somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতি-প্রাকৃত বড় গল্পঃ মিরিনার প্রেম

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




এক
আরেকটু হলেই ধাক্কা লেগে যেত মিরিনার সাথে । কোন রকমে সংঘর্ষটা এড়ালাম । এতো তাড়াহুড়ার ভেতরে ছিলাম যে সামনে দিয়ে যে মেয়েটা এগিয়ে আসছে সেটা খেয়ালই করি নি । তবে মিরিনার দিকে তাকিয়ে মন হল ওর মোটেই অবাক হয় নি । বরং খানিকটা হতাশ হয়েছে, ধাক্কাটা লাগলেই মনে হয় ভাল হত । আমি বললাম
-সরি ।
-কেন ?
-না মানে যদি ধাক্কাটা আমি ইচ্ছে করে দিতে চায় নি । একটু তাড়াহুড়ার ভেতরে আছি তো ।

মিরিনা হাসলো কেবল । তারপর আর কিছু না বলে ঘুরে চলে গেল সিড়ির দিকে । আমি তখনও দাড়িয়ে আছি । আজ ওকে অন্য দিনের মত লাগছে না । মেয়েটার হয়েছে কি ! এমন তো থাকে না । সমস্যাটা কি !
কয়েক ধাপ নেমে মিরিনা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল
-আপনার প্রেজেন্টেশনে দেরি হয়ে যাচ্ছে না ? দাড়িয়ে আছেন কেন ? আর ধাক্কাটা এখনও লাগে নি কিন্তু তবুও সরি বলে দিলেন । ধাক্কাটা পাওয়া রইলো ।

আমি কেবল বোকার মত দাড়িয়েই রইলাম আরও কয়েকটা মুহুর্ত । তারপর মনে হল এতো কিছু ভাবার নেই আমার হাতে । আর মিনিট খানেকের ভেতরে আমার প্রেজেন্টেশন শুরু হবে । আমি মিটিং রুমের দিকে দৌড় দিলাম । দৌড়াতে দৌড়াতেই একটা ব্যাপার আমার মাথায় খুব জোরে ধাক্কা মারলো ।
মেয়েটা আজকে কি রংয়ের পোষাক পরে ছিল ?
সবুজ কামিজ আর কালো জিন্স ! মেয়েটা অন্যান্য দিনের মত মোটেই লাগছিলো না কারন মেয়েটা আজকে চেহারায় একদম মেকাপ দেয় নি । অথচ মিরিনার কড়া মেকাপ দিয়ে অফিসে আসার অভ্যাস । আমার মাথাটা ঠিক কাজ করছে না । কয়েকবার মনে হল যে এটা হতে পারে না । নেহৎই এটা একটা কাকতালীয় কোন একটা ব্যাপার মাত্র আর কিছু না । আমি এখন অন্য কিছু ভাবতে চাচ্ছি না । আমার এখন সম্পর্ন ফোকাস হওয়া উচিৎ সামনের প্রেজেন্টেশন টা । এটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে ।

কিন্তু না চাইলেই অনেক কিছু চলে আছে চিন্তার ভেতরে । মাথার ভেতরে কেবল একটা কথাই আসতে লাগলো কোন ভাবে কি এটার সাথে ওটার কোন সম্পর্ক আছে ? নাহ ! থাকতে পারে না । কোন ভাবেই না । আমি চিন্তাটা এক পাশে সরিয়ে রাখলাম । মনে মনে কেবল বললাম যে আমি এটা নিয়ে চিন্তা করবো তবে সেটা প্রেজেন্টেশনের পরে । এর আগে নয় । আমি মিটিং রুমে প্রবেশ করলাম ।


দুই

-কি মিস্টার ?

তাকিয়ে দেখি টেবিলের সামনে মিরিনা দাড়িয়ে আছে । সত্যি বলতে কি মিরিনাকে আমি এর আগে এতো কাছ থেকে দেখি নি । আমার আর ওর কাজকর্ম এক না । আমরা একই জায়গায় কাজ করলেও আমাদের ঠিক দেখা হয় না । এমনও আছে সপ্তাহ পার হয়ে যায় ওর সাথে আমার একটা বারও দেখা হয় না । দেখা হওয়ার কথা না । ওর কাজ করে আইটি ডিপার্টমেন্টে যেখানে আমি জেনারেল সেকশনে । আইটি নিয়ে কোন সমস্যা হলেই কেবল হয়তো আমাদের দেখা হয় । মাঝে মাঝে যাওয়া আসার মাঝে দেখা হয় এই আর কি ! এমনও আছে যে আইটি সেকশনের অনেকের চেহারা আমি কোন দিন দেখিও নি ।
আমি কেবল কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটা এখানে কি করছে ?
যদিও এখন এখন লাঞ্চ টাইম । তবে মিরিনাকে এর আগে আমি আমাদের অফিস ক্যান্টিনে ঢুকতে দেখি নি ।
আজকে হঠাৎ !
কাকতালীয় ?
নাকি ...... !
নাহ ! চিন্তাটা কোন ভাবেই মেলাতে পারলাম না । মাথা থেকে দুর করে দিলাম । এমনটা হতে পারে না । কোন ভাবেই না ।
মিরিনা বলল
-আপনার কাজটা ভাল ছিল ।
-আপনি দেখেছেন ?
-হুম ! ভুলে যাচ্ছেন কেন আমি আইটি সেকশনে কাজ করি । প্রেজেন্টেশন মনিটরের কাজটা আমার ছিল ।
-ওহ !
-তবে আপনি ঠিক মত প্রেজেন্ট করতে পারেন নি ।
-আসলে আমি মানুষের সামনে ঠিক মত কথা বলতে পারি না ।
-আমারও তাই মনে হল । এর আগেও আপনাকে দেখেছি সবাইকে কেমন যেন এড়িয়ে চলতে চান । কিন্তু জনাব এমন হলে তো সামনে এগুতে পারবেন না ।
মিরিনার কথাটা বলার ধরন টা খুবই স্বাভাবিক । মেয়েটা আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছে যেন আমার সাথে কত দিনের চেনা পরিচয় । আমরা প্রতিদিনই কথা বলি এভাবে । মিরিনা বলল
-মাইন্ড ইফ আই জয়েন ইউ !
-নাহ । কি বলেন । মাইন্ড কেন করবো ?
আমার মনটা আসলেই খানিকটা খারাপ ছিল । প্রেজেন্টেশন টা ভাল ছিল । কয়েকদিন ধরে বেশ পরিশ্রম করছিলাম কিন্তু ঠিক মত প্রেমেন্ট করতে পারি নি । খানিকটা মন খারাপ ছিল । তবে মিরিনার এভাবে পাশে এসে বসাতে কেন জানি বেশ ভাল লাগতে শুরু করলো । মন খারাপের ব্যাপারটা উধাও হয়ে গেল মুহুর্তেই ।
আবারও মনে হল ব্যাপারটা কেবলই কাকতালীও ব্যাপার । এর সাথে ঐ একাউন্ট কিংবা সেই ফেসবুক স্টাটাসের কোন সম্পর্ক নেই । মোটেই নেই ।


তিন

আমার আসলে তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে মিরিনা কি বলল । মিরিনা নিজ থেকে আমাকে বলল যে সে আমাকে সাহায্য করবে । আমার নাকি কিছু চর্চা করলেই এই সমস্যাটা কেটে যাবে । আমার কেন জানি কিছুতেই জিনিসটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না । যে মেয়েটার সাথে আমি এর আগে কোন দিন কথাও বলি নি সেই মেয়েটা আমাকে সাহায্য করতে চাইলো তাও আবার নিজ থেকে । আমার ঘুরে ফিরে কেবল সেই স্টাটাসের কথাটাই মনে আসতে লাগলো ।
বাসায় এসেও কেন জানি ঠিক শান্তি পাচ্ছিলাম না । প্যান্টটা পরে আবার কনকর্ড সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে হাজির হলাম । রাত হয়ে গেছে । একটু পরেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে ।
গতদিনও আমি ঠিক এখানেই এসেছিলাম । বাসার ব্রডব্যন্ড কানেকশনটা হঠাৎই নাই হয়ে গেল । ফোন দিয়ে জানলাম যে কাজ চলতেছে বেশ কিছু সময় লাগবে । তখনও অফিসের কিছু কাজ বাকি ছিল । তাই বাধ্য হয়ে বাসার কাছেই এই সাইবার ক্যাফে এসে হাজির হলাম ।
পিসিতে বসেছি মাত্র দেখি ফেসবুকটা ওপেন করা রয়েছে । এবং সে একটু আগে এখানে বসে ছিল সে এটা ক্লোজ করে নি । লগড-ইন অবস্থায়ই রেখে গেছে । এর আগেও আমি বেশ কয়েকবার এমন পেয়েছি ।
আমার মনে আছে, তখন আমি সবে মাত্র ঢাকাতে এসেছি । এই সাইবার ক্যাফেতে এসে হাজির হয়েছি । নতুন নতুন ফেসবুক চালু করেছি । আমার মনে হয় আমার মতই এদেশে তখন সবাই নতুন নতুন ফেসবুক চালাতো । তাই, খুব একটা খেয়াল থাকতো না । এসে দেখি ফেসবুকটা চালুই রয়েছে । আমি বসে গেলাম । তার একাউণ্টে । তার যতগুলো ফ্রেন্ড ছিল সব গুলাকে আনফ্রেন্ড করে দিলাম । আর কয়েকটা স্টাটাসও দিয়ে দিলাম মনের মত ।

আজকেও যখন এরকম ভাবলাম আজকেও একটু দুষ্টামি করি কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম বেটার কোন ফ্রেন্ডই নাই । যদিও অন্যের মেসেজ দেখা ঠিক না তবুও একবার চোখ চলে গেল সেখানে । দেখি মেসেজও কিছু নাই । যাহ এখানে বসে থেকে কি করবো । এর থেকে আমার কাজ করি । উইন্ডোটা ক্লোজ করতে যাবো তখনই চোখ গেল স্টাটাস বক্সের দিকে । একটু যেন অবাকই হলাম ।
আমার স্টাটাস বক্সে লেখা থাকে "হোয়াটস অন ইয়োর মাইন্ড" আর এখানে লেখা
"হোয়াটস ইয়োর উইস"
আরেকবার ভাল করে দেখলাম ।
হ্যা শব্দট উইসই । ডাব্লিউ, আই এস এইচ !
কয়েকবার রিফ্রেস করে আবারও দেখলাম । নাহ । একই কথা লেখা ।
আমি কয়েক কথায় একটা লাইনই লিখলাম ।
"পছন্দের মানুষটা যেন একেবারে কাছে চলে আসে"

স্টাটাসটা লিখে পোস্ট করতেই পিসিটা ধপ করে বন্ধ হয়ে গেল । তারপর আবার কিছু সময় পরেই আবার চালুও হয়ে গেল । কিন্তু তখন তাকিয়ে দেখি আর সেই ফেসবুকও টাও নাই আর সেই একাউন্টটাও নেই । আমি অতো কিছু চিন্তা করলাম না । নিজের কাজ করতে শুরু করলাম । আর আজকে এই ঘটনা ঘটতে শুরু হল ।


আজকে আবারও সাইবার ক্যাফেতে এসে হাজির হলাম । প্রায় ফাঁকাই বলা চলে । এখন এই রাতের সময় খুব একটা মানুষ নেই । একটু পরেই ক্যাফে টা বন্ধ হয়ে যাবে । আমি কয়েকটা পিসিতে বসে দেখলাম । নাহ সব স্বাভবিক । নিজের ফেসবুক আইডি দিয়ে চেক রে দেখলাম । নাহ, সব কিছু স্বাভাবিকই তো আছে । তাহলে ?
নিজের মনের ভুল । আসলে গতকাল আমি নিজের কাজ নিয়ে একটু বেশি চিন্তিত ছিলাম । তাই এমন হয়েছে । পিসি বন্ধ করে বের হয়ে এলাম ক্যাফে থেকে । এখন আমার বাসায় গিয়ে ঘুমানো দরকার । কালকে অনেক কাজ পরে আছে ।


চার
আমার মনে হয়েছিলো মিরিনা মনে হয় আমাকে আর মনেই রাখবে না । গতকাল কি মনে হয়েছিলো আমার সাথে কথা বলেছিলো আজকে বলার কোন কারন নেই । কিন্তু আজকেও আবার সেই একই কান্ড । দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে মিরিনার সমানে পরে গেলাম । এবার আমি খুব একটা তাড়াহুড়ার ভেতরে না থাকলেও ধাক্কাটা লেখেই গেল ।
মিরিনার মুখের হাসি দেখে কেবল মনে হল যে ধাক্কাটা ও ইচ্ছে করেই মেরেছে । মিরিনা বলল
-গতকাল কে এমনি এমনি সরি বলেছিলেন । আজকে পাওনা ধাক্কাটা মিটিয়ে দিলাম ।
আমি কি বলবো ঠিক আসলেই বুঝতে পারলাম না । কেমন মনে হল আমার ভেতরে একটা আনন্দ অনুভব হচ্ছে । আমিও কেবল হাসলাম । মিরিনা বলল
-তো ! ট্রেনিং শুরু করবেন কবে ?
-কিসের ?
-ওমা ভুলে গেলেন ? আপনার জড়তা কাটানোট ট্রেনিং !
-আপনি কি সত্যি সিরিয়াস ?
-হ্যা । না হলে বলবো কেন ? আজ থেকে ? অফিসে পর কোন কাজ নেই তো আপনার ?

