের কাছে আসতো সাহায্যের জন্য । তারা আমাদের কালচারটা পছন্দ করতো । ১৭ শতকের দিকে এসে লক্ষ্য করলাম যে আমাদের সংখ্যা আবারও বাড়তে শুরু করেছে । লোকজন আবারও আমাদের ব্যাপারে ভাবতে শুরু করেছে । সুতরাং যা হবার তাই হল । আবারও আমাদের হানটিং শুরু হল । আমরা আবারও পালাতে শুরু করলাম । রাজা সপ্তম সেলিমের সময় সেটা এতোটাই কঠিন হল যে আমরা প্রায়ই নিশ্চিহ্নই হয়ে গেলাম । এবং এটার পেছনে অগ্রণী ভুমিকা ছিল এই ইনফিউডালের । এরা সবার সামনে মোটো নিয়ে থাকে যে আমাদের কে শেষ করে দিবে । কিন্তু বাস্তবে এদের লক্ষ্য অন্য । একেবারেই ভিন্ন !
আমার আর নিনা গত দুই দিন থেকেই এই সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডটাতে আছি । এই সময়ে সেন্ট মার্টিনে স্বাধারনত খুব একটা লোক আসে না । কারন এইসময়ে সি ট্রাক বন্ধ থাকে । যারা আসে তাদের আসতে হয় ট্রলারে করে । সবার সেই সাহস হয়ে ওঠে না । তবে আমাদের অবশ্য সেই ভয় নেই । আমরা তো ভিআইপি যানবাহনে এসেছি । দ্য ঝাড়ু এক্সপ্রেস । নিনা আমার দেওয়া নাম টা শুনে বেশ হেসেছে ।
এখানে আমাদের আসলে কোন কাজ নেই । সারাদিন আমরা গল্প করেই কাটিয়ে দেই । আমি জীবনে কি করেছি কিংবা কি করতে চেয়েছি । নিনা নিজের জীবনের গল্প বলে । এর আগে ইন্ডিয়ার একটা প্রদেশে বেশ কিছুদিন ছিল । এরপর বাংলাদেশে এসেছে প্রায় বছর দুয়েক হল । সব কিছু ঠিকই চলছিলো । এদিকে এসবের ধারনা কম ছিল বলেই কোন ঝামেলা হয় নি । কিন্তু গত মাসে সেই জিনিয়া নামের মেয়েটার মৃত্যুর পরেই নিনার মনে একটা সন্দেহ হয় । জিনিয়াও ওর মত উইচ ছিল । সেটা ও ছাড়া এই দেশে আর কেউ জানতো না । মেয়েটার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না । গলাটা ছিল একেবারে দুভাগ করা ! ওর ধারনা ছিল যে ইনফিউডাল ওদের খোজ পেয়ে গেছে । আর জিনিয়ার মৃত্যুর ধরনটাও সেদিকেই নির্দেশ করে ।
আমি আধ শোয়া হয়ে নিনার দিকে তাকিয়ে আছি । নিনা খোলা আকাশের দিকে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি । জানতে চাইলাম
-ইনফিউডালের আসল উদ্দেশ্য কি ?
-অনেকটা আমাদের মতই !
-মানে ? ঠিক বুঝলাম না !
নিনা কিছুটা সময় কোন কথা না বলে আকাশের দিকে তাকিয়েই রইলো । আমার কেন জানি মনে এই প্রশ্নটার জবাব ও দিবে না । তাই আমিও ঠিক ওকে আর কোন প্রশ্ন না করে আকাশের দিকেই তাকিয়ে রইলাম । তারপর নিনা হঠাৎ করেই বলা শুরু করলো
-জানোই তো সব ধর্মেই একটা নেগেটিভ শক্তির কথা বলা আছে । তোমাদের ধর্মে যেমন শয়তাম কিংবা ইবলিশের আছে তেমনি প্রত্যেক ধর্মেই এমন নেগেটিভ শক্তি আছে । তোমরা যেমন ঈশ্বরের আরাধনা কর আমরা করি এই নেগেটিভ শক্তিটার !
আমি এই কথাটা খুব ভাল করেই জানি । ডাইনিদের সকল শক্তি এই শয়তানের কাছ থেকে পায় আরও বিভিন্ন কথা প্রচলিত আছে । নিনা বলল
-আসলে আমার অনেক গুলো পরীক্ষা দিয়েই এই শক্তি গুলো অর্জন করতে হয় । কঠিন শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে হয় ।
-কি দরকার ?
-তোমাদের কাছে হয়তো নেই আমাদের কাছে আছে । এটা তোমরা বুঝবে না । যার যার নিজেদের ব্যাপার । যাই হোক । এই ইনফউডালরাও কিন্তু শয়তানের আরাধনা করে !
এই লাইন টা বলে নিনা আবারও দম নিলো । তারপর বলল
-আসলে ওরা নিজেদের পথ থেকে সকল প্রতিদ্বন্দ্বী সরিয়ে দিতে চায় । আমরা যাতে শয়তানকে না ডাকতে পারি কেবল তারাই যেন তাকে ডাকতে পারে এবং কেবল তারাই যেন তার দেখা পায় কেবল এই জন্য আমাদেরকে খুজে খুজে তারা শয়তানের নামে বলি দেয় । তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য । তাদের ধারনা যে যদি সঠিক পদ্ধতিতে একজন উইচকে বলি দেওয়া যায় তাহলে তার শক্তি তাদের আয়ত্তে চলে আসে।
আমি কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম
-আসলেই আসে ?
নিনা বলল
-নাহ । এমন কোন কিছু আমি জানি না । কোন দিন শুনি নি । তবে সেই ১৭ শতক থেকেই কিংবা তারও আগে থেকেই ইনফিউডালদের ধারনা এমনই ।
-জিনিায় মেয়েটাকেও কি এমন ভাবেই সব পদ্ধতি মেনেই মারা হয়েছিলো ?
-হুম !
-ওর ফ্যাকাসে মুখ দেখেই বুঝেছি ওর শরীর থেকে সকল রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছে । গলাটা নিখুত ভাবে দুই ভাগ করা । আর ওকে পাওয়া গেছে ডেভিল টম্বের কাছে ।
-শয়তামের টম্ব !! মানে ?
নিনা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা ছবি দেখালো । আমি খানিকটা ভরকে গেলাম । খানিকটা অবাক হয়েই বললাম
-এটা ?
-হুম ! এরকম আরও অনেক আছে এখানে । আমি মাঝে মাঝেই যাই তো । সব থেকে পুরনা কোথায় আছে জানো ?
-কোথায় ?
নিনা এবার কথার জবাব না দিয়ে কেবল আমাকে আরেকটা ছবি দেখালো । এই ছবি গুলোই আমাকে ভরকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ছিল । মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো ।
-আসলে এসব কেউ জানে না । আমরা কেবল যারা জানি তারাই এখানে যায় । অনেক কাল আগে এখানে যখন ইংরেজরা এসেছিল কিংবা ফরাসীরা এসেছিলো তখন বানিয়েছে । কেউ টেরই পায় নি আসলে এটা কেন বানানো হয়েছে ।
আমি জানি নিনা সত্য বলতে তবুও কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না । এমনটা হতে পারে না । কোন ভাবেই না ।
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই নিনা উঠে বসলো । আমিও ওর সাথে সাথেই উঠে বসলাম । তাকিয়ে দেখি ওর চেহারাটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছে । কোন কিছু একটার আচ করতে পেরেছে ।
আমি বললাম
-কি হল ?
-ঝামেলা !
-মানে কি !
-জাজি চলে এসেছে !
-কিভাবে ? তুমি না বললে ও আসলে তুমি আগে থেকেই টের পাবে ?
নিনা আরও কিছুটা সময় চুপর করে রইলো । তারপর বলল
-জাজি আমাদের ব্যাপার সব কিছুই জানে । কিভাবে আমাদের জাদু ফাঁকি দিতে হয় ওর জানা আছে । গতদিন ওকে যেভাবে আটকে ছিলাম অন্য কেউ হলে সাত দিনেও ছুটতে পারতো না কিন্তু ওর সময় লেগেছে মাত্র কয়েক আধা ঘন্টার মত । গতদিনেও ও ঠিক এই ভাবেই আমাকে ফাঁকি দিয়ে আমাকে ধরে ছিল । আমি কিছু টের পাওয়ার আগেই আমাকে ধরে ফেলে ।
কথা বলতে বলতেই নিনা উঠে গেল ।
-আমি একটা শক্ত ঝামেলার গন্ধ পাচ্ছি । এবার হয়তো সত্যিই বিপদে পড়বো !
নিনার কথা সত্যি করে দিতেই দেখলাম সেই দৈত্যটা বের হয়ে আড়াল থেকে । বেটার হাতে আমাদের সেই ঝাড়ুটা চিন্তে মোটেও কষ্ট হল না ! আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাঁসলো । তারপর মট করে ঝাড়ুটা মাঝখান দিয়ে ভেঙ্গে ফেলল ।
দি ঝাড়ু এক্সপ্রেস দিয়ে পালানোর পথ শেষ ! এখন ?
চারিদিকে পানি । এদের হাত থেকে তো পালাতেও পারবো না !!
পাঁচ
আমি নিজে কোন দিন এরকম পরিস্থিতিতে পড়বো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি, বাস্তবে তো চিন্তা করাটা আরও অনেক পরের ব্যাপার । অবশ্য নিনার সাথে থাকার পরে আমার সাথে কত ঘটনাই ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে থাকে না । আমার মানষিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে থাকা দরকার ছিল কিন্তু এমনটা যে হবে সেটা আমি ভাবতে পারি নি কোন দিন ।
কতক্ষন ধরে উড়ছি আমি নিজেই জানি না । নিনাকে নিয়ে লঞ্চটা চোখের আড়াল চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই । আমি চেষ্টা করেও সেটা ধরতে পারি নি ।
যখন মানুষ ছিলাম আমার হাতে একটা ঘড়ি আর পকেটে একটা মোবাইল ছিল, এখন সে সবের কোন সুযোগ নাই । কতটা সময় পার হয়েছে সেটা বলার কোন উপায় নেই । আমার কেবল মনে হচ্ছে আমি অনন্তকাল ধরে কেবল উড়েই চলেছি ।
অনেক টা সময় সমুদ্রের এদিক ওদিক কেবল চক্কর মেরেছি । একে তো অন্ধকার তার উপর যেদিকেই তাকাই না কেন কেবলই পানি আর পানি । কিছুতেই দিক ঠিক করতে পারছিলাম না । শেষে একটা মাছ ধরা নৌকা দেখতে পেলাম । সেদিকে এগিয়ে গেলাম । নৌকাটার মাথার উপর চক্কার দিতে শুরু করলাম । ব্যাপার টা এখনও আমার কাছে কেমন যেন অদ্ভুদই মনে হচ্ছে । আমি একটা মাছ ধরা ট্রলারের উপরে উড়ছি, পাখি হয়ে !
এখনও ল্যান্ডিংয়ে ঠিক মত পার দর্শী হতে পারি নি । প্রথম প্রথম তো ঠিক মত উড়তেই পারছিলাম না । তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের নতুন পরিস্থির সাথে মানিয়ে নিয়েছি । তারপর আর অবশ্য অসুবিধা হয় নি ।
আমি আস্তে করে নৌকাটার আরও কাছে চলে এলাম । ইঞ্জিন চালিত নৌকা । একজন হাল ধরে বসে আছে । মাথার দিকে একটা ছোট ছাউনির মত দেখা যাচ্ছে । ভেতরে নিশ্চয় আরও কয়েকজন রয়েছে । মাছ দেখা যাচ্ছে মাঝখানে । মাছ ধরে টেকনাফ ফেরৎ যাচ্ছে এরা । সকলেই এই মাছ টেকনাফের বাজার সহ আরও অনেক জায়গায় চলে যাবে । আমারও এখন টেকনাফ ফেরৎ যাওয়া দরকার । তারপর সেখান থেকে ঢাকা । নিনা এখন কোথায় আছে আমি জানি না । তবে নিনার কথাটা এখনও আমার মাথার ভেতরে চক্কার দিতে লাগলো ।
"আমি তোমাকে কেন সব কিছু খুলে বলেছি জানো ? কারন আমি জানতাম যে কেবল মাত্র তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে । আর কেউ না, আর কেউ না ।"
নিনা আর কিছু বলার সুযোগ পায় নি । আমি তো ওকে কিছু বলতে পারি নি । আমার বলার মত কোন অবস্থাও ছিল না অবশ্য ।
আমি নৌকাটার ছাদে কাছে আসতেই দু'পাখনা মেলে ধরলাম । প্রথমে ভেবেছিলাম পড়ে যাবে । কিন্তু নামার ঠিক আগেই ডানা দুটো মেলে ধরার জন্যই দেহের ওজন যেন আরও কমে গেল । ঠিক যেভাবে একটা বেলুন আস্তে আস্তে বাতাসে ভেসে ভেসে নামে ঠিক তেমন ভাবে আমার পা দুটো ছাদে ল্যান্ড করলো । নামতেই হাল ধরে থাকা লোকটার দিকে আমি তাকালাম । আমাকে নিশ্চিত ভাবেই সে দেখতে পেরেছে । এখন যদি আমাকে ধরতে আসে তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে । আমাকে আবারও উড়ে চলে যেতে হবে । আর নতুন কোন নৌকা খুজে বের করতে হবে । এই রাতের বেলা সেটা খুজে বের করা খুব একটা সহজ হবে না ।
তবে লোকটা এগিয়ে এল না । আমাকে ধরার চেষ্টাও করলো না । আমিও বসে রইলাম । একটু একটু ভয়ভভয় করতে লাগলো অবশ্য । কারনে যে কোন সময় এগিয়ে আসতে পারে । কিংবা ট্রলারে থাকা অন্য কেউও আমাকে ধরার চেষ্টা করতে পারে !
এমন একটা কথা ভাবছি ঠিক তখনই আমি তাকে দেখতে পেলাম । আরও ভাল করে বললে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের একটা সতর্কতা সংকেত পেলাম । এবং লোকটা কে দেখতে পেলাম সাথে সাথেই ।
লোকটাকে আমি এতোক্ষন দেখি নি । ঠিক লোক বলা উচিৎ না । ১৫/১৬ বছরের এক ছোকড়া । এতো সময় খাপটি মেরে ছিল কোথাও । ছোকড়া ছাদের কিনারে কোথা থেকে উদয় হল । আমাকে ধরতে এগিয়ে এল । ঠিক তখনই আমি আওয়াজটা শুনতে পেলাম ।
-এই ধরিস না !
-ক্যান ওস্তাদ ?