আমি আরও কিছুটা সময় কেবল অবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম । এই মেয়েটা আসলেই কি বলছে ? সত্য বলছে তো ! যদিও কোন কারন নেই তবুও আমার কেবল মনে হল সে এসব সবই হচ্ছে ঐ স্টাটাসের কারনেই । আর কোন ব্যাখ্যা হতেই পারে না । কোন ভাবেই না ।
আমি যতদুর জানি আমাদের অফিসের অনেক কয়জন মিরিনার পেছেন হন্য হয়ে ঘুরেছে । কেউ পাত্তা পায় নি । এমন আমাদের যে এমডি, তার ছেলেো নাকি মিরিনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো । মিরিনা নাকি তাকে পাত্তাই দেয় নি । আর সেই মিরিনা আমাকে এতো পাত্তা কেন দিচ্ছে ?
কোন কারন কি আছে ? অথবা কোন ব্যাখ্যা !
আমি খুশি মনে মিরিনাকে বললাম
-আচ্ছা তাহলে অফিসের পরে দেখা হবে ।

মিরিনাও হেসে নিজের রুমের দিকে চলে গেল । আমি তখনও কিছুটা সময় কেবল দাড়িয়েই রইলাম । আমার কেন জানি ব্যাপার টা তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ।


পাঁচ
জায়গাটা আমার অচেনা নয় মোটেও । আমি এর আগেও এই জায়গাতে এসেছি কয়েকবার । এসেছি বলছি কারন পথটা আমার পরিচিত । রাস্তাটা একটা লেক কিংবা বড় পুকুর জাতীয় কিছুর পাশ দিয়ে এগিয়ে গেছে । লেকের পাশটা সারি সারি গাছ দিয়ে ভর্তি । সেই গাচ থেকে প্রতি নিয়ত পাতা ধরে পরছে । কিছু কিছু আমার গায়ে এসে লাগছে । আমি গাছ গুলোর একটাকেও চিনি না । তবে ঠিক ঠিক জানি যে আরেকটু সামনে গেলেই আমি একটা বড় কড়ই গাছ দেখতে পাবো । এতো গুলো গাছের ভেতরে এই একটা গাছই আমি চিনি ।
আমি সামনের দিকে হাটতে থাকি । সময়টা এখন কখন সেটার ব্যাপারে আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত । কারন কোন সময় মনে হচ্ছে এটা গভীর রাত আবার কোন সময়ে মনে হচ্ছে যেন সবে মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে । তবে পথ ঘাট আমি পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি । আকাশে চাঁদ নেই তবুও আলোটা কোথা থেকে আসছে আমার ঠিক জানা নেই ।

আমি আরও একটু এগিয়ে যাই । ঠিক তখনই আমার মনে হল সামনে কি হবে আমার জানা । আমি থমকে যেতে চাই কারন আমি জানি সামনে কি হতে যাচ্ছে কিন্তু আমি থামতে পারি না । আমার পা টা আমি কিছুতেই আটকাতে পারছি না । আমার পা টা যেন আমার নিজের নিয়ন্ত্রনে নেই । সেটা কোন রোবটের পা । আগে থেকেই প্রোগ্রাম ঠিক করে দেওয়া আছে এটা কোন ভাবেই থামানো যাবে না । আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই ।

আরেকটু এগুতেই আমি প্রানীটাকে দেখতে পাই । প্রানীই বলতে হচ্ছে কারন এটাকে কোন ভাবেই মানুষ বলা যাবে না । যদিও এটার মানুষের মত হাত পা রয়েছে তবুও কেন জানি মানুষ মনে হচ্ছে না ।
গায়ের রং কুচকুচে কালো । যেখানে চুল থাকে সেখানে কোন চুল নেই । সেই টাক জায়গাটাও কালো । চোখ থেকে মুখের জায়গায় কেবল ধোয়াসা অন্ধকার হয়ে আছে । যেন ধোয়া উড়ছে । আমি ভীত চোখে তাকিয়ে আছি । তখনও আমার পা টা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে প্রানীটার দিকে । হঠাৎই প্রানীটা বলে উঠলো
-আমার পাওয়া দাও ! পাওনা !
কোন রকমে বললাম
-পা-পাওয়া না ! কি পাও

-তোমার ইচ্ছে পূরন করেছি । এবার আমার পাওয়া দাও ।
-কি দেব ?
-দাও !
এই বলে দেখলাম সেই কালো প্রানীটা আমার দিকে আরও একটু এগিয়ে এল । বড় বড় নখওয়ালা দুহাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে ধরতে এলেই আমার গলা দিয়ে একটা তীব্র চিৎকার বেরিয়ে এল । তখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । ধড়ফড় করে উঠে বসতেই দেখি মিরিনাও উঠে বসেছে । তাড়াতাড়ি করে বেড সুইচ জ্বালিয়ে আমার দিকে ফিরলো । তারপর পাশে টি টেবিলে রাখা পানির জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাস টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ।
-নাও !
আমি এক ঢোকে সম্পূর্ণটা খেয়ে ফেলে ওর দিকে তাকালাম । মেয়েটা কেমন চিন্তিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
-আজকেও দেখোছো ?
-হুম !
-এমন কেন হচ্ছে ? আমরা দুঃস্বপ্ন সবাই দেখি কিন্তু প্রতিদিন একই স্বপ্ন কেন ?
-আমি জানি না !
আমি মিরিনা কে স্বপ্নটা বেশ কয়েকবার বলেছি । আজকে ও আর আমার কাছে জানতে চাইলো না । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা আসো, শোবে । আজকে আর দেখবে না ।
-তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুই ?
মিরিনা হাসলো । প্রতিবার ঘুম থেকে দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরে শোয়ার আবদার করি । ও অবশ্য মানা করে না । কেবল হাসে । তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরেই শুয়ে পড়ে । বেড সুইচ টা জ্বালানোই থাকে । আমি চোখ বন্ধ করলে ও সেটা বন্ধ করে দেয় !
মিরিনার সাথে আমার ঐ ধাক্কার ঘটনার প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেছে । ঐদিনের পর থেকে ঘটনা কেমন খুব দ্রুত ঘটতে থাকে । ঐদিন অফিসের পর থেকেই মিরিনা আমাকে ট্রিনিং দিতে থাকে । কিভাবে সবার সামনে কথা বলতে হবে । প্রথমে অফিসের ক্যান্টিনে । দুদিন পরেই আমার ট্রেনিংটা ওর নিজের ফ্ল্যাটে । বেশ ভালই চলতে লাগলো । অবাক হয়েই লক্ষ্য করলাম যে মিরিনার সাথে আমার সম্পর্কটার খুব বেশি জলদি উন্নতি হচ্ছে । বলতে গেলে আমার মনে হতে লাগলো কেউ যেন কোথা থেকে আমার সম্পর্কটাকে খুব দ্রুত নিজের হাতে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে । সব কিছু যেন খাপে খাপে লেগে যাচ্ছে ।

ঐ মাসটা শেষ হওয়ার মাথায় আমি মিরিনাকে প্রথম চুম খেলাম । ওর নিজের ফ্ল্যাটের সাদের উপর । বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন । অফিস থেকে সোজা ওর বাসাতেই এসেছিলাম । আমার ট্রেনিং অনেকটাই শেষ হয়ে গেছে । এখন আর আগের মত কথা বলতে গিয়ে আমার ভয় করে না । একটা প্রেজেন্টেশন দিয়েও ফেলেছি । ফলাফল অনেক ভাল । এখন মাঝে মাঝে চর্চা করি কিন্তু তাই বলে কিন্তু ওর বাসায় আসা বন্ধ নেই এবং মিরিনা নিজেও সেটা চাচ্ছে না যে আমি আসা বন্ধ করি । আমার যেমন ওর সঙ্গ খুব ভাল লাগে ঠিক তেমনি ওর নিজেরও আমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগে ।

যাই হোক সেদিন একটু চর্চা শেষ করেই মিরিনা চা নিয়ে এল । আকাশ তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে । আমি বললাম যে আমার যাওয়া দরকার । নইলে যেতে পারবো না হয়তো । আমি বের হওয়ার জন্য উঠতে যাবো তখনই মিরিনা আমার হাত ধরলো । থেকে যেতে বলল । বৃষ্টি এখনই নেমে যাবে বৃষ্টি পরে যেতে বলল । আসলে মিরিনা যেমন নিজে একা একা থাকে আমি নিজেও একাই থাকি । বাসায় গিয়েই বা কি হবে । এখানেই অপেক্ষা করি । কিন্তু কেবল অপেক্ষার চেয়েও বেশি কিছু হয়ে গেল । বৃষ্টি যখন খুব জোরে আসা শুরু করলো মিরিনা বারান্দায় গিয়ে ভিজতে লাগলো । এতো জোড়ে বৃষ্টি আসছিলো যেন বারান্দায় দাড়ালেই ভিজে যাচ্ছিলো । আমি মিরিনা কে হঠাৎই বললাম
-চল ছাদে যাই । ভিজবো !
-সত্যি !
-হুম । চমচৎকার হবে । তোমাদের ছাদ তালা মারা থাকে না তো ?
-নাহ !
-চল তাহলে ।
ওকে নিয়েই ছাদে দৌড় দিলাম । সত্যি পুরোটা সময় খুব চমৎকার কাটলো । আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ ছিল না । একটা মিরিনা খানিকটা ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলো । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানিতে আমি ওকে দেখতে লাগলাম এক ভাবে । মিরিনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি দেখো !
-তোমার ঠোঁট !
-কি ! ফাজিল !
তারপর আমরা হঠাৎই এদিক ওদিক হাটতে লাগলাম । একবার এদিক যাই আবার ওদিক যাই । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেটা দেখে অন্ধকারের ভেতরে আমরা হাটছি । পুরো ছাদে পানি জমে আছে । হাটতে হাটতে হঠাৎই মিরিনার পা পিছলে গেল । আমি একদম কাছেই ছিলাম । ধরে ফেললাম ওকে চট করেই কিন্তু অবস্থাটা এমন ও আমার শরীরের খুব কাছে চলে এল । কেমন যেন সব কিছু থেমে গেল । মিরিনাকে কেবল দেখলাম ও আমার দিকে তাকিয়েই আছে ।

তারপর আমার মনে হঠাৎই কোথা থেকে সাহস জড় হল আমি বলতে পারবো না । কেবল মনে হল কেউ যেন কানের কাছে এসে বলল "এখনই মেয়েটাকে চুম খা ! মেয়েটা রাগ করবে না" । আমি তাই করলাম । মিরিনা মোটেই রাগ করলো না এমন কি আমাকে বাঁধাও দিলো না । সেই দিন রাতে আর বাসায় এলাম না । এবং সত্যি বলতে কি সেদিন থেকেই আমি স্বপ্ন টা দেখতে শুরু করলাম ।
গত সপ্তাহে মিরিনাকে বলার পর থেকেই মিরিনা বলল ওর এখানে এসে থাকতে কদিন । আমি একা একা থাকি এই জন্যই মনে হয় একরম টা দেখছি ।
মিরিনাকে জড়িয়েই শুয়ে রইলাম । কেন জানি চোখ বন্ধ করতে ভয় লাগছিলো, মনে হচ্ছি চোখ বন্ধ করলেই আবারও সেই প্রানীটা এসে হামলা করবে । আমাকে নিয়ে যেতে চাইবে । কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলবে
আমার টা দাও । আমার পাওয়া না দাও !


ছয়
মিরিনার কাছ থেকে কথাটা শুনে আমি প্রথমে ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারলাম না । ওর মত পড়ালেখা জানা মেয়ে এসব ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারে ! আমি খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে বললাম
-তোমার মাথা ঠিক আছে তো ?
-একবার চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কি ?
-তোমাকে বলাই আসলে আমার ভুল হয়েছে । কই তুমি আমাকে বলবে কোন মনবিজ্ঞানীর সাথে দেখা করতে, তা না বলছো তান্ত্রিকের সাথে দেখা করতে ।
মিরিনা বলল উনি তান্ত্রক না । একজন হুজুর । আলেম । একবার গেলে সমস্যা কি শুনি ?
মিরিনা আমার স্বপ্নের ব্যাপার টা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিল । কয়েকদিন ধরে আমি যেমন চিন্তায় ছিলাম তেমনি মিরিনাও ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত দেখলাম । তাকে ঐদিনের সব ঘটনা সব খুলে বললাম । ভেবেছিলাম ও হেসেই উড়িয়ে দিবে কিন্তু ওর মুখটা যেন হয়ে গেল । মনে হল আমার কথাটা ও সিরিয়াসলি নিয়েছে । এর পরেই এই খবর নিয়ে হাজির ।
কয়েকবার মানা করলেও শেষে আসতেই হল । আসলে আমরা পুরুষ মানুষেরা যতই বাহাদুরী দেখাই না কেন শেষে আমাদের মেয়েদের কাছে ঠিক ঠিক হার স্বীকার করে নিতেই হয় । তাদের জেদের কাছে আমরা খুব বেশি সময় টিকতে পারি না ।
অফিস শেষে আমরা হাজির হলাম সেই হুজুরের বাসায় । দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়েই একটা বিপত্তি বাঁধলো । বাসাটা পুরান ঢাকার একটা গলির ভেতরে । দিনের বেলাতেও কেমন অন্ধকার অন্ধাকর ! সিড়ি ঘরে একটা এনার্জি বাল্ব ছিল । মিরিনা আর আমি সিড়ি ঘরে ঢুকতেই বাল্বটা স্ব-জোড়ে ঠাস করে ফেঁটে গেল । মিরিনা বেশ চমকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ।
কয়েকটা মুহুর্ত কেটে গেল কোন কথা ছাড়াই । অনুভব করলাম আমি নিজেও খানিকটা ভয় পেয়ে গেছি এরকম হঠাৎ লাইট ফেটে যাওয়ার কারনে ।
আমরা দুজনেই কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । মিরিনাকে বললাম
-কি করবা ? চলে যাবা ?
-জানি না । এভাবে লাইট টা ফেটে গেল কেন ?
-আমি কি জানি ?
একবার মনে হল দরকার নেই এসব ঝামেলার । বাসার দিকে যাই আরেকবার মনে হল ঝামেলা কিছু আছে নিশ্চয়ই । এসেছি যখন দেখাটা করে যাই । আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না কি করবো তখনই নিচের সদর দরজা টা খুলে গেল । আমি ভেবেছিলাম লম্বা দাড়িওয়ালা কাউকে দেখবো কিন্তু তার বদলে মাঝ বয়সী দাড়িবিহীন একজন কে দেখতে পেলাম । পরনে লুঙ্গি আর হাফ হাতা শার্ট । আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলো । বলল
-আসুন ! আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি !
তারপর ফেটে যাওয়া লাইটটার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুটা সময় । আবার বলল
-আসুন !
ঘরের ভেতরে ঢুকে আমার কোন কিছুই অস্বাভাবিক মনে হল না । যেন আমি আমরা কোন মেহমান বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছি । আমি মিরিনার দিকে তাকিয়ে বললাম
-ইনিই কি হুজুর ?
-হুম !
-কই চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না !
-ইনি এই রকমই !
-মানে ?
-আহা কথা বল না ! উনি যা জানতে চাইবে তার জবাব দিবে ।

লোকটা এল কিছু সময় পরেই । নিজের নাম বলল আব্দুল লতিফ । মিরিনার নিজের মনেও খানিকটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে লোকটার ব্যাপার । লোকটার কথা নিশ্চয়ই পরিচিত কারো কাছ থেকে শুনেছিল । কিন্তু এখানে এসে নিজেও কেমন যেন দ্বিধায় পরে গেছে । বিশেষ করে লোকটার চেহেরা দেখে ।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-বলুন আপনার কি সমস্যা ?
আমি শুরু থেকে সব খুলে বললাম । সেই একাউন্টার কথাও বললাম । লোকটা সব শুনলো চুপচাপ । কিছুটা সময় চোখ বন্ধ করে রইলো । তারপর হঠাৎ করেই চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনাদের ভেতরে কি শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে ?
আমি চট করেই মিরিনার দিকে তাকালম । ও নিজেও খানিকটা বিব্রত হল কথা শুনে !
লতিফ সাহেব বলল
-লজ্জার কিছু নেই । বলুন হয়েছে ?
-জি !
-একটু মনে করে দেখুন তো স্বপ্নটা কি আপনি তারপর থেকেই দেখতে শুরু করেছেন কি না !
আমি একটু ভাবলাম তারপরই মনে হল হ্যা ঠিক তাই । আমাকে কিছু বলতে হল না । আমার চেহারার ভাব দেখেই লোকটা বুঝে গেল তার ধারনা সঠিক । লতিফ সাহবে বলল
-আমি মনে হয় ব্যাপারা বুঝতে পারছি । এক প্রকার আত্মা, ভুত, প্রেত যাই বলেন না কেন, এমন এক প্রকার আছে এরকম । আপনার ইচ্ছে পূরন করবে বিনিমনে আপনার কাছ থেকে কিছু চাইবে ।
-মানে ?
-মানে আপনাকে আপনার ভালবাসার মানুষকের কাছে এনে দিয়েছে বিনিমনে সে কিছু চায় !
-কি চায় ?
-সেটা আমি কিভাবে বলবো ! সেটা সেই আত্মা আপনাকে বলবে ।
আমি কি বলবো সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না । লোকটা আবার বলল
-তবে এটা থেকে মুক্তির আরেকটা উপায় আছে !
-কি উপায় ?
-ঐ প্রেত আপনাকে যা দিয়েছে সেটা ফেরৎ দেওয়া !
-অর্থাৎ ?
-অর্থাৎ আপনি যা পেয়েছেন তার কাছ থেকে সেটা না নেওয়া । তাহলে হয়তো সে আর আপনার কাছে আসবে না ।
আমার কেন জানি বিরক্ত লাগলো লতিফ সাহেবের কথা শুনে । বেটা বলে কি । আমাকে মিরিনার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে বলছে । বেটাকে থাপড়ানো দরকার ।
আর বেশি সময় থাকলাম না আমরা । মিরিনাকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছিলো আমার সাথে রিক্সায় যেতে যেতে মিরিনা বলল
-আমার মনে হয় হুজুর সাহেব ঠিকই বলছে !
-মানে ?
-আসলে আমাদের এই সম্পর্কের জন্যই এমন হচ্ছে ।
-কি বলছো এসব ?
-সত্যি বলতে কি ঐদিনের পর তোমার সাথে আমি কিভাবে জড়িয়ে গেলাম আমি নিজেই বলতে পারবো না । আমার এখন মনে হচ্ছে সেটা কোন কিছুর প্রভাবে হয়েছে ।
-তার মানে তোমার সাথে আমার প্রেম টা একটা ধোঁকা । তোমাক .....
-আমি তা বলি নি । তবে একটা ব্যাপার ভেবে দেখো । তোমার সাথে আমার সম্পর্খটা এতো দ্রুত হওয়ার কথা ছিল বল ? সব কিছু যেন খাপে খাপে মিলে গেছে । কেউ যেন আমাদের কে এক সাথে এনে রেখে দিয়েছে ! এটার ওটা হবে এমন !
আমার বিরক্তিটা আরও বেড়ে গেল । ঐ লতিফ ব্যাটাকে আসলেই থাপড়াতে মন চাইলো এখন ।
মিরিনা বলল
-দেখো যেভাবেই আমাদের সম্পর্ক হোক না কেন আমি আসলেই তোমার ব্যাপার খুব সিরিয়াস । তোমার ভাল থাকাটা আমার খুব জরুরী । আমি চাই না আমাদের সম্পর্কের কারনে তোমার কোন ক্ষতি হোক ।
-তুমি কি বলতে চাইছো ?
-বলতে চাইছি যে আমাদের সম্পর্কটা মনে হয় ইতি টানা উচিৎ !

আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো মিরিনা এটা বলবে ! আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । নিজের কাছে আসলেই বিরক্ত লাগছিলো । লতিফ মিয়াকে এখান কাছে পেলে বেটার দাঁত ভেঙ্গে দিতাম । সব থেকে বেশি বিরক্ত লাগছিলো নিজের উপর । আমি ঐ কথাটা না বলতাম তাহলে এমন টা হত না কোন দিন । আমি বললাম
-যদি আমাদের সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরেও ব্যাপার টা না যায় তখন ?
-তখন আবার আগের মত হয়ে যাবো আমরা । সমস্যা কি !

জানি তর্ক করে লাভ নেই । মিরিনা সেটা শুনবে না । তবে আমি খুব বেশি চিন্তিত হলাম না । মনে মনে আমি ঠিকই ঠিক করে নিয়েছি যে ফল যদি আসেও তবুও ওকে আমি মিথ্যা কথা বলবো । বলবো যে আমার সমসম্যাটা যায় নি । আমি ঠিক স্বপ্ন দেখছি
মিরিনা আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে চলে গেল । বলল যে আমার সাথে আগামী এক সপ্তাহ সে কোন প্রকার যোগাযোগ রাখবে না । কোন সম্পর্ক রাখবে না ।
আমি বিদায় জানিয়ে চলে এলাম নিজের বাসায় এবং অবাক করে দেওয়া বিষয় ঐদিন রাতে আমি ঐ স্বপ্নটা দেখলাম না । ঐ রাস্তা দিয়ে হাটলাম না । কিংবা সেই প্রানীটা আমাকে হামলা করতে এগিয়ে এল না ।
অনেক দিন পরে খুব শান্তির ঘুম ঘুমালাম । সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গলো শান্তি নিয়ে । কিন্তু আমি ঠিক করেই রেখেছি । মিরিনাকে ফোন করে বলল যে আমি স্বপ্নটা আবার দেখেছি । ও তাহলে আবারও ফিরে আসবে । আমি ফোন টা হাতে নিয়ে ফোন করতে যাবো ঠিক তখনই আমার ফোনের রিং বেজে উঠলো ।
তাকিয়ে দেখি মিরিনা ফোন দিয়েছে । ও কেন ফোন দিল আমাকে !
-হ্যালো !
-তুমি এক্ষুনি আমার বাসায় আসো ! এক্ষুনি !
কি হল আবার ! আমি কোন রকমে শার্ট প্যান্ট পরেই দৌড় দিলাম নিচের দিকে । এতো সকালে কোন সিএনজি কিংবা রিক্সা পেলেই হয় !