-এগুলা আমগো পথের সাথী । এদের ক্ষতি করা মানে হইতাছে শনি ডাইকা আনা । উড়তে উড়তে হাপায়া গেছে তাই এখানে আইসা বিশ্রাম নিতাছে । থাকতে দে !
ছোকরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেমে গেল । দুরে বসেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । আমিও সতর্কতার সাথে তাকিয়ে রইলাম । তবে এদের কাছ থেকে খুব একটা বিপদের আশংকা করছি না । আমার জন্য সামনে আরও অনেক কিছু অপেক্ষা করছে । নিনা বিপদে আছে । আমি ছোকড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কিছু সময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো মনে করতে লাগলাম ।
নিনা আর আমাকে জাজির লোকজন প্রায় চারিদিক থেকেই ঘিরে ধরেছে । তাকিয়ে দেখি সংখ্যা ওরা বেশ কয়েকজন । গুনে দেখলাম মোট ৮ জন আছে । আমাদেরকে অর্ধ বৃত্তাকারে ঘিরে ধরে এগিয়ে আসছে । পালানোর আসলেই খুব একটা উপায় নেই । কেবল পেছনের সমূদ্র রয়েছে । এখন দুজনকেই সেখানে ঝাঁপ মারতে হবে । এর থেকে বেশি কিছু করা যাবে না ।
জাজি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল
-ভাবছো মাত্র এই কয়জন ? আরও লোকজন আছে । যদি ঝামেলা চাও করতে পারো এবার আমরা পরিপূর্ন প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি । এই বলেই পকেট থেকে কিছু একটা বের করে আমাদের দিকে ছুড়ে দিল । সেটা এসে পড়লো ঠিক আমার থেকে কিছুটা দুর । নিনাকে দেখলাম একেবারে লাফিয়ে উঠে আমার পেছনে চলে যেতে ! আমি নিনাকে জিজ্ঞেস করলাম
-এটা কি ? তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন ?
-এটা বাদুরের মাথা ! পোড়ানো বাদুরের মাথা
-এটা দেখে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে ।
-তোমাকে বলেছিলাম না আমাদের কিছু দুর্বলতা আছে । আমরা যা দেখে ভয় পাই, শক্তিহীন মঅনুভব করি । এই বাদুরের মাথা সেগুলোর ভেতরে একটা । কোন উইচকে যদি বাদুরের রক্ত খাইয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেটা যতক্ষন তার শরীরে থাকতে ততক্ষন সে একেবারে শক্তিহীন হয়ে থাকবে ।
-এখন ?
আমি নিনার কাছ থেকে কোন উত্তর পেলাম না । জাজি আমাদের নিরবতা দেখে বলল
-শোন নিনা তুমি আমাদের সাথে লড়াই করে পারবে না । পালাতেও পারবে না । সুযোগ আছে ধরা দাও ।
-যেন আমাকে মেরে ফেলতে পারো !
-সেটা তোমাকে এমনিতেও মরতে হবে । আজ আর কাল যেদিনই হোক । কেবল পরিশ্রমই হবে ।
নিনা আরও কিছুটা সময় কেবল চুপ করে রইলো । আমি তখন ভাবছি কিভাবে এদের কাছ থেকে কিভাবে পালাবো । সামনে কেবল একটা পথই খোলা আছে সেটা হল সমূদ্রে ঝাঁপ দেওয়া । সেখানে ঝাঁপ দিলে কতটা সময় আমরা টিকতে পারবো সেটা অবশ্য একটা প্রশ্ন । কিছুক্ষন সাঁতরাতে হবে । তারপর যদি আশে পাশের কোন মাছ ধরা নৌকা পাওয়া যায় তাহলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যাওয়া যাবে । তখনই আমাকে অবাক করে নিনা বলল
-আচ্ছা আমি তোমাদের সাথে যেতে প্রস্তুত ।
আমি অবাক হয়ে নিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটার কি মাথা খারাপ নাকি । আমি ফিসফিস করে বললাম বললাম
-তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছ নাকি ? ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে !
নিনাও গলার স্বর নিচু করে বলল
-হুম ! তবে আজকেই না । আগামী পূর্নিমা আসার আগে তো নয়ই ।
-তাই বলে এভাবে বাঘের খাঁচার ভেতরে যাওয়ার তো কোন মানে নেই । চল ঝাপ মারি পানিতে ।
নিনা আমার দিকে না তাকিয়ে জাজির দিকে তাকিয়ে বলল
-ওকে । আমি যাবো তোমাদের সাথে । তবে অপুকে যেতে দিতে হবে !
জাজি কেবল হাসলো ।
-আচ্ছা । ওকে আমাদের কোন দরকারও নেই । ওকে দিয়ে আমরা কি করবো !
তবে জাজির চেহারা দেখে আমার কেন জানি মনে হল না ও সত্যি কথা বলছে । আমাকে সে কিছুতেই যেতে দিবে না ।
এখন ?
নিনা আমার পেছনের জামা আস্তে করে খামচে ধরলো । তারপর আস্তে আস্তে টানতে লাগলো । তাকিয়ে দেখি ও আস্তে আস্তে পিছাচ্ছে । আমিও পেছাতে লাগলাম । কয়েক কদম পিছিয়েছি তখনই জাজি বলল
-নিনা পাগলামো কর না । তোমরা পালাতে পারবে না !
-আমরা পালাচ্ছি না ?
পালাচ্ছি না ?
তাহলে ?
তাহলে পেছনে আসার মানে কি !
ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম নিনা কেন পেছনে যাচ্ছে । আমাদের সামনেই সেই বাদুরের মাথাটা তখনই রয়ে গেছে । সেটা থাকা মানে হচ্ছে নিনা কোন জাদু করতে পারবে না । তাহলে কি ও কোন জাদুর করতে যাচ্ছে ?
এই কথাটা মনে হতেই আমি আমার পেছনে খুব গরম কিছুর ছোয়া পেলাম, মনে হল যেন কেউ গরম কোন আগুনের ছ্যাঁকা দিয়েছে । নিনার দিকে তাকাতেই নিনা একটু হাসলো । তারপর বলল
-আমি তোমাকে কেন সব কিছু খুলে বলেছি জানো ? কারন আমি জানতাম যে কেবল মাত্র তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে । আর কেউ না । আর কেউ না ।
এই বলেই আমার গায়ে একটা চুমু খেল । আর তখনই আমি নিজের ভেতরে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারলাম । নিজেকে খুব হালকা মনে হল । তারপরেই তাকিয়ে দেখি আমি মাটি থেকে অনেকটাই উপরে । আমার দুই হাত ক্রমাগত নড়ছে । নিজের শরীরটা কাঁপছেই । একবার ওদিক যাচ্ছে আরেকবার ওদিক যাচ্ছে । কিছুতেই নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন রাখতে পারছি না । কি হল আমার ! আমার সাথে এমন হচ্ছে কেন ?