সাত

আমরা আবারও আব্দুল লতিফের বাসায় এসেছি । আমরা তিনজনই বসে আছি । আমাদের চারিদিকে একটা গোল সার্কেল আঁকা হয়েছে । আমরা তিনজন গোল হয়ে বসেছি । ঠিক গোল হয়ে না, মিরিনা আমার দিকে একটু সরে এসে বসেছে । ওর হাতটা আমার হাতে ধরা । আব্দুল লতিফ সেই কখন থেকে চোখ বন্ধ করে কি যেন পড়েই চলেছে । আমাদের চোখ বন্ধ করে ওনার মত ধ্যান করার কথা । কিন্তু মিরিনা সেদিকে লক্ষ্য নেই । মিরিনা আমার দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে । সকালের ভয়টা এখনও ওর চোখে লেগে আছে ।
আমি যেখানে শান্তিমত রাতে ঘুমিয়েছি সেখানে মিরিনা মোটেই ঘুমাতে পারে নি । সকাল বেলা মিরিনার ফোন পেয়ে আমি সোজা ওর বাসার দিকে দৌড় দিলাম । কেন জানি মনে হচ্ছিলো কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে । যখন ওর বাসায় পৌছালাম দেখি মিরিনা দরজার সামনে বসে আছে চুপচাপ । হাতে মোবাইলটা ধরা । আমাকে দেখতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো । এতো জোড়ে জড়িয়ে ধরলো যে আমি পরিস্কার বুঝতে পারলাম যে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে ।
ওর মুখে যা শুনলাম তার অর্থ হল যে প্রানীটা এতোদিন আমার স্বপ্নে হামলা করতো সেটা নাকি আজকে ওর স্বপ্নে এসেছে । আমি অনেকবারই প্রানীটার বর্ণনা দিয়েছি মিরিনার কাছে তাই ওর ওটা চিনতে মোটেই কষ্ট হয় নি ।
গায়ের রং কুচকুচে কালো । যেখানে চুল থাকে সেখানে কোন চুল নেই । সেই টাক জায়গাটাও কালো । চোখ থেকে মুখের জায়গায় কেবল ধোয়াসা অন্ধকার হয়ে আছে । যেন ধোয়া উড়ছে । সেটা আজকে মিরিনার স্বপ্নের ভেতরে এসেছে । এবং সেটা কেবল স্বপ্নের ভেতরেই নয় যখন প্রচন্ড ভয় নিয়ে মিরিনার ঘুম ভাঙ্গে মিরিনা অনুভব করে যে ওর ফ্ল্যাটে কেউ আছে । কারো উপস্থিতি সে টের পাচ্ছিলো ।
তখনই সে বাসার বাইরে চলে যায় । সেখানেই বসে থাকে বাকিটা রাত । মোবাইলটা আনতে ভুলে গিয়েছিল কিন্তু পরে আর সাহস হয় নি আর ভেতরে যেতে । একটু আলো ফুটলে ওর খুব সাহস নিয়ে ভেতরে ঢোকে । সেখান থেকে মোবাইল নিয়ে আমাকে ফোন করে ।
ওর চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিলো মেয়েটা খুব বেশি ভয় পেয়ে গেছে । আমাদের আর অফিস যাওয়া হল না । কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে আমরা আবারও হাজির হলাম আব্দুল লতিফের বাসায় । তিনি মন দিয়ে শুনলেন । তারপর বললেন
-যাই হোক সেটা তোমার পেছনে লেগেছে সেটা চাচ্ছে না যে তোমরা আলাদা হও !
-এখন ?
-এখন জানতে হবে সে কি চায় ?
-কিভাবে ?
-উপায় অবশ্য আছে একটা । চেষ্টা করে দেখা যায় ! গতবারই দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু প্রথমেই সেটা করতে চাই নি ।
আমি বললাম
-তাহলে করুন !
আব্দুল লতিফ কি যেন ভাবলো । তারপর ঘরের ভেতরে চলে গেল । মিরিনা তখনও আমার কাছেই বসে আছে আমাকে ধরে । ওর ভয়টা মনে হচ্ছে এখনও কাটে নি । আব্দুল লতিফ ফিরে এল কিছু সময় পরেই । হাত একটা সিরিঞ্জ আর একটা কেচি । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-দেখি তোমার হাত টা ?
-মানে ?
-মানে তোমার একটু রক্ত নিতে হবে ।
তারপর মিরিনার দিকে কেচিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
-তুমি গুনে গুনে তোমার মাথা থেকে ১১ টা চুল কেটে দিবে । কিন্তু দেখবে চুপ গুলোর মাথা যেন ফাটা না হয় !
আমি কিছু না বলে আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম । মিরিনাও লাইটের আলোতে বসে গেল চুল কাটার জন্য । তারপর আমরা বসে রইলাম কিছুটা সময় । আমাদের চুল আর রক্ত নিয়ে আব্দুল ভেতরে চলে গেল । বলে গেল তার কিছু সময় লাগবে আমরা বসেই রইলাম । তারপর যেমন করে হঠাৎ করে গেছিলো তেমনই হঠাৎ করেই ঘরের ভেতরে চলে এল । আমাদের কে ডেকে নিয়ে গেল ভেতরে একটা ঘরে !
ঘরটা বেশ বড় এবং ঘরে আর কোন আসবার পত্র নেই । একেবারে খালি ঘর । কেবল মাথার উপর একটা ৬০ পাওয়ার বাল্ব জ্বলছে । আমি তাকিয়ে দেখি মেঝের উপরে একটা গোল সার্কেল আকা রয়েছে, সেখানে কিছু মোম জ্বলছে । সেটা যে কিছুক্ষন আগেই আকা হয়েছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । এর ভেতরে অদ্ভুদ সব নকশা আকা । আব্দুল লতিফ বলল
-এবার তোমরা এর ভেতরে ঢুকে পর । তবে মনে রেখ বাঁ পা দিয়ে ঢুকবে আর বসবে এক পায়ের উপর আরেক পা দিয়ে আরাম করে । আর যতক্ষন না আমি বলি ততক্ষন উঠবে না ।
আমরা ঠিক সেই রকম ভাবেই বসলাম । তারপর থেকে বসেই আছি । তিনি মন্ত্র না কি যেন পড়তে শুরু করেছেন ।
আরও কিছু সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেই ধুপ করে কোথাও আওয়াজ হল । মনে হল কেউ যেন নিচে নেমে এল কোথা থেকে । ঠিক তারপরই উপরের লাইটটা ফুট-টুস করে ফেটে গেল ।
মিরিনা একটু কেঁপে উঠলো । আমাকে আরও একটু শক্ত করে চেপে ধরলো । ভেবেছিলাম যে ঘরটা মনে হয় অন্ধকার হয়ে যাবে কিন্তু তাকিয়ে দেখি সার্কেলের বাইরে এবং ভেতরে কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছে । আমার নিজের কাছেও কেমন যেন অস্বস্থি লাগছে । আরও কয়েকটা মুহুর্ত কেটে গেল নিশ্চুপে । তারপরই আমি সেই অনুভুতিটা পেলাম ।
এটা আমার পরিচিত । সেই স্বপ্নের মত । প্রানীটা আসছে । আমার ইচ্ছে হল আমি চোখ টা বন্ধ করে ফেলি । সেটা আমি আর দেখতে চাই না । স্বপ্নের এক পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত কিন্তু এখন তো আমি জেগেই আছি । আমার তো ঘুম ভাঙ্গবে না । আমি বাস্তবে প্রানীটাকে দেখতে চাই না ।
আমি চোখ বন্ধ করতে যাবো ঠিক তখনই আমি তাকে দেখতে পেলাম ।
নাহ !
কোন প্রানী না !
মানুষের মত মনে হল ! নীল রংয়ের একটা কোর্ট পরা মানুষটা । আর তার থেকেও গাঢ় রংয়ের প্যান্ট পরা । পায়ে পালিশ করা সু ! ঘরে খুব বেশি আলো নেই তাই লোকটার চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছি না । চেহারার কাছ টা একটু আন্ধকার মত মনে হল ।
কিন্তু আমার অনুভুতিটা ঠিক সেই আগের মত । মনের ভেতরে সেই ভয়টা কাজ করছে ।
তাহলে কি এইটাই সেই ?
আব্দুল লতিফ তখনই বলে উঠলো
-কি চাও তুমি !
কন্ঠ টা শুনেই আমার বুকের ভেতরে সেই ভয়টা আবার ফিরে এল তীব্র এবং পরোপুরি ভাবে । আমার কোন সন্দেহই রইলো না যে এই লোটাই আমার স্বপ্নে আসতো !
-আমি চাই ! চাই চাই চাই ।
-কি ?
-দাও দাও দাও । আমাকে দাও ।
-কি দেবে ? এরা তোমাকে কি দেবে ?
-আমি যা চাই
-কি চাও তুমি ?
-আমি চাই চাই চাই ....
হটাৎই অনুভব করলাম লোকটার কন্ঠ যেন খুব দুর থেকে ইকো করছে । তারপরই দেখলাম লোকটার আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগলো চোখের সামনে থেকে। একটা সময় চলেই গেল । আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারলাম যে ওটা চলে গেছে । আমার ভয়টাও চলে গেছে ।
লতিফ সাহেব আমাদের দিকে ফিরে তাকালো । বলল
-নাহ ! এ শক্ত জিনিস ! আমি ধরে রাখতে পারলাম না । মনে হচ্ছে অনেক পুরোনো কিছু ।
-এখন ?
-যখন একবার নিয়ে এসেছি আবারও নিয়ে আসবো । তোমরা একটু বস, তোমাদের জন্য দুটো তাবিজ নিয়ে আসছি । ঘুমানোর আগে ওগুলো সাথে নিয়ে শুলে আশা করি ওটা আর তোমাদের ভেতরে ঢুকতে পারবে না আশা করি ।
মিরিনাকে নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম যখন ওকে নিয়ে বাসায় পৌছালাম তখনই মিরিনা একটাও কথাও বলে নি । পুরো রাস্তা জুড়ে ও একটা কথাও বলে নি । বাসায় এসেও চুপ করে রইলো । আমি ওর জন্য চা বানিয়ে এলাম । তারপর ওর দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললাম
-কি হল তোমার ? তুমি একটা কথাও বল নি তখন থেকে !
মিরিনার দিকে তাকিয়েই মনে হল ও কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না । আমি আবারও কথাটা জানতে চাইলাম ।
মিরিনা আমার দিকে তাকিয়ে । ওর দিকে তাকিয়েই মনে হল ও কিছু একটা জানে !
আমি বললাম
-মিরিনা ! তুমি সেই তখন থেকে কোন কথা বল নি । যখন থেকে ঐ জিনিস টা সামনে এসেছে ।
-হুম !
-তুমি কিছু জানো তাই না ?
-হুম !
-কি ! বল আমাকে !
-ঐ নীল কোর্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট আর সু ! আমি এই ফিগার টা চিনি !
আমি মিরিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম । একটা ভয়ের ছাপ ওর চেহায়া দেখতে পেলাম স্পষ্ট !