তখন আবার নিনার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম । "ফোকাস অপু"
চোখের সামনে দেখলাম নিনাকে জাজির লোকজন ধরে ফেলল । জাজি তাকিয়ে আছে আমার দিকে । তারপর ওকে নিয়ে হাটা দিল । আমি তাকিয়ে রইলাম আর ডানা ঝাপতাতে থাকলাম । তখনই কিভাবে সামনের দিকে যাবো বুঝতে পারছি না । নিনা আমাকে একটা পাখিতে পরিণত করে দিয়েছে । নিজে আটক হয়ে আমাকে পালানোর একটা পথ করে দিয়েছে
ছয়
যখন আবারও ঢাকার নিজের রুমে পৌছালাম তখন আমার পুরো শরীর ক্লান্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে । রুমে এসে কোন রকম হাত মুখ ধুয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম । এখন দরকার টানা কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম । নিনা বলেছিলো সামনের পূর্নিমার আগে ওরা ওকে বলি দিবে না । তার মানে পূর্নিমা আসা পর্যন্ত বেঁচে থাকবে তবে আমি যদি এখন না ঘুমাই তাহলে আমি নিশ্চিত মারা যাবো । আর মাথা ঠান্ডা না থাকলে আমি ঠিক মত চিন্তাও করতে পারবো না কিভাবে নিনা পর্যন্ত যাবো । আমি বিছানায় শুয়েই চোখ বন্ধ করলাম । ভেবেছিলাম সাথে সাথেই ঘুম চলে আসবে কিন্তু ঘুম সাথে সাথে এল না । মাথার ভেতরে কয়েক ঘন্টা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা ঘুরপাক খেতে লাগলো ।
আমাকে যখন নিনা একটা পাখি বানিয়ে দিয়ে চলে গেল আমি প্রথমে ঠিক মত বুঝে উঠতেও পারি নি আমার সাথে কি হচ্ছিলো । নিজের শরীর নিয়েই আমি কেবল ব্যস্ত ছিলাম । পাগলের মত কেবল পাখা ঝাপটাচ্ছিলাম, আসলে সেটা আমি নিজের হাত ভেবেছিলাম । নিজের অনিয়ন্ত্রিত দেহটাকে সামলাতে পারছিলাম না । তখনই নিনার কন্ঠ স্বর শুনতে পেলাম । আমাকে সুস্থির হতে বলছে । আমার চোখ তখনই চলে গেল নিচে । তাকিয়ে দেখি জাজির লোকজন নিনাকে ধরে ফেলেছে । ওকে নিয়ে যাচ্ছে । ওর চাঁদের এই অল্প আলোতেও যেন আমি ওর চোখ পরিস্কার ভাবে দেখতে পেলাম । মেয়েটা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল ।
ওকে নিয়ে ওরা দ্বীপের লঞ্চ ঘাটের দিকে চলে গেল । আমি তখনও নিজেকে ঠিক মত নিয়ন্ত্রন করতে পারি নি । কেবলই কোন মতে একটা স্থির ভাবে উড়ার অবস্থা আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করছি । পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন আনতে প্রায় ৩০ মিনিটের বেশি সময় চলে গেল । আমি যখন ঘাটের কাছে পৌছালাম তখন নিনাকে বহনকারী ছোট লঞ্চটা প্রায় চোখের আড়াল চলে গেছে । আসলে মানুষের পক্ষে এতো দুরে দেখা সম্ভব নয় কিন্তু আমি তখন আর মানুষ নউই বলেই হয়তো দেখতে পাচ্ছি ।
শরীরের যত শক্তি আছে আমি সেটার দিকে উড়তে শুরু করলাম । কিন্তু লঞ্চের গতি আমার নিজের গতির চেয়ে অনেকটাই বেশি । আর প্রথম বারের মত উড়ার কারনে আমি ঠিকঠাক মত উড়তেও পারছিলাম না । ফল স্বরূপ হাপিয়ে গেলাম খুব জলদি । কোথায় যেন পড়েছিলাম পাখিরা যখন হাপিয়ে যায় তখন কেবল নিজের ডানা দুটো ছেড়ে দেয় । বাতাসেই নাকি তাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে চলে । আমিও তাই করতে লাগলাম এবং আশ্চর্য ভাবেই লক্ষ্য করলাম যে এটাতে কাজ হচ্ছে । আমি ভেসে বেড়াতে লাগলাম । কিন্তু এতে আমার গতি কমে গেল । আমার চোখের আড়াল চলে গেল লঞ্চটা । আমি পথহারা নাবিকের মত এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলাম । চারিদিকে কেবল পানি আর পানি । কোন দিকে যাবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । তারপরই নৌকাটা চোখে পড়লো ।
যখন আমি নৌকাতে বসে বসে ভাবছিলাম কি করবো তখনই আমার মাথায় একটা কথা ধাক্কা মারলো । আচ্ছা আমি পাখি থেকে মানুষ হব কিভাবে ? নিনা তো নেই আসে পাশে আমাকে আবারও মানুষ বানানো জন্য । আর যদি আমি মানুষই না হতে পারি তবে নিনাকে বাঁচাবো কিভাবে ? এই চিন্তাটা আসলেই আমাকে পেয়ে বসলো । অন্য সব কিছু ভুলে গেলাম ।
কিন্তু এটা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করার কোন দরকার ছিল না । নিনা নিশ্চয়ই এসব ভেবেই আমাকে এই অবস্থায় পরিনত করেছে ।
সত্যিই হল তাই । নৌকাটা যখন এপাড়ে পৌছে গেছে ঠিক কিছুটা সময় আগেই আমি আবারও নিজের শরীরের ভেতরে পরিবর্তন টা লক্ষ্য করলাম । নিশ্চয় নিনা নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্য আমাকে পাখিতে রূপান্তর করেছিল । আর আমি যতদুর জানতাম উইচদের জাদুই একটা নির্দিষ্ট সময় পরেই শেষ হয়ে যায় । আমার বেলাতেও ঠিক তেমনই হয়েছে ।
নৌকার ছাদের উপরেই আমি আবার আমার পূর্ন রূপে ফিরে এলাম । তখন নৌকাটা প্রায় পাড়ে পৌছে গেছে । পেছনে তাকিয়ে দেখি হাল ধরে থাকা মাঝি আর ছোকড়াটা কেবল আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে । কথা বলতেও যে ভুলে গেছে ।
স্বাভাবিক !
চোখের সামনে এমন কিছু হতে দেখলে যে কেউ ভড়কে যাবে । আমি ততক্ষনে নেমে পড়েছি নৌকা থেকে ।
সাত
টানা ৭ ঘন্টা ঘুমালাম । যখন ঘুম থেকে উঠেছি সন্ধ্যা হয়ে এসেছে । ঘুম থেকে উঠে আমার সবার আগেই কেবল একটা কথাই মনে পড়লোযে নিনাকে বাঁচাতে হবে । কিন্তু কিভাবে ?
কিভাবে আমি ওকে বাঁচাবো ।
আমি একা কি করতে পারি । যখনই মনে হল আমি একা কি করতে পারি তখনই আমার মাথায় সুমনার বাবার কথা মনে পড়লো । সুমনা আমার ছাত্রীর নাম । ওর বাবা হচ্ছে এই এলাকার ওসি । আমি যদি গিয়ে বলি আমার এক ফ্রেন্ড কিডন্যাপ হয়েছে তাকে বাঁচাতে তবে কিছু একটা করবেনই । ফোনটা বের করে সুমনার মায়ের নাম্বারে ফোন দিতে গিয়ে দিলাম না । আসলে এখন তাকে বলার মত আমার কাছে তেমন কোন কথা্ই নেই । সবার আগে আমাকে নিজে খুজে বের করতে হবে নিনাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেছে । আর কোথায় ওকে নিয়ে আসবে বলি দেওয়ার জন্য !