আট

মিরিনা এই এতো বড় শহরে ঢাকাতে একা একা থাকতো । ওর বড় মামা থাকতো আজিমপুরে তবে সেখানে মিরিনা খুব একটা যেত না । এখানেই থাকতো একা একা । ওর নাকি একা থাকতেই ভাল লাগতো । ওকে যখন থেকে আমি জানতে শুরু করি, চিনতে শুরু করি তখনই ব্যাপারটা একটু অন্য রকম লাগতো । মেয়েটা এখানে একা থাকে কেন ?
ব্যাপারটা এমন না যে মিরিনার কেউ নেই । ওর বাবা মা দুজনেই আছে । তারা চট্রগ্রামে থাকে । মিরিনার বাবা ওখানে বেশ ভাল একটা ব্যবসা করে, তাহলে মেয়েটা এখানে একা একা থাকে কেন ? ঢাকা শহরে এখনও একটা মেয়ে একা একা থাকাটা ঠিক স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া হয় না ।
মিরিনা এতোদিন আমার কাছে প্রশ্নের উত্তরটা দেয় নি । আজকে যখন আমি জানতে চাইলাম ও কিভাবে সেই নীল কোর্ট পরা অশীরীটাকে চিনে তখনই মিরিনা প্রসঙ্গটা নিয়ে এল ।
-তোমার কেন মনে হয় আমি এখানে একলা থাকি ?
-আমি কিভাবে জানবো ? তুমি বল ? আমি সেটাই তো জানতে চাইছি । তারপরই মিরিনা আমাকে আস্তে আস্তে ঘটনা বলতে শুরু করলো । যখন শেষ করলো তখন আমি খানিকটা অবাক চোখেই তাকিয়েই রইলাম । মনে হল মেয়েটা যা বলছে সেটা কি সত্য হতে পারে ?
আমি বললাম
-তুমি কি নিশ্চিত এটা উনিই !
-হ্যা ! উনার কেবল একটা পোষাকই ছিল । উনি সব সময়ই এটা পরে আমাদের বাসায় আসতেন ।
-এখন ?
-আমি জানি না ! আমি কিছু ভাবতে পারছি না ।
আমি মিরিনার চোখে এক ধরনের হতাশাজনিত ভয় দেখতে পেলাম । মেয়েটা আসলেই ভয় পেয়েছে বুঝতে পারছি । বাইরে তাকিয়ে দেখি কেমন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে । আজকে আর বাসায় ফিরে যাওয়া হবে না । অবশ্য আমার যাওয়ার আপাতত ইচ্ছেও নেই । তবে কাল সকালের অফিসে যাওয়াটা একটু কষ্টকর হবে যাবে । আজকে কিছু না বলেই এমনিতেই দুজন এক সাথে কামাই দিয়েছি । কালকে এমন ভাবে কামাই দেওয়া যাবে না ।
মিরিনা আমার আরও একটু কাছে এসে বসলো । একটু আগের দেওয়া চা সে ছুয়েও দেখে নি । সোফার উপরে ওকে নিয়ে বেশ আরাম করে বসলাম । মিরিনাকে বললাম
-তুমি চাইলে কিছুটা সময় ঘুমাতে পারো ! রাতে তোমার ঘুম হয় নি ! রুমে যাবে ?
-নাহ !
মিরিনা সোফার উপরেই আমার কোলে মাথা রাখলো । আমি টিভি চালিয়ে দিয়ে দিয়ে এক হাত দিয়ে রিমোট চাপতে লাগলাম আর আরেক হাত দিয়ে মিরিনার মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম ।
কিন্তু আমার মন পড়ে রয়েছে মিরিনার বলা একটু আগের কথার দিকে । ঘুরে ফিরে সেই কথা গুলোই ফিরে আসছে মনে ।
মিরিনার পরিবার অনেক আগে থেকেই বেশ বড় লোক ছিল । ওর দাদার নিজের কটন ফ্যাক্টারি ছিল চট্টগ্রামে । তারপর ওটা ওর বাবা সেটা সামলায় । ছোট বেলা থেকেই বিলাশিতার ভেতরেই ও বড় হয়েছে । ক্লাস এইটে থাকতেই ওর জন্য বাসায় পিসি চলে আসে । আর সেটা শেখানোর জন্য একজন কম্পিউটার শিক্ষক ।
লোকটার নাম ছিল আরিফুল ইসলাম । মাঝ-বয়সী লোকটা স্থানীয় একটা কম্পিউটার সেন্টারে কাজ করতো । সেখান থেকে সপ্তাহে দুই দিন আসতো মিরিনাকে কম্পিউটার শেখাতে । লোকটা যতদিন এসেছে ওদের বাসায় প্রতিবারই এই নীল কোর্ট আর গাঢ় নেভি-ব্লু প্যান্ট পরে এসেছে । সেই সাথে পায়ে থাকতো চকচকে পালিশ করা সু !
দেখতে দেখতে মিরিনার কম্পিউটার শেখা শেষ হয়ে গেল কিন্তু তারপরেও মিরিনা মাঝেমাঝেই আরিফুল ইসলামকে আসে পাশে দেখা শুরু করলো । কখনও স্কুলের পাশের দোকান থেকে পান কিনছে অথবা কখনও বা ওদের এলাকার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে ।
প্রতিবারই দেখতো লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে । লোকটার তাকানোর ধরনটা মিরিনার মোটেও ভাল লাগতো না । তবে সেটা খুব একটা আমলে নিতো না । আর এটা নিয়ে তার মা বাবার সাথেও কোন কথা বলে নি । এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এমনই হল । মাঝে মাঝেই লোকটাকে মিরিনা দেখতে পেত । মিরিনা জোর করে সেটা মন থেকে দুরে সরিয়ে রাখতো ।
কিন্তু একদিন আর সেটা পাশ কাটানো গেল না । মিরিনা সবে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে । গাড়িতে করেই কলেজে যেত আর আসতো । একদিন কলেজে শেষ করে গাড়ির জন্য দাড়িয়ে আছে । ঠিক তমন সময়ই আরিফুল ইসলামকে পাশে দেখতে পেলাম ঠিক ওর পাশে দাড়িয়ে আছে । একটু চমকে গেলেও সামলে নিল নিজেকে ।
অনেক দিন থেকে চিনে, তাই ভদ্রতা করে আরিফুল ইসলামকে দেখে হাসলো একটু ।
লোকটা হাসি দেখেই যেন আরও একটু এগিয়ে গেল । মিরিনা তখনও তাকিয়ে আছে লোকটা চোখের দিকে । চোখের দৃষ্টিটা মিরিনার সারা শরীরে নজর দিচ্ছে । একটা সুক্ষ ঘৃণায় মিরিনার মনটা তিক্ত হয়ে এল ।
-ভাল আছো ?
-জি স্যার ভাল আছি । আপনি ভাল আছেন স্যার ?
কোন মতে কথাটা বলল মিরিনা । বার কয়েক তাকালো রাস্তার দিকে । এখনও ড্রাইভার পার্কিং থেকে গাড়ি কেন আনছে না ভেবে পাচ্ছে না ।
আরিফুল ইসলাম যেন আরও একটু এগিয়ে এল । মাথায় হাত দেওয়ার মত করে ওর কাধে হাত দিয়ে বলল
-তা এখন কম্পিউটার ঠিক মত চালাতে পারো তো ?
-জি ! পারি ।
-কোন সমস্যা হচ্ছে না তো ?
-জি না !
ততক্ষনে লোকটার হাত মিরিনার পিঠে চলে এসেছে । মিরিনা তীব্র অস্বস্থি নিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো । এরকম খোলা জায়গায় একটা লোক ওর গায়ে হাত দিচ্ছে সেটা ভাবতেই মিরিনার গা গুলিয়ে এল । মিরিনা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই গাড়ির হর্ণ শুনতে পেল । জানে যেন পানি চলে এল । সোজা দৌড়ে দিল গাড়ির দিকে । গাড়িতে উঠে হুহু করে কেঁদে দিল । ড্রাইভার বার কয়েক জানতে চাইলেও কোন উত্তর দিলো না ।
কিন্তু বাসায় এই খবর গোপন থাকলো না । বাবা মায়ের চাপে সেটা মিরিনা বলেই দিল । আরও বলে দিল যে এই লোক অনেক দিন থেকেই তার পেছনেই লেগে আছে ! আর যায় কোথায়, ওর বাবার টাকা পয়সার কোন অভাব ছিল আর টাকা থাকলে মানুষের ক্ষমতা থাকেই । হাত থাকে অনেক উচু মহল পর্যন্ত । মিরিনার বাবা তখনই পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন সেই আরিফুল ইসলামের বাসায়। টেনে হিচড়ে, মাজায় দড়ি দিয়ে বেঁধে বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হল থানায় । সবাই চেয়ে চেয়ে দেখলো তাকে । থানায় নিয়ে বেশ প্যাঁদানি দিয়ে তারপর ছেড়ে দেওয়া হল । আর বলা হল যেন মিরিনা ধারে কাছেও আর কোন দিন দেখা না যায় তাকে ।
ঘটনা চট করেই অন্য দিকে মোড় নিল যখন আরিফুল ইসলাম আত্মহত্যা করে বসলো । নিজের ঘরে সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে ! সেই সাথে একটা সুইসাইড নোট রেখে গেল মিরিনার নামে । সেখানে সে মিরিনাকে কিভাবে ভালবাসতো সেই সব কথা বার্তা । লোকটা ঘর ভর্তি মিরিনা নানা রকমের ছবিও উদ্ধার হল । লোকজন সেই সাথে নানান কথাও বলতে লাগলো ।
মিরিনার বাবা শেষে এসব ঝামেলা এড়াতে মিরিনাকে ঢাকার পাঠিয়ে দিল ওর বড় মামার কাছে । তারপরে মিরিনা আর চট্টগ্রামে যায় নি । মাঝে মাঝে ওর বাবামা-ই আসতো ঢাকায় ।
লোকটার কথা তার মনেই ছিল না এতো দিন কিন্তু হঠাৎই আজকে এরকম ঘটনা সামনে সে চলে আসবে মিরিনা নিজেও কোন দিন ভাবতেও পারি নি । আমি নিজেও ভাবতে পারছি না ।
মিরিনার দিকে তাকিয়ে দেখি ও ততক্ষনে ঘুমিয়ে পরেছে । কেমন বাচ্চাদের মত গুটি সুটি মেরে শুয়ে আছে । আমি বেশ কিছুটা সময় ওর দিকেই তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটার কাছাকাছি আসার জন্য আসলেই কি ঐ অশরীরীটার কোন হাত আছে ?
হয়তো আছে কিন্তু এখন এই মেয়েটাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না কিছু ভাবতে চাইও না ।
এমন কথা যখন ভাবছি তখনই হঠাৎ ঘরের লাইটটা অফ হয়ে গেল । টিভির ঘরের ডান দিকে চোখ গেল চট করেই । সেখান দিয়ে বাইরের বিল্ডিং গুলোর বেশ খানিটা দেখা যায় । সেখানে দেখতে পাচ্ছি কারেন্ট আছে । এমন কি টিভিটাও চলছে । তবে সেখানে কোন ছবি দেখা যাচ্ছে না । কেবল ঝিরঝিরে ছবি আসছে । একটু আগেও সেখানে ছবি দেখা যাচ্ছিলো । সাউন্ড অফ করা ছিল মিরিনা ঘুমাচ্ছিলো বলে ।
মিরিনা ধড়ফড় কটর ঘুম থেকে উঠে আমার হাত চেপে ধরলো । আমিও হাত টা চেপে ধরলাম । বললাম
-কিছু হয় নি । কারেন্টে কোন সমস্যা হয় তো !
মিরিনা কাঁপাকাপা কন্ঠে বলল
-না ! আমি গত কালকেও এমনটা অনুভব করেছিলাম । সেই লোকটা আবার এসেছে ।
আমি জোর করে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম
-কেউ আসে নি । কেউ না । দেখছো না কেউ নেই ঘরে । আমার আর তুমি ছাড়া ।
আমার কথার প্রতিবাদের মনে হয় রান্নাঘরের একটা কিছু পড়ার আওয়াজ পেলাম । মনে হল কেউ যেন একটা চামচ নিচে ফেলে দিল । তারপর আরেকটা । আমি মিরিনার দিকে তাকিয়ে ওকে শান্তনা দেওয়ার জন্য ওর হাত টা আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম । ওকে বোঝার চেষ্টা করলাম যে কোন ভয় নেই । কিছু হবে না ।
কিন্তু সেটা নিজের কাছেই কেমন যেন অদ্ভুদ শোনালো । তারপরই খুব কাছেই আবার শব্দ হল । কেউ যেন দেওয়া একটা ধাক্কা মারলো । আমি পরিস্কার শুনতে পেলাম । টিচিট স্ক্রিনের আলোতে যেটুকু আলো আছে সেই আলোতেই দেখতে পাচ্ছি যে মিরিনার মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে । ভয় আমার নিজেরও করছে । কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না ! একবার মনে হল সোজা বাইরে চলে যাই ঘরের । কিন্তু দরজা খুলে যাওয়ার সুযোগ পাবো তো ?
তখনই আমার মনে হল আব্দুল লতিফের দেওয়া তাবিজের কথা । ওটা এখনও পকেটে আছে । আমি চট জলদি ওগুলো বের করে একটা মিরিনার গলায় পরিয়ে দিলাম এবং আরেকটা নিজে পড়ে নিলাম । ঠিক তখনই যেন রান্না ঘরের আওয়াজ টা আরও বাড়তে গেল । কেউ যেন হঠাৎ করেই রেগে গেছে । আমি মিরিনাকে চেপে ধরে বসেই রইলাম । তবে তাবিজটা পরার পর মনের ভেতরে একটা বিশ্বাস জন্মালো যে আমাদের আর কোন ক্ষতি হবে না ।
প্রায় সারাটা রাতই চললো পুরো ফ্ল্যাট জুরে আওয়াজ হওয়াটা । কখনও আমাদের পাশে ঘরে কখন রান্না ঘরে আবার কখনও শোবার ঘরে । একজনের উপস্থিতি ঠিক ঠিক টের পাচ্ছিলাম । ভোর রাতের দিকে আওয়াজ থেমে গেল । আমরা দুজনেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই বলতে পারবো না ।
একটু যেন বেলা করেই ঘুম ভাঙ্গলো । তাকিয়ে দেখি অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে । মিরিনাকে ডেকে তুললাম । আমরা ভেবেছিলাম হয়তো পুরো ঘরের অবস্থা লন্ডভন্ড হয়ে থাকবে । সারা রাত ধরে যা চলেছে । কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম ঘরদোর যেমন ছিল তেমনই আছে । কোন পরিবর্তন নেই ।
তাহলে আওয়াজটা কোথা থেকে আসলো কিছু যদি নাই পড়ে থাকবে । নাকি অশরীরীটা আবার জায়গার জিনিস আবার জায়গায় তুলে রেখেছে । বড় ভাল ভুত দেখতেছি ।
নাহ আরেকবার আব্দুল লতিফের কাছে যাওয়া লাগবে আজকেই । এর সমাধান কেবল ঐ লোকটাই দিতে পারবে মনে হচ্ছে । আর এই
আরিফুল ইসলাম সম্পর্কেও লোকটাকে বলা লাগবে ! তাহলে আব্দুল লতিফ নিশ্চয়ই কোন না কোন উপায় বের করতে পারবে ।
কিন্তু আমি যখন আব্দুল লতিফের কাছে বলতে গেলাম আসলে এই লোকটা কে তখন আমাকে লোকটা অবাক করে দিয়ে সব বলে দিল । একেবারে মিরিনা আমাকে যা যা বলেছে প্রায়ই সেরকমই কাহিনী । আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে ।
বললাম
-মিরিনা কি ফোন দিয়েছিলো আপনাকে ?
লোকটা হেসে বলল
-তাই কি দেওয়ার কথা ? তুমি তো ওর সাথেই ছিলে এতোক্ষন । আমি ভুল না করলে সে এখনও অফিসেই আছে, তাই না !
আসলেই তাই । মিরিনা এখনও অফিসেই আছে । ওকে না জানিয়ে এখানে এসেছি ।
-আপনি কিভাবে জানলেন ?
-আমি কিভাবে জেনেছি সেটা জরুরী না । জেনেছি সেটা জরুরী ! এখন তুমি যা যা জানো না সটা তোমাকে জানাই । এই আরিফুল ইসলাম কেবল আজ থেকেই না অনেক দিন থেকেই মিরিনার সাথে আছে । কিন্তু এতোদিন কোন পথ পায়নি এভাবে সামনে আসার !
-মানে ?
-মানে খুব সোজা ! যেমন আমি এখনন চাইলেই তোমার উপর হামলা করতে পারি মানে ঝাপিয়ে পরতে পারি ! পারি না কিংবা তুমিও পারো, পারো না ?
-কি কবলছেন এসব ?
-আরে বাবা কথার কথা বললাম । মানুষ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে । কিন্তু এই সব অতৃপ্ত অশরীরীরা এসব পারে না । এদের সেটা করার জন্য একটা পথ লাগে । গ্রামে প্রায়ই শুনবা যে ওমুকে ভুতে ধরেছে । ব্যাপারটা এরকম না যে ভুত আসলো আর পছন্দমত যে কারো উপরে চপেে বসলো । ওরা পজেশনের জন্য ফাঁদ পাতে । যেমন সন্ধ্যা বেলা মনে কর খোলা চুলে বাইরে যাওয়া কোন গাছের তলে যাওয়া, কোন একটা জায়গা দিয়ে যাওয়া এরকম
আমি বললাম
-তাহলে ঐ ফেসবুক একাউন্ট আমার জন্য ফাঁদ ছিল ?
-অনেকটা বলতে পারো !
-ডিজিটাল ভুত দেখতেছি
আব্দুল লতিফ হাসলো । তারপর বলল
-আসলে ওর ইচ্ছেই ছিল তোমার মাধ্যমে মিরিনার শরীরটা পাবে । মিরিনার শরীরের প্রতি ওর একটা লোভ রয়ে গেছে সেই কবে থেকে । আরও ভাল করে বলতে গেলে তোমাকে বডিটা হোস্ট হিসাবে ব্যবহার করছে ও । যদি আমার কাছে না আসতে তাহলে হয়তো এতো দিন করেো ফেলতো ! নিশ্চয়ই স্বপ্নের ভেতরে ওটা তোমার খুব কাছে চলে এসেছিলো । মানে প্রথম যেদিন দেখেছিলে তখন দুরে ছিল আস্তে আস্তে সেটা কাছে আসছিলো তাই না ?
-হ্যা ! আপনি কিভাবে জানলেন ?
-এরা এভাবেই কাজ করে !
-তার মানে মিরিনার কোন সমস্যা নেই, কোন ভয় নেই ?
-নাহ ! মিরিনাকে বড় জোর ওর স্বপ্নে দেখাতে পারবে এর বেশি কিছু না । বেশি ভয় তোমার । তোমার বডিটাকে যদি একবার কাবু করে ফেলে তাহলে কিন্তু সমস্যা হবে ।
-এখন কি করবো তাহলে ?
আব্দুল লতিফ আমার দিকে তাকালো । ওনার চোখ দেখেই আমার কেন জানি ভাল লাগলো না । মনে হল আমি সামনে কোন ঝামেলার ভেতরে পড়তে যাচ্ছি ।
-একটা উপায় আছে । কিন্তু সেটা খুব একটা সহজ হবে না ।
-যেমন হোক আমরা করবো !
কথাটা আমি বলি নি । বলেছে মিরিনা । আমি মিরিনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় ! কখন ও এখানে চলে এসেছে আমি জানি না । নিশ্চয়ই পাশে ঘরে বসেই সব শুনেছে ।
মিরিনাকে দেখে আব্দুল লতিফ কে খুব একটা অবাক হলেন না । তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল
-উপায় একটা আছে । তবে সেটা বেশ ঝুকিপূর্ন, পারবে তো ?
আমি বললাম
-এই ঝামেলা বহন করার চেয়ে দুর করে ফেলা ভাল !
মিরিনার দিকে তাকিয়ে দেখি ও মুখটা শক্ত করে তাকিয়ে আব্দুল লতিফের দিকে ।
আব্দুল লতিফ বলল
-আচ্ছা তাহলে শুনো !