কিন্তু কোথায় পাবো ইনফিউডালদের সম্পর্কে তথ্য । হাতের কাছে পুরান মিলজির যত বই আছে প্রায় সবই খোজ করলাম । লাইব্রেরীতে গেলাম । পরিচিত যারা ছিল সবার কাছে জানতে চাইলাম । আমার পরিচিত কয়েকজন লেখক আছে তাদের কাছেও জানতে চাইলাম । তারা আসলে পুরান মিথলজি নিয়ে বেশ পড়াশুনা করে । নিজেদের বইতে সেগুলো ব্যবহার করে । কিন্তু তারাও কিছু বলতে পারলো না । কেবল একজন বলল যে ইনফিউডাল হচ্ছে উইচ হান্টিং একটা গ্রুপ । এসব আমি জানি কিন্তু আমার আরও বিস্তারিত তথ্য দরকার ।
কি মনে হল আমি ইনফউডাল লিখে গুগলে সার্চ দিলাম । যা পেলাম তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না । আসলে এই পুরোটা সময়ে আমার একটা বারও মনে হয় গুগলে সার্চ দেওয়ার কথা । সহজ একটা সমাধান চোখের সামনে ছিল অথচ আমার চোখ কেবল কঠিন গুলোর দিকেই পড়েছে । কেবল একটা নয় বেশ কিছু তথ্য রয়েছে ইনফিউডাল সম্পর্কে । নিনা আমাকে যা যা বলেছিল তার অনেক কিছুই রয়েছে সেখানে । সাথে রয়েছে আরও নতুন কিছু তথ্য । ইনফিউডেলটা উইচদেরকে নিজেদের সরাসরি প্রতিযোগী মনে করে । উইচদের মতই তারাও কেবল ডেভিলদের আরাধনা করে, যদিও ডেভিলের সুনজর এদের উপর কোন দিন পড়ে নি । আরও ভাল করে বলতে গেলে তাদেরকে শয়তান পাত্তা দেয় নি । অনেকটা প্রতিহিংসা থেকেই ইনফিউডালরা উইচ হানটিংএ নামে । সপ্তদশ শতকের উইচক্রাফ্ট এবং উইচ ট্রাইলের সাথে এরা সরাসরি যুক্ত ছিল । উইচদের সম্পর্কে এরা সব কিছুই জানে বিশেষ করে এদের দুর্বলতার কথা । তাই তৎকালিন মানুষেরাও এদেরকে নিজেদের দলে নিয়ে ছিল কারন তারা ডাইনিদের কাবু করতে জানতো ।
এদের নিজেদের উপাসনালয় ছিল না । সেটা বানানোর ওদের খুব একটা দরকারও ছিল না । এরা খুব গোপনে এবং একান্ত নিজেদের ভেতরেই চার্চের কোন অংশে শয়তানের আরাধনায় মেতে থাকতো । তারপর চার্চ থেকে বেরিয়ে আসতো শয়তানের টম্বের কাছে । এই জন্যই চার্চটা এমন জায়গায় হতে হত যেন তার আসে পাশেই কোন ডেভিলস টম্ব থাকে । এর পেছনে অবশ্য একটা কারন আছে । তখন থেকেই ইনফিউডালে উইচদের শয়তানের উদ্দেশ্য বলি দিয়ে যাচ্ছে । এবং বলিটা দিচ্ছে সবার আগচরে এই ডেভিলস টম্বে । পাশা-পাশি থাকা টা এই জন্য জরুরী ছিল ।
নিনা বলেছিল ডেভিলস টম্বের কথা কেবল মাত্র উইচরা ছাড়া আর কোন মানুষই জানতো না । এগুলো দেখতে সাধারন কোন মন্দির কিংবা সমাধিস্থলের মত মনে হত । বেশির ভাগই ছিল সাধারন জায়গায় । মানুষজনের চোখের সামনে । নিনা আমাকে এও বলেছিলো যে বিশেষ বিশেষ ডেভিসল টম্ব গুলো থাকতো কোন চার্চের পাশেই । ঈশ্বরের চার্চের পাশেই শয়তানের উপাসনালয় অথচ কেউ যেটা জানে না ! টম্ব গুলো এমন ভাবে তৈরি যে মানুষজন সেটা বুঝতেও পারতো না আসলে এটা কি । গভীর রাতেই বসতে উইচদের উপাসনা ।
এরকম একটা টম্বের ছবিই নিনা আমাকে দেখিয়েছিল । সেটা আমাদের শহরেই ছিল । নিনার আসলে এখানে থাকার পেছনে এই টম্বটাও অনেকাংশে দায়ী । কবে কে এইটা বানিয়েছে সেটা নিনা বলতে পারবে না তবে তাদের পুরানো কোন গ্রন্ধে নাকি এইটার কথা লেখা আছে । আমাদের বর্তমান মেয়র ভবনের ঠিক পেছনেই এই টম্বটা অবস্থিত । পুরো কাঠামোটা কালো পাথরের । দুর থেকে দেখলে মনে হবে কোন বিরাটর বড় মানুষের সমাধি । মানুষটা আকারে অনেক বড় হওয়ার কারনে সমাধিটা বেশি উচু আর প্রস্থ হয়ে আছে । কালো পাথরের চারদিক এবং উপরের দিকে কেবল ত্রিভুজাকার আরে কয়েকটা চিহ্ন আঁকা রয়েছে ।
মেয়র ভবনটা যখন নতুন করে বানানোয় তখন নাকি এটাকে ভেঙ্গে ফেলার একটা কথা উঠেছিল কিন্তু অনেকের আপত্তির কারনে সেটা হয় নি । বরং চারিপাশে আরও একটু বেদি তৈরি করে দিয়ে জিনিটাকে আরও ভাল ভাবে সংরক্ষন করা হয়েছে ।
নিনা বলেছিল এই দেশে চেনা জানা বলতে কেবল এই টম্বটাই আছে । অন্য কোন টম্ব নেই । আমি টম্বটার আশে পাশে ঘুরে এলাম পরদিনই । কিন্তু এটা তো কেবল ডেভিলস টম্ব । ইনফিউডালদের উপাসনালয় নয় । আর ওরা এখানে তো নিনাকে কোন ভাবেই নিয়ে আসবে না বলি দেওয়ার জন্য । তাহলে কোথায় নিয়ে যাবে !
তথ্যমতে তো ওরা যেখানে সেখানে নিনাকে নিয়ে যাওয়ার কথা নয় কিন্তু আবার এখানেই আনতে পারবে না কারন এখানে কোন চার্চ নেই । তাহলে কোথায় নিয়ে যাবে ?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ইনফিউডালরা নিনাকে এই শহরেই আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবে । যদিও এমনটা ভাবার অন্য কোন কারন নেই তবুও মন বলছিলো এই শহরেই নিয়ে আসবে আবার । নিনা আমাকে বেশ ভাল করেই বলেছে এই একটা টম্ব ছাড়া এই দেশে কিংবা আর আশে পাশে তাদের আর কোন উপাসনালয় নেই । কদিন আগে আরেকটা উইচও এখানেই মারা গেছে । হিসাব করে দেখলাম সেটা ছিল গত পূর্নিমাতে । এবং মেয়েটার লাশ পাওয়া গেছে এখান থেকে একটু দুরে একটা ডোবার ভেতরে । পুরোপুরি সাদা ছিল মেয়েটার দেশে । যেন কেউ দেহ থেকে সমস্ত রক্ত বের করে নিয়েছে । গলার কাছ টা নিঘুত ভাবেতে কাটা ।
ওদের উইচ বলি দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কেও বেশ
নিনাকে ধরে নিয়ে গেছে গত কাল । আর আগামীকালই হচ্ছে আবার পূর্নিমা , এই অল্প সময়ের ভেতরে নিনাকে অন্য কোথাও ওরা নিয়ে যেতে পারবে না । যদি অন্য কোথাও টম্ব না থাকে এর অর্থ ওদের এখানেই আসতে হবে । কিন্তু এখানে তো কোন চার্চও নেই তাহলে ? এখানেই কি অপেক্ষা করবো নাকি অন্য কোথাও খুজবো ? অন্য কোথাও হলে সেটা কোথায় ?