নয়

এর আগে এমন পরিবেশে আমি পরি নি তাই পরিবেশ টা আমার কাছে একদমই নতুন ! মানুষ বিপদে পড়লে কত কিছু করা লাগে ঠিক তেমনই আমাকে অনেক কিছু করতে হচ্ছে তবে এমন একটা কাজ করতে হবে আমি ভাবতে পারি নি । নিজের কাছে অন্য রকম লাগছে । কেমন যেন একটা অপরাধী অপরাধী লাগছে । সেই সাথে একটা তীব্র ভয় অনুভব হচ্ছে ।

এদিক দিয়ে এক ভাবে কোঁদালের থপ থপ আওয়াজ পড়েই চলেছে মাটিতে । আশার কথা হচ্ছে মাটিটা কেবল গতকালকেই ভরাট করা হয়েছে । তাই খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না মাটিটা আলগা করতে । আমি ভীত চোখে তাকিয়ে আছে । সলিম প্রায় মাটি সরিয়ে ফেলেছে । বাসের সাঁচটা দেখা যাচ্ছে । যতই কাজটা এগিয়ে যাচ্ছে আমার বুকের ভেতরে ভয়টা ততই বেড়েই চলেছে । কারন সমিল ঠিকঠাক মাটিটা সরাতে পারলেও এর পরের কাজটা আমাকেই করতে হবে । আমি কিভাবে কবরে নামবো এটা আমি এখনও ভেবে উঠতে পারি নি ।

কবরে ভেতরে নামা নিয়ে ছোট বেলা থেকেই কত রকম কথা শুনে এসেছি । একবার শুনেছিলাম একজন নাকি তার স্ত্রী কবরে নেমে আর উঠতে পারে নি । স্ত্রীকে খুন করেছিলো তারপর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছিল কিন্তু যেই লাশ নামাতে করবে নেমেছে সেই স্ত্রীর হাতের সাথে তার পাটা লেগে যায় । তারপর আর নাকি ছোটে নি । যদিও এসবই শোনা কথা কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে এই সব শোনা কথা বড়ই সত্য মনে হয় । সেইটা থেকেই ভয় বাড়তে থাকে ।

আমি তাকিয়ে দেখি সলিম বাঁশে সাঁচটা সরিয়ে ফেলেছে । এই কাজ সে আগেও করেছে সেটা কাজের গতি দেখলেই বোঝা যায় । তার ভয়-ডর নেই । থাকার কথাও না । সলিম কবরের ভেতরে তাকিয়ে বলল
-ছ্যার । এখনও গন্ধ বাহির হয় নাই । আমি কি আনুম ?
-না না ! তুমি আনলে হবে না । আমাকে আনতে হবে !
-আইচ্ছা ছ্যার আহেন !

এই বলে সে উঠে দাড়ালো । আমি ভাবতেই পারছি না আমাকে এখন কবরে নামতে হবে । এসবের কোন মানে হয় !

আচ্ছা এই করবের বাসিন্দার আত্মীয় স্বজনেরা জানতে পারলে কি হবে জে জানে ? আমাকে কি আস্ত রাখবে ? নিশ্চয় না । যা করার দ্রুত করতে হবে ! নিজের মন কে বোঝাতে লাগলাম । কেবল মাত্র একজন মেয়ে সে । মৃত মানুষ । গতকালকেই মারা গেছে । আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না । কোন ক্ষতি করবে না !

আমি কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আমার পা জমে গেলে । একে বারে কবরের ধারে চলে এসেছে । মাটি গুলো একপাশে সারনো । কিছু সাঁচ সরানো হয়েছে তবে সব টুকু সরানো হয় নি । সামনে রাখা মশালের আগুনটা পরেছে কবরের ভেতরে । সেখানে সাদা কাফনটা দেখা যাচ্ছে । আমার বুকের ভেতরে হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে লাগলো । সলিমের দিকে তাকিয়ে দেখি সে নিশ্চিন্তে মনে বিড়ি চানছে । আর আমার দিকে স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে আছে । এমন একটা ভাব যেন এমন কাজ যে হার হামেশাই করে থাকে । সলিম আলী বলল
-ভয় পাইয়েন না । কিছু হইবো না । সম্পূর্ন নামতেও হইবো না । এই নেম এই চাকু দিয়া কাইট্টা আনেন !

আমি সলিমের কাছ থেকে ধারালো ছুরিটা হাতে নিলাম । যখন পা টা কবরে নিচে নামানোর জন্য রাখতে যাবো তখনই অনুভব করলাম সেটা প্রবল ভাবে কাঁপছে । আমি পারবো তো ?
পারতে হবে ।
আমাকে পারতেই হবে !
নতুবা মিরিনা আর আমার জীবনটা স্বাভাবিক হবে না । আমাকে পারতে হবে ।
হবেই ।
মিরিনার কথা ভাবতেই বুকে একটু বল এল । কবরের বাসিন্দাকে মনে মনে বললাম
-আমাকে ক্ষমা করে দিও ! আমি নিরুপায় ! আমাকে ক্ষমা করে দিও ।

এরপরেই আমি কবরে নেমে পরলাম । আমার পায়ের ঠিক কাছে সাদা কাফনটা ! আমি আস্তে করে ছুরিটা দিয়ে কাফনের কাপড়টা একটু সরিয়ে লাশটার চুলটা বের করলাম । আব্দুল লতিফ বলেছিলো একটানে কাটতে হবে একগাছি চুল আর কিছু কাপড়ের অংশ ! । চুল গুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই মনে হল আমি কোন জ্যান্ত মানুষের চুল ধরছি । চুলের অংশ টুকু কাপরের সাথে পেঁচিয়ে নিলাম । এবার যেই না কাটতে যাবো তখনই লাশটার মুখের সামনে থেকে কাফনের কাপড়টা সরে গেল । মশালের কাঁপা কাঁপা আলোতে আমি মেয়েটার মুখ দেখে চমকে উঠলাম । বুকের ভেতরে কেমন মোঁচড় দিয়ে উঠলো ।

মিরিনা শুয়ে আছে !
নাহ !
এমন টা হতে পারে না ।

ইচ্ছে হল তখনই দৌড় দিই উঠে । হাতে ভেতরে তখন কাপড় আর চুলের গাছি ধরা । ছুরিটা তখনও গোড়ার ধরা ।

আমার মন বলছিলো এখনই মিরিনার মত দেখতে লাশটা চোখ মেলে উঠবে । এবং সত্যি সত্যিই আমার ধারনা কে সত্য করে দিয়ে মিরিনা চোখ মেলে তাকালো ।

আমার বুকের ভেতরের হৃদপিন্ড টা যেন আমার বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো । বারবার মনে হল আমার এখানে আসা মোটেই উচিৎ হয় নি । মোটেই না। অন্য কোন উপায় বের করা দরকার ছিল ।


আব্দুল লতিক যখন আমাকে বললো কি করতে হবে তখন আমি কেবল অবাক হয়েই তাকিয়ে রইলাম । বারবার মনে হল এই লোকের মাথা ঠিক আছে তো ! এটা কি কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব ? মিরিনার দিকে তাকিয়ে দেখি ও নিজেও কেমন জানি চুপছে গেছে শুনে । একটু আগেও ও আরিফুল ইসলামের আত্মাকে চিরোতরে শেষ করার জন্য যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল সেটা ওর চেহারা থেকে গায়েব হয়ে গেছে । আমি বললাম
-আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? এটা কি মানুষ করতে পারে ?
-কেন পারবে না ? আমি নিজেই কয়েক বার করেছি ।
মিরিনা সাথে সাথেই বলে উঠলো
-তাহলে আপনি আরেকবার করে দিন ।
আব্দুল লতিফ বলল
-উহু ! তা হবে না । আমি করলে সেটা আমার কাজে লাগবে তোমাদের কোন লাভ হবে না । যদি আরিফুল ইসলামের পজেশন থেকে মুক্ত হতে হয় তাহলে কাজটা তোমাকেই করতে হবে !
-আর কোন উপায় নেই ?

মিরিনার কন্ঠের উৎকন্ঠা আমি ঠিক ঠিক টের পেলাম । আব্দুল লতিফ কি যেন ভাবলো । তারপর বলল
-একটা অস্থায়ী উপায় অবশ্য আছে কিন্তু সেটা কেবলই অস্থায়ী । আমি ঘর বন্ধ করে দিতে পারি । তাবিজ দিতে পারি কিন্তু সেটা খুব বেশি দিন কাজ করবে না । দেখ এরকম বিক্ষিপ্ত আত্মাদের খুব একটা ক্ষমতা থাকে না কিন্তু যখন তারা কাউকে ফাঁদে ফেলে তখন তখন সেই হোস্ট বডির কাছ থেকে তার জীবনী শক্তি নিয়ে শক্তিশালী হতে থাকে । আর ঘর বন্ধটা অনেক কারনে ছুটে যেতে পারে । প্রতিবার ঘর বন্ধ করাটা সম্ভব না !

আমি আর মিরিনা দুজনেই একে ওপরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম । কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । আর কোন উপায় নেই মনে হচ্ছে । কিন্তু যেটা করতে বলা হয়েছে সেটা কোন ভাবেই আমার দ্বারা করা সম্ভব নয় ।

আব্দুল লতিফ আমাকে সদ্য মৃত একজন মেয়ের কবর থেকে তার এক গাছি চুল নিয়ে আসতে বলেছে । এর আগে মিরিনার চুল দিয়েই আরিফুল ইসলাম কে নিয়ে আসা গেছে । আমরা যাওয়ার পরেই নাকি আব্দুল লতিফ আবারও আরিফুল ইসলামকে ডেকে নিয়ে এসেছিলো । তার কাছ থেকে সব কিছু শুনেছে তখনই ।
তবে এমন করে কেবল তাকে ডেকেই আনা যাবো । বড় জোর কথা বলা যাবে কিন্তু তাকে কোন কিছু করতে গেলেই সে চলে যাবে । কিন্তু তাকে আটকে রাখতে হয় তাহলে একজন মৃত মেয়ের চুলই লাগবে অন্য কোন কিছু হলে হবে না ।

আমরা দুজনেই চুপ করে আছি দেখেই আব্দুল লতিফ বলল
-আমি একজন কে চিনি যে তোমাদের কে সাহায্য করতে পারবে । ওকে একটু টাকা পয়সা দিতে হবে আর কি !
-টাকা পয়সা সমস্যা না । কিন্তু আপনি বললেন যে কাজটা আমা কেউ করতে হবে ?
-হ্যা তা অবশ্যই । তোমাকেই সেটা কাটতে হবে । এখন নিজের হাতে নিয়ে আসতে হবে এখানে । তবে সে বাকি কাজটা করে দিবে । মানে করব খোজা থেকে শুরু করে কবরের মাটি সরানো পর্যন্ত সব কিছুই করবে । কেবল তোমাকে নিচে নেমে কাজ টা করতে হবে ।
-আপনি যাবেন ?
-আমার যাওয়ার কোন দরকার নেই । তুমি একাই পারবে ।

আর কোন উপায় না দেখে আমি রাজি হয়ে গেলাম । মিরিনা কোন কথা বলল না । সলিমের সাথে আব্দুল লতিফ নিজেই কথা বলল । সলিম থাকে উত্তরার দিকে । বনানী কবর স্থানে ওর কবর খোড়ার কাজ করে, নিয়মিত । তা ছাড়া ওর আরও অনেক রকম কাজ আছে । ওকে খোজ লাগানোর কথা বলে দিল ।

যতদিন না পাওয়া যায় ততদিন আমাদের ঐ তাবিজটা পরে থাকতে বললেন ! দুদিন পরেই খোজ চলে এল । ঠিক ঢাকার ভেতরে না । সলিমের খোজ এনেছে গাজিপুরের একটা গ্রামে মারা গেছে একজন মেয়ে । তার চুল দিয়েই হবে । আমি বিকেলে হাজির হয়ে গেলাম সেখানে । সলিমকে খুজে পেতে খুব একটা কষ্ট হল না । আমাকে দেখে কেবল লিকলিকে একটা হাসি দিল । বলল যে লতিফ ভাই পাঠাইছে তাই আমাকে আর কোন চিন্তা করতে হবে না । যা করার সে নিজেই করবে । কেবল যে কাজটা আমার করার সেটাই আমাকে করতে হবে !


মুহর্তের ভেতরেই আমার সব কিছু মনে পড়ে গেল । মিরিনার মত মেয়েটার লাশের খোলা চোখের দিকে বিস্ফোরিত চোখ আমি তাকিয়ে রইলাম । একটা যে চিৎকার দিবো সেই শক্তি টুকু যেন আমার নেই । লাশটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো এক ভাবে । আমার হাত পা অবশ হয়ে গেছে বিন্দু মাত্র নড়তে পারছি না । আমার আবারও সেই স্বামী-স্ত্রীর গল্পের কথা মনে পড়ে গেল । এবার মেয়েটা আমার পায়ে হাত রাখবে আর আমার পা আর তার হাত জমে যাবে । আমি আর কোন ভাবেই সেটাকে নিজের থেকে আলাদা করতে পারবো না । আমাকে এভাবেই এখানে থাকতে হবে ।

আমার কেন জানি মনে হল আমি চেতনা হারাচ্ছি । এখনই হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবো । কোন ভাবেই চোখ দিয়ে আবারও তাকিয়ে দেখি মিরিনার চেহারা নিয়ে লাশটা এখনও আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে !
একটু কি হাসলো ?
নাকি একটু নড়ে উঠলো ! আমার কেবল মনে এখনই আমার একখন থেকে উঠতে হবে । আমার উঠতে হবে !

-ছ্যার ! ছ্যার !
আমি চমকে তাকিয়ে দেখি সলিম আমার দিকে তাকিয়ে আছে । তখনই বিড়িটা চেনেই যাচ্ছে । আমার কাছে মনে হচ্ছিলো আমি যেন অনন্তকাল ধরে দাড়িয়ে আছি । কিন্তু সলিমের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখের বিড়িটা এখনও শেষই হয় নি । সময় কি থেমে গেছিলো নাকি !
-ছ্যার !
-হুম !
-কাম তো শ্যাষ । উডেন !

আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতে সেই চুল আর সাদা কাপড়ের অংশ টুকু ! আমি চোখ তখনই আবার নিচের দিকে গেল । সেখানে এখনও চেহারাটা দেখা যাচ্ছে ।
অপরিচিত একটা মুখ ।
এই মেয়েকে আমি কোন দিন দেখি নি ।
কিন্তু আমি যে দেখলাম মিরিনার মুখ!!

আমি জলদি কবর থেকে উঠে দাড়ালাম । ততক্ষনে সলিম আবারও কবরটা বুজিয়ে দেওয়া শুরু করেছে আমি কিছুটা সময় কেবল দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতে লাগলাম । আমার বুকের ভেতরে ধরফরানী তখনও থামে নি । কাজ শেষ করে সলিম যখন এল তখনও ওর মুখ হাসি হাসি । যেন খুব স্বাভাবিক একটা কাজ করেছে । আমি পকেট থেকে তিন হাজার টাকা বের করে দিলাম ওকে । দুই হাজার কথা ছিল এক হাজার বেশি দিলাম । দেখলাম সলিমের মুখের হাসিটা আরও একটু বিস্তৃত হয়ে এল ।
-ছ্যার এর পরে কোন দরকার লাগলে বলবেন !
-আর লাগবে না আশা করি । চল যাওয়া যাক ।


দশ
মিরিনা উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো । সব আয়োজন আমাদের করাই ছিল । আব্দুল লতিফ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন কেবল । বললেন চলে
-এস । আমরা কাজ শুরু করি ।
আমি চুলের গোছাটা নিজের হাতেই ধরে রেখেছি । পুরোটা পথে আমি এমন ভাবেই ধরে রেখেছিলাম । আমি আব্দুল লতিফের হাতে চুল আর কাপড়ের অংশ টুকু দিয়ে দিলাম ।

তখনও আসলে আমি নিজের ভেতরে ঠিক মত স্থির হতে পারছিলাম না । আমার একটা আশা ছিল যে আব্দুল লতিফ আমার সাথে ঠিক ঠিক যাবে এসব আনতে । কিন্তু উনি আমার সাথে যানই । কতবার অনুরোধ করার পরেও যান নি । কেবল বলেছেন গেলে সমস্যা আছে তিনি যেতে পারবেন না । এই কাজটা নাকি আমার এবং সেটা আমাকেই করতে হবে । আমাকে তাই বাধ্য হতেই একা একা যেতে হয়েছে ।

এখন আব্দুল লতিফের বাসাতে এসে খানিকটা যেন শান্তিু পাচ্ছি । আমি বললাম
-কাজ কখন শুরু হয়েভবে ?
-শুরু তো হয়ে গেছে । তুমি যখনই রওনা দিয়েছো তখন থেকেই । এই সব কাজে অনেক ঝামেলা । এখন আরও কিছু কাজ করতে হবে । তুমি আর এক কাজ কর । পাশের ঘরে এটার্চ বাথরুম আছে । সেখানে লুঙ্গি গামছা সব আছে । চট করে গোসল করে আসো ।
-এখন ? এই রাতের বেলা ?
-হ্যা এই রাতের বেলাতেই । কাজটা আজকে রাতেই শেষ করতে হবে । নয়তো তোমাকে আবারও কাজ কে আরেকটা করব খুজে বের করতে হবে ।