এভাবে কিছুটা সময় চিন্তা করে যখন কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না তখন আরেকটা তথ্য আমাকে আমার সন্দেহটাকে একেবারে বাস্তবে রূপান্তর করে দিল। শহরের সব থেকে বড় চার্চে গিয়ে খোজ লাগালাম । এবং যেটা জানতে পারলাম তাতে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে আমার ধারনা ঠিক । বর্তমান মেয়র ভবনের পেছনে অনেক বছর আগে একটা চার্চ ছিল । ৮৮ বন্যার সময় সেটা নাকি এতো ব্যাপক ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে সেটাকে আর ঠিক করা সম্ভব হয় নি । সেখানে থেকে চার্চটা সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে বর্তমান জায়গায় !
তার মানে নিনাকে ওরা এখানেই নিয়ে আসবে । এখানেই আসতে হবে ওদের ।
আট
রাতে সুমনার বাবার কাছে সব খুলে বললাম । তবে নিনা কে একজন ডায়নি সেটা গোপন রাখলাম । সেটা বললে তিনি কোন ভাবেই বিশ্বাস করতেন না । নিনাকে বলি দেওয়ার ব্যাপারটা তিন অবশ্য বিশ্বাস করলেন না । তবে কিডন্যাপ যে হয়েছে এটা বেশ গুরুত্বের সাথে নিলেন । আমার কাছে জানতে চাইলেন যে আমি কিভাবে জানি যে ওরা ওকে ওখানেই নিয়ে আসবে। অন্য কোথায়ও তো নিয়ে যেতে পারে । আমি বেশ জোর দিলাম না । কারন বেশি জোর দিতে গেলে অনেক না বলা কথা বলতে হবে । সেটা বলা সম্ভব নয় কোন মতেই । আমি কেবল বললাম আমার ধারনার কথা । সুমনার আব্বা জানালো যে আজ থেকেই তারা খোজ খবর শুরু করে দিবে । তবে ঐ রাতের বেলা তারা সেখানে ফোর্স নিয়ে সেখানে ঐ গুলোর জন্য বসে থাকবে কোন প্রকার ক্লু ছাড়াই এমন হবে না । তবে সন্দেহজনক কিছু দেখা দিলে তারা সেখানে হাজির হতে খুব একটা দেরি করবে না ।
আমি কেবল বললাম যে আপনারা অন্য সব জায়গায় খুজতে থাকেন । কেবল আমি যদি ফোন করে তখন যেন জায়গা মত চলে আইসেন । তাহলেই হবে । আমাকেও থাকতে হবে এখানে ।
নয়
পুর্নিমার আলো চারিদিকে ভরিয়ে দিয়েছে । আমি অনেক টা সময় ধরে অপেক্ষা করছি ওদের জন্য । আমাদের শহরের মেয়র ভবনটার ঠিক পেছন দিকে বেশ খানিকটা জায়গা ফাকা রয়েছে । সেখানে রয়েছে পার্কিং লট আর টয়লেট । পার্কিং লট বেশ বড় আকারে । মেয়র ভবন আর পার্কিংলটের মাঝেই রয়েছে সেই ভেভিলস টম্বটা । চার্চ থেকে খোজ নিয়ে এসেছি আমি । ধ্বংশ হয়ে যাওয়া চার্চ টা । তারপরও বেশ কিছু পতিত জমি পড়ে আছে । এর কিছুটা পাশ দিয়ে গেছে হাইওয়ে । এবং অন্য পাশে গাছ পালায় ভর্তি । আমি রয়েছে সেই গাছ পালার ভেতরে লুকিয়ে । আমার হাতের কাছে বেশ কিছু ইটের চাকা রয়েছে । টেনিশ বলের সাইজের । যাতে করে আমি আমার প্রতিভার সৎব্যবহার করতে পারি । কিন্তু তাদের কোন দেখা নেই ।
আরও ঘন্টা খানেকের ভেতরেও যখন কেউ এল না আমি কেবল বসে বসে মশার কামড় খেতে থাকলাম তখনই মনে হল আমার হিসাবে কোন ভুল আছে । নিনাকে এখানে আনবে না । ওরা হয়তো ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে । হয়তো নিনা জানে না ! কিংবা অন্য কোন কারন আছে !
আমার এখন কি কর উচিৎ ?
চলে যাবো ?
যখন রাত দুইটা বেজে গেল আমি ধরেই নিলাম যে নিনাকে আমি আর বাঁচাতে পারবো না । সে আমার হাত ছাড়া হয়ে গেছে । মেয়েটা আমার উপর ভরসা করেছিল কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি নি । আমি মাথা নিচু করেই সেই গাছ গাছালির ভেতরে চুপ করে বসে রইলাম । বারবার নিনার মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল । মনে হল যে এখানে আর বসে থেকে আর কোন লাভ নেই । চলে যাওয়াই ভাল । আমি কাধের ব্যাগটা নিয়ে উঠে পড়তে যাবো ঠিক তখনই কালো ভ্যানটা কে দেখতে পেলাম । খোলা পার্কিং লটের ভেতরে এসে থেমেছে ।
কখন যে নিরবে চলে এসেছে আমি টের পাই নি । তবে বেশি সময় আগে আসে নি সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । ভ্যানটার কোন লাইট জ্বলছে না । কিছু সময় কেউ বের হল না । তারপরই সামনের দরজা খুলে একজন বের হয়ে এল । অন্ধকারে তার চেহারা ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না তবে তার দেশের আকার দেখে আমার চিনতে মোটেই কষ্ট হল না ।
জাজি !
গম্ভীর গলার নির্দেশ দিল সে । সাথে সাথে কর্ম তাৎপরতা শুরু হয়ে গেল । আস্তে আস্তে ভ্যান থেকে মানুষ বের হতে শুরু করলো । দেখতে দেখতে পুরো প্রাঙ্গলটা ভরে গেল যেন । আমার চোখ নিনাকে খুজছে ।
মেয়েটা গেল কোথায় ?
কোথায় আছে !
কিন্তু তখনও আমি কোথাও নিনাকে দেখতে পায় নি । তাহলে কি নিনাকে আনে নাই সাথে ?
তবে জাজির লোকজন থেমে নেই । মুহুর্তেই টম্বের চারিপাশে দেখলাম মশাল জ্বালিয়ে ফেলে জায়গাটা একেবারে আলোকিত করে ফেলেছে । আমি চুপ করে দেখতে লাগলাম ওরা কি করে ! এখনও নিনাকে আমি দেখতে পায় নি । তাই এখনই সুমনার বাবাকে ফোন দেওয়ার কোন মানে নেই । এখন যদু পুলিশ চলে আসে তাহলে খুব একটা কিছু হবে না । ওরা সব কিছু অস্বীকার করে বসবে !
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম নিনা কোথায় ?
এখনও আনছে না কেন ? নাকি .....।
না ! না এমন টা হতে পারে না । আচ্ছা আরেকটু কি এগিয়ে যাবো ?
না থাক । ওদের চোখে পড়ে যেতে পারে !
আরও ৫ মিনিট পরে আরও একটা গাড়ি এসে থামলো । জাজিকে দেখলাম প্রায় দৌড়ে গিয়েই সেই গাড়ির দরজা খুলে দিতে । একজন মাঝারি উচ্চতার লোক নামলো । তার সামনে জাজির দাড়ানোর ভঙ্গিটা দেখে স্পষ্টই মনে হল এই লোকটা আসলে অনেক বড় কেউ । নয়তো এভাবে জাজি দাড়াতো না । মশালের আলোতে জাজির মুখ দেখেই মনে হল সে সামনের ঐ মাঝারি সাইজের লোকটা এখানকার বস । সে জাজিকে কিছু বলল । জাজি মাথা নেড়ে পকেট থেকে একটা ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করলো । এবার মনে হয় চলে আসবে নিনা !
আমাকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না । দেখলাম আরও কয়েক মিনিটের ভেতরে আরও একটা মিনি ভ্যান এসে থামলো । দরজা খুলে ওরা কিছু কিছু বের করে আনলো । লম্বা আর মোটা কাঠের গুড়ি । একটা নয়, পরপর তিনটা । আমি আরও একটু ভাল করে তাকিয়ে দেখি আসলে ঐ তিনটা গুড়ির সাথে তিনটা মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে । ওদের কে আমার দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে । অর্থাৎ আমি খোলা পার্কিং লটের পাশের জংঙ্গলের ভেতরে আছি এই দিকে । এই দিকেই ঐ চার্চটা ছিল । এখানেই আনতে হবে হিসাব মত ।
ওদের ভেতরেই যে একজন নিনা হবে সেটা বুঝতে আমার মোটেই কষ্ট হল না । আরও একটু কাছে আসতেই ভাল করে তাকাতেই চিনতে পারলাম । একেবাসে শেষের জন । বাকি দুইজন কোথা থেকে এল কে জানে ?
জাজিরা এখনও সেই ডেভিলস টম্বের কাছেই দাড়িয়ে আছে । আরও কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে । যাক আমি আর দেরি করলাম না মোটেও । আমি মোবাইল বের করে সাথে সাথেই ফোন দিলাম সুমনার বাবাকে । কয়েক সেকেন্ড পরেই রিং ঢুকে গেল এবং আমি রিংয়ের আওয়াজ টা শুনতে পেলাম । কোথাও রিং বাজছে ।
তাহলে সুমনার বাবা আগেই চলে এসেছে !
তাকিয়ে দেখি কেবল আমি না ওরাও শুনতে পেরেছে । জাজি চিৎকার করে উঠলো
-কার ফোন বাজে ?
কেউ একজন বলে উঠলো
-আমাদের কারো নয় স্যার ! আমরা এই সময়ে ফোন সাথে আনি না !
-তাহলে ?
-বাইরের কারো হবে !
খুব শব্দ করে জাজি কিছু একটা বলে উঠলো । ভাষাটা আমি ঠিক বুঝলাম না । তারপর চারিদিকে খুজতে শুরু করতে বলল । আমি আমি জানি আমার দিকে ওরা ঠিক ঠিক আসবে । কিন্তু সুমনার বাবা কোন দিকে আছে । আমাকে তো একবার বলা দরকার ছিল যে তিনি চলে এসেছেন । আর ফোন টা সাইলেন্ট করবেন তো !!
কয়েক মূহুর্ত কেটে নিরবে । তারপর হঠাৎ ই একটা গুলির আওয়াজ পেলাম । দেখলাম ডান দিকে চলে যাওয়া জাজির দলের একজন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে । তারপরই সুমনার বাবাকে দেখলাম পিস্তল হাতে বের হয়ে আসতে । উনি জোর গলার বললেন
-যে খানে আছো সোজা হয়ে দাড়াও । সবাই কে ঘিরে ফেলা হয়েছে ।
কিছুটা সময় সব কিছু যেন থেমে গেল । তবে মাত্ট কয়েক সেকেন্ডের জন্য । তারপরই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল । চারি দিক থেকেই গুৈ শুরু হল । আমি মাথা নিচু করে রাখলাম বেশ কিছুটা সময় । নিনাদের কাঠের গুড়ি গুলো ছাড়িয়ে জাজিরা আস্তে অন্য পাশে সরে যাচ্ছে । ঠিক বুঝতে পারছি না কোন দল জিততেছে তবে পুলিশেরা একটু সুবিধা জনক পর্যায়ে আছে । কারন তারা আছে অন্ধকারে কাভার নিয়ে । অন্য দিকে জাজিরা কাভার ছাড়াই আছে ।
আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমার কেবল মনে হল এর ফাকে যদি নিনাদের কে মুক্ত করা যায় তাহলে একটা কাজ হবে । সব গোলাগুলি ঐদিকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে । আমি শুয়ে শুয়েই এগিয়ে গেলাম গুড়ির দিকে । যখন পৌছালাম তখন জাজিদের বেশ কয়েকজন মারা পরেছে ।
মাটির সাথে মিশে এগিয়ে চললাম । ওদের কাছে পৌছে পকেট থেকে ছুরি বের করে আমি কাটতে লাগলাম নিনার বাধন গুলো । কেটে গেল কিছু সময়ের মধ্যেই । নিনা মুক্ত হতেই বললাম
-চল !
-দাড়াও এদের কে মুক্ত করি ! এরা সবাই আমার বোন ।
-এদের কোথায় পেয়েছে ওরা ।
-ওরা ইন্ডিয়াতে ছিল । ওখান থেকে ধরে এনেছে । এতোদিন কেন মেরে ফেলে নি আমি জানি না ।
আমি ভেবেছিলাম যখন ওরা গোলাগুলিতে ব্যস্ত থাকবে তখনই আমি নিনাকে মুক্ত করে নিয়ে কেটে পড়বো । কিন্তু সেটা সম্ভব হল না । মুহুর্তেই দেখলাম জাজি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে । ওর চেহারায় যে একটা তীব্র রাগের চিহ্ন দেখতে পেলাম সেটাতে যেন আমাকে পুড়িয়ে মারবে এমন একটা অবস্থা ।
আমার দিকে তাকিয়ে জাজি চিৎকার করে বলে উঠলো
-ইউ র্যাট, নট দিস টাইম !
সকল গোলাগুলি তুচ্ছ করে সে একেবারে আমার দিকে এগিয়ে এল । আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে গুলিই করে দিবে কিন্তু গুলি না করে সোজা আমার পেটে এতো জোরে একটা ধাক্কা মারলো যে আমি ছিটকে পড়লাম দুরে । মনে হল আমার পেট থেকে সব বাতাশ বের হয়ে গেছে । কেবল বাতাস ই না সব কিছুই বেড়িয়ে আসবে ।
জাজি বলল
-কেবল তোর জন্য আমাদের সব কিছু ভেস্তে গেছে । তোকে ঐখানে গুলো করে মারা দরকার ছিল ।
নিনার দিকে তাকিয়ে দেখি ও তখনও দুজন কে মুক্ত করতে পারে নি । জাজির সেদিকে খেয়াল নেই । জাজি আমার দিকে আবার এগিয়ে এল । দুইহাতে আমার কলার চেপে ধরে আমাকে উপরে তুলে ফেলল । আমি আমার পা ব্যবহার করে ওকে একটা লাথি মারার চেষ্টা করলাম কিন্তু সেটা কোন কাজ হল না ।
ওর দেহের কাছে আমি শরীরটা কিছুই না । আমাকে যখন একেবার মাথার উপর তুলে আছাড় মারতে মারতে যাবে তখন নিনার গলার আওয়টাজ শুনতে পেলাম ।
জাজি ওকে ছেড়ে দাও !