আমি আর কথা বাড়ালাম না । গোসল করে এলাম চট করে । খুব বেশি লাগলো না । আমি ঘরে ঢুকতে দেখি আগের মত ঘরটা আর আবছায়া অন্ধকার নেি । সেখানে আলো জ্বলছে । পুরো মেঝে এখন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে । মোটা বড় বড় দুইটা বৃত্ত আকা হয়ে হয়েছে পাশা-পাশি । আর দুটো ছোট ছোট বৃত্ত আকা হয়েছে একটু দুরে দুরে । আমি আরও একটু কাছে গিয়ে লক্ষ্য করলো ঐ দুটো বৃত্তের ভেতরে একটা আংটা জাতীয় কিছু আছে । সেটা মেঝের সাথে শক্ত করে লেগে আছে । এটা এখানে কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
আমাদের দুজনকে ঐ দুটো সার্কেলের ভেতরে গিয়ে বসতে বলল আব্দুল লতিফ । ঠিক তারপরই আমাদের কে অবাক করে দিয়ে আমার দুজনের হাতেই একটা করে হাত কড়া পড়িয়ে দিয়ে সেই আংটার সাথে আটকে দিলো ।
-এই সব কি করছেন ?
-এটা তোমাদের সেফটির জন্য । যা কিছুই হোক না কেন কোন ভাবেই তোমরা এই সার্কেলের ভেতর থেকে বাইরে আসবে না ।
-আপনি বলেছিলেন যে মিরিনার কোন ভয় নেই তাহলে ওকে কেন এর ভেতরে রাখছেন ?
-আসলে ওদের ব্যাপারে কিছু বলা যায় না । আমি কোন দিক দিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না ।

তাকিয়ে দেখি মিরিনার চোখে মুখে একটা ভয় দেখা দিয়েছে । আগেরবার আমরা কাছাকাছিই ছিলাম । ও ছিল আমার পাশেই । এখন আমাদের মাঝে বেশ খানিকটা দুরুত্ব । জানি না কি হবে ।

ঠিক আগের মত আব্দুল লতিফ আমার হাত থেকে সিরিঞ্জ দিেয় রক্ত বের করে নিল আর মিরিনার কাছ থেকে নিল কাটা চুল । এবার একটা সার্কেলের ভেতরে সে নিজে বসে অন্য সার্কেলের ভেতরে একটা আগে থেকে রাখা হাড়ির ভেতরে সেই চুল রক্ত ঢেলে দিল । কিছুটা সময় আগে আমার নিয়ে আসা মৃত মেয়েটার চুলও ওখানেই রেখেছিল ।

এরপরেই লাইট অফ করে দিয়ে বেশ কিছু মোম জ্বালিয়ে নিল । এরপরই সেদিনের মত আবারও সেই বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়া শুরু । প্রথম প্রথম আমার হাতকড়া টা থেকে একটু অস্বস্থি লাগলেও পরে ঠিক হয়ে গেল কিন্তু আরেকটা অনুভুতি ফিরে এল । আমার সেই স্বপ্নের অনুভুতিটা । আমি যেন সত্যিই ঐ দিনের পরে আমি আর স্বপ্নটা দেখি নি তাই অনুভুতিটা একটু ফিকে হয়ে আসছিলো । আমার মনের ভেতরে একটু একটু ভয় ভয় করতে লাগলো । তাকিয়ে দেখি আব্দুল লতিফ সেই আগের মত করেই চোখ বন্ধ করে মন্ত্র টাইপের কিছু একটা পড়েই যাচ্ছেন । আর কয়েকটা মিনিট কেটে গেল । তখনই যেন চোখের সামনের সব দৃশ্য বদলাতে শুরু করলো । আমি ঐ ঘর থেকে হঠাৎ করেই আবার সেই স্বপ্নের জায়গায় হাজির হয়ে গেলাম মুহুর্তেই । তবে এবার একটু নতুন কিছু আমার চোখ পড়লো ।

মিরিনা !!


আমার স্বপ্নে মিরিনা কখনও থাকতো না । আমি একা একা থাকতাম । আর আমি অন্য স্বপ্নে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতাম এবে এখানে আমি স্থির হয়ে দাড়িয়ে রয়েছি । এর অবশ্য কারন রয়েছে । আমি এখানেো একটা গোল চক্রের ভেতরে দাড়িয়ে আছি এবং আমার হাত দুটো একটা খুটির সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা । আর মিরিনা আমার থেকে ৫০ গজের মত দুরে । আমার দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চল ভাবে । আমার তখনই মনে হল অশুভ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে । মিরিনা এখানে কেন ?
এখানে তো ওর থাকার কথা নয় কোন ভাবেই ।

এখন যদি ঐ প্রাণীটা চলে আসে !

ঐ তো আসছে । ঐ তো আসছে !

সেই প্রাণীটা আস্তে আস্তে মিরিনার দিকে এগিয়ে আসছে । কিন্তু মিরিনার সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই । সে আগের জায়গাতেই দাড়িয়ে আছে । আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে !

আমি জোড়ে ডাক দিলাম !
মিরিনা ! সরে যাও ! মিরিনা !

কোন প্রতিক্রিয়া নেই । মিরিনা শুনতে পাচ্ছে না ।
মিরিনা !!
নাহ ! এভাবে হবে না ! আমাকে ওর কাছে যেতে হবে । আমাকে যেতে হবে ! আমি আমার শিকল টা টানতে লাগলাম । শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে খোলার চেষ্টা করলাম । আমাকে খুলতেই হবে ! মিরিনাকে বাঁচাতে হবে !
প্রাণীটা আরও এগিয়ে আসছে । ঐ তো এগিয়ে আসছে ।

মিরিনা !

আমি যখন শিকল টানতে ব্যস্ত তখনই কেউ যেন আমার মাথার ভেতরে কিছু বলে উঠলো !

অপু !! ফোকাস !

কন্ঠ টা আব্দুল লতিফের !

তুমি যা দেখছো তার কিছুই সত্য নয় ! ওটা মিরিনা নয় !
-কিন্তু !
-কোন কিন্তু না ! ওটা তোমাকে দেখানো হচ্ছে । তুমি সার্কেল থেকে বের হলে কিন্তু তোমার বিপদ হবে । শান্ত হয়ে বস । কিচ্ছু দেখার দরকার নেই । ফোকাস !

আমি নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললাম !

ঠিক তখনই মিরিনার চিৎকার শুনতে পেলাম । চোখটা খুলতে গিয়েও খুললাম না ! মনে মনে বললাম মিরিনা এখানে আসতে পারে না ! কোন ভাবেই পারে না ! এটা একটা চোখের ভুল ! মনে ভুল !

সব কিছু শান্ত হয়ে এল । কতক্ষণ পার করেছি মনে নেই কিন্তু একটা সময় আমার কেন জানি মনে আমি এবার সত্যি সত্যি কারো জোড় গলার কথা শুনতে পাচ্ছি । এবং এটা আমার কিংবা মিরিনা কারোর নয় । অন্য কারো । আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সেই ফাঁকা বৃত্তের মাঝে কিছু একটা এসে হাজির । একটু এবং সেটার চেহারা আমি এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি না তবে তার গায়ের নীল কোর্টটা আমি ঠিক ঠিক দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে । আওয়াজটা সেখান থেকেই আসছে । আস্তে আস্তে সেটা বাড়ছে । দেখলাম আব্দুল লতিফের দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলে শ্বাশাচ্ছে । আব্দুল লতিফ কোন কথা বলছে না ।

গলার আওয়াজ বাড়তে বাড়তে একটা সময় দেখতে পেলাম নীল কোর্টে আগুন লেগে গেল । বিভৎষ বেরিয়ে এল নীল কোর্টের গলা থেকে । তারপর ছুটতে লাগলো পুরো সার্কেল জুড়ে । যেন বের হতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না ।

আমি সেদিকে না তাকিয়ে তাকালাম মিরিনার দিকে । তখনই ব্যাপার টা আমার কাছে কেমন যেন লাগলো । মিরিনা চোখ বন্ধ করে আছে । এবং ওর নাক দিয়ে একটা সুক্ষ রক্তের ধারা বয়ে আসছে যেন । মোমের আবছায়া আলোতে সেটা আমার চোখ এড়ালো না !
তখন যা দেখছিলাম সেটা সত্যি না কিন্তু এটা সত্যি না হয়ে যায় না ।
মিরিনার কিছু হয়েছে ।
আমার ওর ওখানে যাওয়া দরকার । আমি আবারও নিজের হাতকড়া টা খোলার চেষ্টা করলাম । টানাটানা করতে যাবো তখনই আবারও মাথার ভেতরে সেই আওয়াজটা শুনতে পেলাম ।

"এখন বের হতে গেলে তুমি তো মরবেই সবাইকে নিয়েই মরবে ! মিরিনা ভাল আছে"

আমি আবারও চুপ করে গেলাম । তাকিয়ে রয়েছি মিরিনার দিকে মেয়েটার কি হল !!



আরও ৩০ মিনিট পরে সব কিছু শান্ত হয়ে এল । সেই নীলকোর্টের কোন অস্তিত্ব আর নেই । একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে । চোখের সামনে ছাই হয়ে পুড়ে যেতে দেখলাম !

এর একটু পরে দেখলাম আব্দুল লতিফ আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাতের হাত কড়া খুলে দিল । আমি দৌড়ে গেলাম মিরিনার দিকে । মিরিনা অচেতন হয়ে পরে আছে । নাক দিয়ে আসলেই রক্ত বের হচ্ছে ।


মিরিনার হাত কড়া খুলে দিতে দিতে আব্দুল লতিফ বলল
-আমার কিছু করার ছিল না । তুমি সার্কেল থেকে বের হওনি কিন্তু মিরিনা বের হয়ে গেছিলো । তবে সামলে নিতে পেরেছি । এখন কতটা ও সামলাতে পারবে আমি জানি না !
-মানে !
-বাইরে গাড়ি দাড়িয়ে আছে । দেরি না করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও !

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । প্রচন্ড একটা ক্রোধ অনুভব করলাম । আব্দুল লতিফ বলল
-আমাকে চাইলে পরেও ঘুসি মারতে পারবে কিন্তু মিরিনাকে পরে আর বাঁচাতে পারবে না । তোমার এখনই যাওয়া উচিৎ !

আমি আর কিছু না ভেবে দৌড় দিলাম মিরিনাকে কোলে নিয়ে ।

সামনেই কোথাও একটা হাসপাতাল আছে । আমাকে সেখানে যেতেই হবে । মিরিনাকে বাঁচাতেই হবে !


পরিশিষ্টঃ

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই টের পায় নি । আসকে গত কয়েকদিনে এতো এতো ঝামেলা গেছে যে ঠিক ঠাক মত বিশ্রাম নেওয়ার সময় পাই নি । মিরিনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর আমার যেন কোন কাজ ছিলনা । খুব ইচ্ছে করছিল বেটা আব্দুল লতিফ কে গিয়ে দুটো ঘাঁ দিয়ে আসি কিন্তু পরে নিজেকে শান্ত করেছি । উনি যা করেছেন নিজের জন্য কিছুই করেন নি । আমাদের জন্যই করেছেন ।

-এই ! এই !
মিরিনার বেডের পাশেই চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছিলাম । তাকিয়ে দেখি মিরিনা চোখ মেলেছে । আমার দিকে তাকিয়ে আছে !
-হুম ! এই তো আমি আছি !
-কতদিন ঘুমিয়েছি আমি !
-প্রায় তিন দিন ! কেমন লাগছে এখন ?
-ভাল ! তুমি রয়েছো দেখে ভাল লাগছে ।

আমি আব্দুল লতিফ বলেছিল ওর ব্রেনের উপর চাপ পরেছে । ডাক্তারও বলেছিলো মাথার ভেতরে কিছু সমস্যা হয়েছে । যাক এখন ভাল আছে সেটাই বড় কথা । আমি ওর কপালে একটা ছোট্ট চুম খেয়ে বললাম
-তুমি ঘুমাও ! আমি আছি !

আসলেই আমি আছি তোমার পাশে ! সব সময় থাকবো !




কিছু বানান ভুল থাকবে, এই জন্য দুঃখিত
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৩৩
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×