জাজি ওদের দিকে ফিরে চাইলো । আমিও দেখতে পেলাম । তিনজনই মুক্ত হয়ে গেছে ।
জাজি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল
-যদি না ছাড়ি ! কি করবে তোমরা ? তোমাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই ।
-শেষ বারের মত বলছি ছেড়ে দাও !
-তোমাদের কে একমগ ব্যাট ব্লাড খাইয়েছি ! তোমরা কিছু করতে পারবে না । ওকে আগে দেখে নেই তারপর তোমাদের কাছে আসছি আমি ।
নিনা বলল
-তুমি আমাদের ব্যাপারে এতো কিছু জানো আর "থ্রি উইচ টাই" য়ের ব্যাপারে কিছু জানো না ?
জাজির দিকে তাকিয়ে দেখি ও যেন একটা অবাক হয়েছে । তারপর ওদের দিকে ফিরে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে ।
নিনা বলল
-তিনজন উইচের রক্ত যখন এক সাথ মিলিত হয় তাহলে তারা কি করতে পারে তার ব্যাপারে তোমার ধারনা নেই ।
আমি তাকিয়ে দেখি নিনারা তিনজনই পরস্পরের সাথে হাত ধরে আছে । ওদের হাত থেকে রক্ত পড়ছে সেটা আমার চোখ এড়ালো না ! জাজির চোখে এবার আমি সত্যি সত্যিই ভয় দেখতে পেলাম । আমাকে ঠিক আছাড় না মারলেও ছুড়ে ফেলল এক দিকে । আমি মোটামুটি প্রস্তুত ছিলাম তাই সামলে উঠলাম । মাটিতে পড়তেই তাকালম জাজির দিকে । তাকিয়ে দেখি জাজি নিজের পকেট থেকে একটা টোপলার মত কিছু একটা বের করে সামনে ধরেছে । অনেক টা নিজের আত্মরক্ষার মত করে । আর নিনাদের তাকিয়ে দেখি ওদের তিন জনের একসাথে ধরা হাতটা সামনে চলে এসেছে । সেখানে থেকে একটা আগুনের বৃত্ত মত তৈরি হয়েছে । মুহুর্তের ভেতরে সেই আগুনের সার্কেল টা বড় হয়ে গেল । তারপর ওখানে থেকে কিছু একটা প্রাণী বের হয়ে এল ।
প্রাণীটা লম্বায় একটা বড়সর বাঘের মত । কিন্তু মুখটা বাঘের মত না । সেখানে শিং আছে আর মুখের গড়নটা অনেকটাই মহিষ আর কুকুরের সংমিশ্রমন । সব থেকে বড় কথা প্রাণীটা পুরোপুরি কালো । তবে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেমন যেন একটু হাড্ডি বের হয়ে গেছে । মনে হচ্ছে প্রাণীটা অনেক দিন আগে মারা গেছে । মাংশ পচে গেছে । খসে খসে পড়েছে । সেই সাথে একটা তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তবে চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে ।
জাজি এখনও সেই আগের মত পজিশন নিয়ে আছে । কিন্তু আমি ওর চোখে মুখের ভয়টা ষ্পষ্ট ! বিড়বিড় করে কিছু বলছে । মনে হল কোন মন্ত্র পড়ছে । আমি তাকিয়ে আছে পশুটার দিকে । কয়েক মুহুর্ত । প্রাণীটা সোজা গিয়ে জাজির উপর হামলাকরে বসলো । তারপর জাজির গলার কাছে কামড়ে ধরলো । আমি এতো দুর থেকেও মট করে ওর ঘাড় ভাঙ্গার আওয়াজটা শুনতে পেলাম ।
এরপর ঠিক যেভাবে এসেছিলো জাজিকে মুখে করে করে সেই আগুনের সার্কেলের ভেতরে চলে গেল ।
এতো সময় পরে লক্ষ্য করলাম যে গোলাগুলির আওয়াজ অনেক টাই থেমে গেছে । জাজিদের গ্রুপের অনেকেই দেখলাম গ্রাউন্ড পরে আছে । আমি নিনাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল
-এটা কি ছিল ?
-এটা তোমার জানার দরকার নেই । কেবল জেনে রাখো যা দেখেছো সেটা এই পৃথিবীর কিছু ছিল না !
পরিশিষ্টঃ
মোটে ছয়জন মারা পড়েছি জাজিদের গ্রুপ থেকে । দলের প্রধান একজন ফ্রান্সের নাগরিক । তাকে ধরা হয়েছে । সাথেও আরও চারজনকে ধরা হয়েছে আহত অবস্থায় । নিনাদের কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে । ওদের জবান বন্দী নেওয়া হয়েছে । ওরা যে নিজেরা উইচ সেটা ওরা এড়িয়ে গেছে । কাউকে বলে নি । এটা একটা সাধারন কিডন্যাপিং কেস হিসাবেই ধরা হয়েছে ।
সপ্তাহ খানেক পরে আবার নিনার বাসায় হাজির হলাম । গিয়ে দেখি নিনার ঘরটা কেমন গোছগাছ করা । তিনজনই আছে ওরা । ঐ ঘটনার পরে ওরা দুজন কোথাও যায় নি । আমি বলল
-কোথাও যাচ্ছো নাকি ?
-হুম !
-কোথায় ?
-এখানে আর থাকা যাবে না ।
-কিন্তু ওরা তো সব ধরা পরেছে ।
নিনা হেসে বলল
-তুমি জানো না এদের গ্রুপটা কত বড় তোমার সেই সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নাই । একদম গেছে অন্য দল আসবে !
-তার মানে তোমরা এভাবেই পালিয়ে বেড়াবে !
-হুম ! এটা আমরা নিজেরা বেছে নিয়েছি ।
আমি বললাম
-আমাকে বলে যাও কোথায় যাচ্ছো ?
-সেটা বলা যাবে না । তোমার ভালর জন্যই । ওরা হয়তো তোমাকে টরচার করবে এটার জন্য । এর থেকে না জানো । তবে তোমার সাথে আমি যোগাযোগ রাখবো ।
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । নিনা আমাকে নিয়ে বাসার বাইরে চলে এল । তখন সন্ধ্যা নামতেছে । নিনা আমার গালে ছোট্ট করে একটা চুম খেয়ে বলল
-আমাকে নিশ্চিৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তোমার অনেক ধন্যবাদ । মনে রেখো আমরা উইচরা কখনও নিজেদের উপর অন্যের পাওনা রাখি না । তোমার দরকারে আমি ঠিক ঠিক তোমার পাশে থাকবো ! আমি না আসলেও অন্য কেউ ঠিক ঠিক আসবে আমার পক্ষ্য থেকে !
আমার কি বলা উচিৎ আমি জানি না । আরও কিছুটা সময় ওর সাথে কথা বলে চলে এলাম । আসার সময় কয়েকবার ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ওকে । ওরা আজকে রাতেই চলে যাবে । আর হয়তো দেখা হবে না !
সমাপ্ত
কিছু বানান তো ভুল থাকবেই । আমার লেখায় যেমন টা ভুল থাকে সব সময় । সেই সাথে গল্পে ব্যবহৃত সব কথা-বার্তা, তথ্যের আসলে কোন ভিত্তি নেই । সব কিছু কাল্পনিক
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৫৮